৩৫০ বছরেরও বেশী প্রাচীন এক শিব মন্দির |মন্দিরের পাশেই ১৪ একরের একটা বিশাল দিঘী,দিঘীকে বেষ্টন করে লক্ষ ভক্ত দিঘীর জলে ডুব দিয়ে ঘটে জল ভরে মন্দিরে ঢুকছেন |চৈতিমাসের চড়া রোদ উপেক্ষা করে আরও কয়েক হাজার ভক্তের লম্বা লাইন এঁকেবেঁকেঁ এগোচ্ছে আগের দিন রাত থেকে পরের দিন সন্ধ্যা পর্যন্ত |না কোনো কল্পদৃশ্য নয়,নীলষষ্ঠীতে অর্থাৎ চৈত্রমাসের সংক্রান্তির দিন প্রতিবছর এরকমই দৃশ্য চোখে পড়ে মেদিনীপুরের আনন্দপুর থানার কাণাশোলের বাবা ঝাড়েশ্বরের মন্দিরে|
মন্দির তৈরির ইতিহাস ঘাটলে মোটামুটি দুটি মত পাওয়া যাবে|জনশ্রুতি অনুযায়ী জানা যায় আগে জঙ্গলে বটগাছের নীচে একটি কৃষ্ণগাভী প্রতিদিন দুধ ঢেলে দিত,একদিন ওই দৃশ্যটি একজন রাখাল বালকের চোখে পড়ে|ওই রাতেই স্বপ্নাদিষ্ট হন ওই গাভীটির মালিক,ব্রাহ্মণভূমের রাজা আলালনাথ দেব ও আড়িয়াদহের নিষ্ঠাবান ব্রাহ্মণ শীতলানন্দ মিশ্র |যেই স্থানে কৃষ্ণগাভীটি রোজ দুধ ঢেলে দিত সেই স্থানেই খনন করে পাওয়া গেল শিবের অনাদি লিঙ্গ|সেই প্রাচীন বটবৃক্ষ তলে দেবাদিদেব মহাদেব পূজিত হয়ে আসছেন বাবা ঝাড়েশ্বর নামে|এ তো গেল জনশ্রুতি |
তবে ঐতিহাসিক পটভূমিতে বিচার করলে জানা যায় ১৬২৯খ্রী:(১০৩৬ বঙ্গাব্দ)এ ভাদ্রমাসের কৃষ্ণা চতুর্দশী তিথিতে বর্তমান শিবলিঙ্গটির প্রতিষ্ঠা করা হয় |1834খ্রী:(১২৪১ বঙ্গাব্দ)এ নাড়াজোলের রাজা অযোধ্যারাম খানের দেওয়ান রামনারায়ণ জানা বর্তমান এই মন্দিরটি প্রতিষ্ঠা করেন |মন্দিরটি নিয়ে বহু অলৌকিক কাহিনী ছড়িয়ে আছে|শুধু পশ্চিম মেদিনীপুর নয় ভিনজেলা এমনকী ভিনরাজ্য থেকেও পুণ্যলাভের আশায় বাবার মাথায় জল ঢালতে আসেন |চৈত্রমাসের নীলষষ্ঠী বা গাজন উৎসব ছাড়াও শ্রাবনী উৎসব,শিবরাত্রি,ও দূর্গোৎসবের সময় প্রচুর ভক্তসমাগম ঘটে |বিভিন্ন ঐতিহাসিক রচনা ও স্থানীয় লোকজনের সাথে কথা বলে জানা যায় 1834খীষ্টাব্দের পর 1930,1860 ও 1999 খ্রীষ্টাব্দে তিনবার মন্দিরটি আংশিকভাবে সংস্কার করা হয়|বর্তমানে মন্দিরে প্রবেশপথে কানাশোল বাজারে একটি তোরণ তৈরির কাজ চলছে |
মন্দিরের নির্মাণ শৈলী নিয়ে বলতে গেলে বলতে হয় এটি একটি ৬৭ ফুট উচ্চতা বিশিষ্ট একটি বাঁকানো কার্নিশযুক্ত পঞ্চরত্ন মন্দির |মন্দিরগাত্রে রয়েছে অসংখ্য পোড়ামাটির কাজ|পোড়ামাটির মূরতিগুলির মধ্যে রয়েছে বিভিন্ন দেবদেবীর মূর্তি,রাধাকৃষ্ণের লীলা,রামায়ণের কাহিনী,দশাবতার,মিথুনদৃশ্য সহ বিভিন্ন পৌরানিক কাহিনী |
মন্দিরের প্রশস্ত গর্ভগৃহে রয়েছে শিবের গৌরীনট বেষ্টিত শিবের অনাদি লিঙ্গ ও দেওয়ালে চালচিত্রের মধ্যে অষ্টাদশভূজা মা দূর্গার প্রতিকৃতি |মূল মন্দিরের পাশেই রয়েছে মহাকাল ভৈরবের থান,নাটমন্দির, ভোগমন্দির ও নেতনালা|জানা যায় 1851খ্রীষ্টাব্দে সনাতন চৌধুরী আটচালা রীতির এই ভোগমন্দিরটি তৈরি করেন |মন্দিরের পেছনেই রয়েছে ১৪ একরের এক বিশাল দিঘী যেটি রাজা আলালনাথ দেব খনন করেন |রাজা আলালনাথ দেবের নাম অনুসারে এই বৃহৎ দিঘীটি “আলাল দিঘী” নামে পরিচিত |রাজা আলালনাথ দেবের মৃত্যুর পর তাঁর ভাই নদীয়ালদেব দাদার স্মৃতির উদ্দেশ্যে দিঘীর মাঝখানে মাকড়া পাথরের “জলহরি” মন্দির নির্মাণ করেন|তবে দেখভাল ও পরিচর্যার অভাবে জলহরি মন্দিরটি এখন লুপ্তপ্রায়|সঠিক ভাবে তুলে ধরতে পারলে পশ্চিম বঙ্গের পর্যটন মানচিত্রে মন্দিরটি একটি বিশেষ স্থান অর্জন করবে বলে আশা রাখতে পারি|