পাকিস্তানের অভ্যন্তরে গিয়ে বায়ুসেনার আঘাত চিরাচরিত বিদেশনীতির কৌশলগত পরিবর্তন

খ্রিস্টপূর্ব ৪৯ শতাব্দীতে পরবর্তীকালের রোম সম্রাট জুলিয়াস সিজার তৎকালীন রোমান কেষ্টবিষ্টুদের বাধা অগ্রাহ্য করে এমন একটি অঞ্চলে ঢুকেছিলেন যে অঞ্চল প্রায় নিষিদ্ধই ছিল বলা যায়। সামরিকভাবে একটি রেখা টানা ছিল যে এরপর আর এগোলে বিপদ অবশ্যম্ভাবী। সিজার বলেছিলেন আমার এই সীমান্তরেখা পেরোনো নির্ধারিত হয়েই আছে। এই বিপদসঙ্কুল হিংস্ৰ জনজাতি-অধ্যুষিত অধুনা বেলজিয়ামের এলাকার প্রান্তসীমাকে বলা হতো “রুবিকন’। সব বাধা নিষেধ এড়িয়ে এখানে প্রবেশ করাই ছিল সেই অর্থে প্রতিষ্ঠিত রীতি ও নিয়মের উলঙ্ঘন। একবার এই সীমা পার করার অর্থই আর পুরনো প্রথায় ফেরা যাবে না। এটি হবে যুগান্তকারী পরিবর্তন। পুলওয়ামা হামলার প্রত্যাঘাতে ভারতীয় বায়ুসেনা এই লক্ষণরেখা পার করে যুগান্তকারী অবস্থান নিয়েছে।

পাকিস্তানের অভ্যন্তরে ঢুকে জঙ্গি ঘাঁটি ধ্বংস করার প্রসঙ্গে ভারতীয় বিদেশ সচিব বিজয় গোখলে বলেছেন ভারতীয় বায়ুসেনার মিরাজ ২০০০ বিমানের এই বোমাবর্ষণ কিন্তু পূর্ণমাত্রার পরদেশ আক্রমণ আদৌ নয়। এই যে সেনাবাহিনীর চিরাচরিত অবস্থান থেকে সরে এসে পুরোদস্তুর যুদ্ধ প্রক্রিয়া থেকে গা বাঁচিয়ে নিজের কার্যসিদ্ধি করা এটিই সেই রুবিকন অর্থাৎ লক্ষণরেখা পার ও এক অর্থে জলে নেমেও চুল না ভেজানো।

প্রথমত এই অত্যন্ত সুচিন্তিত ‘non military premetive action’ অর্থাৎ শত্রুদেশের সৈন্য বা সামরিক ঘাঁটিতে আঘাত না করে বা অসামরিক জনগণকে অক্ষত রেখে কেবলমাত্র নির্দিষ্ট সন্ত্রাসবাদীর ডেরাকে নির্মূল করে আসার যে অভূতপূর্ব সাফল্য ভারত দেখাল তা সামরিক নীতির ক্ষেত্রে নতুন এক সংজ্ঞা সৃষ্টি করল। ইজরায়েলের সামরিক বাহিনী যে নিবারণমূলক আক্রমণ চালাতে অভ্যস্ত এই কৌশল অনেকটা সেই ঘরানার। ১৯৮১ সালে তৎকালীন ইজরায়েলি প্রধানমন্ত্রী মেনাচিম বিগিন সম্ভাব্য আক্রমণের সম্ভাবনাকে আগাম থমকে দিতে ইরাকের বিরুদ্ধে বাগদাদ অঞ্চলে ভারী বোমাবর্ষণ করেছিলেন। তখন এই আক্রমণকে অনেকটাই আদালতের আগাম জামিন নেওয়ার মতো ‘anticipatory self defence at its best’ হিসেবে সকলে মেনে নেয়। অবশ্য এই ‘বিগিন তত্ত্ব’ মূলত প্রতিদ্বন্দ্বী দেশের পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার নিরস্ত করতে ব্যবহার হয়েছিল। কিন্তু কী সম্ভাবনামূলক, কী প্রত্যাঘাতমূলক দুধরনের বিমান হানাতেই ইজরায়েল দীর্ঘদিন ধরে প্রবল পারদর্শী। এক্ষেত্রে সামরিক লক্ষ্যবস্তুকে আঘাত বা প্রতিবেশী সন্ত্রাসবাদীদের নিকেশের ক্ষেত্রে কৌশলগতভাবেই আক্রমণ করা হয়।

