বাংলার গর্ব দুকড়িবালা দেবী

দুকড়িবালা দেবী
২১ শে জুলাই, ১৮৮৭ – ২৮শে এপ্রিল, ১৯৭০

অনেক মানুষের রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম এবং জীবনের বিনিময়ে ভারতবর্ষ ১৯৪৭ সালে মুক্তি পেয়েছিল ব্রিটিশ পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে। পেয়েছিল তার বহু-কাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতা। এই স্বাধীনতা আন্দোলনে সারা দেশ তথা বাংলার সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল বীরভূম জেলাও। ব্রিটিশ শক্তির বিরোধিতায় এই জেলাতেও সংগঠিত হয়েছিল একাধিক আন্দোলন। ১৮৫৫ সালে সিধো-কানহুর নেতৃত্বে সাঁওতাল বিদ্রোহ দানা বাঁধে। সে সময়ের সাঁওতাল পরগনার পাশাপাশি বীরভূমের উত্তর-পশ্চিমের বেশ কিছু অংশ এই বিদ্রোহের কেন্দ্রভূমি হয়ে ওঠে। ওই সময় সিউড়ি শহর-সহ জেলার বিস্তীর্ণ অঞ্চলকে ব্রিটিশ কবল থেকে মুক্ত করার লড়াইয়ে শামিল হন তাঁরা। পরবর্তী সময়ে জেলার সর্বস্তরের মানুষই স্বাধীনতা আন্দোলনে নেমে পড়েন। এক সময় সাহিত্যিক তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ও যুক্ত হয়েছিলেন এই সংগ্রামে। শুধু তারাশঙ্করই নন, কামদাকিঙ্কর মুখোপাধ্যায় (প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়ের বাবা), জিতেন্দ্রলাল বন্দ্যোপাধ্যায়, পান্নালাল দাশগুপ্ত, জগদীশ ঘোষ-সহ বীরভূমের শতাধিক বিপ্লবী ব্রিটিশ-বিরোধী আন্দোলনে সক্রিয় ভাবে যোগ দিয়েছিলেন।
জেলার বিপ্লবী আন্দোলনে উল্লেখযোগ্য নামটি হল দুকড়িবালা দেবী। নলহাটির ঝাউপাড়া গ্রামের খুব সাধারণ পরিবারের এক গৃহবধূ তিনি। ইংরেজদের দখলদারি মনোভাবকে মেনে নিতে পারেননি। বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের সময় দেশ জুড়ে প্রতিবাদের ঢেউ স্পর্শ করে তাঁকেও। মনে মনে স্বদেশি মন্ত্রে দীক্ষিত হন তখনই। পরবর্তী সময়ে যোগাযোগ হয় তাঁরই এক আত্মীয়, বিপ্লবী নিবারণ ঘটকের সঙ্গে। সম্পর্কে নিবারণের মাসি ছিলেন দুকড়িবালা। নিবারণের সূত্রেই ঝাউপাড়ার দুকড়িবালা দেবীর বাড়ি হয়ে ওঠে বিপ্লবীদের আখড়া। বিপ্লবীদলে দুকড়িবালা দেবী ‘মাসিমা’ নামেই পরিচিত ছিলেন। বিপ্লবীদের কাছ থেকে দুকড়িবালাও শিখে নেন বিভিন্ন ধরনের অস্ত্রচালনার কলাকৌশল। ১৯১৪ সালের ২৬ আগস্ট কলকাতার রডা কোম্পানির জন্য পাঠানো ৫০টি জার্মান মসার পিস্তল এবং বহু সংখ্যক কার্তুজের বাক্স কলকাতা বিমানবন্দর থেকে লুট হয়। সশস্ত্র বিপ্লবীরাই এই অস্ত্র লুটের পিছনে ছিলেন। সেই লুট হওয়া পিস্তল ও কার্তুজের একটি বড় অংশ এসে পড়ে ঝাউপাড়ায়। সে-সব সামলে রাখার দায়িত্ব নেন দুকড়িবালা। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি। অস্ত্র রাখার অভিযোগে ১৯১৭ সালে পুলিশ তাঁকে গ্রেফতার করে। বিচারে দু’বছর সশ্রম কারাদণ্ড হয়। তিনিই ছিলেন বাংলার প্রথম বিপ্লবী মহিলা, যাঁর ওই সময় অস্ত্র আইনে সশ্রম কারাদণ্ড হয়েছিল।
বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনে যথেষ্ট সক্রিয় ছিল এই জেলা। ১৯০৫ সালের ১৯ জুলাই বঙ্গভঙ্গ ঘোষণা করে ব্রিটিশ সরকার। ওই বছরই ১৬ অক্টোবর বঙ্গভঙ্গ কার্যকর হলে সারা বাংলার সঙ্গে বীরভূম জেলাও প্রতিবাদে সরব হয়। জেলার বহু গ্রাম ও শহরে পালিত হয় ‘অরন্ধন’। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাবনায় পালন করা হয় ‘রাখি বন্ধন’ উৎসব। ডাক দেওয়া হয় বিদেশি দ্রব্য বয়কটের। গ্রামে গ্রামে বের হয় শোভাযাত্রা। শামিল হন অগণিত সাধারণ মানুষ। ১৯২০ সালে মোহনদাস কর্মচন্দ গাঁধীর অসহযোগ আন্দোলনের সমর্থনে জেলার ছাত্রেরা স্কুল-কলেজ বর্জন করেন। ১৯২১ সালের সেপ্টেম্বরে এই আন্দোলনের পক্ষে জনমত গঠনের উদ্দেশ্যে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাস সিউড়ি, সাঁইথিয়া এবং রামপুরহাটে জনসভা করেন। নবীনচন্দ্র সেন, গোপীকা বিলাস সেনগুপ্তদের মতো জেলার কংগ্রেস নেতারা এই আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন। অসহযোগ আন্দোলন প্রত্যাহারের পরে ১৯২৫ সালের ২২ জুলাই গাঁধীজি সিউড়ি শহরে একটি জনসভা করেন। সেখানে তিনি তাঁর বক্তব্যে দেশের কল্যাণের জন্য সম্প্রীতির বাতাবরণ সৃষ্টি করার দিকে জোর দেন। বলেন, অস্পৃশ্যতা বর্জনের কথাও। ১৯৩০ সালে তাঁরই ডাকে লবন আইন অমান্য আন্দোলনে শামিল হয়ে বীরভূমের শরৎচন্দ্র মুখোপাধ্যায়-সহ কয়েক জন গ্রেফতার বরণ করেন। তবে এ সময় গাঁধীজির গণ-আন্দোলনের ডাকে তদানীন্তন সশস্ত্র বিপ্লবীরা সাড়া দেননি। বরং তাঁরা অনুশীলন সমিতি এবং যুগান্তর দলের সদস্যদের নিয়ে সশস্ত্র আন্দোলন শুরু করেন।
তবে, বাংলার সশস্ত্র স্বাধীনতা আন্দোলনে বীরভূমের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য পরিচিতি বোধহয় ইতিহাস-খ্যাত ‘বীরভূম ষড়যন্ত্র মামলা’-র সৌজন্যে। ১৯৩০ সালের আগে ও পরের কয়েকটি বছর বিপ্লবীরা অস্ত্রশস্ত্র সংগ্রহ এবং জোরপূর্বক অৰ্থ সংগ্রহের অভিযানে সামিল হন। শাসকের চোখে যা ছিল সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপ। অস্ত্র ছিনতাই, ডাক লুট-সহ নানা কাণ্ডকারখানা শুরু হয় জেলা জুড়ে। জেলার সিউড়ি, দুবরাজপুর, লাভপুর, আমোদপুর, জাজিগ্রাম, ভালাসের মতো বিভিন্ন শহর এবং গ্রামকে বেছে নেওয়া হয় এই সব কর্মকাণ্ডের ক্ষেত্র হিসাবে। কিন্তু কয়েক জন বিপ্লবীর বৈপ্লবিক দৃঢ়তার অভাবে ফাঁস হয়ে যায় আন্দোলনকারীদের গোপন কার্যপ্রণালী। ফলে পুলিশ জেলার বিভিন্ন স্থানে তল্লাশি চালিয়ে ৪২ জনকে গ্রেপ্তার করে। বিপ্লবীদের এই কাজ ব্রিটিশরাজ বিরোধী ষড়যন্ত্র হিসাবে চিহ্নিত হয়। ১৯৩৪ সালের ১৪ জুলাই ২১ জন বিপ্লবীর নামে অভিযোগ দায়ের হয়। ২৬ জুলাই সিউড়ি আদালতে মামলা শুরু হয়। এই মামলাটিই ‘বীরভূম ষড়যন্ত্র মামলা’ হিসেবে পরিচিতি পায়। টানা দু’মাস এই মামলা চলার পর ১৯৩৪ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর রায় বের হয়। মামলার রায়ে ১৭ জন বিপ্লবীকে কারাদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়। প্রভাতকুমার ঘোষ, রজতভূষণ দত্ত, সমাধীশ রায়, হারানচন্দ্র খাঙ্গার সহ দশ জনকে ‘বিপজ্জনক বিপ্লবী’ হিসেবে চিহ্নিত করে আন্দামানের সেলুলার জেলে পাঠানো হয়।
