প্রাক্তন আমলা জহর সরকার প্রত্যক্ষ রাজনীতিতে আসায় প্রশ্ন তুলেছেন অনেকেই। কিন্তু প্রাক্তন ও পদত্যাগী বহু আমলাই নানা সময়ে সর্বভারতীয় রাজনীতিতে এসেছেন। মন্ত্রী-সাংসদ হয়েছেন। গোটা দেশে এ রকম নজীর রয়েছে অনেক। অনেকেই যথেষ্ঠ নাম করেছেন। আসুন দেখা যাক, তাঁদের কীর্তি।
স্যর চিন্তামন দ্বারকানাথ দেশমুখ (১৪ জানুয়ারি ১৮৯৬ — ২ অক্টোবর ১৯৮২) ছিলেন ভারতের অষ্টাদশ আইসিএস অফিসার। ১৯৪৩-এ রিজার্ভ ব্যাঙ্কের প্রথম ভারতীয় গভর্নর হন তিনি। ১৯৫০ থেকে ১৯৫৬ ছিলেন কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী। এর পর ইউজিসি-র চেয়ারম্যান (১৯৫৬-’৬১), দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য (১৯৬২-’৬৭), আইএসআই-এর প্রেসিডেন্ট (১৯৪৫-’৬৪) প্রভৃতি গুরুত্বপূর্ণ নানা দায়িত্বে ছিলেন। স্বাধীনতার পর কোনও আমলার প্রত্যক্ষ রাজনীতিতে আসার প্রথম নিদর্শন সম্ভবত এটাই।
রাজীব গান্ধী প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন গান্ধী পরিবারের ঘনিষ্ঠ ১৯৬৮ ব্যাচের আইএএস অজিত যোগী পদত্যাগ করে কংগ্রেসে যোগ দেন। ছত্তিশগঢ়ের প্রথম মুখ্যমন্ত্রীও হন তিনি। কিন্তু হরেক দুর্নীতির অভিযোগ ও ফৌজদারি মামলায় জর্জরিত হয়ে ২০১৬-তে কংগ্রেস ত্যাগ করেন ওই আদিবাসী নেতা। তাঁর পুত্র অমিতকে ছ’বছরের জন্য সাসপেন্ড করা হয়। নির্বাচনে কংগ্রেসের ভোট কাটতে অজিত যোগী ছত্তিশগঢ় জনতা পার্টি তৈরি করেন।
যশবন্ত সিংয়ের জন্ম পটনায়। ১৯৬০-এর আইএএস, কাজ করেছেন ১৯৮৪ পর্যন্ত। জনতা দলের হয়ে ১৯৯০-’৯১ সালে অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব পান। প্রধানমন্ত্রী ছিলেন চন্দ্রশেখর। এর পর দলত্যাগ করে বিজেপি-তে। প্রধানমন্ত্রী অটলবিহারি বাজপেয়ীর আমলে অর্থ এবং পররাষ্ট্র গুরুত্বপূর্ণ দুটি মন্ত্রকের দায়িত্ব পান। দলের সঙ্গে মতবিরোধের কারণে ২০১৮-তে বিজেপি ছাড়েন। তাঁর পুত্র জয়ন্ত সিংহ এখন অসামরিক বিমান চলাচলের প্রতিমন্ত্রী।
ভারতের চতুর্থ উপপ্রধানমন্ত্রী বাবু জগজীবন রামের কন্যা মীরা কুমার ছিলেন ১৯৭০-এর আইএফএস ব্যাচ। মীরার জন্ম বিহারের আরায়। এক যুগের ওপর সরকারি দায়িত্ব পালন করে রাজনীতিতে আসেন। ১৯৮৫-তে রামবিলাস পাসোয়ানকে এবং উপনির্বাচনে মায়াবতীকে হারিয়ে তাক লাগিয়ে দেন। ২০০৪-এ হন ইউপিএ সরকারের কেন্দ্রীয় সামাজিক ন্যায়বিচার মন্ত্রী। ২০০৯-এ অল্প সময়ের জন্য কেন্দ্রীয় জলসম্পদ মন্ত্রীর দায়িত্ব পালনের পর লোকসভার স্পিকার হন। ওই দায়িত্বে ছিলেন ২০১৪ পর্যন্ত। ২০১৭-তে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে ছিলেন ইউপিএ প্রার্থী। কিন্তু হেরে যান।
