আপনার বাড়ি ভেঙ্গে আপনাকে উৎখাত করতে চেয়ে কেউ সেই জায়গায় গায়ের জোরে নিজের বাড়ি তুলে নিল। কিন্তু আপনি সেখান থেকে উৎখাত হতে রাজি হলেন না, জমি আঁকড়ে, মাটি কামড়ে আপনার উৎখাত হওয়া বাড়ির সামনেই হত্যে দিয়ে পড়ে রইলেন বছরের পর বছর, প্রজন্মের পর প্রজন্ম, শতাব্দীর পর শতাব্দী। বার বার চেষ্টা করলেন আপনার বাড়িটিকে পুনরুদ্ধার করতে, কিন্তু হার মানলেন হানাদার দখলকারীদের পেশীশক্তির সামনে।
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ক্রমশঃ দুর্বল হতে থাকল দখলদারের পেশীশক্তি; তারপর একদিন যখন আপনি পেশীশক্তিতে দখলদারকে হারিয়ে দেওয়ার মতো অবস্থায় পৌঁছলেন, ততদিনে যুগ বয়ে গিয়েছে, কেটে গিয়েছে পেশীশক্তির আমল। যখন এই দখলদাররা কেবলমাত্র পেশীশক্তির জোরে আপনাকে উচ্ছেদ করেছিল আপনার বাসভূমি থেকে, যখন তারা আপনাকে আপনারই বাসভূমির বাইরে রাখতে বার বার ব্যবহার করেছিল পেশীশক্তি, তখন সেই পেশীশক্তির বিরুদ্ধে সমাজ দকোনও কথা বলেনি; কিন্তু যখন নিজের সেই বাসভূমি পুনরুদ্ধার করতে পেশীশক্তি ব্যবহার করতে চাইলেন আপনি, তখন আপনার সেই পেশীশক্তি ব্যবহারের বিরুদ্ধে নিন্দায় মুখর হল সমাজ। সমাজ আপনাকে জানালো যে, পেশীশক্তির যুগ কেটে গিয়েছে, এসেছে আইনি শক্তির যুগ। তাই আপনাকে, নিজের সেই পুরোনো বাসভূমি পুনরুদ্ধার করতে গেলে এবার আইনি শক্তিই ব্যবহার করতে হবে। কালের আদেশকে মাথা পেতে নিয়ে আপনি যখন আইনি শক্তি ব্যবহার করতে উদ্যত হলেন, তখন আপনাকেই প্রশ্ন করা হল, এই বাসভূমি যে আপনারই, তার কি কোনও প্রমাণ আছে? কী প্রমাণ দেবেন আপনি? দখলদারেরা তো দখল করে আছে কয়েক শতাব্দী ধরে। অধিকাংশ প্রমাণই তো ধুয়ে গেছে কালস্রোতে! তাহলে? তবু আপনি আপনার সেই শতাব্দী প্রাচীন বাসভূমির খণ্ডিত ভাঙ্গা টুকরোগুলি, যা ব্যবহার করেই দখলদারেরা তাদের বাড়ি তুলেছিল, তা-ই দেখিয়েই প্রমাণ করতে চাইলেন আপনার অপহৃত অধিকার। কিন্তু আইনি যুদ্ধ তো আর পেশীযুদ্ধের মতো তাৎক্ষণিক ফলদায়ক নয়! তা যে সময়সাপেক্ষ! তাই আবার আপনি প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে লেগে থাকলেন আইনি যুদ্ধে। দখলদারেরা নানাভাবে বিভ্রান্ত করতে চেষ্টা করল আদালতকে। একদিন ধৈর্যের বাঁধ ভেঙ্গে গেল আপনার। হঠাৎ ভুলে গেলেন, এখন যে আপনি আইনি লড়াইয়ে রত, পেশীর লড়াইয়ে নয়। শতাব্দীর পুঞ্জীভূত ক্ষোভ এক আকস্মিক অগ্ন্যুৎপাতের রূপ নিয়ে চুরমার করে দিল আপনার পুরাতন বাসভূমির ওপর গড়ে তোলা দখলদারীর প্রমাণ-কাঠামোকে। এবার দখলদারেরা সুযোগ পেয়ে গেল আপনাকেই হানাদার দাগিয়ে দেওয়ার। “তুমি মহারাজ সাধু হলে আজ, আমি আজ চোর বটে”—‘তুমি হানাদার অধিকারী আজ, আমি আজ হানাদার বটে’। কিন্তু আইনি লড়াই থেমে থাকল না। এরও দীর্ঘ এক প্রজন্ম পরে এল আইনি লড়াইয়ের ফলাফল। ক্ষুদ্র সীমিত দূরদৃষ্টিহীন বিচারের পরিবর্তে আপনি পেলেন প্রকৃত বিচার। বিচারক যখন ঘটনাটির বিগত মাত্র এক প্রজন্মের ইতিহাসকেই সম্পূর্ণ গুরুত্ব দিতে অস্বীকার করে ঘটনার শতাব্দীর পর শতাব্দী প্রাচীন প্রবাহকে সামগ্রিকভাবে বিচার করলেন, আপনার বহু প্রজন্মের সাধনা, ধৈর্য, নিষ্ঠা ও শত অত্যাচার সয়ে মাটি কামড়ে পড়ে থাকার সংকল্পকে উপযুক্ত স্বীকৃতি দিয়ে বিচারক যখন তাঁর রায় শোনালেন, তখন অবশেষে আপনি ন্যায়সঙ্গতভাবে ফিরে পেলেন আপনার সাবেক বাসভূমি। এই যে বিচারের সম্পূর্ণতা, বিচ্ছিন্ন ঘটনাকে সম্পূর্ণ গুরুত্ব দিতে অস্বীকার করে সামগ্রিক ঘটনাপ্রবাহের একত্রিত বিচার, এ কি অন্যায়? নাকি এ-ই হল ন্যায়ের প্রকৃত, প্রকৃষ্ট উদাহরণ?
সুপ্রিম কোর্টের রামজন্মভূমি সংক্রান্ত এহেন রায় পশ্চিমবঙ্গের সংবাদমাধ্যমগুলির আদৌ পছন্দ হয়নি। তাদের মূল প্রতিপাদ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে এই যে, যেখানে সুপ্রিম কোর্টের বিচার্য ছিল একটি টাইটেল স্যুট বা সম্পত্তির অধিকার, সেক্ষেত্রে রায়ে জয় হল কিনা ধর্মবিশ্বাসেরই। সংখ্যাগরিষ্ঠের ধর্মবিশ্বাসের?
