আগামী কাল, ১৫ আগস্ট ভারতের স্বাধীনতার ৭৫ বছর পূর্ণ হবে। স্বাধীনতার এই অমৃত মহোৎসব উদযাপনের জন্য ইতিমধ্যেই নানা কর্মসূচি শুরু হয়েছে এবং সারা বছরব্যাপী সেসব চলবে। আমরা এখন একটি উৎসবের ভাবে আছি। কিন্তু এর মানে এই নয় যে, আমাদের সামনে কোনও চ্যালেঞ্জ বা সমস্যা নেই। অনেক সমস্যার সমাধান ইতিমধ্যে হলেও আরও কিছু নতুন সমস্যাও দেখা দিয়েছে। তবে সমস্যা যাই থাক, স্বাধীনতার অমৃত মহোৎসবের আনন্দ আমরা যাপন করব এবং এটাই স্বাভাবিক।
১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট, বহু শতাব্দী পর, আমরা আমাদের ইচ্ছানুযায়ী স্বশাসন প্রতিষ্ঠা করতে এবং স্বশাসনের ব্যবস্থা করতে সক্ষম হয়েছিলাম। আমাদের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার মধ্যে, আমাদের জাতীয় পতাকার নীচে, বিশাল ভারতের অবস্থান। এই স্বাধীনতা আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে ভারতের মানুষ সম্পূর্ণ স্বাধীনতা অর্জনের লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত না-হয়ে দাসত্ব ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে নিরলস সংগ্রাম করেছিল। ভৌগোলিক দিক থেকে, বিদেশি শক্তির বিরুদ্ধে ভারতীয় জনগণের এই সংগ্রাম ছিল সর্বব্যাপ্ত এবং সর্বাঙ্গীণ। সমাজের সকল শ্রেণি তাদের সামর্থ্য, ক্ষমতা ও শক্তি অনুযায়ী স্বাধীনতা আন্দোলনে অবদান রেখেছিল। যেসব কারণ আমাদের স্বাধীনতার পথে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করেছিল সেগুলি সম্পর্কে দেশের মানুষ ক্রমশ সচেতন হয়ে উঠেছিল।
একদিকে যখন স্বাধীনতার জন্য সশস্ত্র ও নিরস্ত্র সংগ্রাম জোরদার হতে থাকে, অন্যদিকে তখন সমাজকে কুসংস্কারমুক্ত করার এবং সম্মিলিত স্বার্থে কাজ করার জন্য জাগ্রত করার প্রচেষ্টাও গ্রহণ করা হয়েছিল। এই নিরলস প্রচেষ্টার জন্যই ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট, আমরা আমাদের ইচ্ছানুযায়ী, আমাদের পছন্দ অনুযায়ী, আমাদের নিজস্ব লোকদের দ্বারা আমাদের দেশ পরিচালনার অধিকার অর্জন করেছি। ভারতের মাটি থেকে আমরা ব্রিটিশ শাসকদের বিদায় জানিয়ে আমাদের রাষ্ট্র পরিচালনা এবং প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করি। সুতরাং, খুব সঙ্গতভাবেই আমাদের মাতৃভূমির স্বাধীনতার ৭৫ বছর আমরা উত্সাহ ও উদ্দীপনার সঙ্গে উদযাপন করছি।
