মাথায় আমার খেয়াল চুকিবামাত্রই পত্রপাঠ যোগাড়যন্ত্রে লাগিয়া গেলাম। কোর্টে যাইতাম আসিতাম ও সেখানে কয়েকজন বন্ধুর সহিত যোগাযোগে বন্দোবস্ত করিতাম। টাকার ব্যবস্থা হইল, অস্ত্ৰ সংগ্ৰহ চলিতে লাগিল বাহিরে বাহিরে; স্থির হইল, ১০৷ ১২টি রিভলবার বাহিরে সংগ্ৰহ করিয়া জেলের মধ্যে একে একে আনানো হইবে, তাহার পর কোন জেলের লোককে কোন রকমে উৎকোচে বা কৌশলে বশীভূত করিয়া রাত্রে ব্যারাকের চোরা চাবির সাহায্যে বা রেলিং কাটিয়া আমরা বাহির হইব। সামনে পাকশালা, তাহার পর পাইখানা, তাহার পরই জেলের প্রাচীর। বাহিরে মোটরগাড়ী হাজির থাকিবে, তাহাতে চড়িয়া আমরা ছোটনাগপুরের বিন্ধ্য ও কাইমুর গিরিমালার উদ্দেশে যাত্ৰা করিব। একটা ধোয়াটে রকম ধারণা ছিল যে, বিন্ধ্যশ্ৰেণী ধরিয়া রাজপুতানা হইয়া ভারত হইতে আবশ্যকমত চম্পট পরিপাটিও দেওয়া যাইতে পারে।
ভারতের উত্তরে কাবুল কান্দাহার আর পশ্চিমে পারস্য, ইংরাজের এলাকার বাহিরে রাজনীতিক অপরাধী গ্রেপ্তার করা আন্তর্জাতিক আইনে চলে না। জেলের মানুষটিকে রাজী করান হইল। শুভকার্যের রাত্রে সে যোগাড়যন্ত্র করিয়া আপন মনের মানুষ দু’চার জনকে পাহারায় রাখাইবে, আমরা মোম আনাইয়া ব্যারাকের চাবির ছাচি লইবার চেষ্টায় রহিলাম। আত্মীয়-স্বজনের সহিত অনেক বন্ধু-বান্ধবও দেখা করিতে আসিত, সেই দেখার অছিলায় একে একে পিস্তল জেলের মধ্যে প্ৰবেশ করিতে লাগিল। ব্যারাকে শুইবার জন্য মাটি ও ইট দিয়ে উঁচু করিয়া গড়া খাটের মত শান বাধানো ছিল, তাহার ইট দুইএকটা কৌশলে খসাইয়া আমরা পিস্তল রাখিবার খোপ করিয়া লইলাম। তাহার আগেই ২টা পিস্তল আসিয়া পৌঁছিয়াছে। এই সময় ছেলেদের মধ্যে অনেকে জল্পনা-কল্পনা করিতেছিল যে, কি করিয়া নরেন্দ্ৰনাথ গোসাইকে ইহধাম হইতে সরান যায়। আমার পরামর্শ চাহিলে আমি সে চেষ্টা জেলের বাহিরে করাইবার কথায় জোর দিয়াছিলাম, কারণ জেলে করিলে আমার এত সাধের পগার ডিঙাইবার চক্রান্তটি পণ্ড হয়। আমি জানিতাম না যে, ছেলেদের একদল আমাকে লুকাইয়া আমারই আনা পিস্তল দিয়া নরেনকে জেলের মধ্যেই প্ৰাণে মারিবার ফন্দি আঁটিয়াছে। তখন নরেন সত্যমিথ্যা সাক্ষ্য দিয়া অনেক নিরীহ মানুষকে ফাসাইতেছে, তাহার এজাহারে মেদিনীপুর, বাঁকুড়া, রংপুর আদি অনেক স্থানে বহু লোক এমনকি স্থানে স্থানে রাজা জমিদার অবধি ধরা পড়িতেছে। নরেন মরিলে এতগুলি মোকদ্দমা বেমালুম ফাসিয়া যায়। ম্যাজিষ্ট্রেটের কোর্ট হইতে মোকদ্দমা সেসন্সে সোপর্দ হইবার পূর্বেই এ কাজ কিন্তু করা দরকার। তদন্তে সে যাহা বলিতেছে তাহা সেসন্সে বলিতে পাইলে এবং তাহার সাক্ষ্য আর কেহ প্ৰমাণ করিলে (coroborate) মোকদ্দমাগুলি কায়েম হইয়া দাড়াইবে। আমি মনে মনে ঠিক দিয়া রাখিয়াছিলাম যে, বাহির হইতেই কেহ না কেহ এ কাৰ্য্য নিশ্চয়ই করিবে, আমাদের মাথা ঘামাইবার আবশ্যক নাই। আমি মাথা গুজিয়া আপন মনে আপনি তালেই চলিতেছিলাম, কে কি পরামর্শ আঁটিতেছে কিম্বা কি করিতেছে সে দিকে বড় একটা নজর দিই নাই। কাঁচা লিডারের যাহা সচরাচর হইয়া থাকে, আমার ধাতটা তদনুরূপই ছিল, বিলক্ষণ কিছু স্বেচ্ছাচারী ও autocratic গোছের; সবাইকে লইয়া কাজ করিতাম বটে, কিন্তু আপন গোঁয়েই করিতাম। জেলে আসিয়া ছেলেদের কাহারও কাহারও মধ্যে আমার প্রতি একটা বেশ রাগ ও অভিমানের ভাব যে দেখা দিয়াছে তাহা বুঝিয়াছিলাম, বিশেষ কিছু কাজ না করিয়াই ধরা পড়িয়া গেলাম, এই আক্ষেপই এই অভিমানের কারণ। জেলের প্রথম কতক দিন নিজের আশার শ্মশান লইয়াই গুম হইয়া পড়িয়াছিলাম, তাহার পর দেবব্রতের স্পর্শে আমার এতদিনের মুলতুবি রাখা সাধনাও অল্পে অল্পে জীবন পাইতেছিল। তাই ছেলেদের এ রাগ আমি দেখিয়াও দেখি নাই, এটা ভাবিয়া উঠিতেও পারি নাই যে, আমাকে বাদ দিয়া অন্ততঃ আমাকে না জানাইয়া, তাহারা একটা কিছু করিবে। আমার মনোভাব জানিয়া তাহারাও তাহদের কৃতসংকল্পতার কথা আমাকে বিন্দু-বিসর্গও বলে নাই, শুধু একবার, কথায় কথায় মতটা জানিয়া লইয়াছিল।
(বারীন্দ্রকুমার ঘোষের লেখা ‘বারীন্দ্রের আত্মকাহিনী’ বইয়ের নির্বাচিত অংশ)