এই মত প্রচারের মাধ্যমে পশ্চিমবঙ্গের সংবাদপত্রগুলি মানুষের মনের মধ্যে এই ধারণা গেঁথে দিতে চাইছে যে, ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের মতামতই এক্ষেত্রে কোর্টের মত হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাদের সংবাদ ও মতামত পরিবেশনের ধরন দেখে স্পষ্টতই মনে হচ্ছে, এনিয়ে তারা মানুষকে রায়ের বিরুদ্ধে রীতিমতো প্ররোচিত করতে চাইছে। যদিও বর্তমান পরিস্থিতিতে হলুদ ও তৈলাক্ত সাংবাদিকতার যে পরাকাষ্ঠা পশ্চিমবঙ্গের সংবাদমাধ্যমগুলি সাধারণতঃ প্রদর্শন করে থাকে, তাতে তাদের এমন প্রচার মোটেই অপ্রত্যাশিত নয়।
তবে শুধু এরাজ্যের সংবাদমাধ্যমগুলিই নয়, একটি বিখ্যাত জাতীয় সংবাদমাধ্যমের একজন স্বনামধন্য সাংবাদিকও সুপ্রিম কোর্ট বিচারপতি শরদ অরবিন্দ বোবডের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে তাঁকে বার বার জিজ্ঞেস করেছেন, রামমন্দির বিচার প্রক্রিয়ায় সুপ্রিম কোর্টের ওপর সরকারের তরফ থেকে কোনওরকম চাপ সৃষ্টি করা হয়েছিল কিনা। উত্তরে জাস্টিস বোবডে শান্ত ও দ্ব্যর্থহীন ভাবে জানিয়ে দিয়েছেন, না,এমন কিছু কখনও ঘটেনি। তাঁর এই নেতিবাচক উত্তর সাংবাদিকমশাইকে বিশেষ খুশি করতে পেরেছে বলে মনে হয়নি।
আনন্দবাজার পত্রিকা অবশ্য অশোক গাঙ্গুলির মতো প্রাক্তন বিচারপতিকে দিয়ে এমন মন্তব্য করিয়ে নিতে পেরেছে যে, অযোধ্যায় ছিল একটি মসজিদ, যেটিকে ভাঙ্গা হয়েছিল, তারপর বিচারে রায় বের হল যে, সেখানে মসজিদ নয়, মন্দিরই হবে। অর্থাৎ বলতে চাওয়া হল যে, যে-স্থানে মসজিদ ছিল, টাইটেল স্যুটই যদি বিচার্য হয়, তবে সেই স্থানে মসজিদের পক্ষেই রায় যাওয়া উচিত ছিল। কিন্তু প্রশ্ন জাগে,অশোক গাঙ্গুলির মতো সম্মাননীয় প্রাক্তন বিচারপতি সুপ্রিম কোর্টের ফুল বেঞ্চের সর্বসম্মত রায় সম্পর্কে এমন অসম্পূর্ণ ও অর্ধসত্য মন্তব্য আদতেই করেছিলেন কি? নাকি তাঁর বক্তব্যের অংশবিশেষকে নিজেদের পছন্দমতো উপস্থাপন করেছে আনন্দরা? এমন সব ধন্দ দেখা দিচ্ছে বহু মানুষের মনেই। তাই এ বিষয়ে সবিস্তারে আলোকপাত করা প্রয়োজন। সত্যিই কি সুপ্রিম কোর্ট সম্পত্তির অধিকার বিচার করেই বিতর্কিত জমির মালিকানা রামলালাকে দিয়েছেন? নাকি সুপ্রিম কোর্টের এই বিচার আদতে ধর্মীয় ভাবাবেগে আক্রান্ত? রাজ্যের সংবাদমাধ্যমগুলি যখন সম্মিলিতভাবে সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করছে বলে সন্দেহ দেখা দিচ্ছে, তখন সাধারণ মানুষকেই তাদের সীমিত ক্ষমতা নিয়ে সেই সন্দেহ নিরসনের চেষ্টায় সচেষ্ট হতে
অশোক গাঙ্গুলি মশাই বলেছেন যে, অযোধ্যার বিতর্কিত স্থানে ছিল একটি মসজিদ যেটিকে ১৯৯২ সালে করসেবকরা ভেঙ্গে দেয়। সেই সঙ্গে তিনি এই সত্যটিও কি উচ্চারণ করেছিলেন যে, অযোধ্যার ওই বিতর্কিত স্থানটিতে নিজেদের অধিকার দাবি করে সর্বপ্রথম আদালতের দ্বারস্থ হয়েছিল হিন্দুরাই এবং তা ১৮৮৫ সালে ফৈজাবাদ সাব-জজের আদালতে ভারতের সেক্রেটারি অব স্টেটের বিরুদ্ধে (Suit No. 61/280)? বস্তুতঃ, রামজন্মভূমি-বাবরি মসজিদ বিষয়ে ভারতীয় আদালতে নথিবদ্ধ প্রথম মামলা এটিই। এই মামলায় মহন্ত রঘুবর দাস বিতর্কিত জমির স্বত্ত্ব দাবি করেন এবং আদালতের কাছে মন্দিরের পূর্ব চত্বরে রাম চবুতরার ওপরে মন্দির নির্মাণের অনুমতি প্রার্থনা করেন। মহন্ত রঘুবর দাস ছিলেন রাম জন্মস্থানের মহন্ত এবং তাঁর দাবি ছিল, ওই রাম চবুতরাই হল ভগবান শ্রীরামচন্দ্রের জন্মস্থান। সেই মামলার পরিপ্রেক্ষিতে মসজিদ পক্ষ কিন্তু কোনও পাল্টা মামলা তখন দায়ের করেনি। অতএব বিতর্কিত স্থানে মসজিদ থাকা সত্ত্বেও সেই কাঠামোর স্বত্ত্ব আদালতে প্রথম দাবি করেছিলেন মন্দির পক্ষই। (অর্থাৎ বাড়ি আপনার, দখল করেছে হানাদারেরা, তুলেছে নিজেদের কাঠামো, এবার তাদের হাত থেকে নিজের বাড়ির দখল পুনরুদ্ধার করতে যখন আদালতের শরণাপন্ন হওয়ার সুযোগ প্রথম মিলল, তক্ষুনি আপনিই প্রথম বিষয়টিকে আদালতে নিয়ে গেলেন) জমি মামলার শুনানিতে এই তথ্যটি আদালতের কাছে গুরুত্বপূর্ণ ছিল।
দখলই অধিকারের সার
এই জমি-বিবাদটির প্রকৃত স্বরূপ বুঝতে গেলে বিবাদের সময়ানুক্রম ও ঘটনাক্রম জানা প্রয়োজন। সময়ানুসারী ঘটনাক্রমটি অনুসরণ করলে স্পষ্ট হবে যে, মন্দির ভাঙ্গার পরেও এবং ভগ্ন মন্দিরের স্থানে মসজিদ নির্মাণের পরেও হিন্দুরা কোনোদিনই, এমনকি এক দিনের জন্যও সেই স্থানে পূজার্চনা বন্ধ করেননি। অর্থাৎ মন্দির ভেঙ্গেই যে মসজিদ নির্মিত হয়েছিল তার কোনও সরাসরি প্রমাণ নেই বলে পশ্চিমবঙ্গীয় বহু সংবাদ মাধ্যম যে প্রচার চালাচ্ছে তা নিরর্থক ও অসার। কারণ একথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, ইসলামের জন্ম ভারতবর্ষে নয়। আরবদেশ থেকে তাদের এদেশে আগমন। ভারতবর্ষের মাটিতে বর্তমানে অবস্থিত কোনও মসজিদই মুসলমান আক্রমণের আগে এদেশে ছিল না। সুতরাং অযোধ্যার ওই মসজিদ যখনই নির্মিত হয়ে থাকুক না কেন তার আগে ওখানে মসজিদ ছিল না, কিন্তু অযোধ্যা যে তখনও ছিল, সে বিষয়ে সংশয় নেই। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ্য যে নানা ঐতিহাসিক উপাদান থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী ১৫২৮ খ্রিস্টাব্দে বাবরের সেনাধ্যক্ষ মির বাঁকি অযোধ্যার একটি নির্দিষ্ট স্থানে তৈরি করেন এই মসজিদ যেখানে ছিল একটি মন্দির যেটিকে হিন্দুরা রামের জন্মস্থান বলে মানতেন এবং নিয়মিত সেই স্থানে পূজার্চনা করতেন। অপরপক্ষে ১৫১০ খ্রিস্টাব্দে শিখ গুরু ‘গুরু নানকদেব’ তাঁর “বাবরবাণী”তে অযোধ্যার উল্লেখ করেছিলেন “শ্রী রামচন্দ্রজি’র শহর” বলে। অর্থাৎ বাবরি মসজিদ গড়ে ওঠার অনতিপূর্বেও অযোধ্যার সঙ্গে শ্রীরামচন্দ্রের সংশ্লিষ্ট থাকার প্রামাণ্য ঐতিহাসিক নথি রয়েছে। অর্থাৎ অযোধ্যা ও রাম আগে, মসজিদ পরে। সময়ের এই ক্রমটিও লক্ষ্যণীয় ও গুরুত্বপূর্ণ। হিন্দুদের মতে, অযোধ্যার ওই প্রাসাদেই জন্মগ্রহণ করেছিলেন শ্রীরাম। অর্থাৎ ওটি একটি সাধারণ রামমন্দির ছিল না, হিন্দুর বিশ্বাসে ওটি ছিল ভগবান শ্রীরামচন্দ্রের জন্মস্থান। যাঁরা এই বিশ্বাসটি সম্পর্কেই প্রশ্ন তোলেন, তাঁদের উদ্দেশে সবিনয়ে বলতে চাই, ধর্মবিশ্বাসের যাথার্থ্য বা যৌক্তিকতা বিচার করা এ প্রবন্ধের প্রতিপাদ্য নয়। বরং, সুপ্রিম কোর্ট যে বিতর্কিত স্থানে রামলালার অধিকারই সুনিশ্চিত করেছেন (রামলালা কাল্পনিক চরিত্র হোন্ অথবা বাস্তব) এবং মসজিদ পক্ষকে অন্যত্র সরে যেতে বলেছেন, তা কি জমি মামলার আইন ও যুক্তি অনুযায়ী, নাকি ধর্মবিশ্বাসের ভাবাবেগের উপর ভিত্তি করে? এ প্রবন্ধে আলোচ্য শুধু সেটুকুই।
