সমস্যাটি কি নতুন কিছু? না, কোনমতেই নয়। বরং একই সমস্যার বিভিন্ন রক্তাক্ত প্রকাশ। সবসময় যে দেহ রক্তাপ্লুত হবে তার কোন মানে নেই: অপমানে, বেদনায়, নিষ্ফল আক্রোশে হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হলেও তার রক্তাক্ত প্রকাশ থাকে।
‘৪৭এর দেশভাগ ও রাষ্ট্রীয় স্বাধীনতায় পুড়েছিল বাঙ্গালী, বাঙ্গালী হিন্দু ও সেইথেকে নিরবিচ্ছিন্ন আকারেই চলেছে ধ্বংসাবলী একনাগাড়ে। বস্তুত, ১৯৩৭-৩৯এ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের শ্রী – পদ্ম চিহ্ন শূন্যে বিলীন হওয়ার ফলে বাঙ্গালী সমাজে শ্রী আর ফিরে আসেনি। এবং তার প্রকোপে বাঙ্গালী হয়েছে ক্রমশ শ্রী-হীন, বিশ্রী ও কূশ্রী। কি পশ্চিমবঙ্গ, কি আসাম, কি উড়িষ্যা, কি ত্রিপুরা, কি উত্তর-পূর্ব ভারত, কি বিহার, কি ঝাড়খণ্ড, কি অন্যত্র – কি পার্শ্ববর্তী বাংলাদেশ – প্রত্যেক স্থানেই বাঙ্গালী হিন্দু লাঞ্ছিত, অপমানিত, নিষ্পেষিত ও ব্রাত্য।
কখনো ধর্ম, কখনো ভাষা, কখনো জাতিসত্তা – বাঙ্গালীর রেহাই নেই কোনখানেই। দেশভাগের পরে দিল্লির (নেহরু – নেতৃত্বাধীন) প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ হস্তক্ষেপে বৈমাতৃক আচরণের মাধ্যমে রদ করা হল পশ্চিমবঙ্গ ও পূর্ব ভারতে জনবিনিময়, ক্ষতিপূরণ ও এই অঞ্চলের শিল্প সম্ভাবনা চিরতরে নাশ করার জন্য আরোপিত হল মাশুল সমীকরণ নীতি। কিন্তু একই দেশভাগ-পীড়িত পাঞ্জাবের ক্ষেত্রে হল না অসুবিধা কিছু। কেন্দ্রীয় সরকারের প্রত্যক্ষ হস্তক্ষেপে খন্ডিত পাঞ্জাবের শুধুমাত্র পূর্ব শব্দটিই বাদ দেওয়া হল না, একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ রাজ্যরূপে গড়ে উঠতে সাহায্য করা হলো সম্পূর্ণরূপে। একই কারণ, একই রাজনৈতিক বৈশিষ্ট্য, একইভাবে ধর্মীয় কারণে বিভক্ত – একদিকে প্রতিষ্ঠা পেল দুধে ও শস্যে আপ্লুত এক গোষ্ঠী, অন্যত্র মানবেতর জীবনযাপনে বাধ্য আর এক জনগোষ্ঠী।
বিহারের প্রয়াত সমাজতান্ত্রিক নেতা শ্রী কর্পূরী ঠাকুরের আমলে ঠিক কটি বিদ্যালয় বলপূর্বক ও সহসা বাংলা থেকে হিন্দী মাধ্যমে পরিবর্তিত হতে বাধ্য হয়েছিল তা জানা আছে? আজ্ঞে, নেই: বাঙ্গালী অত তুচ্ছ বিষয় নিয়ে চিন্তা করে না। করে একমাত্র যখন তার নিজস্ব গৃহ দাউদাউ করে আগুনে জ্বলতে শুরু করে, এবং দ্রুতপায়ে পালাতে সেই চিন্তাও মিশে যায়। তাই উত্তরটি দেওয়া ভালো এই পরিপ্রেক্ষিতে.. বহু… too many to count.. কিন্তু তাতে ভারতবর্ষের বা বহির্বিশ্বের কারোর সুখনিদ্রায় কোন ব্যাঘাত ঘটেনি। সেই সময় এবং অন্য সময়েও বিহার/ঝাড়খণ্ডের বাঙ্গালীরা পশ্চিমবঙ্গ সরকারের সাহায্য চাইলে এ রাজ্যের গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্র ও বামপন্থায় উদ্ভাসিত নেতৃত্বের universalism ত্যাগ করে শুধুমাত্র বাঙ্গালীকে সাহায্য করা blasphemy মনে হয়েছে। ‘৮০র দশকে ত্রিপুরা, আসামে রক্তাক্ত বঙাল খেদা, উত্তর পূর্ব ভারতে বাঙ্গালীর গণহত্যা – এমনকী আজ যখন ত্রিপুরা রাজ্যে বাঙ্গালীরা পুনরায় আক্রমণের শিকার হচ্ছে, একই নিস্তবদ্ধতাই লক্ষ্য করা গেছে।
অতএব, এই প্রকারের জঘন্য বাঙ্গালী-বিরোধী মনোবৃত্তি নতুন কিছু নয়…. old wine in a new bottle altogether… এবং এইরকমই চলবে। প্রশ্ন ওঠে – South-east Asia র একই অঞ্চলে বারংবার এ হয় কেন? উত্তরটি খুবই সোজা – বাঙ্গালী হিন্দু সামর্থ্যহীন, তাই সকল রাজনৈতিক মত ও পথ, ধর্মীয় – ভাষাগত জনগোষ্ঠী তাকে বেজন্মা সাব্যস্ত করে। ভারতীয় উপমহাদেশের পূর্ব প্রান্তে তার উপস্থিতি প্রবল, তবুও একটি নির্দিষ্ট শক্তিরূপে গড়ে ওঠে না সে।
যজ্ঞাগ্নিকে প্রজ্জ্বলিত করতে প্রচন্ড হাওয়ার প্রয়োজন, যে হাওয়া একটি ক্ষীণ প্রদীপকে নির্বাপিত করতে সক্ষম হয় প্রথম দর্শনেই। শক্তিই একমাত্র আধার, তার বিনা সকলই আঁধার। এই সরল প্রাকৃতিক সত্যটি বুঝতে ব্যর্থ হয়ে বাঙ্গালী যে স্তরে এসে উপস্থিত হয়েছে এতদিনে – তাতে পথ খোলা আছে একটিমাত্র – হয় সম্পূর্ণ মরণ নয় সম্পূর্ণ জাগরণ।
অনিমিত্র চক্রবর্তী