দীর্ঘসময়ের স্বাধীনতা সংগ্রামে অসংখ্য মানুষ, যাঁরা প্রকৃত বীর, তাঁরা নিজের জীবনসহ সবকিছু বিসর্জন দিয়েছিলেন। তাঁদের দৃঢ় চরিত্র, দেশপ্রেম এবং মাতৃভূমির প্রতি ভক্তি সম্পর্কে সমগ্র সমাজকে অনুপ্রাণিত করার জন্য তাঁদের বীরত্ব ও ত্যাগের কাহিনি প্রচার করতে হবে। আপাতদৃষ্টিতে অনেক ছোট-বড় ঘটনা অথবা ছোট-বড় কাজ ছিল যা আমাদের জাতির উপর দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব ফেলেছিল। মাতৃভূমির জন্য যে লক্ষ্যে তাঁরা স্থির ছিলেন এবং যে দায়িত্ব তাঁরা জীবন দিয়ে পালন করেছিলেন—তা শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণে রাখা উচিত। দেশে কেন স্বরাজ্য দরকার? বিদেশি শক্তি দেশের নাগরিকদের জন্য এবং তথাকথিত উন্নয়নের কাজ করলেও, কেন তাদের দ্বারা একটি দেশ শাসিত হওয়া উচিত নয়? আত্মনিয়ন্ত্রণের ও আত্মপ্রকাশের অধিকার যেকোনও সমাজের জন্য মৌলিক। এইভাবে, স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা সহজাত অনুপ্রেরণা দেয়। একটি দেশ তখনই যথার্থভাবে পরিচালিত হতে পারে যখন সেটি স্বাধীন হয় এবং নিজের জন্য প্রয়োজনীয় সিদ্ধান্ত নিজেরাই নিতে পারে। স্বামী বিবেকানন্দ একবার বলেছিলেন, ‘প্রত্যেক জাতির সৃষ্টি হয় অর্থবহ কিছু অবদান রাখতে।’ অবদান রাখতে হলে জাতিকে একইসঙ্গে স্বাধীন ও সক্ষম হতে হবে। এগুলো মৌলিক, তাই অপরিহার্যও। স্বামীজির মতো, কয়েকজন মহান ব্যক্তি ভারতবাসীকে জাগাবার কাজ করেছিলেন। স্বাধীনতা আন্দোলনের জন্য সশস্ত্র ও নিরস্ত্র বিপ্লবকে অনুপ্রাণিত করেছিলেন। তাঁদের নিজস্ব ভাষায় বর্ণনা করেছেন, শুধু স্বাধীনতা অর্জনই অপরিহার্য নয়, বরং কীভাবে তার প্রয়োগ ও সংরক্ষণ হচ্ছে তাও বিবেচ্য।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর ‘ চিত্ত যেথা ভয়শূন্য, উচ্চ যেথা শির’ এবং মহাত্মা গান্ধী তাঁর ‘হিন্দ-স্বরাজ’ উদ্ধৃতির মাধ্যমে স্বাধীন ভারত সম্পর্কে ধারণাগুলি বিশদভাবে তুলে ধরেছেন। স্বাধীনতা সংগ্রামী বীর সাভারকর তাঁর বিখ্যাত ‘স্বতন্ত্র-দেবী আরতি’তে স্বাধীন দেশে সর্বাঙ্গীণ কল্যাণ এবং শ্রেষ্ঠত্বের কথা বলেছেন। আমরা বি আর আম্বেদকরের অবদান অস্বীকার করতে পারি না। দুটি বিখ্যাত বক্তৃতায় তিনি স্বাধীনতার অর্থ, উদ্দেশ্য, যুক্তি এবং একটি মহান জাতি গঠনের জন্য প্রতিটি ভারতীয়ের কর্তব্য পরিষ্কার করেছেন। অমৃত মহোৎসব উদযাপনের এই শুভক্ষণে আমাদের আত্মসমীক্ষা করা উচিত যে, স্বাধীনতার উদ্দেশ্য যদি স্বনির্ভরতা অর্জন করা হয়, তবে আজ ৭৫ বছর পর, ভারত কি সম্পূর্ণ আত্মনির্ভর হতে পেরেছে! ভারতকে যদি বিশ্বমঞ্চে যথার্থ অবদান রাখতে হয়, তবে প্রথমে কি তাকে সবদিক দিয়ে স্বনির্ভর হতে হবে? ভারত কি সমস্ত ক্ষেত্রে আত্মনির্ভরতা অর্জন করেছে?
