জাতপাতের সমস্যাটা ভারতের নিজস্ব ব্যাপার সম্ভবত আর কোথাও এটা নেই। এর দ্বারা দেশের মানুষকে সামাজিক দিক থেকে বিভিন্ন স্তরে বিভক্ত করা হয়েছে। এসেছে উঁচু-নীচুর ভেদাভেদের মানসিকতাও। তাছাড়া অনেক ক্ষেত্রেই জন্মের দ্বারাই ব্যক্তির জীবিকা নির্দিষ্ট হয়েছে। নির্ধারিত হয়েছে তার সামাজিক অবস্থান।
আর্যযুগের মাঝামাঝি সময় এই বর্ণবিভাজন সৃষ্টি হয়েছিল। বিদ্বান ব্যক্তিরা ‘ব্রাহ্মণ বলে পরিচিত হতেন—তারা বিদ্যাদান ও পৌরোহিত্য নিয়ে থাকতেন। শারীরিক বলশালীরা দেশচালনা ও শান্তিরক্ষার কাজ করতেন—তারা ছিলেন ‘ক্ষত্রিয়।‘বৈশ্যরা’ ব্যবসা-বাণিজ্য করতেন। আর ‘শূদ্রদের কাজ ছিল সবারই কাজ করা। ঐতিহাসিক ড. কিরণচন্দ্র চৌধুরীর 017713— This division of classes was simply a division of labour – (Ref অব এন্সিয়েন্ট ইন্ডিয়া, পৃ. ৮৩)। কিন্তু এতে ভেদাভেদের ধারণাও ক্রমে প্রকট হয়ে উঠেছিল। বলা হয়েছে— ব্রাহ্মণরা এসেছেন ঈশ্বরের মুখ, ক্ষত্রিয়রা বাহু, ‘বৈশ্যরা’ উরু এবং ‘শূদ্ররা’ পদযুগল থেকে। তবে প্রথম দিকে ঘৃণা বিদ্বেষের স্থান ছিল না বিভিন্ন জাতের মধ্যে যোগাযোগ, বিবাহ, বন্ধুত্ব ইত্যাদি হতো। ড. মজুমদার, ড. রায় চৌধুরী ও ড. দত্তের মতে, “There was hardly any taboo in intermarriage, change of occupation or commensability (অ্যান্ অ্যাডভান্স হিস্ট্রি অব ইন্ডিয়া, পৃ. ৩৩)।
কিন্তু পরে তাতে এসেছে সঙ্কীর্ণতা গোঁড়ামি, উঁচু-নীচুর ভেদাভেদ। তাছাড়া প্রত্যেকটা বর্ণেও এসেছে অসংখ্য উপ-বিভাগ— এমনকী, জন্ম নিয়েছে অস্পৃশ্যতার তত্ত্বও। তার ফলে তথাকথিত নীচু বর্ণের মানুষ ঘৃণা, বিদ্বেষ ও অবজ্ঞার শিকার হয়েছেন অন্যায়ভাবে। এতে বিরাট বাধা এসেছে জাতীয় ঐক্য ও মানবিকতার ক্ষেত্রেও। কিন্তু আরও বেশি ক্ষতি হয়েছে জাতপাতের বিষয়টা রাজনীতির সঙ্গে মিশে যাওয়ার ফলে। এটা ঠিক শিক্ষার বিস্তার, নগরায়ণ, পাশাপাশি অবস্থান, কর্মগত সান্নিধ্য ইত্যাদি বিষয় এখন এই ভেদাভেদকে কিছুটা দূর করেছে। কিন্তু রাজনীতি জাতপাতের মানসিকতার সঙ্গে মিশে যাওয়ার ফলে নির্বাচনের বিষয়টাও কলুষিত হয়ে গেছে। দেখা যাচ্ছে বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন বর্ণ প্রাধান্য বিস্তার করেছে। যেমন কেরলে নায়ার, লাদার ও রেড্ডীয়ার তামিলনাড়ুতে; লিঙ্গয়েৎ ও এক্কালিঙ্গা কর্ণাটকে; পতিদার ও আন্নাভালাম গুজরাটে; এবং জাঠ ও রাজপুতরা উত্তরপ্রদেশ ও বিহারে প্রাধান্য বিস্তার করেছেন। দুশ্চিন্তার বিষয় হলো—বিভিন্ন রাজনৈতিক দল নির্বাচনী সাফল্যের জন্য প্রভাবশালী জাতের সঙ্গে যোগাযোগ করে এবং তার ফলে জাতপাত এখন রাজনীতির