অযোধ্যার বিতর্কিত স্থানে মন্দির ভেঙ্গেই যে মসজিদ গড়ে উঠেছিল, তার সপক্ষে অজস্র লিখিত ঐতিহাসিক তথ্যাবলী রয়েছে যেগুলির সবিস্তার উল্লেখ এ প্রবন্ধে করব। কিন্তু এত সব তথ্য থাকা সত্ত্বেও সেসব জোর করে অস্বীকার করে তর্কের খাতিরে যদি ধরে নিতেই হয় যে মন্দির ভেঙ্গে মন্দিরের জায়গায় মসজিদ হয়নি, বরং কোনও ফাঁকা জমিতেই মসজিদ তৈরি হয়েছে (সুপ্রিম কোর্টের রায়ে উল্লেখিত ASI-এর রিপোর্ট অনুসারে যা আদতে সত্য নয়), তথাপি একথা অনস্বীকার্য যে, ওই বিতর্কিত মসজিদের ভিতরেও (এবং মসজিদপক্ষীয়দের পেশীশক্তির জোরে যখন তা নিতান্ত অসম্ভব হয়েছে তখন তার সম্ভাব্য নিকটতম স্থানে) নিয়মিত পূজার্চনা চালিয়ে গিয়েছে হিন্দুরা এবং অনবরত মসজিদ-অধিকৃত স্থানটিকে নিজেদের দেবতার জন্মস্থান বলে দাবি করে এসেছে। এক দিনের জন্যও সেই জমির ওপর থেকে তাঁদের দাবি ছেড়ে দেননি হিন্দুরা। যখন যখন দখল ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন, তখনও নিরবচ্ছিন্নভাবে সম্ভাব্য নিকটতম স্থান থেকে নির্দিষ্ট এই জন্মস্থানের উপরে তাঁদের দখলের দাবি জানিয়ে গিয়েছেন। স্বেচ্ছায় কোনওদিন ঐ স্থানের দখল ছাড়েননি তাঁরা। যেহেতু আইনানুসারে যে কোনও সম্পত্তির ওপর দখল কেবলমাত্র পূর্ব দখলদারের স্বেচ্ছানুমতিতেই হস্তান্তরিত হওয়া সম্ভব; সুতরাং যদি দেখা যায় যে, কোনও সম্পত্তির ওপর কোনও ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গ বা গোষ্ঠীর অতীতে কোনওকালে নিরঙ্কুশ, স্বত্ত্বপূর্ণ দখল ছিল এবং সেই ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গ বা গোষ্ঠী তৎপরবর্তীকালে কখনও কোনও স্বেচ্ছানুমতির দ্বারা সেই দখল অন্য কাউকে হস্তান্তর করেনি, তাহলে আইনানুসারে, নিছক আইনানুসারেই, সেই সম্পত্তির ওপর সেই ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গ বা গোষ্ঠীর স্বত্ত্বাধিকার নির্দিষ্ট হয় সেই অতীতের, দখলিকৃত সময়ের স্বত্ত্বাধিকারক্রমেই। এই দিক থেকে দেখলে মন্দিরপক্ষীয়রা যেহেতু কোনওদিনই কোনও স্বেচ্ছানুমতির দ্বারা জন্মস্থানের ওপর দখল মসজিদপক্ষীয়দের হস্তান্তর করেনি এবং অতীতে, সে ৫০০ বছর, ৬০০ বছর বা যে কোনও সুদূর অতীতেই হোক না কেন, অন্ততঃ মসজিদ নির্মাণের আগে সেই জন্মস্থানটির ওপর মন্দিরপক্ষীয়দেরই স্বত্ত্ব ও দখল ছিল (ASI রিপোর্ট অবলম্বনে সুপ্রিম কোর্ট তাঁদের রায়ে একথা স্পষ্ট উল্লেখ করেছেন যে জন্মস্থানে গড়ে ওঠা বাবরি মসজিদটি কোনও ফাঁকা জমিতে গড়ে তোলা হয়নি, বরং গড়ে তোলা হয়েছিল কোনও “নন-ইসলামিক” স্থাপত্যের ওপরে, যে স্থাপত্যটি মন্দিরের কিনা তা নির্দিষ্ট করে বলা সম্ভব নয়), সুতরাং আইনানুসারে আজও সেই জন্মস্থানের ওপরে দখল বা স্বত্ত্ব মন্দিরপক্ষীয়দেরই থাকা সঙ্গত। জমি বিবাদের মীমাংসা করতে গিয়ে হিন্দুদের পক্ষে এটিই সবচেয়ে জোরালো প্রমাণ হয়ে দাঁড়িয়েছে সুপ্রিম কোর্টের কাছে। আইনের ভাষায় দখলই অধিকারের সার, যা হিন্দুরা কখনওই, এমনকি একদিনের জন্যও স্বেচ্ছায় ছাড়েননি, হস্তান্তরের তো প্রশ্নই নেই। Possession is the essence of right.
মন্দির ভেঙেই মসজিদ, ভাঙল কে?
অতঃপর এ বিষয়ে যেসব ঐতিহাসিক তথ্য রয়েছে, সময়ের ক্রম অনুসারে একে একে সেগুলিকে তালিকাবদ্ধ করা আবশ্যক। সেগুলি দেখলে বোঝা যাবে, মন্দির ভেঙ্গেই মসজিদ গড়ে উঠেছিল। অযোধ্যা নগরীর উল্লেখ রামায়ণ মহাভারত, স্কন্দপুরাণ ইত্যাদি প্রাচীন গ্রন্থগুলি ছাড়াও আল বিরুণীর (১০৩০) লেখাতেও পাওয়া যায়। কিন্তু আমরা মূলতঃ বিবেচনা করব ১৫২৮ খ্রিস্টাব্দের অব্যবহিত পূর্বের ও তার পরবর্তী তথ্যসমূহকে। শিখ গুরু গুরু নানকের “বাবরবাণীতে” (১৫১০) অযোধ্যাকে “শ্রী রামচন্দ্রজি’র শহর” বলে উল্লেখ ছাড়াও আবুল ফজলের আইন-ই-আকবরীতেও (১৫৯৮) অযোধ্যার উল্লেখ মেলে। যদিও আইন-ই-আকবরীতে অযোধ্যায় কোনও মসজিদের উল্লেখ ছিল না। আবুল ফজলের প্রায় সমসাময়িককালে, ১৫৭৪ খ্রিস্টাব্দে “রামচরিত মানস”-এর রচয়িতা তুলসীদাসের বর্ণনাতেও অযোধ্যায় ওই স্থানে কোনোও মসজিদের উল্লেখ ছিল না। তা থেকেই কেউ কেউ মনে করেন যে, মসজিদটি ১৫২৮ খ্রিস্টাব্দে বাবরের সময় নয়, বরং তৈরি হয়েছে আরও পরে, সম্ভবতঃ আওরঙ্গজেবের সময়। এমন অনুমানের সপক্ষে আরও কিছু তথ্য ক্রমে উপস্থাপন করব।
আনুমানিক ১৬১১ খ্রিস্টাব্দে উইলিয়াম ফিঞ্চ নামক এক ব্রিটিশ পর্যটক অযোধ্যা ভ্রমণে আসেন। ফিঞ্চ লিখেছিলেন, “ruins of the Ranichand [Ramachand] castle and houses” যেখানে ভগবান “took flesh upon him to see the tamasha of the world.” অর্থাৎ ওই প্রাসাদেই ভগবান অবতার রূপে জন্মগ্রহণ করেছিলেন বলে হিন্দুরা বিশ্বাস করত। ফিঞ্চ বর্ণনা দিয়েছিলেন যে, ব্রাহ্মণ পুরোহিতরা ওই মন্দিরে আগত ভক্তদের নাম ইত্যাদি লিখে রাখতেন। ফিঞ্চের বর্ণনায়ও সেখানে কোনও মসজিদের উল্লেখ ছিল না। তারপর ১৬৩৪ সালে ব্রিটিশ ঐতিহাসিক থমাস হার্বার্টও উল্লেখ করেছিলেন, “a pretty old castle of Ranichand”, যেটিকে তিনি বর্ণনা করেছিলেন “antique monument” বলে যেটি ছিল, তাঁর ভাষায় “especially memorable“. হারবার্টও লক্ষ্ করেছিলেন যে, ব্রাহ্মণ পুরোহিতরা সমাগত ভক্তদের তথ্যাদি সংগ্রহ করে রাখেন। ইনিও অযোধ্যার ওই স্থানে কোনও মসজিদের অস্তিত্বের উল্লেখ করেননি।
ইউরোপীয় জেসুইট মিশনারি জোসেফ টিফেনথেলার ভারত ভ্রমণ করেন ১৭৪৩ থেকে ১৭৮৫ পর্যন্ত এবং অনেক তথ্যাদি লিপিবদ্ধ করেন তৎকালীন ভারতবর্ষ সম্পর্কে। তিনি তাঁর লাটিন ভ্রমণবৃত্তান্ত “Historique et Geographique de L’Inde” (ফরাসী অনুবাদ: জ্যঁ বার্নৌলি, ১৭৮৬) তে অযোধ্যা সম্বন্ধে লিখেছিলেন (১৭৬৬-৭১এ অযোধ্যা ভ্রমণ কালে)— “But a spot particularly famous is known as Sita Rasoi, i.e. table of Sita, Ram’s wife…Emperor Aurangzeb demolished the fortress called Ramkot & got erected a Muslim Temple with three domes on the same place. Others say that it was constructed by Babur. Fourteen pillars of Blackstone, five spans high, are located in the fortress; twelve of these pillars are in the interior arch of the mosque; 2 out of 12 are at the door of the cloister. The other two are in the tomb of an unknown Maure(Muslim)…on