বৃক্ষ ইব স্তব্ধো দিবি তিষ্ঠত্যেকঃ – দ্বিতীয় পর্ব

দ্বিতীয় পর্ব

উপনিষদ্ বলছেন- অথ যদূর্ধ্বং মধ্যন্দিনাৎ প্রাগপরাহ্নাৎ স প্রতিহারস্তদস্য গর্ভা অন্বায়ত্তাস্তাস্মাত্তে প্রতিহৃতা নাবপদ্যন্তে প্রতিহারভাজিনো হ্যেতস্য সাম্নঃ।।

মধ্যাহ্নের পরে , কিন্তু অপরাহ্নের পূর্বে সূর্যের যে রূপ তা – ই প্রতিহার গর্ভস্থ সন্তানেরা সূর্যের এই অংশে অনুগত। এই জন্যই তারা জরায়ুতে রক্ষিত থাকে। নীচে পড়ে যায় না। এই কারণেই তারা সামের প্রতিহার অংশের অধিকারী।

প্রকৃতি প্রেমিক বিভূতিভূষণ , বহুবিচিত্র – রূপধর্মী প্রকৃতির পর্যবেক্ষণে ও চিত্রাঙ্কনে আরণ্যক গ্রন্থটি অপরূপ হয়ে উঠেছে। কিন্তু সে তো বিভূতিভূষণের মূল উদ্দেশ্য নয়। বাহ্যরূপের অন্তরালে প্রকৃতির যে নিগূঢ় প্রাণস্বত্তা বিদ্যমান তিনি প্রধানতঃ তারই সন্ধান করেছেন। ঠিক যেমন উপনিষদ্ বলেছেন। বিভূতিভূষণের দৃষ্টি একই সঙ্গে বস্তুনিষ্ঠ, বৈচিত্র্যদর্শী, শান্ত ও স্নিগ্ধ। জীবনের মূলে যে প্রসন্ন সার্থকতাবোধ আছে, সুগভীর আস্তিক্যবুদ্ধির প্রভাবে সে সম্বন্ধে তিনি সম্পূর্ণ সচেতন। তাই , আরণ্যক – এ প্রকৃতির রুক্ষ ও নিষ্ঠুর স্বভাবের সঙ্গে তিনি অতি সহজেই মিশিয়ে দিয়েছেন তার অপরূপ কোমলতা ও মাধুর্য। সব কিছুকেই তিনি দেখেছেন এক প্রসন্ন দৃষ্টিতে। সকলকে গ্রহণ করেছেন প্রসন্ন মনে।

সেই অরণ্যে যেমন সর্বনাশা দাবানল আছে , যেমন ডাকিনী ,হাকিনী , অশরীরী ,অলৌকিক, পরী , ডামাবাণুর মারাত্মক মায়া আছে, তেমনি সরস্বতী কুণ্ডীর আরণ্যক সৌন্দর্যের অপরূপ স্বপ্নপুরী, ধনঝরি পাহাড়ের পূর্ণিমার জোৎস্না প্লাবনের মধ্যে কোনো এক প্রাচীন রাজকুমারীর ঝুলন নৃত্যের অপ্রত্যাশিত রোমান্স। ঠিক উপনিষদ্ যেমন সূর্যের ব্যাখ্যা দিয়েছেন। প্রকৃতির অন্তরাত্মার একটি আধ্যাত্মিক মূল্য আছে। সে মূল্যের কথা যুগ যুগান্তর ধরে আমাদের বেদ ,উপনিষদ্, রামায়ণ , মহাভারত বলে এসেছে বারংবার। প্রকৃতির ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্য ঈশ্বর সান্নিধ্যেরই রূপান্তর।

যে সকল মানুষ প্রকৃতির অন্তরঙ্গ সাহচর্যে বাস করে, প্রকৃতির কোলে আজন্ম লালিত – পালিত হয় , তারা মানসিক ও নৈতিক বিচারে নাগরিকজনের থেকে অনেক উচ্চতরের হয়ে থাকেন।

