বৈদিক যুগ থেকে হিন্দু পঞ্জিকার প্রচলন চলে আসছে। বেদে পঞ্জিকার গঠন সম্পর্কে অনেক তথ্য পাওয়া যায়। ছয়টি বেদাঙ্গ, যাকে জ্যোতিষও বলা হয়, তাতে সমস্ত রকম পঞ্জিকার ধারণা পাওয়া যায়। পরবর্তী বৈদিক যুগে হিন্দু পঞ্জিকার উন্নয়নে আর্যভট্ট(৫ম শতাব্দী), বরাহমিহির (৬ষ্ঠ শতাব্দী) ও ভাস্করের(১২শ শতাব্দী) মতো অনেক ভারতীয় জ্যোতির্বিদ অবদান রাখেন।
হিন্দু পঞ্জিকার গঠন সম্পর্কে সর্বাপেক্ষা স্বচ্ছ ধারণা দেয় সূর্য সিদ্ধান্ত নামে গ্রন্থটি। এর রচনাকাল সঠিক জানা যায়নি। যদিও কারোর অভিমতে, এটি ১০ম শতাব্দীতে রচিত হয়েছিল।
বিক্রম সংবৎ নৃপতি বিক্রমাদিত্য কর্তৃক প্রবর্তিত একটি অব্দবিশেষ। এটি ভারতের একটি বহুল প্রচলিত অব্দ এবং নেপালের জাতীয় অব্দ। বিক্রম সংবৎ জাতীয় অব্দ হিসেবে স্বীকৃত হলেও এর পাশাপাশি গ্রেগোরিয়ান বর্ষপঞ্জি এবং নেপাল সংবতের প্রচলনও নেপালেব্যাপকভাবে রয়েছে।
হিন্দু পঞ্জিকা বা হিন্দু পঞ্চাঙ্গ হল হিন্দু ধর্মে প্রথাগত ভাবে ব্যবহৃত চান্দ্র-নাক্ষত্র এবং নাক্ষত্র পঞ্জিকাসমূহের সমষ্টিগত নাম।
আঞ্চলিক বৈচিত্র্যের কারণে হিন্দু পঞ্জিকার অসংখ্য সংস্করণ দেখা যায়। এদের মধ্যে অধিক প্রভাবশালী জাতীয় ও আঞ্চলিক হিন্দু পঞ্জিকাগুলি হল– নেপালের সরকারি নেপালি পঞ্জিকা এবং ভারতের বাংলা পঞ্জিকা, পঞ্জাবি পঞ্জিকা, ওড়িয়া পঞ্জিকা, মলয়ালম পঞ্জিকা, কন্নড় পঞ্জিকা, টুলু পঞ্জিকা, তামিল পঞ্জিকা, বিক্রম সংবৎ ও দাক্ষিণাত্যের কর্নাটক, মহারাষ্ট্র, তেলঙ্গাণা আর অন্ধ্র প্রদেশের শালিবাহন পঞ্জিকা।
উজ্জয়িনী নগরীর চন্দ্রবংশীয় রাজা বিক্রমাদিত্যশকদের পরাজিত করে তাঁর বিজয়োপলক্ষে ৫৬ খ্রিস্টপূর্বাব্দে প্রবর্তন করেন চান্দ্র অব্দ বিক্রম সংবৎ। বিক্রম সংবৎ গ্রেগোরিয়ান বর্ষপঞ্জি থেকে ৫৬.৭ বছর এগিয়ে রয়েছে। এটি একটি চান্দ্রাব্দ এবং প্রাচীন সূর্যসিদ্ধান্ত অনুসারে তিথি মতে গণিত হয় এই অব্দের মাস এবং দিনাঙ্ক। উত্তর ভারত এবং নেপালে এই অব্দে নববর্ষারম্ভ হয় চান্দ্র চৈত্র মাসের শুক্লা প্রতিপদ তিথিতে। কিন্তু পশ্চিম ভারতে এই একই অব্দ আরম্ভ হয় চান্দ্র কার্তিক মাসের শুক্লা প্রতিপদ তিথিতে।