মণিশঙ্কর আয়ারের জন্ম লাহোরে। ১৯৬৩ সালের ব্যাচের আইএফএস। চাকরি ছেড়ে ১৯৮৯-তে রাজনীতিতে আসেন। রাজীব গান্ধীর চেয়ে বয়সে বড়, তবে দু’জনই দুন স্কুলে পড়তেন। তাই সখ্যতা ছিল। ১৯৯১-তে তামিলনাডুর ময়লাদুতুরাই কেন্দ্রে লোকসভা ভোটে জেতেন। এর পর বিভিন্ন সময়ে কেন্দ্রে নানা মন্ত্রকের দায়িত্ব পেয়েছেন। তবে বিতর্কিত নানা মন্তব্য করে সমালোচিত হয়েছেন রাজনৈতিক মহলে। গুজরাতের নির্বাচনের আগে এরকমই একটি মন্তব্যের জেরে কংগ্রেস তাঁকে সাসপেন্ড করে। বেশ কিছুকাল বাদে সেই শাস্তি প্রত্যাহৃত হয়।
১৯৫৩ সালের আইএফএস নটবর সিং। ৩১ বছর ছিলেন চিন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র-সহ গুরুত্বপূর্ণ নানা দায়িত্বে। সরকারি চাকরি ছেড়ে ১৯৮৪-তে যোগ দেন কংগ্রেসে। ১৯৮৫-তে পান পদ্মভূষণ। রাজস্থানের ভরতপুর থেকে আটবার লোকসভা ভোটে জেতেন। রাজীব গান্ধী এবং মনমোহন সিংয়ের মন্ত্রিসভায় নানা গুরুত্বপূর্ণ দফতর পেয়েছেন। সনিয়া গান্ধীকে নাম ধরে ডাকতেন। প্রবল প্রতাবান্বিত মানুষটি ‘খাদ্যের বদলে তেল‘ প্রকল্পের কেলেঙ্কারিতে ফেঁসে মন্ত্রিসভা ছাড়তে বাধ্য হন।
অরবিন্দ কেজরিওয়াল ১৯৮৯ সালে আইআইটি থেকে মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করেন। ১৯৯২-তে যোগ দেন ইন্ডিয়ান রেভিনিউ সার্ভিসে। তথ্যের অধিকারের ব্যাপারে সরব হন। ২০০৬-এ পান রামন ম্যাগসেসে পুরস্কার। দুর্নীতির প্রতিবাদে ২০১১-তে আন্না হাজারে যে আন্দোলন শুরু করেন, তাতে অগ্রণী ভূমিকা নেন অরবিন্দবাবু। ২০১২-তে তৈরি করেন আম আদমী পার্টি। ২০১৩-র নির্বাচনে দিল্লির দ্বিতীয় বৃহত্তম দল হয় এটি। কংগ্রেসের সমর্থনে মুখ্যমন্ত্রী হন। কিন্তু ৪৯ দিন বাদে মন্ত্রিসভা ভেঙে যায়। এর পর ’১৫-র নির্বাচনে ৭০ আসনের মধ্যে ৬৭টি আসন পায় তাঁর দল।
বিজেপি আমলেও রয়েছে হরেক নিদর্শন। যেমন হরদীপ সিং পুরি। ১৯৭৪ ব্যাচের এই আইএফএস ইউকে এবং ব্রাজিলের অ্যাম্বাসেডর ছিলেন। নিউ ইয়র্ক এবং জেনিভায় জাতিসঙ্ঘে ভারতের স্থায়ী প্রতিনিধি ছিলেন। জাতিসঙ্ঘের নিরাপত্তা পরিষদে সভাপতি ছিলেন দুবার। ছিলেন আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদ দমন কমিটির চেয়ারম্যান। ২০১৪-র জানুয়ারিতে পদপ্যাগ করে বিজেপি-তে যোগ দেন। ২০১৭-তে হন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী।
১৯৭৫ সালের আইএএস বিহারের রাজকুমার সিং ছিলেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র সচিবের মত গুরুত্বপূর্ণ পদে। ১৯৯০-তে লালকৃষ্ণ আডবাণী যখন রথযাত্রায় বেড়িয়ে সমস্তিপুরে গ্রেফতার হন, রাজকুমারবাবু ছিলেন সেখানকার জেলাশাসক। ২০১৩-তে তিনি বিজেপি-তে যোগ দেন। বিহারের আরা জেলা থেকে ভোটে জিতে কেন্দ্রে মন্ত্রীও হন।