“আরণ্যক” প্রকৃতি শুধু শান্ত সৌন্দর্যের ও কোমল মাধুর্যের ভাণ্ডার নয়। ঐ যেমন উপনিষদ্ বলছেন সূর্যের কেবলই হিঙ্কার , উদ্গীথ বা প্রতিহার রূপ থাকেন না।

অথ যদূর্ধ্বমপরাহ্নাৎ প্রাগস্তময়াৎ স উপদ্রবস্তদস্যারণ‍্যা অন্বায়ত্তাস্তস্মাত্তে পুরুষং দৃষ্টা কক্ষংশ্বভ্ৰমিত‍্যুপদ্রবন্তি উপদ্রবভাজিনো হ্যেতস্য সাম্নঃ।।

অপরাহ্ন অতিক্রম করলে, সূর্যদেব অস্তাচলের পথে , তখন বন্যপশুরা তাদের জীবনধারণের উপযুক্ত খাদ্য খুঁজে পায়। অপরাহ্ন অস্তাচলের পথে যাওয়া সূর্যের রূপই উপদ্রব। আরণ্যক প্রাণী সূর্যের এই অংশের অনুগত। তারা এই সময় বিপদের গন্ধ পায়। আপন প্রাণ ও আপনার জনকে রক্ষার নিমিত্ত তারা দ্রুতবেগে আপন আপনা নিরাপদ আশ্রয়ে প্রবেশ করে। এই সময়ে তারা সামের ” উপদ্রব” অংশের অধিকারী। তাই তারা অস্তাচল সূর্যের ভজনা করে।

বিভূতিভূষণের “আরণ্যক” সেই কথাই বলে। অরণ্যের ভয়াল ও নিষ্ঠুর দিক আছে। অরণ্যে হিংস্র প্রাণীর অভাব নেই। কেবলমাত্র বাঘ , ভাল্লুকই হিংস্র হয় না। আরণ্যক প্রকৃতির ক্ষুদ্রাতি ক্ষুদ্র প্রাণী, জীবাণু, এমন কি নিরীহ দেখতে ছত্রাকটি পর্যন্ত বিষাক্ত , হিংস্র হয়। হিংস্র মানেই কেবল রক্ত মাংস ছিঁড়ে খাওয়া বা সাপের বিষাক্ত ছোবলকে বোঝায় না। প্রচণ্ড উত্তাপ, গ্রীষ্মের দাবদাহে অরণ্যে আসে দাবানল বিভীষিকা। সেই লেলিহান শিখার ভীষণ খুদা সকলকে গ্রাস করে। গ্রীষ্মে প্রচণ্ডতায় অরণ্য মাঝে পথ হারালে বাঁচার কি উপায় আছে?

ওই যে উপনিষদ্ বলেছেন –

অথ যৎ প্রথমাস্তমিতে তন্নিধনং তদস্য পিতরোহন্বায়ত্তাস্তস্মাত্তান্নিদধতি নিধনভাজিনো হ্যেতস্য সাম্ন এবং খল্বমুমাদিত্যং সপ্তবিধং সামোপাস্তে।।

সূর্যাস্তের সময় যে রূপ , তাই নিধন। এই রূপ পিতৃপুরুষ , লৌকিক, অলৌকিক, পরলৌকিক, অতিলৌকিক প্রমুখ সকলের প্রিয়। সূর্যাস্তই পূর্বপুরুষের প্রতি পিণ্ডদানের সঠিক সময়। এই সময় তাঁদের উদ্দেশ্যে দান করা পিণ্ড কুশের উপর রাখা হয়। তাই পিতৃপুরুষগন “নিধন” অংশের ভাগী। এই সময় সামের নিধন অংশ আবৃত হয়। সূর্য সামের যেমন প্রস্তাব থেকে নিধন মোট সপ্ত ভাগ বা রূপ থেকে তেমন এই আরণ্যক আদি প্রকৃতি মাতারও সপ্ত অবস্থা বা রূপ আছে।

