চার দেওয়ালে চিত্রগ্রাহকের জীবনচিত্র, শুরু হল সৌম্যেন্দু রায় সংগ্রহশালা

Story image

সৌম্যেন্দু রায় এবং সত্যজিৎ রায়, ছবি: নিমাই ঘোষ

সুব্রত মিত্র-এর চোখের সমস্যা হওয়ায় সত্যজিৎ রায় ডেকে পাঠান সৌম্যেন্দু রায়কে (সত্যজিৎ রায় লিখতেন সৌমেন্দু রায়), ‘রবীন্দ্রনাথ’ তথ্যচিত্রে চিত্রগ্রহণের জন্য। সেইসঙ্গে ডাক পেলেন ‘তিনকন্যা’ (১৯৬১) কাহিনিচিত্রতেও। শোনা যায়, ‘তিন কন্যা’ ছবির তিনটি আলাদা গল্পের জন্য তিন রকমের আলোক পরিকল্পনা করেছিলেন সৌম্যেন্দু। ‘পোস্টমাস্টার’-এ মেঘলা আলো, ‘মণিহারা’-য় রহস্যঘন আলো এবং ‘সমাপ্তি’-তে ঝকঝকে উজ্জ্বল আলো ব্যবহার করেছিলেন। স্বাধীন আলোকচিত্রী হিসেবে নজির গড়লেন তখনই। তৈরি করলেন ইতিহাস। এমনকি তার এক বছর পর সত্যজিতের ‘অভিযান’ (১৯৬২) ছবিতে রাত্রে গাড়ির মধ্যে ব্যবহার করেছিলেন সাধারণ আলো ও ২০০ এএসএ ফিল্ম, যা নিখুঁত আলোকময় পরিবেশ তৈরি করেছিল। জীবিত কিংবদন্তি সেই চিত্রগ্রাহক সৌম্যেন্দু রায়কে শ্রদ্ধা জানিয়ে উত্তরপাড়ার জীবনস্মৃতি আর্কাইভে নির্মিত হল নতুন ঘর ‘সৌম্যেন্দু-সিন্দুক’। সামগ্রিক পরিকল্পনা অরিন্দম সাহা সরদারের

ছবি সৌজন্যে: জীবনস্মৃতি আর্কাইভ

গত ৮ মে (২০২৩) জীবনস্মৃতি আর্কাইভের ৯তম জন্মদিন উপলক্ষ্যে জীবনস্মৃতি আর্কাইভের কিউরেটর অরিন্দম সাহা সরদারের ভাবনা ও পরিকল্পনায় চিত্রগ্রাহক সৌম্যেন্দু রায়ের সিনেমা-যাপন এবং বাংলা ও বাঙালির চলচ্চিত্রের ইতিহাস নিয়ে সৌম্যেন্দু-সিন্দুক শিরোনামে এই সংগ্রহশালার শুভ সূচনা করা হল। অরিন্দম সাহা সরদার বঙ্গদর্শন.কম-কে জানিয়েছেন, “আমাদের সংগ্রহে আছে নানান চিত্র পরিচালকদের নির্মিত চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্যের কপি, যেখানে ক্যামেরার কাজ করেছিলেন সৌম্যেন্দু রায়। এছাড়াও সংগ্রহে আছে শুটিংয়ের স্থিরচিত্র (ডিজিটাল কপি), শুটিং সংক্রান্ত খুঁটিনাটি বিষয়ের নোটবুক, পোস্টার, বুকলেট, সংবাদ কর্তিকা এবং চলচ্চিত্র সংক্রান্ত বই ও পত্র-পত্রিকা। এছাড়া সৌম্যেন্দু রায়ের করা কাহিনিচিত্র, তথ্যচিত্র এবং টেলিভিশনের ডিজিটাল কপিও থাকছে এই সংগ্রহে। ২০০৭ থেকে ২০১৩ সময়ের মধ্যে আমার নেওয়া সৌম্যেন্দু রায়ের অডিও-ভিডিও সাক্ষাৎকার এবং তাঁর আলোকচিত্র প্রশিক্ষণের অডিও-ভিডিও থাকছে এই সংগ্রহে।”