১৯৮০-র ব্যাচের ইন্ডিয়ান পুলিশ সার্ভিসের সত্যপাল সিং মহারাষ্ট্র ক্যাডারের। মুম্বাইয়ের পুলিশ কমিশনার ছিলেন। গত শতকের নয়ের দশকে মুম্বাইয়ের অপরাধী চক্র নির্মূলের চেষ্টায় সাহসী ভূমিকা নিয়েছিলেন। মধ্যপ্রদেশ ও অন্ধ্রপ্রদেশের নকশাল অধ্যুষিত অঞ্চলে বিশেষ কাজের জন্য পুরস্কৃত হয়েছেন। ২০১৪-তে মুম্বাইয়ের সিপি-র পদ ছেড়ে বিছেপি-তে যোগ দেন। সে বছর লোকসভা ভোটে বাগপত কেন্দ্র থেকে জিতে কেন্দ্রে মন্ত্রী হন।
কেরলের কোট্টায়াম জেলার অবসরপ্রাপ্ত আইএএস আলফোনস কান্নানথানাম ছিলেন ১৯৭৯-র ব্যাচ। গত শতকের নয়ের দশকে দিল্লি উন্নয়ন সংস্থার (ডিডিএ) কমিশনার হিসাবে বহু বেআইনি বাড়ি ভেঙে দেন। উদ্ধার করে দেন ১০ হাজার কোটি টাকারও বেশি মূল্যের সরকারি জমি। ২০০৬-এ অবসরের পর সে বছরেই বাম (এলডিএফ) সমর্থনে নির্দল প্রার্থী হিসাবে তিনি কোট্টায়ামের কাঞ্জিরাপপল্লী বিধানসভা কেন্দ্রে জেতেন। ২০১১-তে যোগ দেন বিজেপি-তে। ছ’বছর বাদে রাজস্থান থেকে রাজ্যসভার সদস্য হন। এর পর কেন্দ্রে মন্ত্রীত্বও পান। গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালীন (২০০১-
২০১৪) প্রাক্তন আমলাদের চোখে পড়ার মত গুরুত্ব দিতেন নরেন্দ্র মোদী। ২০১৪-র মে মাসে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নিয়ে মন্ত্রিসভায় প্রাক্তন আমলাদের নিতে ভোলেননি। মাঝে মাঝেই ৭, লোক কল্যাণ মার্গের বাসভবনের লনে আলোচনায় বসতেন। ২০১৭-র জুন মাসে সিং, পুরি, কেজে আলফোনস এবং সত্য পাল সিং— এই চার জন প্রাক্তন আমলাকে মন্ত্রিসভায় দায়িত্ব দেন। প্রবীন রাজনীতিকদের অনেকে অসন্তুষ্ট হবেন জেনেও এই সিদ্ধান্ত নিতে দ্বিধা করেননি মোদী।
২০১৯-এর জুন মাসে কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভায় মোট ন’টি দফতর প্রাক্তন আমলাদের দেন প্রধানমন্ত্রী মোদী। পাঁচটি পূর্ণমন্ত্রীর, চারটি প্রতিমন্ত্রীর। সুব্রাম্ভনীয়ম জয়শঙ্করের আচমকা শপথ গ্রহণ বিস্মিত করেছিল অনেককে। ১৯৭৭ ব্যাচের এই অবসরপ্রাপ্ত আইএফএস পান পররাষ্ট্র মন্ত্রকের দায়িত্ব। প্রাক্তন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রসচিব আর কে সিং পান দুটি দফতরের স্বাধীন প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব। ‘১৯-এ কেন্দ্রীয় শিল্প ও বানিজ্য দফতরে হরদীপ সিং পুরির সঙ্গে আর এক প্রাক্তন আমলাকে প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব দেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি হলেন পঞ্জাব ক্যাডারের প্রাক্তন আইএএস অফিসার সোমপ্রকাশ।
তালিকায় আছেন ১৯৯৪ সালের আইএএস অফিসার ওডিশার অপরাজিতা ষড়ঙ্গি। অবসরের ১১ বছর আগে তিনি যোগ দিয়েছেন বিজেপি-তে। ওড়িশার ভুবনেশ্বর কেন্দ্রে গত দু’দশক ধরে জিতে এসেছে বিজু জনতা দলের (বিজেডি) প্রার্থী। বিজেপি অপরাজিতাকে প্রার্থী করে। শাসক বিজেডি প্রার্থী করে এক প্রাক্তন আইপিএস অফিসার অরূপ মোহন পট্টনায়ককে। রাজ্যের রাজধানীতে দুই প্রাক্তন আমলার লড়াই স্বাভাবিকভাবেই বাড়তি মাত্রা পায়। শেষ পর্যন্ত অপরাজিতা জেতেন ২৩,৮৩৯ ভোটে।