আরণ্যক প্রকৃতির রহস্যময়। লৌকিক, অতিলৌকিক, অলৌকিক, প্রেতলোক এখানে দিবারাত্র বিরাজ করে আপনমহিমায় । কারণ, অরণ্য তো তাদেরই। তাদের অনুমতি ব্যতীত এ অরণ্য ধ্বংস হলে তারা কি অভিশাপ দেবে না ? সব অভিশাপ তো একবারে ফলে না। কোনো অভিশাপ ফলে যুগযুগান্ত ধরে। বুনো মহিষের দেবতা, অরণ্যের প্রাচীন প্রবাদ টাঁড়বারো ,অরণ্য পথের দিগন্তে কি গহীনে এসে দু হাত তুলে আবির্ভুত হয়।

“আরণ্যকের” রঙ্গমঞ্চ নেহাৎ সংকীর্ণ বা সীমাবদ্ধ ভূখণ্ড নয়। আরণ্যকের বিস্তার আট দশ হাজার বিঘা জুড়ে। যেমন সুবিস্তীর্ণ তার আয়তন তেমনি অসাধারণ বৈচিত্র্যমন্ডিত তার প্রাকৃতিক দৃশ্য। কোথাও উন্মুক্ত প্রান্তর তৃণভূমি, কোথাও গজার জঙ্গল, কোথাও কাশবন, কোথাও ঝাউবন, কোথাও ছড়ানো ঝোপে আসে বসন্তের নাম না জানা মন কেমন করা ফুল, কোথাও কেঁয়োঝাঁকার জঙ্গল। একদিকে সরস্বতী কুণ্ডীর তীরভূমির স্বপ্ন – সৌন্দর্যের মায়াকানন ,অন্যত্র নানা বন্যজন্তু – অধ্যুষিত বৃক্ষছায়াছন্ন লতাজঙ্গল জটিল গহীন অরণ্য, আছে হ্রদ, টিলা, পাহাড়, চারণভূমি, মকাই ক্ষেত, খেরী বা চীনাঘাসের ক্ষেত, দিগন্ত জোড়া গালিচার মতো আগুন রঙা সর্ষের খেত। এ ছাড়া আরও আছে আরও আছে ঋতুরঙ্গশালার একের পর এক পট পরিবর্তন। পৃথিবীর বার্ষিক গতির সঙ্গে তাল বজায় রেখে পাতা, লতা, পুষ্প , পল্লবের রঙ বদলের সমারোহ সূচিত হয়। অপরূপ রূপ বৈচিত্র্যের যেন অন্ত নেই; দেখে দেখে হৃদয়ের আকাঙ্খা আশ , নয়নের তৃষ্ণা ঘোচে না।

আরণ্যকে কোনো ভাষার ইন্দ্রজাল নেই। প্রয়োজন পড়েনি। ভাষা যেমন সাহিত্যের চরম উদ্দিষ্ট , তেমন ভাষা প্রয়োগ করে ঘটনার চিত্র পাঠকের মানসচক্ষে প্রস্ফুটিত করাও উদ্দিষ্ট। বর্ণনীয় বিষয় বস্তুর টানে যখন যে ভাষা স্বতঃস্ফূর্তভাবে তাঁর কলম হতে মা সরস্বতী নিঃসৃত করেছেন তাই তিনি দ্বিধাহীনভাবে ব্যবহার করেছেন। আরণ্যকের ভাষা প্রকৃতির ভাষা। এখানে প্রকৃতি বহুবিচিত্র রূপীনি, তার সৌন্দর্যও ভিন্ন ভিন্ন স্থান ও ঋতু বিশেষে, তাই ভাষার সৌন্দর্য , মাধুর্য , রস ভিন্ন ভিন্ন।

