বিয়ে, অন্নপ্রাশন কিংবা শ্রাদ্ধের প্রয়োজনীয় উপকরণ জোগাড় ও যোগান দিতে আজও হিন্দু বাড়িতে যাঁদের ডাক পড়ে, এককথায় তাঁরা হলেন “নাপিত।” তাঁদের অন্য নামও আছে, যেমন, কেউ বলেন, নরসুন্দর, কেউ বা পরামাণিক। শুদ্ধ কথা অবশ্য “প্রামাণিক” এবং অপভ্রংশে তা আজকের “পরামাণিক।”
আদিম যুগে মানুষের চুল-দাড়ি-নখ কাটার দরকার হতো না আর তখন তাই নাপিতের দরকার হতো না। পরে ক্ষুর-কাঁচি-নরুণ দিয়ে মানুষের চুল-দাড়ি-গোঁফ-নখ কেটে তাকে সুন্দর করে তুলতেন নাপিতরা এবং তাই তাঁদের নাম হয়ে যায় “নরসুন্দর।”
নাপিতের কাজ ছিল পুরুষের কাছে, আর নাপিত বৌয়ের ভূমিকা ছিল মেয়েদের অন্দরমহলে। নাপিত বৌ যজমানদের ঘরের মেয়েদের হাত-পায়ের নখ কেটে পায়ে আলতা পরিয়ে দিতো। বিভিন্ন গ্রামে ছিল এক-একজন নাপিতের যজমান। মাসে দু’দিন নাপিত যজমানদের গ্রামে এসে গৃহস্থ ঘরের ছেলে-পুলে থেকে গৃহকর্তা সবার চুল-দাড়ি কেটে দিতেন। বিনিময়ে নাপিতের পাওয়া হতো বছরে পরিবারের সদস্য অনুপাতে মাথাপিছু এক টিন করে জমির উৎপাদিত ধান। সোজা কথায়, পরিবারের সদস্য সংখ্যা যদি চার হতো, তবে বছরে নাপিতের পাওনা ছিল চার টিন ধান। এছাড়া বিয়ে-অন্নপ্রাশন-শ্রাদ্ধে ছিল আলাদা পাওনা। আর দুর্গাপুজোর পর যাত্রা বাঁধতে আরও কিছু বাড়তি আয় হতো তাঁর। আর গ্রামের পরিবারের সব খবর নখদর্পণে থাকতো বলে নাপিতরা বিয়ের ঘটকালিও করতেন। সব মিলে গ্রামের পরিবারগুলির সঙ্গে নাপিতদের একটি বিশ্বাসযোগ্য সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল। সব কাজে তাঁরা ছিলেন প্রামাণিক এবং তাঁদের নাম হয়ে যায় “প্রামাণিক।” এই “প্রামাণিক” অপভ্রংশে হয়েছে “পরামাণিক।”
মা দুর্গার নখ কাটার জন্য শিব নাপিত জাতির সৃষ্টি করেছেন, এমনই প্রচলিত প্রবাদ। বলা হয়, ব্রাহ্মণ-শূদ্র, ক্ষত্রিয়-শূদ্র, ব্রাহ্মণ-বৈশ্য এবং ক্ষত্রিয়-নিষাদ—এই চার বর্ণের অনুলোম বিবাহের ফলে নাপিতের উদ্ভব। তাই নাপিত হচ্ছে একটি সংকর জাতি। বৃহদ্ধর্মপুরাণ ও অর্বাচীন ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণে নাপিত জাতি উচ্চ সংকর বা সৎশূদ্র বলে উল্লিখিত। ভারতের মৌর্য সম্রাট চন্দ্রগুপ্তের মা মূরা দেবী নাপিত ছিলেন বলে কথিত আছে।
তবে বৈদিক কাজকর্মে নাপিত সূর্যের প্রতীক হিসেবে গণ্য। নাপিতরা নিজেদের ব্রাহ্মণ বলে থাকেন। এ বিষয়ে তাঁদের ব্যাখ্যা হলো, ভারতে বৈদিক যুগে আর্যরা নিজেদের ক্ষৌরকাজ নিজেরাই করতেন। পরে তাঁরা এ কাজে ক্ষত্রিয় বা শূদ্রদের নিয়োগ করেন। আর এরাই পরে নাপিত বলে পরিচিত হোন।