the left, one can see a square box raised 5 inches above the Earth… Hindus call it Bedi i.e. the cradle because formerly it was the house where Beschan & his three brothers were born under the form of Ram…In his slight, Aurangzeb or according to some, Babur destroyed this place in order to prevent Hindus from performing their rituals on this place. However, they still perform their rituals at another place which is the birth place of Ram by rounding it three times and then prostrating flat on the ground.” টিফেনথেলারের লেখায় চৈত্র মাসে অযোধ্যায় যে উৎসবের বর্ণনা পাওয়া গিয়েছিল, তা নিশ্চয়ই রামনবমীর বর্ণনাই ছিল। সে বিষয়ে তিনি উল্লেখ করেছেন যে “on 24th of Chaitra, a large number of people gather here to celebrate the birth of Ram extremely popular throughout India.” সময়ানুক্রম বিবেচনা করলে দেখা যায় যে টিফেনথেলারের বর্ণনাতেই প্রথম অযোধ্যায় রামের জন্মস্থানের মন্দিরে একটি মসজিদের অস্তিত্বের কথাও উল্লেখিত হয়েছে। টিফেনথেলারের ভ্রমনবৃত্তান্তের পূর্বে উল্লেখিত অন্যান্য তথ্যাদিতে অযোধ্যায় মন্দিরের ভগ্নাবশেষের উল্লেখ আছে, কিন্তু সেই স্থানে মসজিদের অস্তিত্বের স্পষ্ট উল্লেখ নেই। আওরঙ্গজেবের রাজত্বকাল (১৬৫৮-১৭০৭). টিফেনথেলার অযোধ্যায় আসেন ১৭৬৬ তে এবং তখন রামের জন্মস্থানে একটি মসজিদও দেখেন। তাই এমন হওয়া অসম্ভব নয় যে অযোধ্যায় রামজন্মস্থানের মন্দিরটি ভেঙ্গেছিলেন বাবর, কিন্তু সেই স্থানে মসজিদটি নির্মাণ করেছিলেন আওরঙ্গজেব। তাই উক্ত মসজিদ বাবরের সময় নির্মিত হয়েছিল নাকি আওরঙ্গজেবের সময় সে বিষয়ে ঐতিহাসিক তথ্য সুনির্দিষ্ট নয়।
মন্দিরের জায়গায় মসজিদ, অজস্র তথ্য
চাগতাই ভাষায় লেখা বাবরের আত্মজীবনী “বাবরনামা”তেও নাকি অযোধ্যায় কোনও মন্দির ভাঙ্গার বা মসজিদ তৈরির বর্ণনা ছিল না। কিন্তু বাবরের রচিত আদত “বাবরনামা”র রচনাকালের প্রায় ৪০০ বছর বাদে ১৯১২ থেকে ১৯২২ সালের মধ্যে যখন “বাবরনামা”র ইংরেজি অনুবাদ করেন অ্যানেট সুজানা বেভেরিজ, তখন তিনি উপাদান সংগ্রহ করেন পার্সি ও তুর্কী দুই সূত্র থেকেই। “বাবরনামা”র এই ইংরেজি অনুবাদে উল্লেখিত হয়েছে যে, অযোধ্যার মন্দিরের সৌষ্ঠব ও হিন্দু পূজারীতির সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে বাবর নাকি উপলব্ধি করেছিলেন যে, নবি মহম্মদের একনিষ্ঠ অনুসারী হিসেবে এমন একটি সুন্দর মন্দিরকে মসজিদে রূপান্তরিত করা তাঁর পরম কর্তব্য। বাবরের সেমত উপলব্ধি অনুযায়ীই নাকি মির বাঁকির উদ্যোগে অযোধ্যার ওই স্থানে মন্দিরের ভগ্নাবশেষের উপর মসজিদ নির্মিত হয়। অর্থাৎ মসজিদটি ১৫২৮এ বাবরের আমলে নির্মিত হয়েছিল নাকি পরবর্তীকালে, সে বিষয়ে মতপার্থক্য স্পষ্ট, যদিও তা জমিবিবাদের এই মামলার রায়ে কোনও প্রভাব ফেলেনি।
ব্রিটিশ সরকারের তথ্যভাণ্ডার অনুযায়ী অবশ্য অযোধ্যায় রামের জন্মস্থানে অবস্থিত সুন্দর একটি মন্দিরের স্থলে মসজিদ নির্মাণ করেছিলেন বাবর, আওরঙ্গজেব নন। উদাহরণস্বরূপ এমন কিছু তথ্য হল : ব্রিটিশ সার্ভেয়ার মন্টগোমারি মার্টিনের “History Antiquities Topography & Statistics of Eastern India” Vol II, 1838, page 335-336, এডওয়ার্ড প্যারি থর্নটনের “A Gazetteer of the Territories under the Government of the East India Company”, Vol. IV, 1854, page 739-740, সার্জন জেনারেল এডওয়ার্ড ব্যালফোরের “Encyclopedia of India & of Eastern & Southern Asia, 1858″, page 56, পি কার্নেগীর “A Historical Sketch of Tehsil Fyzabad, with the Old Capitals Ajudhia & Fyzabad”, 1870, page 5-7, এ এফ মেটেলের “Report of the Settlement of the Land Revenue Fyzabad District”, 1880, page 216-217, 234-235, 238 এবং অনুরূপ আরও বহু তথ্য। মন্টগোমারি মার্টিনের বর্ণনা এইরকম : “The bigot by whom the temples were destroyed, is said to have erected mosques on the situation of the most remarkable temples; but the mosque at Ayodhya, which is by far the most entire, and which has every appearance of being the most modern, is ascertained by an inscription on its walls (of which a copy is given) to have been built by Babur, five generations before Aurungzebe ……. The only thing except these two figures and the bricks, that could with probability be traced to the ancient city, are some pillars in the mosque built by Babur. These are of black stone, and of an order which I have seen nowhere else, …they have been taken from a Hindu building, is evident, from the traces of images being observable on some of their bases; although the images have been cut off to satisfy the conscience of the bigot.” ব্রিটিশ আমলের এইসকল তথ্যাবলী রামজন্মভূমিতে নির্মিত মসজিদটি বাবরের আমলে তৈরি বলেই উল্লেখ করেছে, যদিও এর প্রায় শতবর্ষ আগে লিখিত টিফেনথেলারের বর্ণনায় মসজিদটি আওরঙ্গজেবের সমসাময়িক। বস্তুতঃ ব্রিটিশ সরকারের এই সমস্ত তথ্য উনবিংশ শতাব্দীর মধ্য ও শেষভাগের হওয়ায় এমন হওয়া অসম্ভব নয় যে, ততদিনে হয়ত ওই মসজিদ নির্মাণের সময়কালটি অপেক্ষাকৃত বেশি অতীত হয়ে পড়ায় অস্পষ্ট হয়ে পড়েছিল। কোনও নির্মাণ দেড়শ’ বছরের পুরোনো নাকি সাড়ে তিনশ’ বছরের পুরোনো তা খালি চোখে নির্ণয় করা কঠিন, যদিও কোনও নির্মাণ পঞ্চাশ বছরের পুরোনো নাকি আড়াইশো বছরের পুরোনো তা নির্ণয় করা অপেক্ষাকৃত সহজ। সুতরাং ব্যক্তিগতভাবে আমি মনে করি যে উনবিংশ শতাব্দীর মধ্য ও শেষভাগে লিখিত ব্রিটিশ নথিগুলির তুলনায় এর একশ’ বছর আগে লিখিত টিফেনথেলারের বর্ণনা মসজিদটির সঠিক নির্মাণকাল আন্দাজ করার ব্যাপারে অধিক নির্ভরযোগ্য। তাছাড়া মন্টগোমারি মার্টিনও অযোধ্যার মসজিদটি সম্বন্ধে বলেছেন “the mosque at Ayodhya, … has every appearance of being the most modern,…” অর্থাৎ অযোধ্যার মসজিদটিকে দেখে ১৮৩৮ সালে মার্টিনসাহেবের মনে হয়েছিল যে, ভারতবর্ষের মন্দির ভেঙ্গে গড়ে তোলা মসজিদগুলির মধ্যে ওটিই সবচেয়ে আধুনিক। এই বর্ণনার সঙ্গে অযোধ্যার মসজিদটির বাবরের আমলে নির্মিত হওয়ার তথ্যটি সাযুজ্য পূর্ণ নয়। বরং মসজিদটি আওরঙ্গজেবের আমলে নির্মিত হলেই মন্টগোমারি মার্টিনের বর্ণনার সঙ্গে তা বেশি খাপ খায়। অর্থাৎ যে মসজিদটিকে ১৫২৮ খ্রিস্টাব্দে বাবরের আমলে তৈরি বাবরি মসজিদ বলে উল্লেখ করা হচ্ছে, সেটি আদৌ “বাবরি” মসজিদ কিনা, সে বিষয়েও সংশয় আছে। যদিও জমি মামলার শুনানিতে এর কোনও প্রভাব নেই। কিন্তু তৎসত্ত্বেও এই দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করার কারণ হল এই যে, ইতিহাসের সব তথ্যই যে ধ্রুব সত্য বা এতকাল ইতিহাস বলে যা কিছু জানা গিয়েছে তার সব কিছুই যে একেবারে নির্ভুল, এমন না-ও হতে পারে। বরং সেগুলিকেও ক্রমাগত পুনর্বিবেচনা ও পুনর্বিশ্লেষণ করার প্রয়োজন আছে।
