সুকুমার রায়ের (Sukumar Roy) সেই ছড়াটার কথা মনে আছে? ‘আবোল তাবোল’ বইয়ের মধ্যে ছিল ‘পালোয়ান’ নামের অদ্ভুত ছড়াটা। ‘খেলার ছলে ষষ্ঠীচরণ, হাতি লোফেন যখন তখন / দেহের ওজন উনিশটি মণ, শক্ত যেন লোহার গঠন’। এ গল্প বেনিয়াটোলার সেই ষষ্ঠীচরণের নয়। বাঙালির ক্রীড়া ইতিহাসে বহু পালোয়ান পুরুষ কৃতবিদ্য হয়েছেন ঠিকই কিন্তু মহিলা কুস্তিগীর বা পালোয়ানের কথা বললে খানিক বিস্মিত হতে হয়। তাও আবার যদি তিনি ষষ্ঠীচরণের মতোই বুকের উপর হাতি তুলে দেখাতে পারেন দুঃসাহসিক মারণ খেলা, তাহলে উৎসাহে ও কৌতুহলে চোখ কপালে উঠে যেতেই পারে যে কারোর। নিজের ওজন উনিশ মণ নয় – অথচ সেই কিনা বুকের উপর উনিশ মণ ওজনের হাতি তুলে চল্লিশ-পঞ্চাশের দশকে দেশ-বিদেশের মানুষকে তাক লাগিয়ে দিয়েছিলেন! প্রিয়নাথ বসুর (Priyanath Basu) হাত ধরে বাঙালি তখন সদ্য সার্কাসের স্বাদ পেয়েছে। সার্কাসে মজা বাঙালির কাছে সেই মেয়েই হয়ে উঠেছিল জনপ্রিয় আইকন (Bengali Circus Icon Reba Rakshit)। খাতায়-কলমে তাঁর নাম রেবা রক্ষিত (Reba Rakshit)। প্রকৃত অর্থেই তিনি ছিলেন অসীম ক্ষমতার অধিকারী।
তখন পঞ্চাশের দশক। সদ্য স্বাধীনতা পাওয়া দেশে বাঙালির মনে তখন রোমাঞ্চ জাগিয়ে তুলেছিল প্রিয়নাথ বসুর গ্রেট বেঙ্গল সার্কাসের অভাবিত সব কলা-কৌশল। শুধু তাই নয়, প্রিয়নাথ বসুর অনুসরণে আরও বেশ কিছু সার্কাসের দল গড়ে উঠলো ভারতে। সমস্ত দেশ জুড়ে তখন এই সার্কাসগুলির মধ্যে সুস্থ প্রতিযোগিতা চলছে নিত্য নতুন খেলা দেখানোর। ঠিক এই সময়েই দর্শকদের আকর্ষণের কেন্দ্রে চলে আসেন রেবা রক্ষিত।
ট্রায়াল শো-তে পঞ্চাশ-ষাট মণ ওজনের বাচ্চা হাতি রেবা অনায়াসে বুকে তুলে নিলেন। অবশেষে চূড়ান্ত শো, পূর্ণবয়স্ক একটি হাতি সেদিন অনায়াসে রেবার বুকের উপর দিয়ে হেঁটে চলে গেল, রেবা তখনও অক্ষত প্রাণোচ্ছ্বল।
স্বাধীনতার দুই বছর আগে, সার্কাসের একটা ম্যাটিনি শো-তে বুকের উপর দিয়ে মোটর সাইকেল চালিয়ে এক দুঃসাহসিক নজির তৈরি করেছিলেন রেবা রক্ষিত। সেই শুরু হল রেবার যাত্রা। বুকের উপর মোটরসাইকেল উঠিয়ে দেওয়ার এই মারণ খেলা তাঁকে ক্রমে আরও জনপ্রিয়তা দিলো।
শুনলে আশ্চর্য হতে হয়, তাঁর বয়স তখন মাত্র পনেরো-ষোলো বছর। খেলা দেখাতে গিয়ে দুর্ঘটনাও ঘটেছিল একবার। একটি সার্কাসের শো-য় রেবা রক্ষিত মঞ্চে টানটান হয়ে শুয়ে তৈরি ছিলেন খেলা দেখানোর জন্য। আর তারপরেই বাইকের ভারী সামনের চাকাটা চলে যায় তার উপর দিয়ে, কিন্তু পিছনের চাকাটা ওঠার পরেই মুখের কাছে প্রচণ্ড জোরে আঘাত পান রেবা, চোখে মুখে তখন অন্ধকার দেখছেন। গালে বসে গিয়েছে টায়ারের কালো দাগ। টানা দু মাস অক্ষত ছিল সেই দাগ। সে যাত্রায় প্রাণহানির মুখ থেকে ফিরে এসেছিলেন রেবা। কিন্তু এ তো সামান্য ঘটনা, এতে দমে যাওয়ার পাত্রী তিনি নন। মোটর সাইকেলের পরে এবার শুরু হল বুকে হাতি তোলার খেলা। আর এই খেলাই সমগ্র ভারতে তাঁকে সার্কাসের সম্রাজ্ঞী বানিয়ে তুললো।
