বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী ভাষা আন্দোলনের শহীদ সুদেষ্ণা সিংহ

ভাষা আন্দোলনের বিশ্বের দ্বিতীয় নারী শহীদ সুদেষ্ণা সিংহকে চেনেন? উত্তরটা বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই “না” হতে পারে। তবে তার জন্য আফশোসের কারণ নেই। লেখাটি পড়ে যান, সুদেষ্ণা সিংহকে চিনতে পারবেন।

২১ শে ফেব্রুয়ারি, ১৬ মার্চ ও ১৯ শে মার্চ— এই তিনটি তারিখ পৃথিবীর ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসে তিনটে রক্তঝরা দিন। ১৯৫২ খ্রিস্টাব্দের ২১ শে ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশে, ১৯৬১ খ্রিস্টাব্দের ১৯ শে মার্চ অসমের বরাক উপত্যকায় এবং ১৯৯৬ খ্রিস্টাব্দের ১৬ ই মার্চ মণিপুর ভাষা আন্দোলনের জেরে উত্তাল হয়েছিল। বাংলাদেশ ও অসমের কথা আমরা কমবেশি জানলেও অনেকের কাছেই জানা নেই মণিপুরের কথা। তাই আজকের লেখায় মণিপুরের ভাষা আন্দোলনের ইতকথা।

দেশভাগের পর ভারতের সংবিধানে রাষ্ট্রের সকল ভাষাভাষী জনগণকে মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষা গ্রহণের মৌলিক অধিকার দেওয়া হলেও অসমের বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরীদের সে অধিকার ছিল না। আর এর জেরেই ১৯৫৫ খ্রিস্টাব্দে অসমের বরাক উপত্যকায় বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী ভাষা আন্দোলনের সূচনা। ওই বছর মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষাদানের ৭ দফা দাবিতে আন্দোলন শুরু করে “নিখিল বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী মহাসভা।” পরে এই আন্দোলন সত‍্যাগ্রহের রূপ নিয়ে দশকের পর দশক চলতে থাকে, কিন্তু বিষ্ণুপ্রিয়াদের ভাষার স্বীকৃতি মেলে না।

১৯৯২ খ্রিস্টাব্দের ২৭ শে সেপ্টেম্বর গঠিত হয় “বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী গণসংগ্রাম পরিষদ”, যার নেতৃত্বে ছিলেন রবিশঙ্কর সিংহ, কুলচন্দ্র সিংহের মতো নেতারা। এই সংগঠনের নেতৃত্বে ১৯৯২ থেকে ১৯৯৫ পর্যন্ত অসম ও ত্রিপুরায় বহুবার রেল অবরোধ, পথ অবরোধ, গণ অনশন ও বিভিন্ন ধরণের বিক্ষোভ কর্মসূচি চলতে থাকে।

এর জেরে ১৯৯৫ খ্রিস্টাব্দের ২৬ শে মে ত্রিপুরা সরকার রাজ‍্যের প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলিতে বিষ্ণুপুরী মণিপুরী ভাষা চালু করে। অসমে তখনও কিছু হয়নি। তাই মার্চ মাসে লাগাতার রেল অবরোধের ডাক দেয় গণসংগ্রাম পরিষদ।

অবরোধ চলতে থাকুক। আমরা এই ফাঁকে অসম উপত্যকাটা ঘুরে আসি, চলুন। বর্তমান ভারতের অসম রাজ‍্যের হাইলাকান্দি, কাছাড়, পাথারকান্দি, করিমগঞ্জ, মেঘালয় এবং ত্রিপুরা ও মণিপুর রাজ‍্যে বহু সংখ্যক বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী সম্প্রদায়ের বসবাস। বাংলাদেশেও আছেন এই বিষ্ণুপ্রিয়া গোষ্ঠীর লোকজন।

মণিপুরীদের আদিভূমি হচ্ছে মণিপুর এবং সেখানকার বেশির ভাগ অধিবাসী হচ্ছেন মৈতেয় গোষ্ঠীর লোক। ইন্দো-ইওরোপীয় ভাষাগোষ্ঠীর সদস্য বলে এবং বাংলা ও অসমিয়া ভাষার মধ্যে মিল থাকার কারণে বিষ্ণুপ্রিয়া গোষ্ঠীর ভাষাকে মণিপুরী ভাষা হিসেবে মৈতেয় স্বীকৃতি দিতে নারাজ সরকার। আর এই ভাষার স্বীকৃতির দাবিতে চলে আন্দোলন। ইতিপূর্বে আমরা লাগাতার রেল অবরোধ কর্মসূচিতে এসে থেমেছি।

এর পরের ঘটনা ১৯৯৬ খ্রিস্টাব্দের ১৬ ই মার্চ, শনিবার। এদিন সবচেয়ে দীর্ঘ ৫০১ ঘন্টার রেল অবরোধ কর্মসূচি ঘোষণা করেছিল “নিখিল বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী স্টুডেন্টস্ ইউনিয়ন।” এ সময় আন্দোলনকারীরা অসমের কলকলি ঘাটের গুংঘাঝারি রেলওয়ে স্টেশনে করিমগঞ্জ থেকে আসা একটি ডাউন ট্রেন অবরোধ করে।

আন্দোলনকারীদের মধ্যে ছিলেন ৩২ বছরের এক তরুণী, নাম—সুদেষ্ণা সিংহ। দরিদ্র পরিবারের মেয়ে সুদেষ্ণা আর দারিদ্র্যের মধেই বড়ো হয়ে ওঠা। অসমের বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী অধ‍্যুষিত এলাকা থেকে “ইমার ঠার” ( মায়ের ভাষা বা মাতৃভাষা) আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন সুদেষ্ণা। ১৯৯৬ খ্রিস্টাব্দের ১৬ ই মার্চ মাসের ঠা-ঠা তপ্ত দুপুর। চলছে তীব্র আন্দোলন। ঝাঁপিয়ে পড়ে পুলিশ। ঘটনাস্থলেই দুপুর ১২ টা ১০ মিনিটে শহীদ হোন সুদেষ্ণা সিংহ। গুরুতর জখম হয়ে পরে হাসপাতালে মারা যান আরেক তরুণ আন্দোলনকারী সলিল সিংহ। আহত হোন শতাধিক।

এই ঘটনায় উত্তাল হয়ে ওঠে অসম ও ত্রিপুরা। পরে অসম সরকারের তরফে বিষ্ণুপ্রিয়াদের সব দাবি মেনে নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়। এরপর ২০০১ খ্রিস্টাব্দের ১ লা ফেব্রুয়ারি অসমের বরাক উপত্যকায় প্রায় সব ক’টি (১৫২ টি) প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী ভাষায় পঠন-পাঠন চালু হয়ে যায়।

এর প্রায় ৬ বছর পর ২০০৬ খ্রিস্টাব্দের ৮ ই মার্চ সুপ্রিম কোর্টে স্বতন্ত্র মণিপুরী ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি পায় বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী ভাষা। বর্তমানে বাংলাদেশ ও ভারতে বসবাসকারী বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী ভাষী মানুষ ১৬ ই মার্চ দিনটিকে “শহীদ সুদেষ্ণা দিবস” হিসেবে পালন করে থাকে। না, ব‍্যর্থ হয়নি সুদেষ্ণার সেদিনের আত্মবলিদান। সুদেষ্ণা তাই আজ এক ভাষা আন্দোলনের শহীদের নাম।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.