অখন্ড ভারতের বৈরাগ্যপথ, এক মহাজীবনের পায়ের ধুলোয় আঁকা একতা

কথিত আছে প্রাচীন ভারতে গুরুগৃহে শিক্ষালাভের পর স্নাতক হলে দেশভ্রমণ না করলে শিক্ষার পাঠ সম্পূর্ণ হতো না কারো। এ বিষয়ে পুরাণ ইতিহাস ও চারণ কবি রচিত বিভিন্ন গান দোঁহা ইত্যাদিতে রয়েছে অসংখ্য প্রমাণ। মহিলা শিক্ষার্থীরাও এ প্রথা পালনে ব্যতিক্রম ছিলেন না। উদাহরণ দিতে বসলে সেটা নিয়ে আস্ত একটা বই হয়ে যাবে।

যারা বৈরাগ্যপথ অবলম্বন করে ‘বহুজন হিতায় বহুজন সুখায়’ র জন্য আত্মোৎসর্গ করতেন তাঁরাও সারা ভারতের পথের ধুলো মেখে নিতেন তাঁদের জীবনে। যে যে ইতিহাস আমরা ভুলে গেছি সেকথা বাদ দিয়ে ইতিহাসের আলোতে বৈরাগ্য পথ অবলম্বনকারী যেসব মহান আত্মাদের জীবন সম্পর্কে আমরা জানতে পারি তাঁদের জীবনের পথ তো আসলে যাত্রাই। বুদ্ধ, শঙ্করাচার্য্য , ত্রৈলঙ্গ স্বামী, গুরু নানক, কবীর , মীরা, শ্রী চৈতন্য, স্বামী বিবেকানন্দ…কত কত নাম যে বলা হলো না। সবাই সাধনপথে অগ্রসর হয়ে যখন সেই উপলব্ধিতে পৌঁছন যেখানে আমি, তিনি বিশ্বজগৎ কোথাও কোনো ভেদ নেই, তারপর শুরু হয় তাঁদের যাত্রা।

আসলে ভারতের আত্মাকে প্রাণে প্রাণে উপলব্ধি করতে গেলে বোধহয় ভারততীর্থর ধুলো ছুঁয়ে দেখা প্রয়োজন। একটু খেয়াল করে যদি দেখা যায়, সমস্ত সাধনপথের পথিকের রাস্তা তাই বহুবার বিভিন্ন তীর্থে মিলিত হয়। হিন্দু বৌদ্ধ শিখ সমস্ত সনাতন বিশ্বাসীদের বিশ্বাসের পবিত্র তীর্থগুলি প্রায় এক , কাছাকাছি। একটাই উদাহরণ দেব , বেনারস…এই সুপ্রাচীন শহরের ধুলোয় মিশে আছে সব মতের সব গুরুদের যাত্রাপথের চিহ্ন। এরকম বহু তীর্থই আছে অখন্ড ভারতের সর্বত্র।

এই যাত্রা বা পরিক্রমাকে এতোটাই গুরুত্ব দেওয়া হয় সনাতন বিশ্বাসে যেখানে একটি নদীর চতুর্দিক পরিক্রমা করে লাভ করা যায় আধ্যাত্মিক জীবনচর্যার সবটুকু। সেই নদীর নাম নর্মদা।

নর্মদার তীর থেকে যে আট বছরের বালকের আত্মচেতনার উন্মেষ ঘটে, সেই বালক তাঁর সমস্ত সাধনা শেষ করে যে উপলব্ধিতে পৌঁছন, সেই উপলব্ধি আসলে তাঁর স্বল্পায়ু জীবনে তিনি কার্য্যে পরিণত করে গেছেন। মাত্র বত্রিশ বছরের আয়ুষ্কাল ছিল তাঁর। তিনি বুঝেছিলেন অখণ্ড ভারতভূমির বিস্তীর্ণ অঞ্চলের বহু মানুষ যে একসুতোয় বাঁধা তা তারা বিভিন্ন আলাদা মতে উপলব্ধি করতে গিয়ে ক্রমশ বিস্মৃতপ্রায়। সবাই এটা ভাবছে যত মত তত পথ। কিন্তু মূলে যে এক সনাতন দর্শন তা ভুলে নিজনিজ গুরু এবং তৎনির্দিষ্ট পথে কেবলই একে অপরের থেকে ঝগড়া বিবাদ করে দুরে সরে যাচ্ছে।

শুরু হলো আচার্য্য শঙ্করের যাত্রা। উদ্দেশ্য একটাই অখণ্ড ভারতভূমিকে একসুতোয় বাঁধা। যত মতের যত পথের তার্কিক আছে সবাইকে পরাস্ত করে সবাইকে এক সুতোয় বেঁধে তৈরি হলো দশনামী সম্প্রদায়। তৈরি হলো চার ধাম। যাতে উপলক্ষ্য অর্থাৎ নিজনিজ গুরুবাদ নিয়ে পরস্পরে বিবাদ কখনো উদ্দেশ্যকে অর্থাৎ সনাতন দর্শনে পথ চলাকে ছাড়িয়ে না যায়। এতো স্বল্প সময়ের জীবনে এতো কাজ করেছিলেন, যা এখানে বলা সম্ভব নয়। এতো বড় ভারতভূমির এত পথ অতিক্রম করেছিলেন এবং কোনো যানবাহন ছাড়াই সেই অষ্টম শতাব্দীতে, যতবার ভাবি আমার এই তুচ্ছ বুদ্ধিতে সেই কর্মযোগের কোনো কুলকিনারা পাই না। এখানে কেবল ছবি দিলাম। সেই মহাজীবনের যাত্রাপথ যদি কয়েক আঁচড়ে ধরা যেত।

স্বাগতা মণ্ডল

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.