উর্দুতে লেখা ঐতিহাসিক উপাদানগুলির মধ্যে মুন্সি হাশিমের সহায়তায় ১৯২৩ সালে লক্ষ্ণৌয়ে লক্ষ্মীনারায়ণ সদর কানুনগো বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করেছেন কীভাবে মসজিদের দ্বারা প্রতিস্থাপিত হয়েছিল অযোধ্যার মন্দিরটি। ১৯১৯ সালে মহম্মদ নাজমু রচিত তারিখ-ই-অওয়ধ-এর পঞ্চম খণ্ডে আছে, “at Ayodhya, where there stood the temple of Ramchandra Ji’s janmasthan, there is Sita Ji ki Rasoi adjacent to it, King Babur got a magnificent mosque built there.” এছাড়া, ১৮৭৬ এ নিজামুদ্দিন দওলাহ্, ১৮৯৬ এ সৈয়দ কামাল-উদ্-দিন হায়দার, প্রত্যেকেই নিজের নিজের রচনায় অযোধ্যার রামমন্দির এবং সেই স্থানে মসজিদ নির্মাণের কথা উল্লেখ করেছেন।
অর্থাৎ যে সমস্ত সংবাদমাধ্যম মন্দির ভেঙ্গেই মসজিদ গড়ে উঠেছিল তার কোনও নির্দিষ্ট প্রমাণ নেই বলে প্রচার করতে চাইছে, তা অসত্য বলেই প্রতীত হয়। মন্দিরকে যে মসজিদ দিয়ে প্রতিস্থাপন করা হয়েছিল, তার সপক্ষে সমসাময়িক ঐতিহাসিক দলিলের কোনও অভাব নেই। তাছাড়া টিফেনথেলারের ভ্রমণ কাহিনি থেকে এ বিষয়েও নিশ্চিত হওয়া যায় যে, ১৭৭১ সালে জন্মস্থানে মসজিদ থাকা সত্ত্বেও সেই স্থানে নিয়মিত পূজা ও ভক্তসমাগম বজায় ছিল। অর্থাৎ অযোধ্যায় বাবরি মসজিদ তৈরি হয়েছিল এমন কোনও স্থাপত্য ভেঙ্গে যা ইসলামিক স্থাপত্য ছিল না এবং মসজিদ তৈরি হওয়ার পরেও মন্দিরপক্ষ ওই স্থানের উপর থেকে তাদের দাবি ও দখল স্বেচ্ছায় ছাড়েননি। টিফেনথেলারের দেওয়া তথ্য (যার উদ্ধৃতি আগেই দেওয়া হয়েছে) থেকে এ-ও প্রমাণিত হয় যে, হিন্দুরা স্বেচ্ছায় কাউকে সেখানে মসজিদ বানানোর অনুমতি দেয়নি। অর্থাৎ সম্পত্তির ঐচ্ছিক আদান-প্রদান হয়নি, বরং মসজিদপক্ষই সেখানে বলপূর্বক ভাঙ্গচুর করে মসজিদ নির্মাণ করে। এটিও এই জমিবিবাদের মামলায় মন্দিরপক্ষীয়দের সপক্ষে জোরালো যুক্তি হিসেবে আদালতের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়েছে।
রামলালা ‘আইনি ব্যক্তিত্ব’
প্রবন্ধটি এতদূর পর্যন্ত যাঁরা পড়েছেন, তাঁরা নিশ্চিতভাবেই “মন্দির ওহি বনায়েঙ্গে” স্লোগানের মর্মার্থ বুঝতে ও উপলব্ধি করতে পেরেছেন। ‘ওহি’ কথাটি এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ। কারণ ওই স্থানটি, অর্থাৎ যে বিশেষ স্থানে রামলালা জন্মগ্রহণ করেছিলেন বলে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে লোকের বিশ্বাস, সেই স্থানটির অধিকার কখনওই হস্তান্তর করেননি হিন্দুরা এবং দাবিও ছাড়েননি। পেশীশক্তির চাপে দখল ছাড়তে যখন যখন বাধ্য হয়েছেন তখনও ওই স্থানটির সম্ভাব্য নিকটতম স্থানে নিজেরা মাটি আঁকড়ে থেকেছেন। আবার যখনই সুযোগ পেয়েছেন ওই স্থানে ফিরে এসেছেন। তাই ওই বিশেষ জায়গাটি তাঁদের চাই—এই ছিল আদালতের কাছে তাঁদের নিছকই আইনসঙ্গত দাবি। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ্য যে ইতিহাস বা History হল His Story. এই He হলেন সমসাময়িক এক সাধারণ মানুষ। অর্থাৎ কোনও স্থানের সাধারণ মানুষের দৃষ্টিতে সেই স্থান ও সেখানকার ঘটনাগুলির বর্ণনাই হল প্রকৃত his story বা ইতিহাস। লোকের মুখে ফেরা লোককথা ও বিশ্বাসও সেই স্থানের ইতিহাসের উপাদান ও অঙ্গ বললে তাই ভুল হয় না। রামের অস্তিত্ব ও জন্মস্থানের বিষয়েও মানুষের শতাব্দীপ্রাচীন বিশ্বাস, ঐতিহাসিক উপাদান ও লোককথাকে সম্পূর্ণ অস্বীকার করার সপক্ষে জোরালো প্রমাণ নেই।
যাঁদের আবারও মনে হবে যে রাম নিজেই কাল্পনিক, তাঁর আবার জন্মস্থান কিসের, তাঁদের আর একবার মনে করিয়ে দিতে চাই যে, ভারতীয় আইনে দেবতা juristic person হতে পারেন। এবং এই মামলায় বাদীপক্ষের অন্যতম হলেন juristic person রামলালা / তাঁর প্রতিনিধি। ফলে রাম কাল্পনিক না বাস্তব তা এক্ষেত্রে আদালতের বিচার্য ছিল না। আইনের দৃষ্টিতে রামলালা একজন ব্যক্তি।
১৮৫৫ সাল পর্যন্ত ওই বিতর্কিত স্থানে হিন্দু ও মুসলমান দুই সম্প্রদায়ই যথাক্রমে পূজা ও প্রার্থনা করত। এমনই লিখেছেন ১৮৬০-এর দশকের একজন ব্রিটিশ অ্যাসিস্ট্যান্ট কমিশনার পি কার্নেগী। ইতিপূর্বেও এই প্রবন্ধে কার্নেগীসাহেবের “A Historical Sketch of Tehsil Fyzabad, with the Old Capitals Ajudhia & Fyzabad”-এর উল্লেখ করেছি। ১৮৭০-এ কার্নেগী সাহেবের রচনায় উল্লেখিত হয়েছে যে, ১৮৫৫ সালে হনুমানগড়ী ও ‘জন্মস্থান’-এর অধিকার নিয়ে দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে দাঙ্গা বাঁধার আগে পর্যন্ত অযোধ্যার বিতর্কিত স্থানে দুই সম্প্রদায় একত্রে পূজা ও প্রার্থনা করত। “Hindus and Muslims alike used to worship in the mosque-temple” লিখেছেন পি কার্নেগী। টিফেনথেলারও তাঁর ভ্রমণবৃত্তান্তে (পূর্বে বিবৃত) ওই প্রাসাদে হিন্দু ও মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের পূজা ও প্রার্থনার কথা বর্ণনা করেছেন। কার্ণেগী আর টিফেনথেলারের বর্ণনায় প্রধান পার্থক্য একটিই। টিফেনথেলার অযোধ্যায় রামকোট প্রাসাদ ভেঙ্গে সেখানে “Muslim Temple” স্থাপনের বর্ণনা দিয়েছেন। আর কার্নেগী সাহেব সরাসরি ওটিকে mosque-temple বলেছেন। টিফেনথেলারের বর্ণনায় আগে “Ramkot fortress” তারপর “Muslim Temple”, আর তার ১০০ বছর বাদে কার্নেগীর লেখায় আগে উল্লেখিত হল “mosque” পরে “temple”. অর্থাৎ সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ওই বিতর্কিত স্থানের অস্তিত্ব ও পরিচিতি বদলে যাচ্ছিল, যা হিন্দুদের মধ্যে ক্ষোভের জন্ম দিচ্ছিল।
