দেবী মাহাত্ম্যে আমরা জানতে পারি সকল দেবতার মিলিত তেজ ও শক্তিতে গড়ে উঠেছিল দেবী দুর্গার অবয়ব এবং আয়ূধ। এরই মধ্যে দেখা যায়, সূর্যদেব তাঁর নিজের শরীরের প্রচণ্ড কিরণ দেবীর লোমকূপে কূপে ঢেলে দিয়েছিলেন। তাই দেবী হয়ে উঠেছিলেন তীব্র জ্যোতির্ময়ী। অসুর সেই প্রখর আলোর দিকে তাকালে চোখ ধাঁধিয়ে যাবে তার। অশুভ শক্তির আগ্রাসন ওখানেই অর্ধেক আটকে পড়বে।
এভাবেই যদি ভারতের গ্রামে গ্রামে সজ্জন শক্তি জেগে ওঠে, তাদের প্রতিটি লোমকূপে জাগে ভারত ভক্তি, তবে বিশ্বের এমন কোনো অধর্ম-শক্তি নেই যে, ভারতবর্ষকে দুর্বল করার চ্যালেঞ্জ জানাতে পারে। তখনই বিশ্বগুরুর আসনে বসবে ভারত। ৫ ই অক্টোবর, বিজয়া দশমী উপলক্ষে সঙ্ঘের প্রতিষ্ঠা দিবসে ভারতের জনগণের জন্য একটি অর্থবহ বার্তা দিয়েছেন রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের পরম পূজনীয় সরসঙ্ঘচালক ডা. শ্রী মোহন জী ভাগবত। বক্তৃতায় তিনি বলেন “গ্রামে গ্রামে সজ্জন শক্তি। প্রতি লোমকূপে ভারত ভক্তি” — এটাই হবে বিজয়ার মহামন্ত্র।
স্বাধীনতার পর ৭৫ বছর পূর্ণ হয়েছে। ১৯৪৭ সালের ১৫ ই আগষ্ট প্রথম স্বাধীনতা দিবসে ঋষি অরবিন্দ যে পাঁচটি স্বপ্নের কথা বলেছিলেন সেখানে যথার্থ স্বাধীনতা ও ঐক্যের ভাবনা ছিল, ছিল অখণ্ড ভারত গঠনের কথা৷ সেই সঙ্গে ছিল কর্তব্যের আহ্বান। ভাগবতজী সেই কর্তব্যের দিকটি তাঁর ভাষণে এদিন পুনরায় স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন।
“রাষ্ট্রের ইতিহাসে এমন একটি সময় আসে যখন ভাগ্য তার সামনে একটিই কাজ, একটিই লক্ষ্য রাখে, যার জন্য অন্য সবকিছু, তা সে যতই উন্নত বা উদাত্ত হোক না কেন, সবকিছুই সমর্পণ করতে হয়। আমাদের মাতৃভূমির জন্য এখন এমন এক সময় এসেছে, যখন তাঁর সেবার চেয়ে প্রিয় আর কিছুই নেই। যখন অন্য সব কিছু তাঁরই জন্য সম্পাদন করতে হয়। আপনি যদি অধ্যয়ন করেন, তবে তাঁরই জন্য অধ্যয়ন করুন। আপনার দেহ, মন, আত্মাকে তাঁর সেবা করার জন্য প্রশিক্ষণ দিন। দেশের জন্য বাঁচার জন্য নিজের জীবিকা অর্জন করুন। আপনি সমুদ্র পেরিয়ে বিদেশে যাবেন, যাতে সেখান থেকে অর্জিত জ্ঞানের মাধ্যমে তাঁর সেবা করতে পারেন৷ তাঁর গৌরবের জন্য কাজ করুন। তিনি যাতে আনন্দে থাকেন, তার জন্য আপনি দুঃখ সহ্য করুন৷”