ওই যে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছিলেন –
” ঐ গাছগুলো বিশ্ববাউলের একতারা, ওদের মজ্জায় মজ্জায় সরল সুরের কাঁপন, ওদের ডালে ডালে পাতায় পাতায় একতালা ছন্দের নাচন। যদি নিস্তব্ধ হয়ে প্রাণ দিয়ে শুনি তা হলে অন্তরের মধ্যে মুক্তির বাণী এসে লাগে। মুক্তি সেই বিরাট প্রাণসমুদ্রের কূলে, যে-সমুদ্রের উপরের তলায় সুন্দরের লীলা রঙে রঙে তরঙ্গিত, আর গভীরতলে “শান্তম্‌ শিবম্‌ অদ্বৈতম্‌’। সেই সুন্দরের লীলায় লালসা নেই, আবেশ নেই, জড়তা নেই, কেবল পরমা শক্তির নিঃশেষ আনন্দের আন্দোলন। “এতস্যৈবানন্দস্য মাত্রাণি’ দেখি ফুলে ফলে পল্লবে; তাতেই মুক্তির স্বাদ পাই, বিশ্বব্যাপী প্রাণের সঙ্গে প্রাণের নির্মল অবাধ মিলনের বাণী শুনি।”

এই বিরাট ব্যাপ্তি ও রসবৈচিত্র্য তার সন্ধান খুব কম সাহিত্যই দিতে পেরেছে।

উপনিষদ্ বলছেন –
অন্তরিক্ষোদরঃ কোশো ভূমিবুধ্নো ন জীর্যতি।
দিশো হ্যস্য স্রক্তয়ো দ্যৌরস‍্যোত্তরং বিলম।।
স এষ কোশো বসুধানস্তস্মিন্বিশ্বমিদং শ্রিতম্।।

সমগ্র জগৎ রত্নপেটিকা। অন্তরিক্ষ যার উদর , ভূমি যার নিম্নভাগ, তা কখনো জীর্ণ হয় না। দিকসমূহ এর বিভিন্ন পার্শ্ব। দ্যুলোক হল ঊর্ধ্ব মুখ। এই ভুবনকোশ রত্নভাণ্ডারের মধ্যে রয়েছে সকল জগৎ, রয়েছে অপরূপা আরণ্যক প্রকৃতি। এই ব্রহ্ম সৃষ্ট কোশে সকল কিছু ব্রহ্মময়ী নিরাপদ রাখেন। হ্যাঁ , তাদের রূপ বদলায়, কিন্তু বিনাশ প্রাপ্ত হয় না। সময়ের অপেক্ষায় থাকে কেবল কু কে দমনের নিমিত্ত।

Delonix regia or Krishnachura outdoor in Bangladesh

বিভূতিভূষণ সরল নিরলঙ্কার ভাষায় বলেছেন –

” নাঢ়া বইহারের বন – প্রান্তরের পথে এত রাত্রে আসিতে ভয় – ভয় করে।বাঁয়ে ছোট একটি পাহাড়ী ঝর্ণার জলস্রোত কুলকুল করিয়া বহিতেছে, কোথায় কি বনের ফুল ফুটিয়াছে, গন্ধে ভরা অন্ধকার এক – এক জায়গায় এত নিবিড় যে ঘোড়ার ঘাড়ের লোম দেখা যায় না, আবার কোথাও নক্ষত্রালোকে পাতলা।”

সেই রত্নভান্ডারে কখনো প্রেম অবলীলায় স্বপ্নাবেশে অবস্থান করে। সেই স্বপ্নের ভাষায় বিভূতিভূষণ বলেছেন – ” আর কি সে জোৎস্না! কৃষ্ণপক্ষের স্তিমিতালোক চন্দ্রের জোৎস্না বনে – পাহাড়ে যেন এক শান্ত, স্নিগ্ধ অথচ এক আশ্চর্য রূপে অপরিচিত স্বপ্নজগতের রচনা করিয়াছে – সেই খাটো খাটো কাশজঙ্গল, সেই পাহাড়ের সানুদেশে পীতবর্ণ গোলগোলি ফুল, সেই উঁচু- নিচু পথ ― সব মিলিয়া যেন কোন্ অদৃশ্য লোকে অশরীরী হইয়া উড়িয়া চলিয়াছে।….