বিতর্কিত স্থানের অধিকার নিয়ে হিন্দু ও মুসলমান দুই সম্প্রদায় সময়ে সময়ে কীভাবে পরস্পর-বিবদমান হয়ে উঠেছে তার সময়ানুক্রমিক বর্ণনা ছাড়া এ প্রবন্ধ শেষ করা যাবে না। ১৮৫৩ সালে নির্মোহী আখড়া নামে একদল সশস্ত্র সন্ন্যাসীবাহিনী ওই স্থানের দখল নেয় এবং বিতর্কিত কাঠামোটির স্বত্ত্ব দাবি করে। ভারতে মুসলমান শাসকের রাশ তখন একেবারেই আলগা হয়ে গিয়েছে। মুঘল বাদশাহ্ বাহাদুর শাহ জাফরের নামমাত্র সাম্রাজ্য তখন শুধু দিল্লির মধ্যেই সীমাবদ্ধ। এমন সময়ে নির্মোহী আখড়ার সন্ন্যাসীরা অযোধ্যায় হাজির হলেন এমত দাবি নিয়ে। তারপর থেকে মাঝে মাঝেই চলতে থাকল দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে বিক্ষোভ ও অধিকারের লড়াই। ১৮৫৫ সালে অযোধ্যায় রাম-জন্মস্থানে হানাদারির ৩২৭ বছর পূর্ণ হয়েছে এবং ভারতবর্ষে তখন মুসলমান শাসনও বস্তুত শেষ হয়ে গিয়েছে। ঠিক সেই সময় এই বিতর্কিত স্থানে হিন্দু ও মুসলমান দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে বিক্ষোভ প্রবল হিংসার রূপ নিল। মুসলমান শাসনের অবসানে হিন্দুদের মনে এতদিনের জমাট ক্ষোভ দাঙ্গার আগুনে পরিণত হল। বিক্ষোভ নিয়ন্ত্রণ করতে প্রশাসনকে শেষ পর্যন্ত হস্তক্ষেপ করতে হয়। মুঘল বংশের নামেমাত্র বাদশাহকে অসন্তুষ্ট করতে না চেয়ে প্রশাসন ওই স্থানে মন্দির নির্মাণ বা পূজার্চনা করবার অনুমতি দিল না। তার ঠিক পরের বছরেই, অর্থাৎ ১৮৫৬য় অযোধ্যার শেষ নবাব ওয়াজিদ আলি শাহের নবাবী অধিগ্রহণ করে নিল ব্রিটিশ এবং ওয়াজিদ আলি শাহকে পাঠিয়ে দিল কলকাতায়। অযোধ্যার নবাবী শাসন তখন কাগজে কলমেও শেষ হল। তারপর এল ১৮৫৭, শুরু হল সিপাহি বিদ্রোহ। মুঘল সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফরও অংশ নিলেন ১৮৫৭-র বিদ্রোহে। এই বিদ্রোহকে পরবর্তীকালে ঐতিহাসিকরা ‘মহাবিদ্রোহ’ আখ্যা দিয়েছিলেন। সিপাহি বিদ্রোহকে দমন করল ব্রিটিশ এবং বাহাদুর শাহ জাফরকে গ্রেফতার করে পাঠিয়ে দিল তৎকালীন বার্মায় (আজকের মায়ানমার)। তখন সেই মুঘল সাম্রাজ্য, বাবরের আক্রমণ দিয়ে যার সূচনা, আক্ষরিক অর্থেই তা শেষ হল। “রাজছত্র ভেঙ্গে পড়ে, রণডঙ্কা শব্দ নাহি তোলে, জয়স্তম্ভ মূঢ়সম অর্থ তার ভোলে”—লিখেছেন রবীন্দ্রনাথ।
রামলালার জন্মস্থান কিন্তু তখনও বর্তমান। বাবরের বহু আগেও মানুষ যেমন বিশ্বাস করত যে ওটি রামের জন্মস্থান, বাহাদুর শাহ জাফরের গ্রেফতার ও মুঘল সাম্রাজ্যের পতনের পরেও মানুষ একইরকমভাবে বিশ্বাস করতে থাকল যে, ওই স্থানটি রামের জন্মস্থান এবং সেখানে মন্দিরই থাকা উচিত, মসজিদ নয়। বাহাদুর শাহ জাফরের গ্রেফতারের এক বছরের মধ্যেই ১৮৫৮ সালে ব্রিটিশ প্রশাসন বিতর্কিত স্থানটিকে দুই ভাগে ভাগ করে মধ্যিখানে রেলিং তুলে দেয়। বন্দোবস্ত হয় যে, রেলিং-এর ভিতরের অংশে প্রার্থনা করবেন মুসলমানরা এবং বহির্চত্বরে ‘রাম চবুতরা’ নামক একটি উচ্চ ও উত্তোলিত বেদীর ওপর পুজোর অর্ঘ্য নিবেদন করবেন হিন্দুরা। ১৮৮৩ সালে হিন্দুরা ‘রাম চবুতরা’র ওপর মন্দির নির্মাণের উদ্যোগ নেয়। মুসলমানদের দিক থেকে আসে প্রতিবাদ। তারই ফলশ্রুতিতেওই স্থানের ডেপুটি কমিশনার ১৮৮৫ সালের ১৯শে জানুয়ারি মন্দির নির্মাণে নিষেধাজ্ঞা জারি করেন। তার ঠিক পরেই ২৭ শে জানুয়ারি, “রাম চবুতরার” মহন্ত রঘুবর দাস ফৈজাবাদ সাব-জজের আদালতে ভারতের সেক্রেটারি অব স্টেটের বিরুদ্ধে ওই বিতর্কিত স্থানের আইনি স্বত্ত্ব দাবি করে মামলা করেন (Suit No. 61/280)। ইতিপূর্বেই উল্লেখ করেছি যে অযোধ্যার বিতর্কিত কাঠামোর অধিকার সংক্রান্ত প্রথম মামলা এটিই। এই মামলায় মহন্ত রঘুবর দাস মন্দিরের পূর্ব চত্বরে রাম চবুতরার ওপরে মন্দির নির্মাণের অনুমতিও প্রার্থনা করেন। প্রত্যুত্তরে মসজিদের মুসলমান ট্রাস্টিদের পক্ষ থেকে জানানো হয় যে, গোটা জমিটিই মসজিদের। ১৮৮৫ সালের ২৪ ডিসেম্বর সাব-জজ পণ্ডিত হরি কিষাণ সিং মামলাটি খারিজ করে দেন। এরপর মহন্ত রঘুবর দাস পুনরায় একই দাবি নিয়ে মামলা করেন উচ্চতর জেলা জজের আদালতে। ১৮৮৬ সালের ১৮ মার্চ জেলা জজ এফ ই এ ক্যামিয়েরও মামলাটি খারিজ করেন। জজ ক্যামিয়ের স্বীকৃতি দিয়েছিলেন যে, মসজিদটি গড়ে তোলা হয়েছিল এমন জমিতেই যে জমিকে হিন্দুরা পবিত্র মনে করেন, কিন্তু ওই স্থানে অবস্থার কোনও পরিবর্তন ঘটানোর সম্ভাবনাকে তিনি নাকচ করেন, কারণ তিনি মনে করেছিলেন যে, তার জন্য অনেক দেরি হয়ে গিয়েছে। এফ ই এ ক্যামিয়ের উল্লেখ করেছিলেন যে, “it was too late now to remedy the grievance”। এর পর জুডিশিয়াল কমিশনার ডব্লিউ ইয়ং-এর কাছে আর একটি আপিল করেন হিন্দুরা, কিন্তু ইয়ংসাহেবও সেটিকে খারিজ করেন ১৮৮৬ সালের ১ নভেম্বর। তারপর ১৯৩৪ সালের ২৭ মার্চ নিকটবর্তী শাহজাহানপুর গ্রামে গোহত্যাকে কেন্দ্র করে অযোধ্যায় শুরু হয় হিন্দু-মুসলমান সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা। তখন বিতর্কিত ওই মসজিদের চারিপাশের দেওয়াল এবং একটি ডোম ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ব্রিটিশ সরকার এগুলিকে পুনরায় মেরামত করে দিয়েছিল।
অর্থাৎ যে বিবাদ প্রথম থেকেই ছিল, যে জমি হিন্দুদের কাছে পবিত্র, যে প্রাসাদ হিন্দুদের কাছে তাঁদের দেবতার জন্মস্থান, সেই জমিতে, সেই প্রাসাদের অংশ ব্যবহার করে মসজিদ গড়ে তোলার কোনও প্রয়োজন ছিল কিনা, মুসলমান শাসকের দিক থেকে নতুন দেশ শাসন করতে এসে সে দেশের মানুষের ধর্ম-সাংস্কৃতিক বোধকে আক্রমণ করে ধূলিসাৎ করার প্রয়োজন ছিল কিনা, বিচার্য হওয়া উচিত ছিল সেইটি। কিন্তু দুঃখের বিষয় হল, সে বিচার আজও পর্যন্ত হয়নি। এমনকি ৯ নভেম্বর, ২০১৯ -এও সুপ্রিম কোর্ট রায় দিয়েছেন, অযোধ্যার জমি বিবাদিত। অযোধ্যার ওই জমিতে মসজিদ গড়ে তোলা সঙ্গত ও সুসভ্য আচরণ ছিল কি না, সে বিচার আজও কোনও আদালতে হয়নি।
পাঁচ শতাব্দীর ধৈর্যের জয়, সত্যের জয়