১৯৫৩ সাল থেকে নিয়মিত টেকনিশিয়ান্স স্টুডিওতে যাতায়াত শুরু হয় সৌম্যেন্দু রায়ের। পরিচালক দীনেন গুপ্তের অধীনে শিক্ষানবিশ হিসেবে কাজে যোগ দেন। এই দীনেন গুপ্তই তখন ‘পথের পাঁচালী’ ছবিতে ক্যামেরা পরিচারকের কাজ করছিলেন। সেই ১৯৫৫ সালেই সত্যজিৎ রায়, সুব্রত মিত্র এবং বংশী চন্দ্রগুপ্তের সঙ্গে আলাপ হয় সৌম্যেন্দুর। এরপর ‘দেবী’ (১৯৬০) এবং ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা’ (১৯৬২) ছবিতে সহকারী চিত্রগ্রাহকের কাজ করেন। সত্যজিৎ রায়ের একেবারে শুরুর দিকে কিছু ছবিতে ট্রলি এবং আলোর হ্যান্ডেলার হিসাবেও কাজ করেছিলেন সৌম্যেন্দু। ‘তিন কন্যা’ (১৯৬১), ‘চিড়িয়াখানা’ (১৯৬৭), ‘গুপি গাইন বাঘা বাইন’ (১৯৬৯), ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’ (১৯৭০)‘সীমাবদ্ধ’ (১৯৭১), ‘অশনি সংকেত’ (১৯৭৩), ‘সোনার কেল্লা’ (১৯৭৪), ‘ঘরে বাইরে’ (১৯৮৫)-সহ সত্যজিৎ রায়ের মোট ২২টি ছবিতে প্রধান চিত্রগ্রাহক হিসাবে কাজ করেছিলেন সৌম্যেন্দু রায়। এছাড়াও যাত্রিক পরিচালিত ‘পলাতক’ (১৯৬৩), তরুণ মজুমদারের ‘বালিকা বধূ’ (১৯৬৭), তপন সিংহের ‘এক ডক্টর কি মৌত’ (১৯৯১), বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের ‘চরাচর’ (১৯৯৩) ইত্যাদি ছবিতেও কাজ করেছিলেন তিনি। সেরা চিত্রগ্রাহক হিসেবে চারবার পেয়েছেন জাতীয় পুরস্কার। বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের তথ্য ও সংস্কৃতি মন্ত্রকের অধীনে ইন্দো-ইতালীয় ফিল্ম ইনস্টিটিউট রূপকলা কেন্দ্রের সিনেমাটোগ্রাফি বিভাগের উপদেষ্টা। যদিও শারীরিক অসুস্থতার কারণে সেই কাজ থেকে অব্যাহতি নিয়েছেন।

সৌম্যেন্দু-সিন্দুকের অন্যতম আকর্ষণ সিনেমা সংক্রান্ত বহু পত্র-পত্রিকা যেমন রঙ্গমঞ্চ, উল্টোরথ, দীপালি, সিনেমা জগৎ, আনন্দলোক, টেলিভিশন, চিত্রবীক্ষণ, চিত্রভাষ, চিত্রপট, চিত্রভাবনা, এক্ষণ ইত্যাদিতে প্রকাশিত বহু বাংলা সিনেমা চিত্রনাট্য, মূল পোস্টার, বুকলেট, শুটিংয়ের ছবি, লবিকার্ড, বিজ্ঞাপন। বিগত ১৬ বছর ধরে অরিন্দম সাহা সরদারের নেওয়া চলচ্চিত্রের নেপথ্য শিল্পীদের অডিও-ভিডিও সাক্ষাৎকারও রয়েছে এই সিন্দুকে। আছে সৌম্যেন্দু রায় (২০০৭), সুব্রত মিত্র (২০১০) এবং বংশী চন্দ্রগুপ্ত (২০১২)-কে নিয়ে অরিন্দমের করা তথ্যচিত্র এবং সেই সংক্রান্ত গবেষণার নানা ছবি এবং তথ্য।

ছবি সৌজন্যে: জীবনস্মৃতি আর্কাইভ

অরিন্দম জানিয়েছেন, “শারীরিক অসুস্থতার জন্য সৌম্যেন্দু-সিন্দুক নামাঙ্কনলিপি সৌম্যেন্দু রায়ের বাসভবনেই উদ্বোধন করা হয়েছে। তিনি আমাদের শিক্ষক। তাঁর কাজ দেখে আমরা বারবার অনুপ্রাণিত হয়েছি। সিনেমাকে আরও গভীরভাবে ভালোবেসেছে। তাই আমার শিক্ষকের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে এই ঘর সাজিয়েছি। যাঁরা সদ্য সিনেমা জগতে প্রবেশ করেছে, এমনকি অভিজ্ঞ পরিচালক-সম্পাদক-চিত্রগ্রাহক ও দর্শকদের গবেষণার কাজে আসবে আমাদের এই সংগ্রহ।”

ছবি: নিমাই ঘোষ

কয়েকবছর আগেই সৌম্যেন্দু রায় জীবনস্মৃতির কিউরেটর অরিন্দম সাহা সরদারের হাতে তুলে দিয়েছিলেন তাঁর সৃষ্ট আলোকচিত্রে সমৃদ্ধ কয়েকটি চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্যের কপি। দিয়েছিলেন সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে তাঁর স্বাধীন আলোকচিত্রের শুটিং পর্যায়ের বিভিন্ন খুঁটিনাটি তথ্য সংবলিত একটি ডায়েরি। এছাড়াও বিভিন্ন সময়ে তিনি জীবনস্মৃতিকে দান করেছিলেন অনেক বই, গুগাবাবা-য় হাল্লা রাজার সভাগৃহে ব্যবহৃত একটি চাঁদমারি আর সত্যজিৎ রায়-সহ নানা পরিচালকের যে সব ছবিতে তিনি চিত্রগ্রাহকের কাজ করেছেন সে সবের শুটিং স্টিলের ডিজিটাল কপি। গবেষকদের ব্যবহারের জন্য সৌম্যেন্দু রায়ের এই দানগুলিকে সংরক্ষণ, প্রদর্শন ও ব্যবহারের যথাযথ ব্যবস্থা করল ‘জীবনস্মৃতি’। গত ৮ মে ‘সৌম্যেন্দু-সিন্দুক’ ঘরের উদ্বোধন করেন চিত্রশিল্পী হিরণ মিত্র এবং আলোকচিত্রী আদিনাথ দাস।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.