যেমন উপনিষদ্ বলেছেন –

তস্য প্রাচী দিগজুহূর্নাম সহমানা নাম দক্ষিণা রাজ্ঞী নাম প্রতীচী সুভৃতা নামোদীচী তাসাং বায়ুর্বৎসঃ স য এতমেবং বায়ুং দিশা বৎসং বেদ ন পুত্র রোদং রোদিতি সোহহমেতমেবং বায়ুং দিশাং বৎসং বেদ মা পুত্ররোদং রুদম্।।

এই সমগ্র যে ভুবনকোশ , তার পূর্বদিক হল “জুহু” । কারণ পূর্বমুখী হয়েই যজ্ঞ আহুতি প্রদান করা হয়। ইহাই জুহ্বোতি। দক্ষিণ হল ” সহমানা”, কারণ দক্ষিণদিকে হল যমপুরী। এখানেই পাপীরা পাপের ফল স্বরূপ দুঃখ সহ্য করে। তাই ইহাই সহন্তে। পশ্চিমদিক “রাজ্ঞী” , কারণ সূর্যাস্তে পশ্চিমাকাশ রক্তবর্ণ ধারণ করে। ইহাই হল রাগ। উত্তরে ” সুভূতা” , কারণ উত্তরে আদি অনন্ত দেবাদিদেব অবস্থান করেন। তিনিই বিভূতিমান , তিনিই ঐশ্বর্যশালী। এই সকল দিক হতে বায়ুর উৎপত্তি। তাই বায়ু হলেন দিক সমূহের সন্তান। এই পৃথিবীতে যে ব্যক্তি বায়ুকে অমর ও দিক সমূহের পুত্র বলে বিশ্বাস করেন তাঁর কখনো সন্তান বিয়োগ হয় না।

“আমি বায়ুকে সন্তানরূপে জ্ঞান করি , তাই আমাকে যেন কোনোদিন সন্তান শোকে কাঁদতে না হয়।”

দিক সমূহে শক্তি প্রকৃতি নানাভাবে অবস্থান করেন। কোশরূপে ত্রিলোক আত্মা ব্রহ্ম অবস্থান করেন। তাঁদের সন্তান রূপে বায়ু সর্বব্যাপী হয়ে অবস্থান করেন। সেই সুবিশাল জ্ঞাত ও অজ্ঞাত প্রকৃতি এবং ব্রহ্মই আমাদের নিত্যদিনের সঙ্গী।

তাই বিভূতিভূষণ নস্টালজিক হয়ে সেই মায়া প্রকৃতির উপাসনা করে বলেছেন –

“হাজার , হাজার বৎসর পূর্বে এমনি কত বন, কত শৈল্যামালা, এমনিতর কত জ্যোত্স্নারাত্রে ভানুমতীর মত কত বালিকার নৃত্যচঞ্চল চরণের ছন্দে আকুল হইয়া উঠিয়াছিল তাহাদের মুখের সে হাসি আজও মরে নাই― এই সব গুপ্ত অরণ্য ও শৈলমালার আড়ালে প্রচ্ছন্ন থাকিয়া তারা তাহাদের বর্তমান বংশধরগণের রক্তে আজও আনন্দ ও উৎসাহের বাণী পাঠাইয়া দিতেছে। “

উপনিষদ্ বলেছেন –

” অথ যদবোচং ভূঃ প্রপদ্য ইতি পৃথিবীং প্রপদ্যেহন্তরিং প্রপদ্যে দিবং প্রপদ্য ইত্যেব তদবোচম্।।