পুলওয়ামার প্রেক্ষিতে ভারত ঘোষণা করেছে তাদের কাছে পর্যাপ্ত গোয়েন্দা তথ্য রয়েছে যে দেশে আত্মঘাতী হামলার পুনরাবৃত্তি হতে চলেছে, যা দেশের পক্ষে সমূহ বিপজ্জনক। সেই পরিস্থিতিতে আত্মরক্ষার খাতিরে ভারতকে নির্দিষ্ট জঙ্গি আশ্রয়স্থলগুলিতে আক্রমণ চালাতে হয়েছে। এই আক্রমণকে তাই প্রতিশোধমূলক যুদ্ধের তকমা দেওয়া যাবে না। এইখানেই ১৯৮০ সাল থেকে পাকিস্তানের সঙ্গে চালু থাকা যুদ্ধনীতির নিয়ম পাল্টে দিয়েছে ভারত।

এই নতুন কূট সামরিক কৌশলের তত্ত্বই হচ্ছে যে ভারতের অভ্যন্তরে সন্ত্রাসবাদী হামলার প্রত্যুত্তরে তা নিবারণের জন্য নির্দিষ্ট দেশে সেই সন্ত্রাসদের ওপর প্রত্যাঘাতমূলক হামলা চালালে তাকে কখনই সামরিক আক্রমণের সঙ্গে এক পঙক্তিতে বসানো যাবে না। ভারতের পাকিস্তানের জঙ্গি ঘাঁটিতে এই ধ্বংসাত্মক আক্রমণ কিন্তু অতীত যুদ্ধ ঘোষণার নিয়মকে বরাবরের জন্য বদলে দিয়েছে।

দ্বিতীয়ত, কৌশল ও সিদ্ধান্তের এই ভূমিকম্পের অনুভব সৃষ্টি করা কাজকে কখনই খাটো করে দেখার কারণ নেই। ১৯৯৯ সালে কার্গিল যুদ্ধে ৫২৭ জন ভারতীয় সেনা শহিদ হলেও ভারতীয় বিমানবাহিনী সদাসতর্ক ছিল যাতে পাকিস্তানের সঙ্গে এলওসি না লঙ্ঘিত হয়। দুটি লড়াকু জেট ও একটি আক্রমণকারী হেলিকপ্টার শত্রু আক্রমণে হারাতে হলেও সেনা এলওসি অতিক্রম করেনি। বাজপেয়ী সরকারের কড়া সতর্কবাণীর প্রেক্ষিতে হয়তো বলা যায় বায়ুসেনা কিছুটা আচমকা স্থগিতাদেশের অপেক্ষায় (এলওসি-র ক্ষেত্রে) ত্রস্ত হয়ে লড়াই করত। এইবারের বায়ুসেনার পাকিস্তানের সঙ্গে আন্তর্জাতিক সীমান্ত পার করে গভীরে ঢুকে ‘খাইবার পাখতুনকা’ অঞ্চলের বালাকোট জঙ্গি ছাউনি ধ্বংস করা অভূতপূর্ব। এই বালাকোট আবার কুখ্যাত আবোটাবাদ, যেখানে পাকিস্তানের মিলিটারি অ্যাকাডেমি অবস্থিত, তার থেকে মাত্র ১০০ কিলোমিটার দূরে। এখানেই পাকিস্তানের নজরদারিতে নিরাপদ ডেরা গেড়েছিল বিশ্বাস ওসামা বিন লাদেন। এই ঘৃণ্য স্থানেই মার্কিন নৌসেনার বিশেষ পরাক্রমী কম্যান্ডোরা তাকে হত্যা করেছিল। ভারতীয় সেনাবাহিনী সেই ১৯৭১-এর পর এই প্রথম পাকিস্তানের এত ভেতরে সক্ষম হামলা চালাল।

তৃতীয়ত, এই আক্রমণ ২০১৬ সালের বিখ্যাত ‘সার্জিকাল স্ট্রাইক’-এর থেকে সম্পূর্ণ ভিন্নধারার। প্রবীণ সমর বিশারদরা ভালোই জানেন যে সেনার বিশেষ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত বাহিনী পুর্ববর্তী সরকারের আমলেও স্থানীয়ভাবে আক্রমণের প্রত্যাঘাত করতে ভূমিকা নিয়েছিল। কিন্তু উরি পরবর্তী শত্রুঘাঁটিতে গিয়ে আঘাতের ভয়ংকরতা ও ব্যাপ্তি এবং সরকারের নাগরিকদের মধ্যে এর প্রচার আগেকার সমস্ত লড়াইকে একেবারেই ম্লান করে দেয়। ধীরে ধীরে জনমনেও এই নিয়ে প্রতিজ্ঞাবদ্ধতা গড়ে উঠছিল। এই ভিত্তিভূমির ওপর দাঁড়িয়েই সরকার এতদূর এগোতে পারল একথা বলা যায়।