১৯৪২-এর ‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলনেও এই জেলার বিশেষ ভূমিকা ছিল। ৯ অগস্ট ভারত ছাড়ো আন্দোলন শুরু হলেও বীরভূমে আন্দোলনের ঢেউ এসে পড়েছিল ১৩ অগস্ট। আন্দোলনের সমর্থনে স্কুল-কলেজের ছাত্রেরা পথে নেমে পড়েছিলেন। জায়গায় জায়গায় শুরু হয় পিকেটিং। আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন আনন্দগোপাল সেনগুপ্ত, নৃসিংহ সেনগুপ্ত, দ্বারকেশ মিত্র, লালবিহারী সিংহ প্রমুখ। ওই বছরই ১৫ অগস্ট সিউড়ি শহরে জেলার শতাধিক বিপ্লবী বীরভূম জেলাকে স্বাধীন বলে ঘোষণা করেন। এর পরেই শুরু হয় পুলিশি তৎপরতা। গ্রেফতার করা হয় বহু নেতাকে। ভারত ছাড়ো আন্দোলন ও স্বাধীনতা সংগ্রামের সঙ্গে বীরভূমের প্রাচীন জনপদ দুবরাজপুরেরও এক সমৃদ্ধ ইতিহাস জড়িয়ে রয়েছে। ’৪২-এর ১ সেপ্টেম্বর মিছিল করে আক্রমণ করেছিল দুবরাজপুর আদালতের উপরে। তৎকালীন ব্রিটিশ পতাকা নামিয়ে উড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল ভারতের জাতীয় পতাকা।
আন্দোলন, গ্রেফতার এবং বিপ্লবীদের জেলবাসের ফলে সিউড়ি জেলখানাও নানা ঘটনাপ্রবাহের সাক্ষী হয়ে উঠছিল। এই জেলেই বন্দি ছিলেন সাঁওতাল বিদ্রোহের তিন নায়ক কানহু, চাঁদ ও ভৈরব। বন্দি ছিলেন চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠনের অন্যতম সৈনিক বিপ্লবী অম্বিকা চক্রবর্তী। স্বদেশি করার ‘অপরাধে’ তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ও বন্দি ছিলেন এখানে। এই জেলে বসেই তিনি রচনা করেন ‘চৈতালী ঘূর্ণি’র মতো উপন্যাস। এ ছাড়াও ‘বীরভূম ষড়যন্ত্র মামলা’-র বেশ কয়েক জন বিপ্লবী বন্দি-জীবন কাটিয়েছেন সিউড়ি জেলে। স্বাধীনতা সংগ্রামে এই জেলার বিপ্লবীদের অবদান যে কোনও অংশেই কম ছিল না, জেলার মাটিতে জন্ম নেওয়া নানা বিদ্রোহ এবং বিদ্রোহের ব্যাপকতাই তার প্রত্যক্ষ প্রমাণ। আবার বীরভূমের সুরেন্দ্রনাথ সরকার, হংসেশ্বর রায়, সুষেন মুখোপাধ্যায়দের পাশাপাশি দুকড়িবালা দেবী সুরধনী মোল্লানি, সরোজিনী দেবী, সত্যবালা দেবী, অহল্যা দাসীদের মতো মহিলারাও স্বাধীনতা যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। এঁদের সম্মিলিত লড়াইয়ের ফলেই উজ্জ্বল হয়েছে বীরভূম জেলার স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস।

ঋণস্বীকার:
‘পশ্চিমবঙ্গ’ ( সাঁওতাল বিদ্রোহ সংখ্যা) অগস্ট, ’৯৫
বীরভূম ষড়যন্ত্র মামলা ও জগদীশচন্দ্র ঘোষ: স্বাধীন গুপ্ত
সিউড়ির ইতিবৃত্ত: পার্থপ্রতিম দে
বীরভূমের স্বাধীনতা সংগ্রামী: নবকুমার চক্রবর্তী।
https://www.anandabazar.com/editorial/dukribala-devi-was-one-of-the-freedom-fighters-of-birbhum-district-1.

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.