ছোট বেলায় মা-মাসীরা বলতেন “বলা মুখ আর চলা পা” নাকি নিয়ন্ত্রণ করা যায় না। কথাটা যে কতোটা সত্যি তা আজ হারে হারে বুঝতে পারছি।
কেন বুঝতে চলুন ফিরে যাই আজ থেকে ঠিক ছয় মাস আগে। তারিখটা 2রা ডিসেম্বর, 2019; রাজ্যসভায় দাঁড়িয়ে মাননীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ তথ্য সহ পরিসংখ্যান দিচ্ছেন যে 120 জন BJP-RSS কর্মীদের হত্যা করা হয়েছে কিন্তু একটি ক্ষেত্রেও ঐ মৃত্যুগুলোর তদন্ত পর্যন্ত করেনি তথাকথিত সাম্যবাদী কেরল সরকার। মৃতদেহগুলোকে কেমন বর্বরতার সাথে মৃত্যুর পরও পাশবিক প্রক্রিয়ায় খন্ড-বিখণ্ড করা হয়েছে তা মাননীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রীজী উত্থাপন করতেন কিনা জানা নাই কিন্তু পরিসংখ্যান শেষ হতে না হতেই বাম-কংগ্রেস এর তুমুল হট্টগোল এবং কিছুসময় এর জন্য সভা মুলতুবি। মনে রাখতে হবে অভিন্নহৃদয় বন্ধু বাম-কংগ্রেস যাঁরা ভারতীয় রাজনীতিতে নিজেদের মৌরসিপাট্টা ধরে রাখার জন্য 60 বছর নিজেদের মধ্যে যুদ্ধ-যুদ্ধ খেলা দেশবাসীকে প্রদর্শন করেছেন কিন্তু কংগ্রেস যতবারই ঘোর বিপদে পড়েছে সাহায্যের হাত বাড়াতে দ্বিধা করেনি বামেরা, যাঁরা নাকি তথাকথিত ভিন্ন মেরুর দল। এই মাণিকজোড় বাম-কংগ্রেস লোকসভায় বর্তমানে আনুবিক্ষণিক হয়ে গেলেও রাজ্যসভায় এখনও যথেষ্ট ক্ষমতাশালী। পুনরায় বলার সময় মাননীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নিজের অবস্থানের আরো কঠোর ব্যাখ্যা দিলেন কিন্তু যে সমস্ত সংবাদপত্র না পড়লে পিছিয়ে পড়তে হয় বা যাঁরা ভগবান ছাড়া কাউকে ভয় পান না বা যাঁরা ভগবানকেও ভয় পান না তাঁদের কলমের কালি হয়তো ঐ সময়ে বাড়ন্ত ছিল।
তাই ঠিক ছমাস পর যখন একটি 6 মাসের অন্তঃসত্ত্বা হাতিকে বারুদ ভর্তি আনারসের খেতে দিয়ে সচেতনভাবে তার মুখের মধ্যে বিস্ফোরণ ঘটিয়ে তাকে মৃত্যুমুখে পর্যবাসিত করা হলো অথচ ফরেস্ট অফিসার এর বয়ান অনুযায়ী হাতিটি মৃত্যু যন্ত্রণায় কাতর হয়েও কোন মানুষের বা একটিও ঘরবাড়ির ক্ষতি করেনি; যখন কেরলবাসী কোন মানুষের বা মনুষ্যগোষ্ঠীর বর্বরতা হার মানাল পশুর পাশবিকতাকেও অবাক হয়নি, একটুও অবাক হইনি। কেন অবাক হব? এই তথাকথিত সর্বাধিক শিক্ষিত কেরলই তো ভারত থেকে সবথেকে বেশী সংখ্যক জেহাদি জঙ্গির যোগান দেয় মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে। একটু ভেবে দেখুন তো “বাংলাপক্ষ” নিয়ে লড়াই করে দুধেভাতে “আমরা বাঙালি” রাই কেরল বন্যার সময় বেশ আন্দোলিত হয়েছিলাম এবং হাত উপুর করে দানও করেছিলাম CAG এর অডিটের আওতায় না থাকা কেরলের মুখ্যমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিলে; বেশ করেছিলেন করাটাই মানবিকতা ছিল।
কিন্তু অস্বীকার করতে পারেন ঐ সময় একটা হাওয়া তুলে দেওয়া হয়েছিল যে হাওয়াটা চোখে পড়েনি পাশ্ববর্তী ওড়িশা যখন ফণী ঝড়ে বিধ্বস্ত হয়েছিল।
