নেশন বোধে উদ্দীপ্ত করেছেন ভাগবত

রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘আত্মশক্তি’ পর্যায়ের নিবন্ধে লিখেছেন, ‘অতীতে সকলে মিলিয়া ত্যাগ দুঃখ স্বীকার এবং পুনর্বার সেইজন্য সকলে মিলিয়া প্রস্তুত থাকিবার ভাব হইতে জনসাধারণকে যে একটি একাভূত নিবিড় অভিব্যাক্তি দান করে তাহাই নেশন। ইহার পশ্চাতে একটি অতীত আছে বটে, কিন্তু তাহার প্রত্যক্ষগম্য লক্ষণটি বর্তমানে পাওয়া যায়। তাহা আর কিছু নহে— সাধারণ সন্মতি, সকলে মিলিয়া একত্রে জীবন বহন করিবার সুস্পষ্ট পরিব্যক্ত ইচ্ছা।’ ওই নিবন্ধেরই আরও একটি অংশে রবীন্দ্রনাথ লিখেছন— ‘নেশন একটি সজীব সত্তা, একটি মানস পদার্থ।

দুইটি জিনিস এই পদার্থের অন্তঃ প্রকৃতি গঠিত করিয়াছে। সেই দুটি জিনিস বস্তুত একই। তাহার মধ্যে একটি অতীতে অবস্থিত, আর একটি বর্তমানে। একটি হইতেছে সর্বসাধারণের প্রাচীন স্মৃতি সম্পদ, আর একটি পরস্পর সম্মতি, একত্রের বাস করিবার ইচ্ছা—- যে অখণ্ড উত্তরাধিকার হস্তগত হইয়াছে তাহাকে উপযুক্ত ভাবে রক্ষা করিবার ইচ্ছা। মানুষ উপস্থিত মত নিজেকে হাতে হাতে তৈরি করে না। নেশনও সেইরূপ সুদীর্ঘ অতীত কালের প্রয়াস, ত্যাগস্বীকার এবং নিষ্ঠা হইতে অভিব্যক্ত হইতে থাকে।’

রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের প্রতিষ্ঠাতা ডা. কেশব বলীরাম হেডগেওয়ারের বক্তব্যেও দেখতে পাই, শুধুমাত্র একটি ভূমিখন্ডকে তিনি ‘নেশন’ বলে মনে করছেন না। তিনি মনে করছেন একই সাংস্কৃতিক ধারায় লালিত, পারস্পরিক শ্রদ্ধা, সহানুভূতি, ঐক্য বোধ এবং স্বার্থত্যাগের ইচ্ছা সংবলিত এক নাগরিক গোষ্ঠীই প্রকৃত নেশনের জন্মদাতা। ‘নেশনে’ র ভাবনায় রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে হেডগেওয়ারের আশ্চর্যরকম মিল।

‘আত্মশক্তি’ পর্যায়ের নিবন্ধগুলি পাঠ করলে এও দেখি, রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, ‘মানুষ জাতির, ভাষার ধর্মমতের বা নদীপর্বতের দাস নহে। অনেকগুলি সংযতমনা ও ভাবোত্তপ্ত হৃদয় মনুষ্যর মহাসংঘ যে একটি সচেতন চরিত্র সৃজন করে তাহাই নেশন। ‘ দুঃখের এই যে, রবীন্দ্রনাথ এবং হেডগেওয়ারের মত ব্যক্তিত্বরা বারবার এই নেশন গঠনের ওপর জোর দিলেও স্বাধীনতার সাত দশক পরেও ভারতবর্ষকে একটি ‘নেশন’ হিসাবে গড়ে তুলতে সম্পূর্ণ সফল বোধ করি আমরা হতে পরলাম না। ‘সংযতমনা ও ভাবোত্তপ্ত হৃদয় মনুষ্যের মহাসংঘ’ গড়ে উঠল না ভারতবর্ষে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তরকালে ইউরোপ যা পেরেছিল, জাপান যা পেরেছিল, এমনকী পরবর্তীতে ইজরায়েল যা পেরেছে, তা আমরা পারিনি— এ স্বীকার করতেই হবে। আমাদের নেশন ভাবনা কোথায় যেন সেই মানচিত্রের পরিসরের মধ্যেই বারবার সীমাবদ্ধ হয়ে রয়েছে।