অর্থাৎ , “আমি ভূঃ- এর শরণ নিচ্ছি”….আমি এই সমগ্র পৃথিবী, ওই অন্তত অন্তরীক্ষ এবং স্বর্গের শরণাগত হচ্ছি। ত্রিলোকের ভব এবং ভবানী সংসারের মঙ্গল করুন।

তাই আরণ্যকে বিভূতিভূষণ বর্ণসমারোহের ভাষায় বলেছেন-

” কি অপরূপ সবুজের সমুদ্র চারিদিকে….যতদূর দৃষ্টি চলে ..… মোহনপুরা অরণ্যের নীল সীমারেখা পর্যন্ত বিস্তৃত থৈ থৈ করিতেছে…..বর্ষাসজল হাওয়ায় মেঘকজ্জল আকাশের নীচে এই দীর্ঘ মরকতশ্যাম তৃণভূমির মাথায় ঢেউ খেলিয়া যাইতেছে। ….একদিকের আকাশে এক অদ্ভুত ধরনের নীল রং ফুটিয়াছে। তার মধ্যে একখণ্ড লঘু অস্তদিগন্তের রঙে রঞ্জিত হইয়া বহির্বিশ্বের দিগন্তে কোন্ অজানা পর্বত শিখরের মতো দেখা যাইতেছে।”

উপনিষদ্ বলেছেন –

অথ যদেতদাদিত্যস্য শুক্লং ভাঃ সৈবর্গথ যন্নীলং পরঃ কৃষ্ণং তৎ সাম তদেতদেতস্যামৃচ্যধ‍্যূঢ়ং সাম তস্মাদৃচ্যধ‍্যূঢ়ং সাম গীয়তে।।

সূর্যের যে শুভ্র দীপ্তি তাই হল ঋক্। আর যা নীল , গভীর কৃষ্ণবর্ণ আভা তাই সাম। সূর্যের কৃষ্ণ সূর্যের শুভ্রে প্রতিষ্ঠিত। অর্থাৎ, ঋকে অধিষ্ঠিত সাম গান। সূর্যের শুভ্রতায় কৃষ্ণকে অনেকেই দেখতে পান না। সূর্য সৃষ্টির পূর্বে যে অসীম কৃষ্ণ, সেই কৃষ্ণকে সকলে দেখতে পান না। যোগী, শাস্ত্রজ্ঞ , শুদ্ধমনের ব্যক্তিই সেই কৃষ্ণ প্রাপ্তি করেন। যেমন প্রাপ্তি করেছিলেন বিভূতিভূষণ।

সেই মিস্টিক অনুভূতির ভাষায় তিনি বলেছেন – ” এই নিস্তব্ধ নির্জন রাত্রে দেবতারা নক্ষত্ররাজির মধ্যে সৃষ্টির কল্পনায় বিভোর, যে কল্পনায় দূর ভবিষ্যতের নব নব বিশ্বের আবির্ভাব, নব নব সৌন্দর্যের জন্ম, নব নব প্রাণের বিকাশ বীজরূপে নিহিত। শুধু যে আত্মা নিরলস অবকাশ যাপন করে জ্ঞানের আকুল পিপাসায়, যার প্রাণ বিশ্বের বিরাটত্ব ও ক্ষুদ্রত্ব সম্বন্ধে সচেতন আনন্দে উল্লসিত ― জন্ম-জন্মান্তরের পথ বাহিয়া বর্তমানে মিলিয়া গিয়াছে, সেই তাদের সে রহস্য রূপ দেখিতে পায়।”

উপনিষদ্ বলেছেন – তস্য যথা কপ্যাসং পুন্ডরীকমেবমক্ষিণী তস্যোদিতি নাম স এষ সর্বেভ্যঃ পাপ্মভ্য উদিত উদেতি হ বৈ সর্বেভ্যঃ পাপ্মভ্যো য এবং বেদ।।

