স এবাধস্তাৎ স উপরিষ্টাৎ স পশ্চাৎ পুরস্তাৎ স দক্ষিণতঃ স উত্তরতঃ স এবেদং সর্বমিত্যথাতোহহঙ্কারাদেশ  এবাহমেবাধস্তাদহমুপরিষ্টাদহং পশ্চাদহং পুরস্তাদহং দক্ষিণতোহহমুত্তরতোহহমেবেদং সর্বমিতি।।
সেই ভূমাই নিম্নে, উপরে, তিনিই পিছে এবং সুমুখে, তিনিই ডানদিকে এবং তিনিই বামে.. এসব কিছু তিনিই। এবার আমি দৃষ্টিতে উপদেশ  -আমিই নীচে , আমিই উপরে, আমিই পিছনে , আমিই সামনে, আমিই ডানে এবং বামে। এই সব কিছুই আমি।


আমার আত্মাই সর্বভূতের অন্তরাত্মা। আকাশে , বায়ুতে , জলে , কীটপতঙ্গে, এমন কি বৃহত্তম প্রাণীর মধ্যেও আমিই রয়েছি। এই আত্মা সর্বত্র, সর্বব্যাপী, সর্বভূতে ও সব কিছুর মধ্যে। ইনিই সৎস্বরূপ।
কল্পনা করা যাক, এই বিশ্বব্রহ্মান্ড এক বিশাল সমুদ্র। সেই সমুদ্রে নানা আকারের ঢেউ খেলছে। কোনটি ছোট , কোনটি বড় , কোনটি উত্তাল  কোনটি আবার সামান্য আলোড়ন মাত্র। কিন্তু জল একই….জল বিষয়টির কোনো পরিবর্তন নেই। ঠিক তেমনি, আত্মা এক, কিন্তু আমরা নানা বৈচিত্র্য দেখি। এক আত্মার উপর নাম রূপ আরোপিত হয়ে এই বৈচিত্র্য দেখায় । সেই বৈচিত্র্য কিন্তু সত্য নয় , আত্মাই সত্য। আর এই আত্মাই আমাদের অন্তরাত্মা।


এই যে তত্ত্ব বললেম উপনিষদের তা কিন্তু কেবলমাত্র তত্ত্ব নয়, সত্যদ্রষ্টা ঋষির প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা। তাঁরা বলেন, ধর একটা বিশাল হ্রদ রয়েছে। তার মাঝখানে একটা পাথর তুমি ছুঁড়েছ। সেই পাথরটা জলে পড়ামাত্র তার চারদিকের জলে আলোড়ন উঠবে। সেই আলোড়ন দেখতে দেখতে সমগ্ৰ হ্রদে ছড়িয়ে পড়বে। তেমনি , কারো কোথাও যদি আঘাত লাগে , সেই আঘাত তোমার গায়েই লাগে। একটা ঘরে অনেকগুলো তারের যন্ত্র রয়েছে। তার মধ্যে যদি একটা যন্ত্র বাজানো হয়, তাহলে অন্যগুলিও আপনা আপনি বেজে ওঠে। একটা যন্ত্রের শব্দকম্পন অন্য যন্ত্রগুলিকে স্পর্শ করে। এও ঠিক তাই। 


স্বামী বিবেকানন্দের জীবনে এধরনের অভিজ্ঞতা বহুবার হয়েছে। একবার তাঁর এক গুরুভাই দেখেন, স্বামীজী মাঝরাত্রে বারান্দায় অস্থিরভাবে পায়চারি করছেন। তিনি স্বামীজীকে এর কারণ জিজ্ঞাসা করলে , স্বামীজী উত্তর দিলেন – ” কোথাও একটা ভীষণ কোনো দুর্ঘটনা ঘটেছে, তাই ঘুম ভেঙে গেল। ” পরের দিন প্রভাতে সংবাদপত্রে দেখা গেল , ঠিক ওই সময়েই ফিজি দ্বীপপুঞ্জে ভয়ঙ্কর অগ্নুৎপাত হয়েছে, ফলে বহু মানুষের প্রাণহানি ঘটেছে।


সত্যদ্রষ্টা ঋষির অনুভূতি এতটাই সূক্ষ্ম হয়। কারণ, তিনি উপলব্ধি করেন, সর্বত্র এক মন, এক প্রাণ এবং এক চৈতন্য রয়েছে। অপরে যা চিন্তা করে , তা তাঁর মনেও ভেসে ওঠে। কারো মনে কোনো দুঃখ থাকলে তিনি একবার তাকিয়েই বুঝতে পারেন। 


এখন যদি প্রশ্ন কর, ” আমি সকলের সঙ্গে এক এবং অভিন্ন এমনটি ভাবা কি সম্ভব?” শাস্ত্র বলেন , হ্যাঁ , তা সম্ভব বৈকি। এখন তুমি নিজেকে ছোট মনে করছ , অল্প ভাবছ। ভাবছ ,তুমি একজন ব্যক্তি এবং অপরের থেকে আলাদা। যখন নিজেকে জগতের সঙ্গে অভিন্ন বলে ভাবতে শিখবে , তখন তুমিই অসীম, তুমিই ভূমা হয়ে যাবে।