আর এখন “আমরা বাঙালি” রাই যখন উম্ফুন এর তান্ডবে বিভিন্ন জায়গায় সহায়সম্বলহীন, গৃহহীন, বস্ত্রহীন, “আমরা বাঙালি” রা রাস্তার উপর ভ্যান রিক্সার উপর রাত্রিযাপন করছি অথচ সেই অদৃশ্য হাওয়া ওঠেনি। আচ্ছা হাওয়া না উঠলেও মেকলের শিক্ষাদর্শন অনুযায়ী সর্বাধিক শিক্ষিত কেরলবাসী পশ্চিমবঙ্গের জন্য কত সাহায্য করেছেন? আসলে এই অদৃশ্য হাওয়াই নিয়ন্ত্রণ করে আপনি মহারাষ্ট্রের পালঘরের সাধুহত্যা নিয়ে প্রতিবাদ করবেন নাকি সুদূর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কৃষ্ণাঙ্গ হত্যা নিয়ে, এই অদৃশ্য হাওয়াই নিয়ন্ত্রণ করে আপনি পাশ্ববর্তী বাংলাদেশ এর নিজেরা ছেড়ে আসা সহায়সম্বল নিয়ে পরিবারের মধ্যে একটু আলোচনা করবেন নাকি মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ নিয়ে রাজপথে মিছিলে হাঁটবেন, এই হাওয়াই নিয়ন্ত্রণ করেছিল আপনি সুদূর আমেরিকা নয়, প্রতিবেশী দেশের তিয়েনআমেন স্কোয়ারে গণতান্ত্রের পক্ষে, বাক স্বাধীনতার পক্ষে প্রতিবাদে জমায়েত হওয়া ছাত্রছাত্রীদের উপর পৈশাচিক গণহত্যার প্রতিবাদ করে বিপর্যস্ত হবেন নাকি তথাকথিত সাম্যবাদী যুক্তির মোড়কে পরিবেশন করা শ্মশানের শান্তির নীতি মেনে নিয়ে ‘ভয়ঙ্কর নিরাবতা‘ পালন করবেন।
এখন আবার কেরলের বর্বরতা নিয়ে নতুন নতুন ন্যারেটিভ সামনে আনা হচ্ছে, ‘বাঘ-সিংহদের’ নিজেরাই নিজেদের ইতিহাস লেখার মত বালখিল্যকর চিরাচরিত অলীক স্বপ্ন ফেরি করার মত ন্যারেটিভগুলোকে অবজ্ঞা করা গেলেও একটি গুরুত্বপূর্ণ ন্যারেটিভ খুব জোরের সাথে প্রচারিত হচ্ছে সেটি হল ‘একটি কঠোর আইন প্রণয়ন প্রয়োজনীয়‘। আচ্ছা আইন কি সত্যিই নেই? কিন্তু এই পাশবিকতাকে হার মানানো বর্বরতা কি শুধু আইন করেই নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব? তাহলে আবার রাষ্ট্রের নজরদারি, নাগরিকের পায়ে শৃঙ্খল পড়ানোর সাম্যবাদী অভিযোগ সামনে আসবে না তো? তাও যাদের কথা ভেবে আইন প্রণয়নের কথাটি সামনে এল তাঁরা তথাকথিত সর্বাধিক শিক্ষিত রাজ্যের জনগণ তাহলে তো মানতেই হবে গলদটা শিক্ষাব্যবস্থার এবং প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাপদ্ধতির মধ্যেই নিহিত আছে।
সবশেষে BBC-বাংলার বিচারে “আমরা বাঙালি” এর ভোটে সহস্রাব্দের সেরা বাঙালি হওয়ার দৌড়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কাছে পরাজিত প্রণম্য কবিগুরুর কথাতেই বলি “বিদ্যা সহজ, শিক্ষা কঠিন। বিদ্যা আবরণে, শিক্ষা আচরণে।।” তাই আজও যদি আমরা “আবরণ” নিয়েই ব্যস্ত থাকি শিক্ষাকে আচরণের মাধ্যমে প্রকাশ করে আমাদের নিয়ন্ত্রক হয়ে বসা এই অদৃশ্য হাওয়াকে প্রতিহত না করতে পারি এই অদৃশ্য হাওয়াই হয়তো একদিন আমাদেরকেও সহায়সম্বলহীন করে দেবে।
দ্বৈপায়ন ভারতীয় (Dvaipayana Varatiyo)