নাপিত সম্পর্কে প্রবাদ আছে—
“নরাণাং নাপিতো ধূর্ত: ।” আর নাপিতদের সম্পর্কে চতুরতার বিষয়টি সুপরিচিত। বলা হয়, নদীয়ারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের রাজসভার সুরসিক গোপাল ভাঁড় ছিলেন জাতে একজন নাপিত।
একসময় নাপিতরাই ছিলেন গ্রামের শল্য চিকিৎসক। ফোঁড়া, আঙুলহাড়া, কার্বংকল ঘা নাপিতরাই তাঁদের নরুণ দিয়ে চিরে পু়ঁজ-রক্ত বের করে দিয়ে ওষুধ লাগিয়ে দিতেন। যখন কাছাকাছি স্বাস্থ্যকেন্দ্র ছিল না, তখন নাপিতের ক্ষুরই ছিল মুশকিল আসান। শিক্ষা-শিল্পে নাপিত জাতির বিশেষ অবদান রয়েছে। যেমন, বিশ্ববিখ্যাত ভাস্কর রবীন্দ্র স্নেহধন্য রামকিঙ্কর বেজ ছিলেন জাতে নাপিত।
একটা সময় নাপিতদের কবিত্ব শক্তির পরিচয় পাওয়া যেতো বিয়ের আসরে। বর ও কনে দু’পক্ষের নাপিত ছড়া কেটে বিয়ের আসরকে জমিয়ে রাখতেন।
নাপিতদের মধ্যে বিভিন্ন ভাগ বা “থাক্” রয়েছে, যেমন—আনরপুরিয়া, বারেন্দ্র, বামনবনে, মাসুদাবাদ, সপ্তগ্রাম, সাতঘরিয়া, ফুল নাপিত, উত্তর রাঢ়ী, দক্ষিণ রাঢ়ী, পশ্চিম রাঢ়ী প্রভৃতি। পূর্ববঙ্গের নোয়াখালীতে ভুলুয়া নাপিত, পশ্চিমবঙ্গের চব্বিশ পরগণায় হালদার নাপিত, কোলা পরামাণিক, হংস দাহা পরামাণিক, মুক্তগাঙ্কি পরামাণিক প্রভৃতি রয়েছেন। যে সব নাপিত নিচুতলার মানুষের ক্ষৌরকাজ করেন, তাঁদের বলা হয় “বর্ণের নাপিত।”
নাপিতদের মধ্যে প্রচলিত গোত্রগুলি হলো—কাশ্যপ, গোলক ঋষি, জিও ঋষি, শাণ্ডিল্য, মৌদগল্য, গৌতম, কনক ঋষি, ভরদ্বাজ প্রভৃতি। আর পদবিগুলি হলো—ভাণ্ডারী, প্রামাণিক, পরামাণিক, নাই, বিশ্বাস, ঢক, বেজ, বাগলি, চৌধুরী, সেন, বেরা, বাগ, শিকদার, দে, সরকার, হাজরা, মজুমদার, ছাতাইত, মর্দন্যা, দেব, সিং, শর্মা, আদিত্য, শীল, রায়, মান্না, ভৌমিক, পাল, শীল শর্মা প্রভৃতি।
সাতচল্লিশে দেশভাগের পর বহু নাপিত পশ্চিমবঙ্গে চলে এসেছেন বলে জানা যায়।
শেষে বিয়েতে প্রচলিত নাপিতের কয়েকটি ছড়ার নমুনা দেওয়া হচ্ছে:
১) হরগৌরী বিবাহের কথা শুনুন শুনুন মহাশয়, করি নিবেদন।
হরগৌরীর বিবাহ কথা, করি গো বর্ণন। ।
হরগৌরীর বিবাহে কৌতুক লাগিল।
বরণডালা লয়ে রাণী মেনকা আইল। ।
কুমকুম কস্তুরি আমলা মেথি যত।
সকল দ্রব্য লয়ে থালা করিল পূর্ণত। ।
সাততী ঘুরাইতো যখন দেউটি জ্বালিয়া।
শিবের নিকটে যান স্বর্ণথালা লইয়া। ।
তাহার মধ্যে ছিল এক ঈশ্বরমূলের মূলী
ঈশ্বরমূলের গন্ধ পাইয়া পালায় ভূজঙ্গ।
তাহা দেখি সদানন্দ হইলেন উলঙ্গ। ।
লজ্জিত হৈয়া রাণী যান অন্তপুরে।