সম্প্রতি অক্ষয় তৃতীয়ার দিন রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের সর সংঘচালক মোহন ভাগবত তাঁর ভাষণে এই ‘নেশন’ গড়ার আহ্বানটিই আবার জানিয়েছেন। কেউ যদি ভেবে থাকেন, তাঁর এই ভাষণটি শুধুমাত্র রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের স্বয়ংসেবকদের প্রতিই, তাহলে সেই ভাবনাটি ভুল ভাবনা হবে। তাঁর বক্তব্যে, ভাগবত স্বয়ংসেবকদের উদ্দেশ্যে এই সংকটকালে তাঁদের কী কর্তব্য হবে তা স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন ঠিকই। কিন্তু সমগ্র নাগরিক সমাজের কাছে তিনি একটি বার্তা দিতে চেয়েছেন। কী সেই বার্তাটি? এটি সেই বার্তা যেটি অতীতে রবীন্দ্রনাথ দিয়েছেন, হেডগেওয়ার দিয়েছেন। অর্থাৎ ‘সকলে মিলিয়া ত্যাগ দুঃখ স্বীকার’ এবং ‘একীভূত নিবিড় অভিব্যক্তি’ লাভ করবার বার্তা’। ভাগবত তাঁর বক্তব্যে এও স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন, সংকটের মুহূর্তে একীভূত ভাবে সকলে মিলে ত্যাগ দুঃখ স্বীকার এবং পরস্পরের সাহায্যে হওয়াই নেশন গঠনের কাজকে তরান্বিত করে।

ভাগবত তাঁর ভাষণে বারবার ১৩০ কোটি ভারতবাসীর কথা বলেছেন। বলেছেন, এই ১৩০ কোটি ভারতবাসী আমাদের ভাইবোন। এই ভারতবাসীকে তিনি হিন্দু, মুসলমান, শিখ, জৈন বা বাঙালি, বিহারি, গুজরাতিতে ভাগ করেননি। ১৩০ কোটি ভারতবাসীকেই একীভূত হওয়ার বার্তাটিই তিনি দিয়েছেন। পালঘরে হিন্দু সন্ন্যাসী হত্যায় নিন্দা এবং দুঃখজনক ঘটনাটি অবশ্যই এসেছে তাঁর বক্তব্যে। কিন্তু সেই ঘটনার উল্লেখ করে কখনই উগ্র হিন্দুত্ববাদীদের সুরও চড়ান নি ভাগবত। বরং, সংকটের সংযত থাকতে বলেছেন। প্রতিবাদের প্রতীকি ভাষা ব্যক্ত করেছেন, আইন ভঙ্গ করার কথা বলেননি। অত্যুৎসাহী কিছু হিন্দুত্ববাদীর অতি উগ্র আচরণ যে সংকটের সময় দেশকে আরও নতুন সমস্যার সম্মুখীন করতে পারে, তা উপলব্ধি করেই দায়িত্ববান স্টেটসম্যানের মতোই নিজের হাতে রাশ টেনেছেন তিনি।

রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ যে কোনও রাজনৈতিক সংগঠন নয়। ভাগবত বারবার মনে করিয়ে দিয়েছেন সে কথা। রাজনৈতিক সংগঠনের ক্ষেত্রে যেমন প্রচার আবশ্যিকতার পর্যায়ে পড়ে, সংঘের কাছে যে তা একেবারেই অনভিপ্রেত—- সে কথাও স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। সংঘের জন্ম জাতি গঠনের জন্য, নেশন গড়ে তোলার লক্ষ্যে। সমাজের জন্য সেবা কর্মটি তার আবশ্যিক এবং দৈনন্দিন কর্ম — সেটি মনে করিয়ে দিয়ে ভাগবত বলেছেন, এই সংকটের সময়ও সংঘ তার সেবাকর্ম থেকে বিরত থাকতে পারে না। ফলে, ১৩০ কোটি ভারতবাসীর পাশে, জাতি ধর্ম বর্ণ বিচার না করেই, এই সংকটের মুহূর্তে স্বয়ংসেবকদের দাঁড়াতে হবে। এরই পাশাপাশি প্রচারের ঝোঁক ত্যাগ করতে হবে। আত্মপ্রচারের জন্য সেবাকার্য নয়, সেবার জন্যই সেবা— এই বোধ নিয়ে কাজ করতে হবে।

