কৈলাশ থেকে ইতিমধ্যেই সপরিবারে এসে হাজির হয়েছেন মা দুর্গা। দেবীকে ঘিরে থরে থরে সাজানো উপঢৌকন। ফুলের সজ্জা, আলোর রোশনাই অথবা পুজোর উপাচারে কোথাও কোনো ফাঁক নেই। রাজবাড়ির ঠাকুর দালানে লোকে লোকারণ্য। এসবের মধ্যেই কামানের গর্জনে শুরু হয়ে গেল দেবীর সপ্তমীবিহিত পুজো।
১৭৭০-এর আশ্বিনে হাওড়ার (Howrah) আন্দুল রাজবাড়িতে (Andul Rajbari Durga Puja) সেই প্রথম দুর্গাপুজো। রাজবাড়ির পুজো বলে কথা, এমনিতেই বৈভবের খামতি নেই। খামতি নেই আড়ম্বরেরও। সেই জৌলুসের পারদ আরও চড়ে গেল লর্ড ক্লাইভের পদার্পণে। রাজবাড়ির সামনে এসে থামল সারি সারি জুড়িগাড়ি। পিছনে সুসজ্জিত ফিটন। সেই জুড়িগাড়ি থেকে নামছে ডালার পর ডালা সন্দেশ। আর পিছনের ফিটন থেকে নামলেন স্বয়ং লর্ড ক্লাইভ সাহেব। পলাশির যুদ্ধ পেরিয়ে গিয়েছে বেশ কিছু বছর আগে। নবাবরা থাকলেও, সেই ক্ষমতা আর নেই। বরং রাজদণ্ড উঠে এসেছে ব্রিটিশদের হাতে। যুদ্ধে নবাব সিরাজদৌল্লাকে হারিয়ে কোম্পানির নয়ণের মণি তখন লর্ড ক্লাইভ (Lord Clive)। সেই ক্লাইভ সাহেবের দেওয়ান ছিলেন আন্দুলের রামলোচন রায়। ক্লাইভের সুপারিশেই শেষ মুঘল সম্রাট দ্বিতীয় শাহ আলমের কাছ থেকে তিনি পেয়ে ছিলেন ‘রাজা’ উপাধি।
নিছক গল্পকথা নয়, ঐতিহাসিক সত্য। ক্লাইভের পরামর্শেই আন্দুল রাজবাড়িতে দুর্গাপুজোর সূচনা। তাঁর অনুগত ‘রাজা’কে উৎসাহ দিতে প্রথমবারের সেই পুজোয় দশ হাজার টাকার সন্দেশ, দেবীর পাদপদ্মে নিবেদনের জন্য ১০৮টি পদ্ম ও এক হাজার টাকা প্রণামী নিয়ে উপস্থিত হয়েছিলেন লর্ড ক্লাইভ।
সূচনালগ্ন থেকেই আন্দুল রাজবাড়ির পুজোর নাম ছড়িয়ে গেল সর্বত্র। শুরুতে কামানের গর্জন, তূর্যধ্বনি, আলোর রোশনাই, কাঙালি ভোজন, নাচমহলের বেলোয়ারি ঝাড়ের টুংটাং শব্দের সঙ্গে বাইজিদের মুজরো এসবই ছিল আভিজাত্যের স্মারক। এছাড়াও ছিল মহিষ এবং ছাগল বলির রেওয়াজ।
যত দিন গেল, জাঁকজমক বেড়ে চলল আরও। শোনা যায়, পরবর্তীকালে ওয়ারেন হেস্টিংসও এসেছেন এই পুজোয়। সব মিলিয়ে রাজকীয় জৌলুস বাড়তে লাগলো। সময়ের সঙ্গে তার রেশ ছড়িয়ে পড়লো রাজবাড়ির বাইরেও। রাজপরিবারের পাশাপাশি সাধারণ মানুষরাও যোগ দিতে থাকলেন পুজোয়।
এখন সেই রাজাও নেই, রাজপাটও গেছে চুকে। কিন্তু ইতিহাস আজও আঁকড়ে ধরে আছে হাওড়ার বিখ্যাত এই রাজবাড়িকে। আর রয়েছে দুর্গাপূজা। জৌলুস কমেছে ঠিকই তবে ঐতিহ্য রক্ষায় খামতি নেই কোথাও।আজও কৃষ্ণা-নবমী তিথিতে কল্পারম্ভ হওয়ার রীতি পালিত হয় এখানে। সেই রীতি মেনে অনান্য পুজোর ১২দিন আগেই বসে পুজোর আসর। রাজবাড়ির মাঠে বসে মেলা। কিন্তু সেদিনের কামান আজ আর গর্জে ওঠে না, বন্ধ হয়েছে বলিও। বাইজিদের সেই মুজরোর আসরের জায়গায় এখন রাজবাড়ির সদস্যরা স্বয়ং সামিল হন ধুনুচি নাচে। সময়ের সঙ্গে রাজবাড়ির প্রাচীন আঙিনাতে আঁচড় পড়েছে অনেক। মন্দিরের আদলে এসেছে আধুনিকতার স্পর্শ। পুরোনো বেলোয়ারি ঝাড় বদলে লাগানো হয়েছে আধুনিক মানের ঝাড়বাতি। কিন্তু ঐতিহ্য বজায় রাখতে প্রথা মেনে এখনও আটমণ মাটি দিয়ে তৈরি হয় একচালা প্রতিমা। বাহন সিংহের মুখ ও গ্রীবাদেশ করা হয় ঘোড়ার মতো। দুর্গাপূজার হাত ধরেই প্রতি বছর এখানে ইতিহাসকে ছোঁয়ার চেষ্টা চলে বারবার; আর তার শরিক হন সমগ্র আন্দুলবাসী।
১৯৬২ সালে মীনাকুমারী, গুরু দত্ত এবং ওয়াহিদা রহমান অভিনীত ‘সাহেব বিবি আউর গুলাম’ তৈরির জন্য পরিচালক গুরু দত্তর টিম দীর্ঘদিন শুটিং করেছিল আন্দুল রাজবাড়িতে। টলিউড, টেলিফিল্ম সহ বিজ্ঞাপনের ছবি সবকিছুই হয়েছে এই রাজবাড়িতে। শুটিং করেছেন স্বয়ং সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ও।
এখন রায় পরিবারের রাজত্ব আর নেই। বদলে মিত্রদের বাস এখানে। কিন্তু আন্দুল রাজবাড়ি আছে সেই আগের মতোই। পেল্লাই এই প্রাসাদের সর্বাঙ্গে এখন জীর্ণতার ছাপ, কিন্তু মাহাত্ম্য কমেনি একটুও। যেমন কমেনি এখানকার দুর্গাপুজোর জাঁকজমক। প্রথা মেনে ১২ দিন আগে ঢাকে কাঠি পড়ে, সনাতনী ডাকের সাজে সজ্জিতা হয়ে ওঠেন দেবী দুর্গা। আর আন্দুল রাজবাড়ির আরাধনায় বর্তমান প্রজন্মের হাত ধরে ইতিহাসের পুনঃস্থাপন হয় বারবার।
।