ভাগবতজী এদিন বলেছেন, পবিত্রতা রক্ষার জন্য এবং শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্যই শক্তির আশ্রয় অপরিহার্য হয়ে পড়ে। আর শক্তিস্বরূপা জগজ্জননীই মঙ্গলকারী সংকল্পের সফলতার আধার। যখন একটা রাষ্ট্রের নবোত্থান হয়, তখন সেখানে সমাজিক সংহতি প্রয়োজন পড়ে। ভারতবর্ষের এখন সেই অবস্থা। এই সংহতিতে মাতৃশক্তির জাগরণ হওয়া জরুরি, সশক্তীকরণ জরুরি। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে এদিনের কার্যক্রমে নাগপুরের সঙ্ঘ সদর দপ্তরে প্রধান অতিথি রূপে উপস্থিত ছিলেন শ্রীমতী সন্তোষ যাদব যিনি হিমালয়ের গৌরীশঙ্করের উচ্চতাকে পায়ে হেঁটে দু’বার অতিক্রম করেছেন।
ভাগবতজী বলেন, ভারতের সাধারণ মানুষ এই মুহূর্তে অনুভব করতে পারছে রাষ্ট্রীয় নবোত্থানের প্রক্রিয়া চলছে। ভারতে প্রতিনিয়ত বৃদ্ধি পাচ্ছে সামরিক শক্তি, শীল বা কৌলিন্য এবং জাগতিক প্রতিপত্তি বা পণ্য উৎপাদন। ভারতের সরকার এখন স্বাবলম্বী হতে চায় ব’লেই গ্রহণ করেছে স্বনির্ভরতার নীতি। তাই নীতিগ্রহণকারীরা পুরস্কৃত হচ্ছেন। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে ভারতের গুরুত্ব বেড়েছে, বেড়েছে ভারত সম্পর্কে বিশ্বাস এবং আস্থা। নবজাগরণের একটি প্রক্রিয়া শুরু হয়ে গেছে। অবশ্য তার কিছু বাধাও আছে।
ভাগবতজী বলেন, গতানুগতিকতা সবচেয়ে বড় বাধা। তাই ঐতিহ্য ও সমকালের সমন্বয় দরকার। চিরন্তন শাশ্বত মূল্যবোধের মধ্যে নতুন এবং যুগোপযোগী, দেশানুকূল ঐতিহ্য তৈরি করে নিতে হবে।
দ্বিতীয় বাধা হচ্ছে অপশক্তির বাধা, যারা ভারতবর্ষের এই ঐক্য এবং সংহতি চায় না। তারা চারিদিকে বিভ্রান্তি ছড়িয়ে বেড়ায়, তারা সন্ত্রাসমূলক কাজকর্ম করে, বিভেদ বাড়িয়ে নৈরাজ্য স্থাপন করে। তাদের প্ররোচনায় কখনোই পা দেওয়া উচিত নয়। তাদের এবং তাদের মোহ পরিত্যাগ করতে হবে। তাদের কঠোরভাবে প্রতিরোধ ও প্রতিকার করতে হবে। সরকার যখন এদের নিয়ন্ত্রণ করছে, আমাদের উচিত সরকারের সহায়ক শক্তি হয়ে ওঠা৷
এই মুহূর্তে সমাজ জাগরণের কাজে অধিক গুরুত্ব অর্পণ করেছেন ভাগবতজী। কারণ বিশ্বের যাবতীয় মহতী এবং টেঁকসই পরিবর্তন সম্ভব হয়েছে সমাজ জেগেছে বলেই। তারপরই সমাজে সেই মোতাবেক ব্যবস্থাপনা এবং সিস্টেম চালু হয়। মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষার প্রসার বিষয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের নীতি, মনোযোগ এবং কৃত্য সম্পর্কে সন্তোষ প্রকাশ করেন তিনি। বলেন নতুন শিক্ষানীতির ফলে সমাজে ভাল মানুষ তৈরি হবে। দেশপ্রেম জাগবে, সুসংস্কারযুক্ত মানুষ উঠে আসবে।