দীর্ঘকাল ধরে সংকটের সময় সংঘের স্বয়ংসেবকদের নিরলস এবং প্রচারবিমুখ সেবাকর্মেরও উদাহরণ দিয়েছেন ভাগবত তাঁর ভাষণে। ‘৬২ সালের ভারত চিন যুদ্ধ বা ‘৬৫ সালে ভারত পাকিস্তান যুদ্ধের সময় স্বয়ংসেবকদের ভূমিকার উল্লেখ করেছেন তিনি। ভারতের জনজাতি, বনবাসী, আদিবাসী এবং পিছিয়ে পড়া সমাজের ভেতর সংঘের সেবা এবং উন্নয়ন কার্যের কথাও উল্লেখ করেছেন ভাগবত। সংঘের সেবাকার্যের আরও অনেক নিদর্শনই তিনি দিতে পারতেন। দেননি। দিলে সেটি শোভন হত না। কেননা, বিগত ন’টি দশকে সংঘ প্রচারের মোহবাদ দিয়েই তার সেবাকর্যের ধারাটি অক্ষুন্ন রেখেছে।

ভাগবতের এই ভাষণটি কেন গুরুত্বপূর্ণ এবং কেন ব্যতিক্রমী? আমি এক্ষেত্রে আমার ব্যক্তিগত একটি অভিজ্ঞতা উল্লেখ করি। অক্ষয় তৃতীয়ার দিন সন্ধ্যেবেলা আমার লন্ডন নিবাসী এক বন্ধুর সঙ্গে টেলিফোনে কথাবার্তা হচ্ছিল। তিনি ইউটিউবে ভাগবতের ভাষণটি শুনছিলেন। আমাদের কথাবার্তার মূল বিষয়টিই ছিল ভাগবতের অক্ষয় তৃতীয়ার ভাষণ। আমার এই বন্ধুটিকে কখনই সংঘ পরিবার বা বিজেপির সমর্থক বলা যাবে না। বরং তিনি কোনও কোনও ক্ষেত্রে সংঘ পরিবারের কড়া সমালোচক। কিন্তু অক্ষয় তৃতীয়ার দিন ভাগবতের ভাষণ শোনার পর তিনি আমাকে টেলিফোনে বলেছিলেন, ‘রাজনীতির অনেক উর্ধ্বে উঠে গিয়ে সমগ্র দেশের জন্য ভাবনা এই ভাষণটিতে পরিস্ফুটিত হয়েছে।’
ভাগবতের অক্ষয় তৃতীয়ার ভাষণটি একারণেই গুরুত্বপূর্ণ যে, এটি শুধু স্বয়ংসেবকদের জন্য ছিল না। শুধুমাত্র কোনও ধর্মীয় গোষ্ঠী, কোনও জাতি গোষ্ঠী বা কোনও বর্ণের মানুষের জন্য সীমাবদ্ধ ছিল না। ওই ভাষণটি শুধুমাত্র বিজেপি কংগ্রেস বামপন্থীদের জন্য ছিল না। প্রকৃতঅর্থেই ওই ভাষণটি ছিল ১৩০ কোটি ভারতবাসীর জন্য। সমস্ত সংকীর্ণতাকে অগ্রাহ্য করে ১৩০ কোটি ভারতবাসীকে একীভূত করার আহ্বান জানানোর জন্য ভাগবত একজন স্টেটসম্যান হিসেবেই বিবেচিত হবেন।

লেখাটা শেষ করার আগে ছোট্ট একটি পরিসংখ্যান তুলে দিই। পরিসংখ্যানটি বিগত ২৪ এপ্রিল পর্যন্ত সমগ্র দেশে করোনা সেবাকার্যে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের কাজের একটি পরিসংখ্যান। ওই সময়ের ভেতর সারা দেশে ৫৫ হাজার ৭২৫টি স্থানে সংঘ সেবাকার্য সংঘটিত করেছে। ৩ লক্ষ ৮০৯ জন স্বয়ংসেবক এসেবা কার্যে নিযুক্ত রয়েছেন। সারাদেশে ওই সময়ের ভিতর ৩৩ লক্ষ ৭৫ হাজার ৬৬৪ পরিবারকে রেশন সামগ্রী পৌঁছে দেওয়া হয়েছে। ওই সময়ের ভেতর রান্না করা খাবার দেওয়া হয়েছে ২ কোটি ১৬ লক্ষ ৮২ হাজার ৫৪০ জনকে। বিভিন্ন উপায়ে ৩ লক্ষ ৭৬ হাজার ২৩৪ জন পরিযায়ী শ্রমিককে সাহায্য করা হয়েছে। রক্তদান শিবির সংগঠিত হয়েছে ১৩ হাজার ৫৬২।
উল্লেখ্য, এই পরিসংখ্যানের ভিতর সংঘের শাখা এবং সহযোগী সংগঠনগুলোর সেবাকার্য ধরা হয়নি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.