বন্দীশালার অগ্নিবীর

আমি আছি মানুষের মাঝখানে,ভালবাসি আমি মানুষকে
ভালবাসি আন্দোলন,
ভালবাসি চিন্তা করতে,
আমার সংগ্রামকে আমি ভালবাসি
আমার সংগ্রামের অন্তস্থলে মানুষের আসনে 

ছোটবেলা থেকেই ভগৎ চোখের সামনে দেখছিলেন ব্রিটিশদের কবলে তাঁর দেশটা কিভাবে শোষিত হয়ে চলেছে ক্রমাগত।

 শোনা যায়, মাত্র ৪বছর বয়েসে ভগৎ সিং নাকি একবার বিখ্যাত কংগ্রেস কর্মী মেহতা আনন্দ কিশোরকে বলেছিলেন, ‘…মাঠে রাইফেল পুঁতে বিশাল এক রাইফেলগাছতৈরী করে ব্রিটিশদের এই দেশ থেকে ভাগিয়ে দেব!

 তাঁর বাড়িতে মহান বিপ্লবীদের আনাগোনা ছিল নিত্তনৈমিত্তিক ব্যাপার। আসলে ভগৎ সিংয়ের বাবা অনেক দিন ধরেই নানান বিপ্লবী কাজকর্মের সঙ্গে যুক্ত,তাঁর তাই অগাধ অভিজ্ঞতা। তিনি বিখ্যাত গদর পার্টিকে পয়সা দিয়ে সাহায্য করতেন এবং সমর্থনও করতেন। ভাই অজিত সিংও গদর পার্টিরসাথে বেশ ভালোভাবেই যুক্ত ছিলেন। বিখ্যাত গদর বিপ্লবী শহীদ কর্তারসিং সারাভার পদধূলিও বঙ্গে গ্রামের ১০৫ নম্বর চকে পড়েছিল, তখন ভগৎসিং খুবই ছোট, কিন্তু পরে পূর্ণবিকশিত ভগৎ সিংয়ের জীবনের একমাত্রআদর্শ হয়ে ওঠেন তরুণ শহীদ কর্তার সিং সারাভা।

তখন মাত্র ১২। পড়ে ৭ম শ্রেণিতে। একদিন স্কুল ছুটির পর ছেলেটি বাসায় না ফিরে লাহোরে যায়। সেখান থেকে বাসে করে চলে যায় ৫০-৬০ কিলোমিটার দূরের জালিয়ানওয়ালা বাগে। সেখানে আগের দিন অর্থাৎ ১৩ এপ্রিল, ১৯১৯ ঘটেছিল নারকীয় হত্যাকাণ্ড। সেখানে গিয়ে অদ্ভুত এক কাজ করে ছেলেটি। সাথে নিয়ে যাওয়া বোতলে সেখানকার কিছু মাটি সংগ্রহ করে বাড়ির পথে রওনা দেয়। 

বিষণ্ণভাবে বেশ অনেকটা দেরি করেই ঘরে ফিরে সে। বোন ‘অমর কাউর’ খাওয়ার কথা বললে ছেলেটি উত্তর দেয়, “খাবারের কথা বোলো না আমাকে। এসো তোমাকে একটা পবিত্র জিনিস দেখাই।” এই বলে ছেলেটি সাথে করে নিয়ে আসা মাটি ভর্তি বোতল দেখিয়ে বলে, “দেখ, ইংরেজরা আমাদের কত মানুষকে হত্যা করেছে। দেখ, তাদেরই রক্ত-রাঙা মাটি। এ মাটি পবিত্র।” 



ছেলেটির নাম ভগৎ সিং, বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী সশস্ত্র সংগ্রামের অন্যতম বিপ্লবী। মাত্র ২৩ বছর বয়সে হাসতে হাসতে ফাঁসিতে ঝুলেছিলেন তিনি।

বৃটিশ সরকার বিপ্লবীদেরকে দমনের জন্য পুলিশকে অধিক ক্ষমতা প্রদান করে ভারত প্রতিরক্ষা আইন পাশ করার সমস্ত প্রক্রিয়া চুড়ান্ত করে। 

