১৯৪৪ এর অক্টোবরের এক সকাল। উত্তর কলকাতার নাট্যনিকেতন থিয়েটার। আজাদ কাগজে মৌলানা আক্রম খানের সম্পাদকীয় পড়তে পড়তে কপালের ভাঁজ গভীরতর হতে লাগলো বাংলা সিনেমার বিখ্যাত ভিলেন এবং বিখ্যাত নাট্যব্যক্তিত্ব নটসূর্য অহীন্দ্র চৌধুরীর। বললেন “সন্তানের রিহার্সালের জানাজানি হলো কিভাবে ?”
নাট্যনিকেতনের মালিক প্রবোধ গুহ বললেন
” বঙ্কিমচন্দ্রের আনন্দমঠের নাট্যরূপ দিয়েছেন বাণীকুমার।সুর দিয়েছেন পঙ্কজ মল্লিক আর সত্যানন্দের ভূমিকায় অভিনয় করছেন অহীন্দ্র চৌধুরী। চাপা থাকে?”
উঠে দাঁড়ালেন অহীন্দ্র চৌধুরী। একবার লালবাজারে যেতে হবে।পারমিশন করানোর জন্য। কয়েকবছর আগে মনমোহন থিয়েটারে শিবাজীর দেশপ্রেম নিয়ে নাটক শচীন সেনগুপ্তের “গৈরিক পতাকা” বন্ধ করে দিতে হয়েছে মৌলানা আক্রম খানের আপত্তিতে। সাহিত্যিক বুদ্ধদেব বসু মৌলানা আক্রম খানের প্রতিবাদ করেছিলেন। বঙ্কিমচন্দ্রের “রাজসিংহ” উপন্যাস অবলম্বনে ছায়াছবি বন্ধ করে দিতে হয়েছে। রঙপুর টাউন হলের এক সভায় মৌলানা আক্রম খান বাংলা ভাষাকে পৌত্তলিকদের ভাষা এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোগ্রামে “শ্রী এবং প্রথম” পৌত্তলিকদের প্রতীক বলেছেন। শেষ পর্যন্ত ফান্ড বন্ধ করে দেওয়ার হুমকিতে “শ্রী” বাদ গিয়েছে ।
প্রবোধ গুহের কন্ঠস্বর ম্রিয়মান শোনাল ” সন্তান নিয়ে না কোনো ঝামেলায় পড়ি অহীনবাবু। এত খরচ করে নতুন নাটক নামাবো।”
অনেকটা স্বগতোক্তির মতই অহীন্দ্র চৌধুরী বলে উঠলেন ” প্রতিবাদ করার, আপত্তি করার একটা ধুম উঠেছে। এমন দিন থাকবে না, দেখে নেবেন।”
লালবাজারের অ্যাসিস্ট্যান্ট কমিশনার সত্যেন্দ্রনাথ ঘোষ তেমন আশার আলো দেখাতে পারলেন না।
” রাজসিংহ নিয়ে দেখলেন তো কি গন্ডগোলটা হয়ে গেল ফার্স্ট শো তে। রিস্ক নেওয়ার আগে জনমত আপনাদের ফেবারে কিনা জানতে চেষ্টা করুন।”
সন্ধেবেলা নাট্যনিকেতনে একটা মিটিং বসল।
কেউ কেউ প্রস্তাব দিলেন, নাটকে গানটা থাক, কিন্তু বিজ্ঞাপনে না জানালেই হল। কিন্তু নটসূর্য এই ছলনার আশ্রয় নিতে রাজি হলেন না।
বাণীকুমার বললেন, ” শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জির কাছে যাওয়া হয়েছিল।”
অহীন্দ্র চৌধুরী জিজ্ঞাসা করলেন “তিনি কি বললেন?”
“নাটক চালিয়ে যাও। বন্দেমাতরম গাওয়া হোক। ওরা আপত্তি করছে, করতে দাও।”
অহীন্দ্র চৌধুরী বললেন, ” দর্শকদের মধ্যে অনেক বয়স্ক ব্যক্তি , মহিলা এবং শিশুরা থাকবেন। সেই সময় যদি অ্যাটাক হয়?”