কম্বোডিয়া, লাওস, মায়ানমার, শ্রীলঙ্কা ও থাইল্যান্ডেরবৌদ্ধ বর্ষপঞ্জি আর কিছু সৌর-চান্দ্র পঞ্জিকা হিন্দু পঞ্জিকারই প্রাচীন সংস্করণের উপর প্রতিষ্ঠিত।
বেশিরভাগ হিন্দু পঞ্জিকাই ৫ম ও ৬ষ্ঠ শতাব্দীতে গুপ্তযুগের আর্যভট্ট ও বরাহমিহিরের জ্যোতির্বিদ্যার ফসল। এই জ্যোতির্বিদ্যার মূল আধার ছিল প্রাচীন হিন্দু গ্রন্থ বেদাঙ্গ জ্যোতিষ, যাকে পরে সংস্কার করে সূর্য সিদ্ধান্ত গ্রন্থটি লিখিত হয়। মধ্যযুগের এই পঞ্জিকার আঞ্চলিক বৈচিত্র্য সৃষ্ট হতে থাকে। দ্বাদশ শতাব্দীতে দ্বিতীয় ভাস্কর জ্যোতির্বিদ্যার নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেন।
বর্ষপঞ্জির আঞ্চলিক সংস্করণে ওই গুপ্তযুগীয় গণনারই কিছু পার্থক্য দেখা যায়, তবে প্রতিটি সংস্করণের ভিত্তি মূলত হিন্দু সৌর-চান্দ্র পঞ্জিকা।
১৯৫৭ সালে সেই হিন্দু পঞ্জিকার ওপর ভিত্তি করেই ভারতের জাতীয় বর্ষপঞ্জি শক সংবৎ গঠিত হয়।
হিন্দু পঞ্জিকায় চৈত্র মাসের শুক্লপক্ষের প্রতিপদের দিন বছরের শুরু বা নববর্ষ। কিন্তু চৈত্র মাসে মলমাস কিংবা ক্ষয়মাস থাকলে, বিধান অনুযায়ী কিছু সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়:
শুদ্ধ চৈত্রের আগে মল চৈত্র থাকলে, শুদ্ধ চৈত্রেই বর্ষারম্ভ হবে (যেমন, ২২ ফেব্রুয়ারি, ১০১৫ খ্রি)।মল চৈত্র ও চৈত্র-বৈশাখ ক্ষয় পরপর থাকলে, বর্ষারম্ভ মল চৈত্রেই হয়।চৈত্র-বৈশাখ ক্ষয়ের আগে কোনো মল চৈত্র না থাকলে, ওই মাসেই নববর্ষ হবে।ফাল্গুন-চৈত্র ক্ষয় সৃষ্টি হলে, সেই মাসেই বর্ষারম্ভ হয়।
প্রাচীন বৈদিক পঞ্জিকায় বছরের শুরু হত অগ্রহায়ণ(অগ্র = প্রথম + অয়ন = সূর্যের গতি) বা মার্গশীর্ষ মাস দিয়ে। এই মাসে সূর্য বিষুবরেখাকে অতিক্রম করে। এই মাসের অপর নাম মার্গশীর্ষ এসেছে ৫ম নক্ষত্র মৃগশিরার (ল্যাম্ডা ওরিঅনের কাছে) নাম থেকে। পৃথিবীর অক্ষের ধীর সরণের জন্য বিষুবরেখা বর্তমানে মীন রাশিতে অবস্থান করছে, অর্থাৎ প্রথম মাসের নাম চৈত্র।
হাজার-হাজার বছর ধরে বিষুবরেখার এই সরণের জন্য ভারতীয় উপমহাদেশের নানা অঞ্চলে নানা মাস দিয়ে বছর শুরু করার প্রথা চালু হয়। কিছু পঞ্জিকা (যেমন, বিক্রম সংবৎ) চৈত্র মাসকে বছরের শুরু ধরে নিয়েছে, এই চৈত্র মাসেই বর্তমান বিষুবরেখা অবস্থান করছে। আবার কিছু পঞ্জিকা বৈশাখ মাসকে বর্ষারম্ভ মেনে নিয়েছে (যেমন, বঙ্গাব্দ)। অগ্রহায়ণ থেকে চৈত্র ― অর্থাৎ বিষুবরেখার সরণ হয়েছে চার মাস। আর পৃথিবীর অক্ষের সম্পূর্ণ সরণের সময়কাল ২৫,৮০০ বছর। এর থেকে গণনা করে বোঝা যায়, আনুমানিক চার হাজার কিংবা পাঁচ হাজার খ্রিস্টপূর্বাব্দে বিষুবরেখা অগ্রহায়ণে অবস্থান করছিল।