যতদিন অযোধ্যার বিতর্কিত স্থানটি মুসলমান শাসকের অধীনে ছিল, ততদিন হিন্দুরা শাসকের থাবার মধ্যে নিরুপায় হয়ে রামের জন্মস্থানের মাটি আঁকড়ে পড়ে থেকেছেন এবং নিত্য পূজা চালিয়ে গিয়েছেন। মুসলমান শাসকের সময় গত হলে হিন্দুরাই প্রথম আদালতের দ্বারস্থ হন এবং যে মন্দির ভেঙ্গে মুসলমান শাসক (হয় বাবর নয় আওরঙ্গজেব) মসজিদের গম্বুজ তৈরি করেছিলেন, সেই মন্দিরের জমির আইনি স্বত্ত্ব ফিরে পাওয়ার জন্য আবেদন করেন। হিন্দুদের মামলার কোনও পাল্টা মামলা সেই সময় মসজিদের পক্ষ থেকে করা হয়নি। তাঁরা আদালতে শুধু আত্মপক্ষ সমর্থন করেছেন এবং হিন্দুদের দাবির বিরোধিতা করে গিয়েছেন। তাই আজ অযোধ্যা মামলার ঐতিহাসিক রায়ের পরে, হয়ত রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবেই, কিছু লোক বলছেন যে, বেআইনিভাবে মসজিদ ভাঙ্গল যারা, ভাঙ্গা মসজিদের জমির স্বত্ত্ব কিনা শেষ পর্যন্ত তাদেরকেই দিল আদালত? মসজিদ ভাঙ্গার প্রতিবাদে আদালতে আপিল করেছিল মসজিদপক্ষ; কিন্তু আদালত কিনা শেষ পর্যন্ত মসজিদ যারা ভেঙ্গেছিল তাদেরই পুরষ্কৃত করল? এমন যাঁরা বলছেন, তাঁদের জানা এবং মনে রাখা প্রয়োজন যে মসজিদের দাবি নিয়ে মুসলমানরা আদালতের দ্বারস্থ হওয়ার বহু বছর আগে হিন্দুরা ওই বিতর্কিত জমির স্বত্ত্ব প্রার্থনা করে এবং সেই স্থানে মন্দির নির্মাণের অনুমতি চেয়ে আদালতে গিয়েছিল। ১৯৯২ সালে মসজিদ ভাঙ্গার ১০৭ বছর আগে তারা প্রথমবার মামলা করেছিল আদালতে। তাই শেষ বিচারে ওই জমির স্বত্ত্ব তাদের কাছেই গিয়েছে। এ বিচার যদি সুবিচার না হয়, তবে সুবিচারটি আর কী-ই বা হতে পারত। যে জমিবিতর্কটি ৪৯১ বছর ধরে চলেছে, সেই বিতর্কের সমাপন করতে গেলে আদালতের পক্ষে কি কেবল ১৯৯২ সালে মসজিদ ভাঙ্গার পরবর্তী অধ্যায়টুকুর ইতিহাস অর্থাৎ গত মাত্র ২৭ বছরের ইতিহাসের উপর ভিত্তি করে বিচার করা সম্ভব ছিল? নাকি এ বিষয়ে গত ৪৯১ বছরের ইতিহাসেরই পুনর্বিবেচনার প্রয়োজন ছিল? ভারতের সর্বোচ্চ আদালত এই ৪৯১ বছরের দীর্ঘ জমি বিবাদের সম্পূর্ণ ঘটনাপ্রবাহ এবং তার পারম্পর্যকে সামগ্রিকভাবে বিচার করেছেন বলেই ন্যায়বিচার সুনিশ্চিত করতে পেরেছেন বলে মনে করেন বর্তমান ভারতবর্ষের অধিকাংশ সংবেদনশীল মানুষ।
১৯৪৯ সালে, ভারতের স্বাধীনতার পরে বিতর্কিত ওই স্থানে এক ৯ দিনব্যাপী রামায়ণ গানের আসর ও যজ্ঞের আয়োজন করে হিন্দু মহাসভা। সেই সময়ে, যজ্ঞের ঠিক পরেই ওই স্থানে রেলিং-এর ভিতরে বিরাজমান হয় রামসীতার এক যুগল মূর্তি। বাস্তবে হিন্দু মহাসভাই রেলিং-এর ভিতরের অংশে স্থাপন করেছিল ওই মূর্তি। এই প্রসঙ্গে আরও একবার মনে করা প্রয়োজন যে, এই রেলিং ব্রিটিশরা তৈরি করেছিল ১৮৫৮ সালে। তার আগে পর্যন্ত দুই সম্প্রদায় একত্রেই ওই স্থানে পূজা ও প্রার্থনা করত, কোনও রেলিং ছিল না। রেলিং-এর ভিতরের অংশেও হিন্দুরা যেত। ফলে রেলিং দিয়ে ওই কাঠামোর একটি অংশে হিন্দুদের প্রবেশ কার্যতঃ নিষিদ্ধ করার প্রতিবাদেই হিন্দু মহাসভা ওখানে স্থাপন করেছিল রামসীতার মূর্তি। বার্তা ছিল স্পষ্ট। ওই জমি ও কাঠামোর গোটাটাই হিন্দুদের। ওটি কোনও একটি সাধারণ মন্দির নয়, অতি বিশেষ একটি মন্দির। তার ওপর অধিকার ত্যাগ করতে পারেন না হিন্দুরা। তাছাড়া বেআইনিভাবে হলেও রেলিং-এর ভিতর মূর্তি স্থাপন করার আইনি তাৎপর্য এ-ও ছিল যে, ওই ঘটনার ফলেই স্বাধীন ভারতে বিতর্কিত বিষয়টিকে পুনরুজ্জীবিত করে তুলতে পেরেছিল হিন্দু মহাসভা। তার ফলেই মসজিদপক্ষও প্রথমবার আদালতের দ্বারস্থ হয়ে ওই স্থানের পূর্ণস্বত্ত্ব দাবি করে এবং হিন্দুরাও একের পর এক দেওয়ানি মামলা দায়ের করেন স্বাধীন ভারতের আদালতে। অর্থাৎ রেলিং-এর ভিতর রামসীতার মূর্তি স্থাপনের দ্বারাই স্বাধীন ভারতে রাম-জন্মভূমির আইনি লড়াইয়ের শুভারম্ভ হয়েছিল। এই কারণেই তখন ঘোষণা করা হয়েছিল যে, যজ্ঞের পরেই ভগবান শ্রীরামচন্দ্র স্বয়ং ঘটাবেন অলৌকিক।
১৯৪৯ সালে রেলিং এর ভিতরে মূর্তি পাওয়া যাওয়ার পর তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু সেই মূর্তি সরানোর আদেশ দেন তৎক্ষণাৎ, কিন্তু অযোধ্যার তৎকালীন জেলাশাসক সে আদেশ পালন করতে অস্বীকার করেন জনরোষের কারণ দর্শিয়ে। বলেন, ওই স্থানে মূর্তি স্পর্শ করার অর্থ হল মানুষের বিশ্বাসে হাত দেওয়া। এই ঘটনার পর হিন্দু ও মুসলমান উভয়পক্ষই আদালতে দেওয়ানি মামলা দায়ের করেন ওই স্থানের স্বত্ত্ব দাবি করে। মসজিদপক্ষ রেলিং,-এর ভিতরে মূর্তি স্থাপনকে তাঁদের নামাজ-স্থলের অপবিত্রকরণ বলেই চিহ্নিত করেন এবং তখনই তাঁরা প্রথমবার ভারতীয় আদালতে দেওয়ানি মামলা দায়ের করেন ওই স্থানের স্বত্ত্ব দাবি করে। অর্থাৎ ঐ স্থানের স্বত্ত্ব দাবি করে মুসলমানরা আদালতে যাওয়ার ৬৪ বছর আগে হিন্দুরা প্রথম আদালতে গিয়েছিল ওই একই কারণে এবং ওই স্থানে (ওহি) “রাম চবুতরা”র ওপরে মন্দির নির্মাণ করতে চেয়ে। ১৯৪৯ সালের এই ঘটনার পরেই ওই স্থানটিকে স্বাধীন ভারত সরকারও বিতর্কিত বলে চিহ্নিত করে এবং তার পরে তালা পড়ে যায় সেখানকার সিংহদুয়ারে। তারপর থেকে হিন্দু মহাসভা এবং আরও নানা সংগঠন ওই স্থানে মন্দির নির্মাণের অনুমতি চেয়ে বার বার নানা মামলা দায়ের করেছে আদালতে, যার দীর্ঘ বর্ণনা এ প্রবন্ধে নিষ্প্রয়োজন।
১৯৮০ সালে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ, বিশ্ব হিন্দু পরিষদ এবং ভারতীয় জনতা পার্টি ওই স্থানে অসামান্য এক মন্দির গড়ার দাবিতে সমস্ত দেশব্যাপী একটি সম্মিলিত প্রচারকার্য শুরু করে। এই আন্দোলন ও প্রচারকার্য অধিক গতি লাভ করে যখন ১৯৮৬ সালে জেলা আদালতের রায় বেরোয় যে, ওই বিতর্কিত স্থানের প্রধান দরজা হিন্দুদের জন্য খুলে দেওয়া হবে এবং হিন্দুরা সেখানে পূজার্চনা করতে পারবেন। জেলা আদালতের এ হেন রায়কে স্বাগত জানান তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধী। ১৯৯০ সালে ভারতীয় জনতা পার্টির বরিষ্ঠ নেতা লালকৃষ্ণ আডবাণী সেই বার্তা নিয়ে শুরু করেন এক রথযাত্রা। তাঁর রথযাত্রা আটকে দেয় লালুপ্রসাদ যাদবের মুখ্যমন্ত্রীত্বে তৎকালীন বিহার সরকার। কিন্তু তৎসত্ত্বেও দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে করসেবকরা অযোধ্যায় পৌঁছন। অযোধ্যার ওই বিতর্কিত কাঠামোর ওপর তাঁরা গৈরিক পতাকা উত্তোলন করেন। তার জন্য উত্তরপ্রদেশের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী মুলায়ম সিং যাদবের নির্দেশে করসেবকদের লক্ষ্য করে গুলি চালায় নিরাপত্তারক্ষীরা। প্রাণ হারান শত শত করসেবক। এ রাজ্যের দুই তরুণ রাম ও শরদ কোঠারির মৃত্যু হয় ওই ঘটনায়। এর পর ১৯৯২ সালের ৬ ডিসেম্বর ১,৫০,০০০ করসেবক আবার অযোধ্যায় পৌঁছন এবং শেষ পর্যন্ত ভেঙ্গে ফেলেন বাবরি মসজিদ। বাবরি মসজিদ ভাঙ্গার মতো ঘোর বেআইনি কাজটি ১৯৯০ সালে শত শত করসেবককে নৃশংসভাবে গুলি করে মারার প্রতিক্রিয়া ছিল। লালকৃষ্ণ আডবাণী, অটলবিহারী বাজপেয়ী, মুরলী মনোহর যোশীর মতো নেতৃবৃন্দের বারংবার সতর্ক বার্তা ও অনুরোধ সত্ত্বেও করসেবকদের বাঁধভাঙ্গা আবেগ সেদিন বাবরি ধ্বংসের কারণ হয়েছিল। প্রশ্ন হল, এমন ঘটনার পিছনে ১৯৯০ সালে মুলায়ম সিং যাদবের নির্মম ভূমিকাও কি সমপরিমাণে দায়ী ছিল না?
