আরে কলোনি: ‘মুম্বইয়ের ফুসফুস’ বুলডোজারের নীচে! বিক্ষোভকারীদের মানব-শৃঙ্খল ভাঙছে পুলিশ, গ্রেফতার ২৯, আটক ২০০

ধীরে ধীরে এগোচ্ছে বুলডোজার। চাকার তলায় পিষে পিষে যাচ্ছে একের পর এক গাছ। হাতে হাত ধরে মানব-শৃঙ্খল তৈরির ব্যর্থ চেষ্টা করছেন পরিবেশপ্রেমীরা। ধাক্কা মেরে, লাঠি তুলে সরিয়ে দিচ্ছেন পুলিশ কর্তারা। “মুম্বইয়ের ফুসফুসকে শেষ হতে দেব না। এই সবুজ আমাদের জীবন,” স্লোগান উঠছে মুর্হূমুর্হূ। শুক্রবার রাত থেকে এটাই চেনা ছবি মুম্বইয়ের আরে কলোনির।

সবুজ সরিয়ে আরে কলোনিতে মেট্রো প্রকল্পের কাজ শুরু হয়েছে। ২৩ হাজার ১৩৬ কোটি টাকার কোলাবা-বান্দ্রা মেট্রো প্রকল্পের জন্য আরে অঞ্চলকে প্রায় বৃক্ষশূন্য করতে হবে। একটা কারশেড তৈরির জন্যই কাটতে হবে আড়াই হাজারের বেশি গাছ। রাজ্য সরকারের এই পরিকল্পনার কথা সামনে আসার পরই তুমুল বিক্ষোভ শুরু হয় আরে কলোনিতে। স্থানীয়রা তো বটেই, রাজ্যের নানা জায়গা থেকে পরিবেশপ্রেমী, ছাত্রছাত্রী থেকে অধ্যাপক-গবেষকরা ভিড় জমান কলোনিতে। হাতে হাত রেখে মানব-শৃঙ্খল তৈরি করে বৃক্ষছেদনে বাধা দেন। জমায়েত তুলতে হাজির হয় মুম্বই পুলিশের বিশেষ বাহিনী। গোটা এলাকা রণক্ষেত্রের চেহারা নেয়।

আরে এলাকায় গাছ কাটা রুখতে চারটে পিটিশন দাখিল হয় বম্বে হাইকোর্টে। গতকাল এই আপিল খারিজ করে দেয় আদালত। জানানো হয়, আরে কলোনি সবুজে ভরা হলেও এই এলাকাকে ‘জঙ্গল’-এর স্বীকৃতি দেওয়া হবে না। আদালত মুখ ফিরিয়ে নিলে গতকাল রাত থেকে ফের গাছ কাটার তোড়জোড় শুরু করে দেয় মুম্বই পুরসভা। গতকাল থেকে আজ, শনিবার সকাল পর্যন্ত বিক্ষোভকারী ২৫ জন পরিবেশবিদকে গ্রেফতার করা হয়েছে। আটক করা হয়েছে আরও ২০০ জন আন্দোলনকারীকে। গোটা এলাকায় জারি হয়েছে ১৪৪ ধারা।

শুক্রবার রাত থেকে শনিবার সকাল অবধি বিক্ষোভের নানা ছবি:

মুম্বইয়ের ফুসফুস-নিধন চলছে, বিক্ষোভের ঝড় উঠেছে গোটা দেশে

আন্দোলনকারীদের দাবি, গতকাল থেকে আটশোর বেশি গাছ কেটে ফেলেছেন পুরকর্মীরা। বাকি গাছ আগামী দু’দিনের মধ্যে কেটে ফেলা হবে। পরিবেশ বাঁচাও অভিযানে গোটা দেশ যেখানে তৎপর, সেখানে নির্বিচারে বৃক্ষছেদন চলছে। তাও আবার মুম্বইয়ের ‘গ্রিন লাঙ’ (Green Lung) বলে পরিচিত আরে কলোনিতে।

আরে কলোনির বৃক্ষছেদন নিয়ে তুলকালাম চলছে সোশ্যাল মিডিয়াতে। টুইটার-যুদ্ধে মেতেছেন আমজনতা থেকে রাজনীতিবিদ, সমাজকর্মীরা। আরে কলোনিতে গাছ কাটার তীব্র প্রতিবাদ করে কংগ্রেস নেতা অভিষেক মনু সিঙ্ঘভি টুইট করে বলেছেন, “আধুনিক মানুষরা প্রথমে নির্দ্বিধায় গাছ কাটে। পরে সেই মৃত গাছ থেকে তৈরি কাগজে পরিবেশ বাঁচানোর কথা লেখে।”

মুম্বই পুলিশের ব্যবহারে ক্ষুব্ধ শিবসেনা নেত্রী প্রিয়ঙ্কা চতুর্বেদী বলেছেন, “আমাকে আরে কলোনিতে ঢুকতে দেওয়াই হয়নি। পুলিশ রাস্তা আটকে দাঁড়িয়ে রয়েছে। আমি কোনও আইন ভাঙিনি, তাও জোরজবরদস্তি করে পুলিশ আমাকে সরিয়ে নিয়ে গেছে। কোথায় আমাকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে সেটাও বলা হয়নি। এমন ব্যবহার আশা করা যায় না।”

