প্রাচীন ভারতীয় গুরু ঐতিহ্য অনুসারে গুরু তেগ বাহাদুর ছিলেন শিখদের নবম গুরু, যিনি গুরু পরম্পরা অনুসারে শিখদের প্রথম গুরু নানকের পথ অনুসরণ করেছিলেন। তাঁর রচিত ১১৫ টি শ্লোক গুরু গ্রন্থ সাহেবের অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। তিনি কাশ্মীরি পণ্ডিতদের জোর করে মুসলিম ধর্মে ধর্মান্তরিত করার তীব্র বিরোধিতা করেছিলেন।ইসলাম গ্রহণ না করার ১৬৭৫ সালে, মোগল শাসক আওরঙ্গজেব জন্য তাঁর শিরশ্ছেদ করেন।

গুরুদ্বার শীশ গঞ্জ সাহেব এবং গুরুদ্বার রাকাবগঞ্জ সাহেব সেইসব জায়গায় স্মৃতি আমাদের সামনে তুলে ধরে যেখানে গুরুজি শহীদ হয়েছিলেন । পুরো বিশ্বের ইতিহাসে ধর্ম ও মানবিক মূল্যবোধ, আদর্শ ও নীতি রক্ষার্থে যারা নিজের জীবন উৎসর্গ করেছিলেন তাদের মধ্যে গুরু তেগ বাহাদুর অন্যতম স্থান অধিকার করবেন। ।

গুরুজির আত্মত্যাগ কেবল ধর্মচর্চার জন্যই নয়, বরং সমগ্র মানব সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের জন্য ছিল। ধর্ম ছিলো তাঁর জন্যে সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ এবং জীবন বিধানের নাম। সুতরাং, ধর্মের চিরন্তন সত্য মূল্যবোধের জন্য তাঁর ত্যাগটি আসলে সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য এবং নিজের স্বাধীন জীবনযাপনের পক্ষে চূড়ান্ত দু: সাহসিকতারই কাজ ছিল।

গুরু তেগ বাহাদুর ছিলেন গুরু হরগোবিন্দের পঞ্চম পুত্র । অষ্টম গুরু, তাঁর নাতি হরিকৃষ্ণ রায়ের অকাল মৃত্যুর কারণে জনগণের ইচ্ছায় তিনি নবম গুরু পদে আসীন হন। তিনি আনন্দপুর সাহেব তৈরি করে সেখানেই বসবাস শুরু করেছিলেন। তাঁর শৈশবের নাম ছিল ত্যাগগমল। মাত্র ১৪ বছর বয়সে তিনি তার বাবার সাথে মোগলদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে বীরত্ব প্রদর্শন করেন।

যুদ্ধে ত্যাগমলের তাঁর বীরত্ব দেখে মুগ্ধ হয়ে তাঁর পিতা তাঁর নাম ত্যাগমল পালটে তেগ বাহাদুর রাখেন। ধৈর্য ও ত্যাগের প্রতীক গুরু তেগ বাহাদুর টানা ২০ বছর ধরে বাবা বাকালা নামক স্থানে একাকীত্ব পালন করেন।

গুরুজী ধর্ম প্রচারের জন্য বহু স্থান পরিদর্শন করেছিলেন। তিনি আনন্দপুর সাহেব থেকে
কিরাতপুর, রোপণ, সাইফাবাদ হয়ে খিয়ালা (খদল) পৌঁছেছিলেন । এখানে প্রচারের সময় তিনি দমদমা সাহেব হয়ে কুরুক্ষেত্রে পৌঁছান। কুরুক্ষেত্র থেকে যমুনার তীর হয়ে তিনি কড়ামানকপুরে পৌঁছেছিলেন এবং এখানেই তিনি সাধু ভাই মালুকদাসকে উদ্ধার করেন।