১৯২৯ সালের ৮ এপ্রিল সেন্ট্রাল লেজিসলেটিভ অ্যাসেম্বলিতে আইনটির অধ্যাদেশ পাশ হবার সিদ্ধান্ত হয়। এই আইনকে রুখে দেওয়ার জন্য ভগৎ সিং এর ‘হিন্দুস্থান সোসালিস্ট রিপাবলিকান এসোসিয়েশন’ প্রস্তুতি গ্রহণ করে। ১৯২৯ খ্রিস্টাব্দে ৮ই এপ্রিল ভগৎ সিং ও দলের অপর একজন সদস্য বটুকেশ্বর দত্ত দিল্লির আইন পরিষদে বোমা নিক্ষেপ করেন । এসময় পুলিশ তাঁদের গ্রেফতার করে।


মামলায় ভগৎ সিং ও বটুকেশ্বর দত্ত উভয়েই যাবজ্জীবন দ্বীপান্তরে দণ্ডিত হন। কিন্তু তাঁদের দু’জনকে পুলিশ ইনসপেক্টর স্যান্ডার্সকে হত্যা মামলায় অভিযুক্ত করা হয়। এই মামলায় যথেষ্ট প্রমাণের অভাবে বটুকেশ্বর দত্ত অব্যাহতি পান। 

কিন্তু ভগৎ সিং, সুখদেব ও রাজগুরুকে খুনের অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত করে জেলে পাঠানো হয়। জেলে বন্দী থাকাকালে ভগৎ সিং বৃটিশ ও ভারতীয় বন্দীদের সমানাধিকারের দাবিতে ৬৩ দিন অনশন করেন। সে সময় ভারতীয় বন্দীদের চেয়ে ব্রিটিশ চোর ও খুনিদের প্রতি অধিকতর ভাল আচরণ করা হত। ৬৩ দিন অনশনের ফলে ব্রিটিশ সরকার নতি স্বীকার করতে বাধ্য হয়।
.
ভগৎ সিং জেলে থাকার সময় ডায়রী লিখতেন। তিনি প্রচুর বই পড়তেন। বিপ্লব সম্পর্কে তাঁর মতামত তিনি লেখেন জেল ডায়েরিতে বলেন,“বিপ্লব মানে রক্তক্ষয়ী হানাহানি নয়। বিপ্লবের সঙ্গে ব্যাক্তিগতভাবে কোন প্রতিশোধ বা প্রতিহিংসা মেটাবারও সম্পর্ক নেই। বিপ্লবের অর্থ বোমা বা পিস্তলের চর্চাও বুঝায় না। ‘বিপ্লব’ হল বর্তমান সমাজ ব্যবস্থা, যা কিনা জ্বলন্তরূপে অন্যায়ের কাঠামোর উপরে দাঁড়িয়ে আছে, সেই ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন।”


১৯৩০ সালের ৭ অক্টোবর। তিন বৃটিশ বিচারকের সমন্বয়ে গঠিত এক বিশেষ ট্রাইব্যুনাল ভগৎ সিং, সুখদেব ও রাজগুরুকে অপরাধী সাব্যস্ত করে এবং ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার রায় প্রদান করে।

এই সময় জেলের অফিসারের ডাক এলো, সার্দারজি, ফাঁসি লাগানে কা হুকম আ গ্যায়া। আপ তৈয়ার হো যাইয়ে।” ভগৎ সিংয়ের ডান হাতে বইটা ছিল। বাঁ-হাতে অফিসারকে থামিয়ে দিয়ে তিনি বললেন, দাঁড়ান ,‘ থমকে দাঁড়ালেন অফিসার। কিছুটা পড়ার পর বইটা রেখে ভগৎ সিং তেজোদীপ্ত ভঙ্গিতে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বললেন, “চলুন”।

ফাঁসির মঞ্চে ভগৎ সিং, সুখদেব ও রাজগুরুর দৃপ্ত শ্লোগান – ” Down with British Imperialism. Up National Flag”
.
অবশেষে ১৯৩১ সালের ২৩ মার্চ সন্ধ্যা ৭ টায় এই তিন বিপ্লবীকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয় সবার অগোচরে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.