১৯৪৭ সালে, আমরা ভারতকে সর্বশ্রেষ্ঠ করার এবং যুগান্তর আনার শপথ নিয়েছিলাম। যেখানে ভারত নতুন আলো, নতুন পথ দেখাবে এবং অবশিষ্ট বিশ্বকে নেতৃত্ব দেবে। কিন্তু এর জন্য আমাদের চিন্তা ও কর্ম উভয় ক্ষেত্রেই যথেষ্ট স্বচ্ছতা, দৃঢ়তা এবং উপযুক্ত দিকনির্দেশনার প্রয়োজন। ভারতের চিরন্তন দৃষ্টি, তার চিন্তাধারা এবং সংস্কৃতির সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য হল ঐক্যের ভাব, সামঞ্জস্য এবং সম্পূর্ণতা। এই সংস্কৃতি চর্চার মাধ্যমে ভারত বিশ্বকে বার্তা দেয়। ভারতের একাত্মতা স্বাভাবিক। তাই বিরোধমুক্ত, সর্বজনীন, চিরন্তন, যুক্তিভিত্তিক এবং বৈজ্ঞানিক সত্যের উপর প্রতিষ্ঠিত সম্প্রীতি যেন অটুট থাকে। এদেশে বৈচিত্র্যর মধ্যেও ঐক্যের প্রকাশ ঘটে। বৈচিত্র্য মানে পার্থক্যের প্রকাশ নয়। ঐক্য প্রতিষ্ঠার জন্য সকলকে একইরকম হতে হবে না। যদি কেউ সকলকে একইরকম হতে বাধ্য করে তখন বিরোধ এবং বৈষম্যের আশঙ্কা দেখা দেয়। আমাদের একে অপরের মধ্যে আপাতদৃষ্টির পার্থক্য বুঝতে এবং সম্মান করতে হবে। একটি ঐক্যবদ্ধ সমাজ গঠনের জন্য সবাইকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। নানারকম স্বার্থান্বেষী শক্তি, সংগঠন এবং ব্যক্তি নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য সমাজের বিভিন্ন অংশের মানুষের মধ্যে বিভ্রান্তি বা সংঘাত সৃষ্টি করে। এরা দেশের বাইরে থেকেও সক্রিয় থাকে। সমাজ সজাগ, সুসংগঠিত এবং শক্তিশালী হলে অপশক্তিকে পরাজিত করা সম্ভব। সমাজের প্রতিটি স্তরের মধ্যে নিরন্তর এবং স্বচ্ছ সম্পর্ক বজায় রাখার সূত্রগুলি উন্নত করতে হবে। একটি মুক্ত ও গণতান্ত্রিক দেশে, নাগরিকদের নিজেদের জন্য তাদের প্রতিনিধি বাছাই ও নির্বাচন করার অধিকার রয়েছে। আর নির্বাচিত প্রতিনিধিদের উচিত, তাঁদের সামর্থ্য ও বিচক্ষণতার সর্বাধিক প্রয়োগ করে দেশের সার্বিক স্বার্থে কাজ করা। দলীয় আদর্শের ঊর্ধ্বে উঠে জাতীয় স্বার্থকে প্রাধান্য দেওয়া উচিত। তাদের অবশ্যই আইন, সংবিধান, নাগরিক শৃঙ্খলা সম্পর্কে সাধারণ বোধ রাখতে হবে। একটি সফল গণতন্ত্রের জন্য এটা জরুরি। তবে সম্প্রতি এসব গুণাবলির কিছু অবনতি ঘটেছে। আমরা সবাই দেখছি, কীভাবে স্রেফ রাজনৈতিক চমক ও ছলচাতুরির কারণে সমাজে ভাঙন বা অবক্ষয় ঘটছে। মানুষের মধ্যে উত্তেজনার সময়, নিজের বীরত্ব প্রমাণ করার জন্য লাগামহীন বক্তব্য রাখাও (যা এখন সোশ্যাল মিডিয়াতে একটি সাধারণ নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে) এই ভাঙন সৃষ্টির একটি বড় কারণ। ফলে রাজনীতি দেশের স্বার্থের থেকে দলের স্বার্থে বেশি পরিচালিত হচ্ছে। তারপর একমাত্র কাজ হচ্ছে অন্যদের হেয় প্রতিপন্ন করা। নেতৃত্বসহ আমাদের প্রত্যেকের উচিত এ ধরনের আচরণ থেকে দূরে সরে নাগরিক-শৃঙ্খলা বজায় রাখা। আইনের শাসন মানতে হবে এবং সমাজে সমুন্নত পরিবেশ তৈরি করতে হবে।
‘স্বাধীনতার অমৃত মহোৎসব’ উদযাপনের এই শুভক্ষণ আমরা অনেক ত্যাগ ও কষ্টের বিনিময়ে অর্জন করেছি। ভারতকে তার গৌরবের শিখরে প্রতিষ্ঠার জন্য আমাদের একইভাবে নিষ্ঠার সঙ্গে কঠোর পরিশ্রম করে যেতে হবে। আসুন, উদ্যম, দৃঢ়তা এবং সংকল্পের সঙ্গে এই যাত্রাকে ত্বরান্বিত করি আমরা।
লেখক ড. মোহনরাও ভাগবত, রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের প্রধান