অগ্নি যদি ব্রহ্ম হন তবে পৃথিবী শক্তি। তেমনই বায়ু ও অন্তরীক্ষ , চন্দ্র ও নক্ষত্র এবং সূর্য শুভ্র ও কৃষ্ণে প্রতিষ্ঠিত। অর্থাৎ , আদিত্যমন্ডলের অধিষ্ঠিত পুরুষ এবং শক্তিকে যে যেমন জানবেন তাঁরা তেমনি। তাঁরা হলেন #উৎ ,অর্থাৎ সব কিছুর ঊর্ধ্বে। তাঁরাই সর্বশ্রেষ্ঠ। বেদান্ত সেই কথাই বার বার বলেছেন। উৎ ও ব্রহ্ম এবং ব্রহ্মময়ী এক ও অভেদ। তাঁরা নানা রূপে, নানা ভাবে এই জগৎ সংসারে ব্যাপ্ত হয়ে আছেন। তাঁরা জিতেন্দ্রিয়। তাঁরা নিরাকার হয়েও সর্বতভাবে সাকার।

বিভূতিভূষণ তাই আরণ্যকে ধ্রুপদীর ছাঁচে বলছেন -” জায়গাটা সত্যিই একবারে অদ্ভুত; অমন রুক্ষ অথচ সুন্দর, পুষ্পাকীর্ণ অথচ উদ্দাম ও অতিমাত্রায় বন্য ভুমিশ্রী দেখি নাই কখনও জীবনে। আর তার উপর ঠিক – দুপুরের খাঁ খাঁ রৌদ্র। মাথার উপরের আকাশ কি ঘন নীল! আকাশে কোথাও একটা পাখী নাই, শূন্য মাটিতে বন্য প্রকৃতির বুকে কোথাও একটা মানুষ বা জীবজন্তু নাই ― নিঃশব্দ ভয়ানক নিরালা।”

উপনিষদ্ বলেছেন – অথ হৈনমাহবনীয়োহনুশশাস প্রাণ আকাশো দ‍্যৌর্বিদ্যুদিতি য এষ বিদ্যুতি পুরুষো দৃশ্যতে সোহহমস্মি স এবাহমস্মিতী।।

প্রাণ, আকাশ, দ্যুলোক, বিদ্যুৎ – এঁরা সকলেই সকলেই আমার অর্থাৎ ব্রহ্মের শরীর। বিদ্যুৎতে যিনি অবস্থান করে তিনিই আমি।

তাই বিভূতিভূষণ আরণ্যকে লিখছেন -” এই বর্বর রুক্ষ বন্য প্রকৃতি আমাকে তার স্বাধীনতা ও মুক্তি মন্ত্রে দীক্ষিত করিয়াছে, শহরের খাঁচার মধ্যে আর দাঁড় বসিয়া থাকিতে পারিব কি? এই পথহীন প্রান্তরের শিলাখন্ড ও শালপলাশের বনের মধ্য দিয়া এইরকম মুক্ত আকাশতলে পরিপূর্ণ জ্যোৎস্নায় হু -হু ঘোড়া ছুটাইয়া চলার আনন্দের সহিত আমি দুনিয়ার কোন সম্পদ বিনিময় করিতে চাই না।”

বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের শাস্ত্র, ইতিহাস ,লৌকিক, অলৌকিক, ভূগোল এবং বিজ্ঞান সম্পর্কে অসামান্য পান্ডিত্য ছিল। তাঁর প্রতি রচনায় সেসবের প্রতি ফলন পরিলক্ষিত হয়। শাস্ত্র বিশেষ করে তন্ত্র শাস্ত্র এবং প্রাচীন ইতিহাস সম্পর্কে তাঁর কৌতুহল ও অনুসন্ধিৎসার দীর্ঘায়িত পরিচয় পাওয়া যাবে আরণ্যকে। নানা স্থানে আছে ভূগোল, ভূবিদ্যা – সংক্রান্ত জ্ঞান। আর কি আছে? আর আছে জ্যোতির্বিজ্ঞান ও ব্যোমবিজ্ঞান।

