আজ সেই চলে যাওয়ার দিন । ২ রা মে,২০২১ ।
ছবি যেটা দেখছেন সেটা মানিকতলার রেল ব্রিজের কাছে থাকত যে ছেলেটা তার । নাম অভিজিৎ সরকার । বয়স ২৬ । ছবিতে সঙ্গে যে কুকুর, যে কুকুরের ছোট্ট বাচ্চা তাদেরও পিটিয়ে মেরেছিল তৃণমূল রড দিয়ে, বাঁশ দিয়ে । আর যাঁর হাতে এই পশু শাবক তাকে ? তাকেও পিটিয়ে মেরেছিল পরেশ পালের দলবল । এই ২ রা মে’র দুপুরে । যেদিন বাংলার বিধান সভার ফলাফল বেরিয়েছিল সেই দুপুরে ।
অভিজিতের পারলৌকিক ক্রিয়ায় পৌঁছেছিলাম । ঘটনার বিবরণ শুনে আঁতকে উঠেছিলাম ।
সেই দুপুরে ফলাফল যখন একে একে বেরোচ্ছে, তৃণমূল বিপুল ভোটে অনেক জায়গায় যখন জিতছে পরেশ পালের মস্তান বাহিনী প্রথমেই ছুটে এসেছিল অভিজিতের ছোট্ট কুঁড়ে ঘরটায় ।
অভিজিৎ খুব ছোট বেলা থেকে এলাকায় একমাত্র সক্রিয় বি জে পি কর্মী হিসেবে পরিচিত ছিল । পেশা ছিল একটা ছোট্ট চার চাকা ছোট হাতি চালানো, ভাড়া খাটা আর অবসর সময়ে বি জে পির ফ্ল্যাগ লাগানো, পোস্টার মারা, খবর পেলেই মিছিলে, মিটিংয়ে যাওয়া । ছোট্ট প্রায় কুঁড়ে ঘরে থেকেও এলাকার প্রায় ২৯ টা রাস্তার কুকুরের দেখভাল করত অভিজিৎ । খাওয়া দাওয়া থেকে ওষুধ, সেবা চিকিৎসা সব । পাশের একটা ক্লাব ঘরে কুকুর শাবকদের থাকার জায়গা করেছিল অভিজিৎ । সেটাই ছিল ওর উপাসনার মন্দির । মন ভালো রাখার কেন্দ্র ।
সেই দুপুরে পরেশ পালের দলবল প্রথমে এসেই এই ক্লাবঘরে হানা দেয় । বড় কুকুর গুলো অনেকেই পালাতে পারলেও ছোট্ট সবে জন্ম নেওয়া কুকুর বাচ্চাগুলোকে ওরা একে একে নৃশংস ভাবে পিটিয়ে মারে । তারপর বাড়ি থেকে অভিজিৎকে টেনে বার করে । প্রথমে উদোম মার আর তারপর কেবল লাইনের তার ছিঁড়ে গলায় পেঁচিয়ে দু দিক থেকে টেনে অভিজিৎকে নিস্তেজ করে দেয় ।
অভিজিতের মা তখন পাগলের মত চিৎকার করছেন – ছেড়ে দে, ছেড়ে দে আমার ছেলেটাকে, ও মরে যাবে । ততক্ষনে অবশ্য অভিজিতের মুখ দিয়ে ফিনকি দিয়ে রক্ত পড়ছে । মাথাটা থেঁতলে গেছে । ভিড়ের মধ্যেই আচমকা লুটিয়ে পড়ল দেহটা বৃদ্ধা মায়ের সামনে ।
কাজ শেষ হয়ে গেছে বুঝেছে ততক্ষনে মস্তানের দল । সবুজ আবীর উড়িয়ে উল্লাস করতে করতে দৌড়ালো ঘাতক বাহিনী – মমতা ব্যানার্জি জিন্দাবাদ, অভিষেক ব্যানার্জি জিন্দাবাদ, পরেশ পাল জিন্দাবাদ, বি জে পি র কালো হাত ভেঙে দাও, গুঁড়িয়ে দাও…… ।
অসহায় বৃদ্ধা মা তখন কাঁদতে কাঁদতে ছুটেছেন সামনে দাঁড়ানো নারকেল ডাঙ্গা পুলিশের কাছে । পুলিশ তাতে এল । বিধবা মা কে বলল একটা চাদর আনুন । বৃদ্ধা দৌড়ে চাদর আনলেন । নিথর রক্তে ভেজা অভিজিতের দেহটাকে মুড়ে নিয়ে ভ্যানে তুলল নারকেলডাঙ্গা থানার পুলিশ । বৃদ্ধা তখন পাগলের মত কেঁদে চলেছেন, চোখের সামনে সন্তান হারানোর যন্ত্রণায় মাথা ঠুকে চলেছেন মাটিতে ।
আজ সেই মাথা ঠোকারই বর্ষপূর্তি ।
এই নির্মম খুনের অপরাধীদের কলকাতা পুলিশ সেদিন ধরেনি । অভিজিতের দাদা বিশ্বজিৎ নিজে হাতে অপরাধী ধরেছেন, পুলিশের হাতে দিয়েছেন । তাও যখন অন্য অপরাধীদের ধরতে কলকাতা পুলিশ reluctant সেই সময় কলকাতা হাইকোর্টের নির্দেশে মামলা যায় সি বি আইয়ের হাতে । সি বি আইয়ের কব্জায় আসে অধিকাংশ অপরাধীরা ।আর বাকি অপরাধীদের বাঁচাতে মাননীয়ার নির্দেশে কলকাতা পুলিশ অবশ্য এখনও লড়ে যাচ্ছে প্রাণপন ।
বছর ঘুরে আজ আবার ফিরে এল ২ রা মে ।
প্রত্যক্ষদর্শিদের মুখে শোনা বছর খানেক আগের সেই ভয়াবহ ঘটনাটা পুনরায় আজ নিজের চোখে জল নিয়েই লিখলাম । কষ্ট হচ্ছিল লিখতে, তাও । খোদ কলকাতা শহরে বিরোধী রাজনীতি করার অপরাধে এক ২৬ বছরের যুবকের জীবন দিয়ে প্রায়শ্চিত্ত করার সেই নির্মমতম কাহিনী ।
আজ ২রা মে, ইচ্ছে আছে সেই বৃদ্ধার কাছে একবার গিয়ে অন্তত দাঁড়ানোর । আর ক্ষমা চাওয়া সেই সমাজের হয়ে যে সমাজ তাঁর সন্তানকে শুধু নয়, সন্তানের পোষ্যদেরও জীবন কেড়েছে শুধুমাত্র তার আশ্রয়দাতা ভিন্ন মতের পথিক হওয়ার কারণে , এত নির্মম নৃশংসতা দেখেও যে সমাজ, যে সমাজের ‘বিবেক’রাও চুপ করে থেকেছে লেসার এভিলের যুক্তি ভাঁড়িয়ে ।
সন্ময় বন্দ্যোপাধ্যায় (৯৮৩০৪২৬০৭৮)
Black2ndMayAtBengal