কেউ কোনো কথা বলতে পারলেন না।
কিছুদিন পর আজাদ অফিসে মু$লিম লীগের আবুল কালাম সামসুদ্দিনের নামে একটা চিঠির এল। লিখেছেন অহীন্দ্র চৌধুরী।
“আনন্দমঠের নাট্যরূপ সন্তান আমরা মঞ্চস্থ করব ঠিক করেছি। আপনাদের সঙ্গে একটু আলোচনা করতে চাই। সামনের শনিবার বিকেলে নাট্যনিকেতনে আসুন। আমাদের সঙ্গে চা খেয়ে যাবেন।”
শনিবার বিকেলবেলা। নাট্যনিকেতন থিয়েটারের অফিস। অহীন্দ্র চৌধুরীর হাতে “সন্তান” নাটকের পান্ডুলিপি। ” আমরা এমনভাবে নাট্যরূপ দিয়েছি আপনাদের আপত্তির কোনো কারণ থাকতে পারে না। আমি নাটকটা পড়ছি। আপনি শুধু একটু ধৈর্য ধরে শুনুন।”
সামনে সোফায় বসা সামসুদ্দিন বললেন “আপনাদের খুবই কশাস হতে হবে অহীনবাবু। নয়তো রাজসিংহের দশা এটারও হতে পারে।”
অহীন্দ্র চৌধুরী পড়ে চলেছেন। রাত সোয়া আটটার নাগাদ পড়া শেষ হল।
সামসুদ্দিন বললেন, ” আনন্দমঠ নিয়ে আপনারা যথেষ্ট মাজা ঘষা করেছেন। কিন্তু “বন্দেমাতরম ” বাদ দিতে হবে। গোটা বন্দেমাতরম মু$লিমদের জন্য আপত্তিকর।”
“কিন্তু রবীন্দ্রনাথ তো এইটুকু রাখারই পরামর্শ দিয়েছিলেন। এ তো বাংলার প্রকৃতি বর্ণনা মাত্র।”
“কংগ্রেস রবীন্দ্রনাথের পরামর্শ মেনে নিয়েছে। কিন্তু আমরা মু$লিমরা মানতে রাজি নই। বন্দনা একমাত্র খোদা ছাড়া আর কাউকে মু$লমানেরা করতে পারে না। গানটা বাদ দিন।”
“কিন্তু সেটা কিকরে সম্ভব ?” অহীন্দ্র চৌধুরীর গলায় হতাশা ঝরে পড়ছিল।
“বন্দেমাতরম মানতে পারছি না। ওটা বাদ দিন।”
সন্তান নাটকটির উদ্বোধন কিছুদিনের জন্য স্থগিত রাখা হয়। একটা গুজব রটে গিয়েছিল অহীন্দ্র চৌধুরী আক্রম খানের চাপে নাটকটি থেকে “বন্দেমাতরম” সংগীতটি বাদ দিয়েছেন। হিন্দু ছাত্ররা থিয়েটারের দেওয়ালে পোস্টার মারতে থাকে, “বয়কট অহীন্দ্র চৌধুরী।” এই ভুল বোঝাবুঝি কেটে যায় দৈনিক বসুমতীর সম্পাদক হেমেন্দ্রকুমার ঘোষের সৌজন্যে। তিনি অহীন্দ্র চৌধুরীকে আসল ঘটনা বিবৃত করে একটি স্টেটমেন্ট দিতে বলেন। বসুমতী কাগজে প্রকাশ করা হয় সেই স্টেটমেন্ট।
হিন্দু জনসাধারণের চাপে মৌলানা আক্রম খান অ্যান্ড কোংএর অন্যায় আবদার খড়কুটোর মতো উড়ে গিয়েছিল সেইসময়। ১৯৪৫এর আঠেরোই জানুয়ারি “সন্তান” মঞ্চস্থ হয়। সুপারহিট হয়েছিল নাটকটি। মৃণালকান্তি ঘোষের গলায় “বন্দেমাতরম” গীত হওয়ার সময় দর্শকেরা উঠে দাঁড়িয়ে গলা মেলাতেন।
মজার কথা, মৌলানা আক্রম খান বাংলাকে পৌত্তলিকদের ভাষা বললেও পঞ্চাশের দশকে ভাষা আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন।
“সংখ্যালঘুকে কনসেশনের পর কনসেশন দিতে দিতে দেখা যাবে একসময় এর কোন শেষ নেই । এভাবে অন্যায় সুযোগ নেওয়া বন্ধ করা যায় না।”
তিরিশের দশকে যখন প্রথম “বন্দেমাতরম” নিয়ে বিতর্কের সূত্রপাত হয়, তখনই রবীন্দ্রনাথ গান্ধীকে সাবধান করে দিয়েছিলেন ।
তথ্যসূত্র: ১.আলো নেই। শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়। দে’জ পাবলিশার্স। পৃষ্ঠা ২৪০-২৪৫
২. শ্যামাপ্রসাদ। কালিদাস রায়।শ্যামাপ্রসাদ ফাউন্ডেশন। পৃষ্ঠা ৩৯
৩. নিজেকে হারায়ে খুঁজি। অহীন্দ্র চৌধুরী। ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েটেড পাবলিশিং কোং প্রাইভেট লিমিটেড। পৃষ্ঠা ৩৯৮-৪০৫
©পিনাকী পাল