একটা অপরিহার্য উপাদান হয়ে গেছে। প্রার্থী নির্বাচন, নির্বাচনী প্রচার ইত্যাদি ব্যাপারে প্রায় সব দলই সংশ্লিষ্ট অঞ্চলের জাতপাতের বিশ্লেষণ সতর্কভাবে করে। আর অধিকাংশ ভোটারই রাজনৈতিক তত্ত্ব, অর্থনৈতিক কর্মসূচি, প্রার্থীর ব্যক্তিগত যোগ্যতা ইত্যাদিকে কোনও গুরুত্ব না দিয়ে নিজ নিজ জাতের প্রার্থীকেই বেছে নেন। বলা বাহুল্য, অনেকের ক্ষেত্রই এই বর্ণ-আবেগ প্রভাব বিস্তার করেছে। তাই জাতপাত এখন রাজনীতির সঙ্গে একাত্ম হয়ে গেছে।
জি. রাজন অবশ্য মনে করেন, এই ভাবাবেগটা গ্রামাঞ্চলেই বেশি— অন্যত্র এটা ততটা প্রকট নয়— (ডেমোক্র্যাসি অ্যান্ড ইকনমিক চেঞ্জ, পৃ. ৭৪)। কিন্তু বাস্তবের কথা হলো— কম হলেও এটা শহরের উচ্চাঙ্গ মহলে অনেকটা আছে— কারণ আবেগটা প্রাচীন এবং বংশানুক্রমিক। তাই সহদেব গুপ্ত মন্তব্য করেছেন, ‘Feeling of casteism is as strong as the religious sentiment(ইন্ডিয়ান কস্টিটিউশান, পৃ. ২২২)।
তার ফলে অনেক ক্ষেত্রে দুই দলের নির্বাচনী লড়াই কার্যত দুই জাতের দ্বন্দ্বে পরিণত হয়। ড. এস. এল. সিক্রি লিখেছেন, ‘caste is evident everywhere and all levels of electoral process, the selection of candidates, compaign, voting, behaviour and the formation of ministries- (ইন্ডিয়ান গভর্নমেন্ট অ্যান্ড পলিটিক্স)। অনেক সময় দেখা গেছে— একটা জাতের বহু মানুষ একসঙ্গে বুঝে গেছেন তাদের জাতের প্রার্থীকে ভোট দেওয়ার জন্য। রাজনীতির তত্ত্ব বা জাতীয় স্বার্থ তাদের কাছে বড়ো কথা নয়— প্রধান বিষয় হলো মনোনীত প্রার্থীর সাফল্য। সেই জন্য ডবলিউ. এইচ. মরিস জোস্ মন্তব্য করেছেন, Politics is more important to castes and castes are more important to politics than ever before – (গভর্নমেন্ট অ্যান্ড পলিটিক্স ইন্ ইন্ডিয়া)
প্রখ্যাত রাষ্ট্রবিজ্ঞানী জন্ স্টুয়ার্ট মিল্ মন্তব্য করেছেন—‘universal education must precede universal adult franchise— অর্থাৎ সার্বজনীন প্রাপ্ত বয়স্কের ভোটাধিকার স্বীকার করার আগে সার্বজনীন শিক্ষার ব্যবস্থা করা উচিত। তা না হলে রাজনৈতিক সচেতনতা, স্বচ্ছ চিন্তা, ও বাস্তব অভিজ্ঞতার অভাব ইত্যাদি কারণে ভোটের অপব্যবহার হতে পারে। শিক্ষার বিস্তার না ঘটলে নির্বাচনী আচরণে বর্ণ, ধর্ম, আঞ্চলিকতা, ভাষা, ব্যক্তিপূজা, অর্থলোভ, ক্ষুদ্র স্বার্থ ইত্যাদি আবেগ প্রাধান্য পায়। এই কারণে ব্রিটেনে শিক্ষাবিস্তারের সঙ্গে সঙ্গতি রেখেই ধাপে ধাপে ভোটাধিকার সম্প্রসারিত করা হয়েছে। আমাদের দেশে ব্যাপারটা হয়েছে উল্টো শিক্ষা বিস্তারের আগেই রাতারাতি সার্বজনীন প্রাপ্তবয়স্কের ভোটাধিকার স্বীকৃত হয়েছে। তার ফলে অনেক সময় সুষ্ঠু নির্বাচন হয় না বিভিন্ন ধরনের আবেগ, উন্মাদনা, লাভ লোকসানের খতিয়ান নির্বাচনী আচরণকে প্রভাবিত করে।