ছি: ছি: বলিয়া নিন্দা করেন শংকরে। ।
ভবেতে ভবানী পদ হরষিত মনে।
অসংখ্য প্রণাম আমার ব্রাহ্মণের চরণে। ।
সভাসদগণে আমি নমস্কার করি।
জাতিতে নরসুন্দর শ্রীপাণ্ডব ভাণ্ডারী। । ( লেখকের সংগৃহীত)
২) যত সব সখীগণে আনন্দিত মনে
সবে ঘোমটা টানি সভাতে বসিয়ে,
বেদধ্বনি মতে দিচ্ছে উলুধ্বনি
শিবদুর্গার বিবাহ হয় স্বর্ণমুকুট মাথে।
আনন্দিত হয়ে গিরি বলেন শিবের হাতে
কৌতুক করেন গিরি করেন সম্মানেতে।
এ কারণে নরসুন্দর করেন গোমোক্ষণ
উত্তর দিকে কৃষ্ণবর্ণ গাভী ছিল
গাভীর বন্ধন মুক্ত হৈল।
এখানে উল্লেখ্য, কন্যার বিয়েতে গাভী দান করা হতো। কালো রংয়ের গাভীর দুধ মিষ্টি হয়, এরকম একটি কথা প্রচলিত আছে গ্রামবাংলায়। তাই কৃষ্ণবর্ণের গাভী দানের প্রাধান্য ছিল বেশি।
৩) নম: নম: গণপতি প্রণাম চরণে
গোমোক্ষণ করি আমি শুনুন সর্বজনে।
কর্ণেতে ধুতুরা ফুল বৃষোপরি চড়ি
ঢলিতে ঢলিতে যায় গিরি রাজার বাড়ি
কদলীর বৃক্ষ দিয়ে মুক্ত আচ্ছাদিয়ে
লগ্ন অনুসারে শিবানী উত্তরিল গিয়ে।
লয়ে পুষ্পমালা নাপিতের নন্দন
শিবের নিকট আসিয়া দিল দরশন।
মনোহর পাত্র ভোলা, ছোড়লা করেছে আলা
মস্তকেতে শোভা করে কান,
উলুধ্বনি মংলা ( মঙ্গলধ্বনি) গায় যতেক রমণী,
ছোড়লা তলায় দাঁড়িয়ে নাপিত বলে, হরি হরি।
দেবকান্ত, দেরুকান্ত সভাবন্দ নর
এই গোমোক্ষণের দক্ষিণা দিয়া কন্যা নিয়ে যান ঘর।
৪) শ্রীরামের বিবাহ শুনিয়াছেন সকল
মুনি দণ্ড কমণ্ডুলু করি হাতে
স্বর্গে নাচে দেবগণ, মর্ত্যে নাচে সর্বজন
হরিষে নারীগণ
শ্রীদেব সঙ্গে নাচিছেন ব্রহ্মা রঙ্গে।
শচী সঙ্গে নাচেন শচীপতি স্থাবর জঙ্গম আদি
সবে নাচে চমকারী, উল্লসিত নাচে
বসুমতি দিব্য দিব্য আভরণ সাজায় কত রাঙা পায়
শ্রীরাম নিরখিতে সম্মুখে নাচেন বিদ্যাধরী
রত্নের প্রদীপ জ্বালেন পরিপূর্ণ সারি সারি।
৫) শুনুন শুনুন মহাশয় করি নিবেদন
জানকী রামের বিবাহ কথা করুন শ্রবণ।
কন্যাদান মহাদান সর্বশাস্ত্রে কহে
তার সম ফল আর এ সংসারে নহে।
অবনীতে যদি কন্যাদান কেহ করে
ত্রিভুবন আনন্দিত প্রফুল্ল অন্তরে।
শুনেছিলাম শ্রীরামের বিবাহের কালে
হরের ধনুক ভেঙেছিল রাজার নন্দন।
শ্রীরামের আজ্ঞা পেয়ে গেলেন অন্ত: পুরে
রাজনন্দন আইল রাজকন্যা প্রফুল্ল অন্তরে।
গাল বাজাইয়া নৃত্য করে ত্রিলোচন
শ্রীরামের বিবাহ হয়েছিল, বদন ভরিয়া হরি হরি বল।
তথ্যসূত্র:
১) রাঢ়ের জাতি ও কৃষ্টি, প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয় খণ্ড: মানিকলাল সিংহ।
২) বাঙালি জাতি পরিচয়: শৌরীন্দ্র কুমার ঘোষ।
৩) ব্যক্তিগত ক্ষেত্র সমীক্ষা।