ভারতবর্ষ বীরের দেশ। ভারত বিদেশী শাসকদের বিরুদ্ধে স্বাধীনতা যুদ্ধ ও স্বাধীনতা যোদ্ধাদের দেশ। ভারতবর্ষ হলো দেশের মুক্তির জন্যে নিজেকে অবহেলে আহুতি দেওয়া দামাল ছেলেদের দেশ।
দ্বিতীয় তরাইনের যুদ্ধে ভারতের স্বাধীনতা অস্ত যাওয়ার পর থেকেই একদিকে যেমন এসেছে একের পর এক বিদেশী শাসন‚ তেমনি একইসাথে এসেছে অসংখ্য স্বাধীনতা যোদ্ধাদের ঢেউ। তারা নিজেদের প্রাণ বিলিয়ে দিয়েছে দেশের স্বাধীনতাকল্পে‚ দেশকে বিদেশী শাসকদের থেকে মুক্ত করার আশায়। যাদেরই অবিরাম জীবনপাতের ফলেই অবশেষে প্রায় ১০০০ বছর পর ১৯৪৭ সালে ভারত স্বাধীন হয়েছিল বিদেশী শাসনের হাত থেকে।
তেমনই এক বীর বিপ্লবী স্বাধীনতা সংগ্রামী হলেন কানাইলাল ভট্টাচার্য!
দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলার জয়নগরের মজিল পুরে ১৯০৯ সালে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম নগেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য। ছোটবেলা থেকেই দেশের প্রতি তাঁর ছিলো অগাধ ভালোবাসা। আর সেই ভালোবাসার টানেই তিনি জুড়ে গিয়েছিলেন অগ্নিযুগের বিপ্লবীদের সাথে। যে বিপ্লবীরা একসময় স্রেফ হাতবোমা ও রিভালভার মাত্র সম্বল করেই কাঁপিয়ে দিয়েছিলো ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের ভিত।
অলিন্দ যুদ্ধ খ্যাত বিনয়-বাদল-দীনেশের নাম নিশ্চয়ই আমরা সবাই জানি। সেই বিনয়-বাদল-দীনেশ‚ যাদের ভয়ে একদিন টেবিলের তলায় লুকিয়ে বেঁচেছিলো রাইটার্স বিল্ডিংয়ে বসে ভারতবর্ষ চালানো ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের জাঁদরেল অফিসাররা।
এখন‚ এই দীনেশ গুপ্ত ও রামকৃষ্ণ বিশ্বাসের ফাঁসির আদেশ দিয়েছিলেন ব্রিটিশ বিচারক আর গার্লিক। ফলে স্বাভাবিকভাবেই তাকে হত্যা করে ব্রিটিশদের সমুচিত জবাব দেওয়াটা দায়িত্বের মধ্যেই পড়ে যায় বিপ্লবীদের। আর
দেশের স্বার্থে গার্লিক নিধনের মতো কাজে যোগ্যতম ব্যক্তি হিসাবে বেছে নেওয়া হয় কানাইলাল ভট্টাচার্য্যকে।
বস্তুত দীনেশকে কানাই কোনোদিন চোখেও দেখেননি। এমনকি দীনেশ আর কানাইলাল এক সংগঠনের বিপ্লবীও ছিলেন না। দীনেশ ছিলেন বিভি বা বেঙ্গল ভল্যান্টিয়ার এবং কানাইলাল ছিলেন যুগান্তর দলের সদস্য।
তবুও দেশ ও জাতিপ্রেমের অমোঘ মন্ত্রে উজ্জীবিত কানাইলাল সেদিন এগিয়ে এসেছিলেন দীনেশের হত্যাকারীকে পালটা হত্যা করে সারা দুনিয়ার সামনে দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে। যে‚ মৃত্যুদণ্ড দিয়ে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামকে দমিয়ে রাখা যাবে না। একজনকে ফাঁসি দিয়ে ব্রিটিশ শাসক শ্বাস নিতে না নিতেই অপর আরেকজন এগিয়ে আসবে আগের জনের হত্যার প্রতিশোধ নিতে। আর তারপর আগেরজনের মতোই হেলায় বিসর্জন দিয়ে দেবে নিজের জীবন দেশমাতৃকার পদতলে।
এই দায়িত্ব পালনেই এগিয়ে আসেন কানাইলাল ভট্টাচার্য্য!১৯৩১ সালের ২৭ শে জুলাই গার্লিককে হত্যা করেন এই বিপ্লবী। আর একইসাথে ব্রিটিশ বাহিনীর গুলিতে মাত্র ২২ বছর বয়সেই শহীদ হন এই তিনি ।
কিন্তু অদ্ভুতভাবে, তাঁকে হত্যার পর ব্রিটিশ পুলিশ তাঁর পকেটে এক টুকরো কাগজ পায়। যাতে লেখা ছিল,
//“ ধ্বংস হও, দীনেশ গুপ্তর ফাঁসির দেওয়ার পুরস্কার লও “//
– বিমল দাশগুপ্ত।
প্রাচ্যের স্কটল্যান্ড ইয়ার্ড বলে পরিচিত কলকাতার পুলিশ দীর্ঘদিন তার প্রকৃত পরিচয় উদ্ধার করতে পারে নি। এমনকি শণাক্তকরণের সময় কানাইলাল এর বীরাঙ্গনা মাও নিজের ছেলের মৃতদেহ চিনতে অস্বীকার করে। পুলিশের হাজারো চাপের মুখেও নির্দ্বিধায় বলে যান – “ এ আমার কানু নয় “। সফল হয় বিপ্লবীদের পরিকল্পনা। তাদের আসল দলের সন্ধান পেতে ব্যর্থ হয় পুলিশ। এমন মায়ের ছেলে ছিলেন বলেই হয়তো এইভাবে আত্মত্যাগ করতে পেরেছিলেন কানাইলাল।
ভারতের মানুষ কিন্তু ভোলেনি এই বীর যুবককে। আজও জয়নগর মাজিল পুরের এই দামাল ছেলেদের স্মরণে পালিত হয় আত্মহুতি দিবস। তাঁর স্মৃতিতে আলিপুরের বেকার রোডের নামকরণ করা হয়েছে বিপ্লবী কানাইলাল ভট্টাচার্য রোড। তাঁর পৈতৃক বাড়ির সামনে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ব্রোঞ্জ মূর্তি। জন্মস্থান মজিলপুরের একটি রাস্তাও তাঁর নামে নামাঙ্কিত।।
মুক্তির মন্দির সোপানতলে যেসব প্রাণ বলিদান দিয়ে গেছে নিজেদের প্রাণ‚ কানাইলাল ভট্টাচার্য্য চিরকালই তাদের মধ্যে অন্যতম স্থান অধিকার করবেন।