স্বামীজী বলতেন : ধর,  তুমি ওই যে কালো শ্যামল মেঘ, তার মধ্যে একটা ক্ষুদ্র জলকণা মাত্র। একদিন বৃষ্টি হয়ে সমুদ্রের দিকে পড়ছ। তুমি সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে উঠছ , ” আমি হারিয়ে যাচ্ছি  হারিয়ে যাচ্ছি গো ও ও ও ..!” কিন্তু সেই বিশালাকার সমুদ্রে যখন তুমি পড়লে , তখন কি হল ? তখন তুমি আর ক্ষুদ্র নও। তুমিও বিশাল, তুমিও সমুদ্র …মিলে মিশে একাকার হয়ে গেছ। 


আমরা নিজেদের একে অপরের থেকে পৃথক মনে করি, তাই আমরা ক্ষুদ্র। এই পৃথক বোধ থেকেই আমরা একে অপরকে ভয় পাই। হিংসে করি। আমরা কেউ সুখী নই এই পৃথিবীতে। কখনো হয়তো মানুষের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করছি কখনো দয়া করছি , আবার কখনো স্বার্থপরের মতো কারোর দিকে ফিরেও তাকাচ্ছি না। 


বেদান্ত বলছেন:  যখন তুমি অনুভব করবে এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সঙ্গে এক ও অভিন্ন,তুমি ব্যতীত আর দ্বিতীয় কোনো বস্তু নেই, তখন আর স্বার্থপরতার লেশমাত্র থাকবে না।  একবার এই একাত্ববোধ হলে তা আর কোনোদিন হারায় না। তখনই মানুষ প্রকৃত সুখী হয়। আসল কথা হল, আমরা  নিজেকে নিজে কি ভাবছি। উপনিষদ্ আমাদের এখানে ভাবতে বলছেন : উপরে, নীচে, সামনে , পিছনে সর্বত্র আমিই বিরাজ করছি। এই সবকিছু আমিই হয়েছি।


অধিকাংশ মানুষের জীবনে কোন না কোন সময় মুর্হূর্তের জন্য হলেও এই একত্বের অনুভূতি হয়। কেউ হয়তো আঘাত পেয়েছে, আমি তাকে চিনি না। কিন্তু,মনে হয় সে আঘাত আমার গাত্রে ব্যাথা জাগায়। যার অনুভূতি এমনতর সূক্ষ্ম, সেই ঠিক ঠিক একত্ব হবার পথে এগিয়ে চলেছে। 


এর অর্থ কিন্তু এই নয় যে ব্যবহারিক জগতে আমাদের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই বা পার্থক্য না থাকাটা খারাপ। অবশ্যই আছে আর থাকবেও।  সবই এক ছাঁচে গড়া হোক তা আমি তুমি সে কেউই চায় না। কিন্তু আমাদের পার্থক্য হল কেবল খুঁটিনাটিতে। উপাধিতে পৃথক, স্বরূপতঃ নয়।


আমি বেঁটে , ও লম্বা। আমি মোটা , ও রোগা। এই সব বেঁটে , লম্বা, রোগা ,মোটা এসব উপাধি। আমাদের যে প্রকৃত স্বরূপ তার উপর এগুলি বাহির হতে আরোপ করেছি। কিন্তু সামগ্রিক দৃষ্টিতে যখনই দেখতে শিখব, আপনাকে সকল কিছুর মধ্যে দেখতে পাব। তখন ভাবব, আমি লম্বা, আমিই বেঁটে, আমি রোগা এবং মোটা , আমিই বুদ্ধিমান ও আমিই বোকা। নামরূপে আলাদা। কিন্তু আমিই সব হয়েছি।

  • #অহম্_এব_ইদম্_সর্বম্ ― এ সব কিছুই আমি। ইদম্ অর্থাৎ এই , অর্থাৎ এই দৃশ্যমান জগৎ। যা কিছু আমরা দেখি ,অনুভব করি,যা ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য, তাই #ইদম্। আমরা মনে করেছি যে জগৎটাকে বুঝে ফেলেছি। কিন্তু একই জিনিস তোমার কাছে শক্ত, আমার কাছে নরম, তুমি দেখ লাল আমি দেখি গৈরিক। জগতের স্বাভবই এই। কখনো কোনো দুজন মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি একই হয় না। কিন্তু উপনিষদ্ বলছে, এই বৈচিত্র্যময় জগতের পেছনে রয়েছে #ভূমা। সেই এক আত্মা সর্বত্র রয়েছেন – নানা নামে, নানা রূপে। 
  • আমি অনন্ত , আমি সবার সঙ্গে এক এবং অভিন্ন।
  • ©দুর্গেশনন্দিনী
  • তথ্যঃ ছান্দোগ্য উপনিষদ্

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.