আরে কলোনির সবুজ-নিধনকে পুরোপুরি বেআইনি দাবি করে প্রতিবাদ জানিয়েছেন দলিত নেতা তথা গুজরাটের বডগামের বিধায়ক জিগনেশ মেবাণী এবং শিবসেনা নেতা আদিত্য ঠাকরে। জিগনেশের দাবি, “পরিবেশ রক্ষার অভিযানে নেমেছেন যাঁরা, তাঁদের উপরেই লাঠি চালাচ্ছে পুলিশ। একটা শান্তি আন্দোলনকে চোখ রাঙিয়ে, মারধর করে ছত্রভঙ্গ করে দেওয়ার চেষ্টা চলছে। আইন রক্ষার নামে বেআইনি কাজ চলছে আরে কলোনিতে।”

একই দাবি আদিত্য ঠাকরেরও। টুইট করে আদিত্য বলেছেন, “রাতের অন্ধকারে বিশাল বাহিনী নিয়ে বেআইনি কাজ করছে পুলিশ। মেট্রো প্রকল্পের কাজ অবশ্যই হোক, কিন্তু পরিবেশ ধ্বংস করে নয়। মুম্বইয়ের বিষাক্ত বাতাসে সেটুকু অক্সিজেন আসত সেটাই বন্ধ করে দিতে চাইছে সরকার।”

সবুজ-প্রতিবাদে বলিউড

মুম্বইতে এতবড় একটা দক্ষযজ্ঞ চলছে অথচ বলিউডের সিংহভাগ নীরব। গতকাল থেকে সোশ্যাল মিডিয়ায় এমন অভিযোগ তুলছেন নেটিজেনরাই। তর্ক-বিতর্কের মাঝে এ দিন বেলার দিকে টুইট করেন আলিয়া ভাট। আলিয়া লেখেন, “উন্নয়ন এবং সংরক্ষণ–এই দুইয়ের মাঝে বিরোধ চিরন্তন। শহরে জনসংখ্যা বাড়ছে, কাজেই পরিকাঠামোর অগ্রগতি খুব দরকার। পাশাপাশি, সবুজায়নও প্রয়োজন। এই অরণ্যকে আমাদের রক্ষা করার উচিত।”

আরে কলোনির সমর্থনে মুখ খুলেছেন অভিনেত্রী রাকুল সিং। টুইটারে হ্যাশট্যাগ ‘আরে ফরেস্ট’ লিখে তাঁর দাবি, সবুজের নিধন মানে ধ্বংসের দাবানলে আর একটু পেট্রল ফেলে দেওয়া।

আরে কলোনি নিয়ে গতকাল থেকেই টুইটারে সরব পূজা ভাট। এ দিনও তিনি লেখেন, “আমরা এমন একটা পৃথিবীতে বাস করছি, যেখানে সবুজের প্রয়োজনীয়তাটা বুঝতেই পারছেন না মানুষজন। নীতিবোধ এবং অভিজ্ঞতার বড়ই অভাব।”

“ক্ষমতার আস্ফালন অনেক দেখিয়েছে মুম্বই। কিন্তু এ বার যেটা হচ্ছে, সেটা জনসাধারণের মতের বিরুদ্ধে গিয়ে। আরে কলোনির ধ্বংস সাধারণ মানুষ চান না, ” টুইটার-যুদ্ধে সামিল অভিনেতা বরুণ ধওয়ানও।

দু’বছরের আন্দোলন মুখ থুবড়ে পড়েছে, চোখে জল-মুখে ধিক্কার পরিবেশপ্রেমীদের

পরিবেশকর্মীদের কথায়, দীর্ঘ দু’বছর ধরে আরে কলোনিকে সবুজ বনাঞ্চলের তকমা দেওয়ার জন্য লড়াই চলছে। বম্বে হাইকোর্ট সমস্ত পিটিশন খারিজ করে দিয়েছে। সুপ্রিম কোর্ট ও ন্যাশনাল গ্রিন ট্রাইবুনালের দরজায় কড়া নেড়েও লাভ হয়নি। মামলাটি সেখানেও ঝুলে রয়েছে। কাজেই সমবেত ভাবে প্রতিবাদ জানানো ছাড়া আর কোনও উপায় নেই।

পাঁচ লক্ষেরও বেশি গাছ রয়েছে আরে কলোনিতে। অনেক বিরল প্রজাতির গাছও রয়েছে। পরিবেশবিদদের কথায়, এই অঞ্চলকে মুম্বইয়ের ফুসফুস বলা হয়। দূষিত মুম্বই শহরকে অক্সিজেন দিয়ে বাঁচিয়ে রেখেছে এই সবুজ অঞ্চল। এই এলাকাকেই ধ্বংস করার কাজে মেতেছে সরকার। আরে কলোনি ঘিরে রেখেছে বিশাল পুলিশবাহিনী। তাই কলোনির বাইরেই ক্যাম্প করে রাতভর প্রতিবাদ করেছেন বহু মানুষ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.