গুরু তেগ বাহাদুর প্রয়াগ, বেনারস, পাটনা, আসাম প্রভৃতি অঞ্চলে গিয়ে সেখানে আধ্যাত্মিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, উন্নয়নের জন্য সৃজনশীল কাজে আত্মনিয়োগ করেন। আধ্যাত্মিকতা ও ধর্ম সম্পর্কে জ্ঞান দান করেন । বিভিন্ন কুপ্রথা ও কুসংস্কারের সমালোচনা করে নতুন আদর্শ প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি সবার জন্য কূপ, ধর্মশালা ইত্যাদি নির্মাণও করে দিয়েছিলেন। এই যাত্রাপথেই পাটনাতে ১৬৬৬ খ্রিস্টাব্দে গুরুজির একটি পুত্রসন্তানের জন্ম হয়। যিনি পরবর্তীতে দশম গুরু গোবিন্দ সিং নামে পরিচিত হয়েছিলেন।

মুঘলদের অত্যাচারে ভীত সন্ত্রস্ত কাশ্মীরি পণ্ডিতরা গুরু গুরু তেগ বাহাদুরের কাছে এসে তাঁকে জানায় যে কিভাবে তাদের ইসলাম গ্রহণ করার জন্য নির্যাতন করা হচ্ছে। গুরু যখন সমস্যাটির সমাধানের ব্যাপারে উদ্বিগ্ন ছিলেন, তখন তাঁর নয় বছরের পুত্র গোবিন্দ রায় তাঁর উদ্বেগের কারণ জিজ্ঞাসা করেন। পিতা তাকে পুরো পরিস্থিতি সম্পর্কে অবগত করে বলেছিলেন যে এদের বাঁচানোর একমাত্র উপায় হলো এই নৃশংস অত্যাচার সহ্য করে আমার নিজের জীবন উৎসর্গ করা।

গুরু তেগ বাহাদুর পণ্ডিতদের বলেছিলেন যে আপনারা গিয়ে আওরঙ্গজেবকে বলুন আমাদের গুরু যদি ইসলাম গ্রহণ করেন তবেই আমরা তাঁর পরে তা করব। আপনি যদি গুরু তেগ বাহাদুরকে ইসলাম গ্রহণ করতে সক্ষম না হন তবে আমরাও ইসলাম গ্রহণ করব না। এতে আওরঙ্গজেব ক্ষুব্ধ হন এবং তিনি গুরু তেগবাহাদুরকে কারাবন্দি করার নির্দেশ দেন।

গুরুজি আওরঙ্গজেবকে বলেছিলেন যে আপনি যদি মানুষদের ইসলাম গ্রহণে বাধ্য করেন তবে আপনি প্রকৃত মুসলমান নন কারণ ধর্ম এই শিক্ষা দেয় না যে কাউকে নির্যাতনের দ্বারা মুসলমান করা উচিত। আওরঙ্গজেব এই কথা শুনে রেগে যান। এবং দিল্লির চাঁদনী চকে গুরু তেগ বাহাদুরের মস্তক ছিন্ন করার নির্দেশ দেন। গুরু তেগ বাহাদুর হাসতে হাসতে নিজের জীবন উৎসর্গ করেছিলেন।

গুরু তেগ বাহাদুরের স্মরণে আত্মবলিদানের স্থানে একটি গুরুদ্বার নির্মিত হয়েছে, যার নাম রাখা হয়েছে গুরুদ্বার শীশ গঞ্জ সাহেব। গুরু তেগ বাহাদুরের অনেকগুলি রচনা গুরু গ্রন্থ সাহেবের 9 নম্বর মহালায় সংরক্ষিত আছে। গুরু তেগ বাহাদুর বীরগতি প্রাপ্ত হওয়ার পরে তাঁর পুত্র গুরু গোবিন্দ রায়কে সিংহাসনে বসানো হয়েছিল, যিনি প্রাচীন ভারতীয় গুরু ঐতিহ্য অনুসারে শিখদের দশম গুরু হয়েছিলেন।

সহনশীলতা, কোমলতা এবং নম্রতার উদাহরণের পাশাপাশি, গুরু তেগ বাহাদুর সর্বদা এই বার্তা দিয়েছিলেন যে কোনও মানুষকে ভয় দেখানো বা নিজেও ভয় পাওয়া উচিত নয়। গুরু তেগ বাহাদুর আত্মবলিদানের যে উদাহরণ দিয়েছেন সেই কারণে তাঁকে ভারতের চাদর না ভারতের ঢালও বলা হয়ে থাকে। তিনি অন্যকে বাঁচাতে নিজে আত্মত্যাগ করেছিলেন।