২০০৫-এর আইএএস ও পি চৌধুরী ছত্তিশগঢ়ের মুখ্যমন্ত্রী রমন সিংয়ের অনুপ্রেরণায় ২০১৮-তে রাজনীতিতে আসেন। সে বছর বিধানসভা ভোটে খারসিয়া কেন্দ্রে হেরে যান কংগ্রেস প্রার্থীর কাছে। চৌধুরীর কথায়, “সে সময় বিজেপি-র সর্বভারতীয় সভাপতি অমিত শাহ বলেছিলেন, ভাল কাজ করছ। এত অল্প বয়স। তুমি তো মুখ্যসচিব হবে। কেন তাহলে রাজনীতিতে আসছ? আমি ঠিক করে ফেলেছিলাম রাজনীতিই করব। এখন মনে হচ্ছে প্রশাসনিক কাঠামোর মধ্যে থেকে কাজ করলেই ভাল হত।“ এখন চৌধুরী সর্বক্ষণের রাজনৈতিক কর্মী।
একই মন্তব্য ৬০ বছর বয়সী প্রাক্তন আইএএস অফিসার এমজিভিকে ভানুর। কংগ্রেসের হয়ে লোকসভা নির্বাচনে তিনি প্রার্থী হন তেজপুর কেন্দ্রে। ৪ লক্ষ ৪০ হাজার ভোট পেয়েও হেরে যান। এর পর নবীন আইএএস-দের উদ্দেশে বলেন, “কোনও কোনও প্রাক্তন আইএএস মন্ত্রী হয়ে যাচ্ছে। এটা দেখে কেউ আইএএস-এর চাকরি ছেড়ে রাজনীতিতে এসো না। ভোটে জেতা আইএএস হওয়ার চেয়েও কঠিন।“ লোক গঠবন্ধন পার্টির হয়ে গত লোকসভা নির্বাচনে উত্তরপ্রদেশের ফৈজাবাদ থেকে প্রার্থী হয়েছিলেন প্রাক্তন কেন্দ্রীয় সচিব তথা দুর্নীতি-দমন আন্দোলনের মুখ বিজয় শঙ্কর পান্ডে। ভোট পান মাত্র ২,০৫৬ (প্রদত্ত মোট ভোটের ০.১৯%)।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও গত এক দশকে প্রাক্তন আমলাদের অনেককে প্রশাসনে এবং মন্ত্রিসভায় এনেছেন তাঁদের অভিজ্ঞতার ফসল পেতে। প্রথমেই নাম করা যেতে পারে গৌতম সান্যালের। মমতা-গৌতম সমঝোতা এখনও অটুট। তবে প্রাক্তন আইএএস দীপক ঘোষের সঙ্গে মুখ্যমন্ত্রীর সখ্যতা স্থায়ী হয়নি। ২০১৭-র ১৮ ডিসেম্বর সবংয়ের জনসভায় দীপকবাবু তৃণমূল ছেড়ে বিজেপি-তে যোগ দেন। তার পর থেকে তাঁকে সেভাবে খুঁজে পাওয়া যায়নি। আরেকজন হলেন নীতীশ সেনগুপ্ত। মেধাবী নীতীশ ১৯৫৭ সালে ইন্ডিয়ান অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিসে যোগ দেন। রেভিনিউ সেক্রেটারির পদ সামলেছেন। প্ল্যানিং কমিশনের সদস্য থেকেছেন। ১৯৯৬ সালে তিনি তৃণমূল কংগ্রেসের হয়ে সাংসদ হন। পিএসি-সহ গুরুত্বপূর্ণ নানা কমিটির সদস্য ছিলেন তিনি। প্রাক্তন আইএএস আধিকারিক এবং পশ্চিমবঙ্গের প্রাক্তন মুখ্যসচিব মণীশ গুপ্ত, আইএএস দেবব্রত বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখের অভিজ্ঞতার ফসল নিয়েছেন মমতা। মণীশবাবু তো প্রায় তিন বছর (১৪ই মার্চ ২০১৭ – ৩রা মার্চ ২০২০) রাজ্যসভার সাংসদ ছিলেন। এবার সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে সক্রিয় প্রাক্তন আমলাদের এই তালিকায় যুক্ত হল জহর সরকারের নাম।
অশোক সেনগুপ্ত