১৯৩০ সালে অবিভক্ত বাংলার কুমিল্লায় রেবার জন্ম। খেলাধুলো, শরীরচর্চা, দৌড়, সাঁতার কাটা, গাছে চড়া ইত্যাদি কাজে-কর্মে তাঁর উৎসাহের অন্ত ছিল না, সেই ছোটোবেলা থেকেই। স্কুলে যখন পড়তেন, সেই সময়েই কুমিল্লা থেকে কলকাতায় এসে ওঠে তাঁর পরিবার। বাড়ির অমতেই একপ্রকার জেদ ধরে কলকাতার একটি যোগচর্চা কেন্দ্রে ভর্তি হন রেবা। কেন্দ্রের নাম জাতীয় ‘ক্রীড়া ও শক্তি সংঘ’। এই সংঘের কর্ণধার শম্ভু মল্লিকের (Shambhu Mallik) সঙ্গে নানা জায়গায় ক্যাম্পে উপস্থিত থাকতেন রেবা। এগারো বছর বয়সে পুরোপুরি শরীরচর্চায় মনোনিবেশ করার জন্য শম্ভু মল্লিকের সংঘ থেকে রেবা রক্ষিত চলে আসেন বিষ্টু ঘোষের (Bistu Ghosh) কুস্তির আখড়ায়। তাঁর কাছে আসন আর যোগাভ্যাসের পাঠ নেন রেবা। একই সময়ে বিষ্ণুচরণ ঘোষের কাছে পেশি ও শ্বাস-প্রশ্বাস নিয়ন্ত্রণের খেলা শিখে নেন তিনি। যোগাভ্যাসের পাশাপাশি প্রাণায়ামের পাঠও রপ্ত করেছিলেন। এইসবই পরবর্তীকালে হাতির খেলা দেখানোয় কাজে লাগিয়েছিলেন রেবা রক্ষিত.
রেবার আগ্রহ ও উৎসাহ দেখে বিষ্টু ঘোষ নিজেই এক সার্কাসের মালিকের সঙ্গে কথা বলে শোয়ের বন্দোবস্ত করে দেন। ট্রায়াল শো-তে পঞ্চাশ-ষাট মণ ওজনের বাচ্চা হাতি রেবা অনায়াসে বুকে তুলে নিলেন। অবশেষে চূড়ান্ত শো, পূর্ণবয়স্ক একটি হাতি সেদিন অনায়াসে রেবার বুকের উপর দিয়ে হেঁটে চলে যায়, রেবা তখনও অক্ষত প্রাণোচ্ছ্বল। এরপরই নানা সার্কাস থেকে ডাক আসতে থাকলো। রেবা ক্রমান্বয়ে দেখাতে শুরু করলেন তাঁর হাতির খেলা। শো-পিছু উপার্জনও হতে লাগলো ভালোই। সেকালের হিসেবে শনিবার কিংবা রবিবারের প্রতি শো-পিছু ২০০ থেকে ২৫০ টাকা উপার্জন করতেন রেবা।
গ্রেট বম্বে সার্কাসে (Great Bombay Circus) টানা আট বছর এই হাতির খেলা দেখিয়েছেন তিনি। বুকের উপর পেতে রাখা কাঠের তক্তা দিয়ে হাতি হেঁটে চলে যেত। রেবা নির্বিকার শুয়ে থাকতেন, পরে কাঠের তক্তা সরানো হলে উঠে আসতেন সবল সুঠাম শরীরে। নির্ভীক এই বঙ্গমহিলার কাণ্ড দেখে দর্শকরা ভয়ে চোখ বুজে ফেলতেন সেই সময় আর সেটাই ছিল তাঁর শোয়ের বিশেষত্ব।
ইন্টারন্যাশনাল সার্কাসের হয়েই শেষবারের মতো খেলা দেখিয়েছিলেন। পঞ্চাশের দশকে বাঙালির ক্রীড়া সংস্কৃতির ইতিহাসে শরীরচর্চার এমন রোমহর্ষক প্রদর্শনী দেখিয়ে বিখ্যাত হয়েছিলেন রেবা রক্ষিত। ভারত সরকার তাঁকে পদ্মশ্রী পুরস্কারে ভূষিত করে। তবে বাঙালির সম্মিলিত স্মৃতিতে (Collective Memory) রেবা রক্ষিত অনুজ্জ্বল এক ক্ষীণ জ্যোতিষ্কের মতোই অনালোচিত থেকে গিয়েছেন আজও। বাঙালির সার্কাসের সংস্কৃতি যেভাবে ধ্বংসের মুখে, সেখানে এককালে সার্কাস কাঁপানো এই বঙ্গমহিলাকে কেই বা মনে রাখবে!
সিমন রায়
বঙ্গদর্শন