জগৎ সংসার এমন আত্মত্যাগের দ্বারা অনুপ্রাণিত, যারা প্রয়োজনে তাদের জীবন দিয়ে দিয়েছে, কিন্তু সত্যকে ত্যাগ করেনি। নবম পাদশাহ শ্রী গুরু তেগ বাহাদুরের বলিদানও ঠিক একইরকম ছিল। গুরু জী নিজের জীবন নয়, বরং অন্যের অধিকার এবং বিশ্বাস রক্ষার জন্যই জীবন ত্যাগ করেছিলেন।

গুরু তেগবাহাদুরের শিক্ষা

কাহে রে বন খোজন জাহী।
সরব নিবাসী সদা অলেপা তেহি সঙ্গ সমাই।
অর্থাৎ,
হে মানুষ, তুমি তাকে বনে কোথায় খুঁজছো, প্রতিটি কোনায় কোনায় বসে সে সর্বদা তোমার সাথে থাকে।

জন নানক সভ হী ম্যায় হী পূরণ এক পুরখ ভগবানো।
(রাগ বসন্ত হিন্দোল মহলা ৯, পৃষ্ঠা ১১৮৬ )
অর্থাৎ ‚
সকলের মধ্যে একজন ঈশ্বরই বসবাস করেন।

সাধো গোবিন্দো কে গুন গাউ।
মনস জনমু অমোলকু পাইও বিরথা কাহি গাওয়াবাউ।
(গৌড়ী মহল 9, পৃষ্ঠা 219)
অর্থাৎ,
হে মানুষ, তুমি গোবিন্দের প্রশংসা কর ‚ মূল্যবান মানবজন্ম লাভ করে এটিকে নষ্ট করো না।

জগ রচনা সব ঝুট হ্যায় ‚ জানি লোহু রে মীত।
কহি নানক খিরু না রহে জিউ বালু কি ভীতি।

(শ্লোক ৪৯ , পৃষ্ঠা -১৪২৯)
অর্থাৎ,
হে মানুষ, এই পৃথিবীটি মিথ্যা, যেমন বালির প্রাচীর দীর্ঘকাল স্থায়ী হয় না, তেমনি এই পৃথিবীও বেশি দিন স্থায়ী হয় না।

যতন বহুত সুখ কে কীয়ে ‚ দুখ কীও না কোই। কহু নানক সুনি রে মন হরি ভাবই সো হোই।
(শ্লোক ৩৯ ‚ পৃষ্ঠা -১৪২৮)
অর্থাৎ
মানুষ আনন্দ এবং তার লোভের সন্ধানে আরও বেশি দুঃখ ভোগ করে, সংসারে সেটাই ঘটে যা ঈশ্বর মঞ্জুর করেন ।

মগন রহিও মাইয়া মে নিস দিনি ছুট্টী নমন কী কাই।
(টোডি মহলা ৯, পৃষ্ঠা ৭১৮)
অর্থাৎ ‚
মানুষ দিনরাত মায়ার পিছনে ছুটে বেড়ায় ‚ তবুও মনের ময়লা দূর হয় না।

প্রাণি রামু ন চেতই মাডি মাইয়া কে অন্ধু।
কহু নানক হরি ভজন বিনু পরত নহি জম ফন্ধ।
(শ্লোক – ৩১, পৃষ্ঠা ১৪২৮ )
অর্থাৎ,
মায়ায় উদ্বিগ্ন প্রাণীরাই কেবল মৃত্যুকে ভয় পায় এবং অকাল পুরখের ভালোবাসা পাওয়া ব্যক্তিরাই কেবলমাত্র এই ভয় থেকে মুক্তি পেতে পারে। যাঁরা নাম সংকীর্তন করেন না তারা জীবন মরণের বন্ধন থেকে মুক্তি পেতে পারেন না।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.