জাতপাত তেমনই একটা পুরনো ও অলৌকিক আবেগ। কোটি কোটি মানুষের মধ্যে এটা রয়ে গেছে এবং অধিকাংশ রাজনৈতিক নেতা এটাকে তাদের সুবিধাবাদী। রাজনীতিতে কাজে লাগান। রজনী কোঠারী। তাই মন্তব্য করেছেন, ‘Caste has been unduly politicised’— (কাস্ট ইন দ্য ইন্ডিয়ান পলিটিক্স)। বিশেষ করে বিহার, হরিয়ানা, মধ্যপ্রদেশ, উত্তরপ্রদেশ প্রভৃতি রাজ্যে এর প্রভাব পড়েছে বেশি করে। এম. এন. শ্রীনিবাস তাই মন্তব্য করেছেন, Nowa-days, all political parties put up candidates belonging to the locally preponderant castes’– (কাস্টস্ ইন্ মডার্ন ইন্ডিয়া)। এটা অবশ্য আশ্চর্যের কিছু নয়।
নেতারা বোঝেন দুটো কথা– ক্ষমতা পাওয়া এবং ক্ষমতা ধরে রাখা। সুতরাং তাদের অনেকের কাছেই জাতপাত একটা মহা মূল্যবান নির্বাচনী সামগ্রী। সেই জন্য ড. সিক্রি লিখেছেন, ‘caste-factors are still very important voting deferminants-ঐ, পৃ. ১১২)।
এটা লক্ষ্য করা গেছে যে, আমাদের অনেক নেতাই এই জাতপাতের রাজনীতিকে প্রাধান্য দিয়েছেন। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়— জগজীবন রাম তপশিলি বলে তপশিলি-অধ্যুষিত এলাকায় বরাবর দাঁড়িয়ে সাফল্য পেয়েছেন। হরিয়ানার দেবীলাল কয়েকটা বর্ণের মানুষকে একত্রিত করে ‘অজগর’ ও ‘সোলাঙ্কী’ গঠন করেছিলেন নির্বাচনী সাফল্যের জন্য। এই ভাবেই গড়ে উঠেছে জাতভিত্তিক রাজনীতির প্রাধান্য। অনেক ক্ষেত্রে আবার জাতপাতের ভিত্তিতেই রাজনৈতিক দল গড়ে উঠেছে— যেমন ডি. এম. কে., এ. আই. ডি. এম. কে. ইত্যাদি। আর বহু রাজনৈতিক দলই নির্বাচনে জয় লাভের জন্য বিশেষ বিশেষ জাতের ওপর নির্ভর করে। যেমন অনেকে তামিলনাড়ুতে ফরোয়ার্ড ব্লকে ‘মেজর পার্টি’ বলেন, অন্ত্রের রেড্ডীদের অনেকেই কংগ্রেস অনুরাগী। অনেক জাতই নিজেদের স্বার্থে বিশেষ বিশেষ দলের সঙ্গী হয়ে যায়। এভাবেই জাত-ভিত্তিক রাজনীতির সৃষ্টি হয়েছে।
ড. হরিহর দাস মন্তব্য করেছন, তাৎপর্যের বিষয় হলো—যদিও রাজনৈতিক দলগুলো জাতভিত্তিক রাজনীতিকে প্রকাশ্যে নিন্দা করে, তারা কিন্তু এটাকেই প্রাধান্য দিয়ে 216 yet they give top, mosts priority to the casteism in politics'(ইন্ডিয়া : ডেমোক্র্যাটিক গভর্নমেন্ট অ্যান্ড পলিটিক্স, পৃ. ৩৯৬)। এভাবেই জাতপাত আমাদের রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে গেছে।
ড. নির্মলেন্দুবিকাশ রক্ষিত

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.