আজ ভাদ্রের শুক্লা অষ্টমী (এ বছর আশ্বিন মাসে তিথিটি পড়েছে), আজ রাধাষ্টমী। শাস্ত্রীয় অনুষ্ঠান হলেও, তার শিকড়ে রয়েছে লোকায়তিক সংস্কৃতি, বৃহত্তর লোকচারণা। ভারতের নানান প্রান্তে গো-কেন্দ্রিক, গো-আধারিত, গো-পালক সমাজে যে বহুবিচিত্র লোকানুষ্ঠান উৎযাপিত হয়, তার সঙ্গে যুক্ত হয়ে আছে শাস্ত্রীয় আচার-অনুষ্ঠান। শাস্ত্রীয় ও লৌকিক — সব মিলেমিশেই এক সমন্বিত রূপ পরিগ্রহ করেছে ভারতীয় সংস্কৃতি। পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণ-পশ্চিম সীমান্তের জনপ্রিয় ‘বাঁদনা পরব’, জঙ্গল মহলের ‘সোহরী’, ওঁরাও-মুণ্ডা-বিরহর-কোরোয়া-অসুর জনজাতির ‘সোহরাই’ প্রভৃতি একই লক্ষ্যে রচিত সাংস্কৃতিক পালপার্বণ। গোপাষ্টমী, গোষ্ঠাষ্টমীও সেই বৃহত্তর বৃত্তেরই অমল সংস্কৃতি, এক অনবদ্য উত্তরাধিকার। গোপালিকা নারীশক্তিকে দেবীজ্ঞানে শ্রদ্ধা করবার একটি তিথি। এদিন রাধাজয়ন্তী। এদিন ননী-ছানার দেশে কন্যাসন্তানকে যত্ন করা হবে৷ যত্ন নেওয়া হবে গাই গরুকেও।
গাইকে যত্ন করেছে রাধার মতো গোপীসমাজ। সারা বছর মাঠে মাঠে ফসলের জন্য খেটেছে গাই-বলদও। সম্বৎসর গাই আর গোপীদের শ্রমে কৃষিফসলে গোলা উঠেছে ভরে, দুধের শ্বেতবিপ্লব। যাদের জন্য পাওয়া গেছে পুষ্টিকর দুধ, গোবর সার, জ্বালানি ঘুঁটে — আজ তাদেরই যত্ন করবার দিন। মাতৃশক্তি গোপালিকাদের দিন। ধানের পরই গো-সম্পদের কদর! গরুকে নিয়েই চিরন্তন ভারতবাসীর চিরকালের উৎসাহ! গরুকে অন্তর দিয়ে ভালোবেসেছে নারীসমাজ। লোকসাহিত্য থেকে শিষ্টসাহিত্য সর্বত্র তার অনুরণন। লৌকিক ছড়ায়, “ধান ধন বড় ধন/আর ধন গাই।/সোনারূপা কিছু কিছু/আর সব ছাই।” সবচেয়ে বড় ধন কন্যাশক্তি।
“গোষ্ঠাষ্টম্যাং গবাং পূজাং গোগ্রাসং গোপ্রদক্ষিণম্।
গবানুগমনং কুর্য্যাৎ সঠবপাপবিমুক্তয়ে।।”
কেবল শ্রীরাধিকার পূজা সম্পন্ন হবে তাই নয়, গো-পূজন হবে, গোগ্রাসদান হবে, গোপ্রদক্ষিণ করে সারা বছরের কাজের স্বীকৃতি স্বরূপ ধন্যবাদ জ্ঞাপন করাও হবে। গবানুগমন গোশালায় সযত্নে রাখা হবে গরু। এতে মহাপুণ্যের অংশীদার হওয়া যায় এবং সর্বপাপ দূর হয়।
এ সেই গ্রাম-ভারত, ননী-ছানার গাঁ, যেখানে ঘরে ঘরে দধি-মন্থ-ধ্বনি ওঠে। মাঠের পথে ধেনু চলে গো-খুর-রেণু উড়িয়ে। আঙিনাতে বধূ দুগ্ধ দোহন করে, ঘাটে গোপাঙ্গনা, কুঞ্জবনে নৃত্যরত ময়ূর। সেই চিরন্তন ব্রজের গোপবালিকা হতে কে না চায়! সমৃদ্ধ অর্থনীতির প্রতীক গো-কেন্দ্রিক কৃষি।
“ওঁ নমো গোভ্যঃ শ্রীমতীভ্যঃ সৌরভেয়ীভ্য এব চ।
নমো ব্রহ্মসুতাভ্যশ্চ পবিত্রাভ্যো নমো নমঃ।।”
লিখলেন ড. কল্যাণ চক্রবর্তী এবং শ্রী অরিত্র ঘোষ দস্তিদার।