তিনি মা সরস্বতীর বরপুত্র ছিলেন। তাঁর সকল জ্ঞান মিলেমিশে গিয়ে উপন্যাসের রসপুষ্টি সাধন করেছিল। বৃক্ষ, অরণ্য, লতাগুল্ম, ফুল, পাতা প্রভৃতি সকল উদ্ভিজ্জ সম্পর্কে তাঁর অপরিসীম জ্ঞানস্পৃহা, কৌতূহল ছিল যে অনেকে তাঁকে ” বটানিবাতিকগ্রস্ত” বলে ঈষৎ বিদ্রুপ করেছেন। কিন্তু অরণ্য ও মানুষ একত্রে যিনি উপন্যাস লেখেন ,তাঁর লেখায় মহামায়ার সংসারের প্রকৃতি , বৃক্ষরাজি, আদিম অরণ্য ও আরণ্যক ব্যষ্টিমানবের মতই নিজ নিজ বৈশিষ্ট্য মন্ডিত হয়ে অবস্থান করবে এইটাই স্বাভাবিক। বিভূতিভূষণ যে সর্বেশ্বরবাদে বিশ্বাস করতেন, সেই বিশ্বাসই তাঁকে পৃথক পৃথকভাবে বহুরূপে, সর্বজীবে, নানাভাবে একটি করে চৈতন্যসত্তা ও আধ্যাত্মসত্তা বলে ভাবতে শিখিয়েছিল।

পূর্বেই বলেছি আরণ্যকে কেবলমাত্র প্রকৃতিদেবী মহানায়িকা হয়ে রাজত্ব করেছেন। তিনি বড় ট্র্যাজিক নায়িকা। তাঁর বুক থেকে আদিম অরণ্যকে বাবু খেলাতচন্দ্র ঘোষের কর্মচারী সত্যচরণ উপড়ে ফেলেছিল একটু একটু করে। সুবিশাল অরণ্যভূমির বনশোভা সত্যচরণ ধ্বংস করেছে একে একে। তবে কি সত্যচরণ অর্থাৎ বিভূতিভূষণ পাপী? অধ্যাপক রবীন্দ্রনাথ দাশগুপ্ত বলেছেন – ” আরণ্যক গ্রন্থখানির মূল বস্তু এক অনুতপ্ত হৃদয়ের বস্তু এমন কথা কেহ বলিবেন না।লেখক গ্রন্থশেষে অরণ্যানীর আদিম দেবতাদের ক্ষমা প্রার্থনা করিয়াছেন, কিন্তু তাঁহার কাহিনী এক অনিচ্ছাকৃত পাপকর্মের কাহিনী হিসাবে পরিকল্পিত হয় নাই।”

আরণ্যক এক দ্বিতল কাহিনী। সৌন্দর্য – উপভোগের কাহিনী , অনুধ্যানের কাহিনী, স্মৃতির কাহিনী….আবার অরণ্য ধ্বংস হয়ে যাওয়ার পর অদূরভবিষ্যতে তার পুনরাবির্ভাবের আশার অতীন্দ্রিয় অস্তিত্বের কাহিনী।

Beauty that vanishes; beauty that passes away ; However rare – rare it be…

সমাপ্ত

তথ্যঃ ১. ছান্দোগ্য উপনিষদ্ ( দ্বিতীয় অধ্যায় , অষ্টম খণ্ড)

২. আরণ্যক উপন্যাস

©দুর্গেশনন্দিনী

( প্রবন্ধটি ধারাবাহিকভাবে ঋতম্ বাংলায় প্রকাশিত হল)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.