সংখ্যাগত চিহ্ন ছাড়াও, হিন্দু পঞ্জিকায় ৬০টি বর্ষনামের একটি চক্র আছে, একে সংবৎসর বলা হয়। এই চক্র প্রথম বছরে শুনো হয়েছিল (যখন অতিক্রান্ত বর্ষের সংখ্যা শূন্য), এবং পর্যায়ক্রমে চলছে:
প্রভাব (১৯৮৭-৮৮)বিভব (১৯৮৮-৮৯)শুক্ল (১৯৮৯-৯০)প্রমোদ (বা প্রমোদূত) (১৯৯০-৯১)প্রজাপতি (বা প্ৰাজোপতি) (১৯৯১-৯২)অঙ্গিরা (১৯৯২-৯৩)শ্রীমুখ (১৯৯৩-৯৪)ভাব (১৯৯৪-৯৫)যুব (১৯৯৫-৯৬)ধাত্রী (১৯৯৬-৯৭)ঈশ্বর (১৯৯৭-৯৮)বহুধান্য (১৯৯৮-৯৯)প্রমাথী (১৯৯৯-২০০০)বিক্রম (২০০০-০১)বৃষ (২০০১-০২)চিত্রভানু (২০০২-০৩)স্বভানু (২০০৩-০৪)তারণ (২০০৪-০৫)পার্থিব (২০০৫-০৬)ব্যয় (২০০৬-০৭)সর্বজিৎ (২০০৭-০৮)সর্বধারী (২০০৮-০৯)বিরোধী (২০০৯-১০)বিকৃত (২০১০-১১)খর (২০১১-১২)নন্দন (২০১২-১৩)বিজয় (২০১৩-১৪)জয় (২০১৪-১৫)মন্মথ (২০১৫-১৬)দুর্মুখ (২০১৬-১৭)হেবিলম্বী (২০১৭-১৮)বিলম্বী (২০১৮-১৯)বিকারী (২০১৯-২০)সাবর্ণি (২০২০-২১)প্লব (২০২১-২২)শুভকৃতি (২০২২-২৩)শোভাকৃতি (২০২৩-২৪)ক্ৰোধী (২০২৪-২৫)বিশ্ববসু (২০২৫-২৬)পরাভব (২০২৬-২৭)প্লবাঙ্গ (২০২৭-২৮)কীলক (২০২৮-২৯)সৌম্য (২০২৯-৩০)সাধারণ (২০৩০-৩১)বিরোধীকৃতি (২০৩১-৩২)পরিধাবী (২০৩২-৩৩)প্রমাদীচ (২০৩৩-৩৪)আনন্দ (২০৩৪-৩৫)রাক্ষস (২০৩৫-৩৬)অনল (২০৩৬-৩৭)পিঙ্গল (২০৩৭-৩৮)কালযুক্তি (২০৩৮-৩৯)সিদ্ধার্থী (২০৩৯-৪০)রৌদ্র (২০৪০-৪১)দুৰ্মাথী (২০৪১-৪২)দুন্দুভি (২০৪২-৪৩)রুধিরোদ্গারী (২০৪৩-৪৪)রক্তাক্ষী (২০৪৪-৪৫)ক্রোদন (২০৪৫-৪৬)অক্ষয় (২০৪৬-৪৭)
জুলিয়ান বর্ষপঞ্জির মতোই এই পদ্ধতিতেও অধিবর্ষ-এর ধারণা আছে। প্রতি চার বছর অন্তর, বছরে ৩৬৫ দিনের জায়গায় ৩৬৬ দিন থাকে। বছর শুরুর বিন্দুটি হল মেষাদি বা মেষ সংক্রান্তি (হিন্দু সৌরবর্ষে মেষ-এর প্রথম দিন)। এতে দিনের হিসেবও রাখা হয়। প্রথম দিন থেকে শুরু করে এখন পর্যন্ত ১৮৬৪০০০-এর বেশি দিন কেটে গিয়েছে। অর্থাৎ বর্তমান কলিযুগের (চতুর্যুগের ১/১০ অংশ) অনেকটা দিনই পার হয়ে গিয়েছে।