উন্নত মানের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার প্রস্তাব করেছেন তিনি। কম খরচে উত্তম মানের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা অবশ্যই হওয়া দরকার। তা যেন হয় সার্বজনীন, সহজলভ্য এবং বাণিজ্যিক মানসিকতা মুক্ত। বিবিধ চিকিৎসা পদ্ধতির সমন্বয়ের বার্তাও তিনি দিয়েছেন। স্বাস্থ্য ব্যবস্থার সঙ্গে পরিচ্ছন্নতা চাই, সেটিও যাতে ঠিকভাবে পরিচালিত হয়, তার প্রস্তাব রাখেন তিনি। উল্লেখ করেছেন যোগ ও ব্যায়ামের উদ্যোগ সম্পর্কে।
তিনি বলেন, সংবিধান অনুযায়ী রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সাম্যের পথ দেখানো হলেও প্রয়োজন হচ্ছে সামাজিক সাম্যের। সেই সাম্য না এলে কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তন আসে না, সেই পরিবর্তন দীর্ঘস্থায়ীও হয় না। সবমিলিয়ে পরিবর্তনের অপরিহার্য শর্ত হল সদর্থক সামাজিক মানসিকতা তৈরি করানো৷ এরজন্য ভিত্তিভূমি দরকার। এই ভূমি হল শোষণমুক্ত আদর্শ এবং ভোগমুক্ত উন্নয়ন। ব্যক্তি জীবন থেকেই যদি ভোগ ও শোষণের ইচ্ছে দূর হয়, তবেই সামাজিক শোষণের অপনোদন হবে।
দেশে বিপুল জনসংখ্যার কর্মসংস্থানের প্রেক্ষিতে বলতে গিয়ে তিনি বলেন, রোজগার বলতে আমরা যেন কেবলমাত্র চাকরির কথা না মনে করি। কায়িকশ্রম, পুঁজি এবং মেধাগত শ্রম, সবেরই এক গুরুত্বপূর্ণ দিক আছে৷ ব্যক্তিগত উদ্যোগের প্রবণতা বাড়ানোর কথা বলেছেন, তাতেও হয় কর্মসংস্থান।
সন্তানের সংখ্যা কী হবে, সে বিষয়ে তিনি বলেন, জনসংখ্যা পরিবেশকে প্রভাবিত করে৷ তাই জনসংখ্যা সম্পর্কিত নীতি প্রণয়ন করতে হবে সামগ্রিক ও সমন্বিত ভাবে। এরজন্য জনসচেতনতা দরকার। এর সঙ্গেই জড়িত আছে মায়ের স্বাস্থ্য, আর্থিক ক্ষমতা, শিক্ষা, নিজের ইচ্ছে প্রভৃতি। সবার জন্যই এই নীতি যাতে সমানভাবে প্রয়োগ করা হয়, তা দেখা দরকার।
গণতান্ত্রিক পরিবেশে জনগণের সহযোগিতার গুরুত্ব অসীম। দেশের স্বার্থে এবং দুর্বল মানুষের স্বার্থে আত্মত্যাগের কথা বলেছেন ভাগবতজী। একেই তিনি ব্যাখ্যা করেছেন — ‘স্ব’-এর বোধ ও গৌরব বলে। বলেছেন এই ‘স্ব’ দিয়েই সমাজ ও রাষ্ট্রের সকল কিছুকে সংযুক্ত করা যায়৷ ঐতিহ্য থেকে এটাই আমাদের প্রাপ্ত সত্য। সেই সঙ্গে দেশের সমস্ত বৈচিত্র্য সুরক্ষার কথা ভাবতে হবে। জীবনের যাবতীয় সমন্বয়, আলাপ-আলোচনায় সম্প্রীতি বাড়াতে হবে। বলেছেন ‘বসুধৈব কুটুম্বকম্’-এর কথা ‘বিশ্বম্ ভবত্যেকনীড়ম’-এর কথা।
কল্যাণ গৌতম