চতুর্থত, তত্ত্বগতভাবে পাকিস্তানের সেনাবাহিনীকে একটা জটিল হিসেব নিকেশ করে বোঝানো হতো এবং তারা নিয়ন্ত্রিত হতো একটি নির্দিষ্ট ভাবধারায়। ভারতের অভ্যন্তরে জঙ্গি অনুপ্রবেশ ঘটিয়ে ভারতের সেনাবাহিনীকে সদা উত্যক্ত করে দেশের মধ্যে অরাজকতা সৃষ্টি করাই ছিল এই প্রক্সি বা ছায়াযুদ্ধের বহু পরিচিত চরিত্র। কিছুতেই সরাসরি যুদ্ধের ঝুঁকি তারা নিত না। এই তত্ত্বকেই হিংস্রভাবে বুঝিয়েছিলেন জুলফিকার আলি ভুট্টো bleeding India by thousands cuts. শরীরে বহুবিধ ক্ষতস্থান থেকে রক্তপাত ঘটিয়ে ভারতের মৃত্যু ঘটান হবে। এটা আরও কার্যকর মনে করা হয়েছিল ছিল ১৯৯৮ সালে পারমাণবিক অস্ত্র পাকিস্তানের হাতে আসার পর। পাকিস্তান মনে করত সন্ত্রাসী হামলা, আত্মঘাতী হামলার মাত্রা বাড়ালেও ভারত যুদ্ধের ঝুঁকি নেবে না। কারণ সেই পারমাণবিক অস্ত্রের জুজু। যদিও ভারতের হাতে তা আগেই মজুত ছিল। পাকিস্তান এটাকে খেলার চেহারা দিয়েছিল।

সেই ২৬/১১-এর মুম্বইয়ের নৃশংস হত্যালীলা থেকে সদ্য ঘটা পুলওয়ামার আত্মঘাতী আক্রমণ পর্যন্ত নিরন্তর জঙ্গি হামলার প্রত্যুত্তরে পাকিস্তানের ওপর কোনো দমনমূলক ব্যবস্থা না নেওয়ায় এক ধরনের অসহায়তার সৃষ্টি হয়েছিল। বায়ুসেনার এই ঝটিতি বোমারু আক্রমণ পুরনো ধীরে ধীরে যুদ্ধ পরিস্থিতির আবহাওয়া তৈরি করে শেষমেশ তাকে এড়িয়ে চলার নীতিকে ফুৎকারে উড়িয়ে দিয়েছে। সামরিক কায়দায় জবাব দিতে যে ভারত গড়িমসি করবে না, বরাবরের জন্য তা জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। সামরিক পরিভাষায় এর retaliation বা জবাবি হামলা পাকিস্তানের দিক থেকে যে কোনো মুহূর্তে প্রত্যাশিত। তার মোকাবিলায় আমরাও অনেকটা ইজরায়েলি মডেলের ধাঁচে রকেট আক্রমণের পর প্রস্তুত থাকার মতো সজাগ রয়েছি।

মাথায় রাখতে হবে, তেলআভিবকে কিন্তু কোনো পারমাণবিক শক্তিধর দেশের সঙ্গে পাল্লা দিতে হয় না বা প্রতিদ্বন্দ্বী দেশটির আয়তনও পাকিস্তানের মতো নয়। ফলে তার সেনাবাহিনীর বহরও পাকিস্তানের তুলনায় অনেক ছোটো। এই সূত্রে একটি ধূসর অতীতের প্রসঙ্গ এসে যায়। সংঘর্ষস্থল বালাকোট হচ্ছে সেই ঐতিহাসিক স্থান যেখানে মহারাজা রণজিৎ সিংহ এই উপমহাদেশের প্রাচীনতম জেহাদি রায়বেরিলির সাইদ আমেদ ও শা ইসমাইলকে তার শিখ বাহিনী নিয়ে ১৮৩১ সালে ধুলোয় লুটিয়ে দিয়েছিলেন।

ইতিহাসবিদ আয়েষা জালালের বিশ্লেষণটিতে বিগত শতাব্দীর ৯০ এর দশক থেকে ঠিক এখানেই জেহাদি তৎপরতার নব উন্মেষ ও কালগ্রাসে সন্ত্রাসবাদের কারখানা হয়ে ওঠার মধ্যে স্থান মাহাত্ম্যের সঙ্গে ঐতিহাসিক যোগসূত্রটিও উড়িয়ে দেওয়া যায় না।

ভবিষ্যতের গর্ভে কী আছে তা অনিশ্চিত হলেও ভারত পাকিস্তানের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের চলমানতায় বালাকোটের আক্রমণ এক নতুন দিকনির্দেশ।

নলিন মেহতা

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.