২০০৩ সালে আদালতের নির্দেশে ওই স্থানে খননকার্য চালায় আরকিওলজিক্যাল সোসাইটি অব ইন্ডিয়া। তাঁদের রিপোর্ট অনুযায়ী ওই বিতর্কিত কাঠামোর নীচে ছিল ভারতীয় স্থাপত্যের এক অনন্য নিদর্শন। তাঁদের পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী মকরপ্রাণাল চিহ্নযুক্ত সুবিশাল গোলাকৃতি স্থাপত্যের হিন্দু মন্দির হওয়ার সম্ভাবনাই সর্বাধিক। খননকার্যে আবিষ্কৃত হয় এক বিশাল কক্ষস্থলও যা থেকে অনুমান করা হয় যে, সেটি ছিল বহু মানুষের সমাগম স্থল। ওই খননকার্যের অন্যতম সদস্য এবং আর্কিওলজিক্যাল সোসাইটির তৎকালীন আঞ্চলিক ডিরেক্টর কে কে মুহম্মদের পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী বিতর্কিত স্থানে নির্মিত মসজিদটির ১২ টি স্তম্ভ নির্মাণ করা হয়েছিল মন্দিরের ভাঙ্গা অংশবিশেষ দ্বারা। এমন স্তম্ভের উল্লেখ ও বর্ণনা টিফেনথেলারের লেখায়ও ছিল, (“…Fourteen pillars of Blackstone, five spans high, are located in the fortress; twelve of these pillars are in the interior arch of the mosque; 2 out of 12 are at the door of the cloister. The other two are in the tomb…”) আবার ১৮৩৮ এ মন্টগোমারি মার্টিনের বর্ণনায়ও ছিল। (“…some pillars in the mosque built by Babur. These are of black stone, and of an order which I have seen nowhere else, …they have been taken from a Hindu building, is evident, from the traces of images being observable on some of their bases; although the images have been cut off to satisfy the conscience of the bigot.”) অর্থাৎ টিফেনথেলার এবং তাঁর ১০০ বছর পর মন্টগোমারি মার্টিন, দুজনের বর্ণনা অনুযায়ীই বাবরি মসজিদের ডোমগুলি তৈরি হয়েছিল পুরোনো মন্দিরের ব্ল্যাক স্টোনের তৈরি স্তম্ভ দিয়ে। আবার ASI-এর কে কে মুহম্মদের রিপোর্টও সেই বর্ণনাকে সমর্থন করেছে। ‘অষ্টমঙ্গল চিহ্ন’ ও ‘পূর্ণ কলস’ হিন্দুরীতি অনুযায়ী সমৃদ্ধির প্রতীক। কে কে মুহম্মদ তাঁর পর্যবেক্ষণে মসজিদের তলদেশে প্রাপ্ত স্থাপত্যের ভিতে ‘অষ্টমঙ্গল চিহ্ন’ ও ‘পূর্ণ কলস-এর উপস্থিতি ওই স্থাপত্যের হিন্দু মন্দির হওয়ার সপক্ষে জোরালো প্রমাণ বলে মন্তব্য করেন। ASI রিপোর্ট অবলম্বনে সুপ্রিম কোর্ট তাঁদের রায়ে একথা স্পষ্ট উল্লেখ করেছেন যে, জন্মস্থানে গড়ে ওঠা বাবরি মসজিদটি কোনও ফাঁকা জমিতে গড়ে তোলা হয়নি, বরং গড়ে তোলা হয়েছিল কোনও “নন-ইসলামিক” স্থাপত্যের ওপরে, যে স্থাপত্যটি মন্দিরের কিনা তা নির্দিষ্ট করে বলা সম্ভব নয়। মসজিদের নীচের স্থাপত্য মন্দিরই ছিল কিনা তা নিশ্চিত করে বলা যায় না– সুপ্রিম কোর্টের বক্তব্যের এই অংশকে মূলধন করেই ধন্দ ও অপপ্রচার চালাচ্ছে মসজিদ-সমর্থকরা। এমনকি প্রাক্তন আমলা জহর সরকারও আনন্দবাজারের উত্তর সম্পাদকীয়তে কৌশলে লিখেছেন যে, নীচে মন্দির থাকার অকাট্য প্রমাণ না থাকা সত্ত্বেও বাবরি মসজিদের জমি কেন মন্দিরপক্ষীয়রা পেল? তবে কি ধর্মবিশ্বাসেরই জয় হল? এমন লেখা পড়ে পাঠকের মনে হতেই পারে যে মসজিদের নীচে মন্দির থাকার অকাট্য প্রমাণ নেই মানে ফাঁকা জমিতেই বুঝিবা মসজিদ তৈরি হয়েছিল। কিন্তু সুপ্রিম কোর্টের রায়ে যে স্পষ্ট বলা হয়েছে মসজিদের নীচে ছিল একটি নন-ইসলামিক স্থাপত্য, সে কথাটা জহরবাবু সুকৌশলে চেপে গিয়েছেন। আসলে মসজিদের নীচে যে স্থাপত্য ছিল, তা কোনও মন্দির ছিল কিনা সেটি বড় কথা নয়, যা ছিল, তা যে একটি নন-ইসলামিক স্থাপত্য, সেটিই গুরুত্বপূর্ণ। অর্থাৎ ফাঁকা জমিতে বাবরি মসজিদ গড়ে তোলা হয়েছিল, মুসলমানদের এমন দাবি আদালত কক্ষে মিথ্যা বলে প্রমাণিত হয়েছে। উপরন্তু, ইসলামিক নয় এমন কোনও স্থাপত্যকে ভেঙ্গে সেখানে মসজিদ গড়ে তোলা হয়েছে, হিন্দুদের এই দাবিও এই রায়ের দ্বারা সত্যায়িত হয়ে গিয়েছে। অর্থাৎ কোনও একটি অমুসলমান স্থাপত্য ভেঙ্গে (তর্কের খাতিরে যদি ধরেও নেওয়া হয় যে সেটি মন্দির ছিল না, তাহলেও) মসজিদ তৈরির ইসলামিক নীতিটিকেও এই রায়ের মাধ্যমে পরোক্ষে অননুমোদন করেছেন ভারতের সর্বোচ্চ আদালত।এই রায়ের দ্বারা পরোক্ষে সরাসরি প্রত্যাখ্যান করেছেন ভারতের উচ্চতম আদালত। সেই নীতিটি একবার সুপ্রিম কোর্টের দ্বারা অননুমোদিত হওয়ার অর্থ গভীর। ভারতবর্ষের বুকে অজস্র প্রি-ইসলামিক স্থাপত্য ধ্বংস করে মসজিদ গড়ে তুলেছিল মুসলমান শাসক। ছোটো বড় সব মিলিয়ে সংখ্যাটি প্রায় ৪০,০০০। মসজিদগুলি তাদের ধর্মীয় আধিপত্যের প্রতীক হিসেবে স্থাপিত হয়েছিল। তাই বাবরি মসজিদকে সরে যেতে বলার তাৎপর্য হল, এর ফলে অন্যান্য নানা মসজিদ ও ইসলামী স্থাপত্যগুলির গড়ে ওঠার ইতিহাসও প্রশ্নের মুখে পড়বে। ঠিক সেই কারণেই হয়ত সুপ্রিম কোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে রিভিউ পিটিশন দাখিল করতে চলেছে অল ইন্ডিয়া মুসলিম পার্সোনাল ল বোর্ড।
হায়দরাবাদের নালসার ল ইউনিভার্সিটির উপাচার্য ফয়জান মুস্তাফা এমনও লিখেছেন যে, তুলসীদাস তাঁর “রামচরিতমানস”-এ কোনও একটি বিশেষ স্থানকে রামের জন্মস্থান হিসেবে উল্লেখ করেননি। উপাচার্য অবশ্য একথা বলেননি যে, তুলসীদাসের রচনায় অযোধ্যায় কোনও মসজিদের অস্তিত্বের উল্লেখও ছিল না। এ বিষয়ে এই প্রবন্ধে ইতিপূর্বেই বিশদে লিখেছি। হিন্দু ও মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ই ওই স্থানে পূজা ও প্রার্থনা করত, ১৭৭০-এ ইউরোপীয় মিশনারি জোসেফ টিফেনথেলারের এমন বর্ণনাকে গুরুত্ব দিতে রাজি হননি নালসার ল ইউনিভার্সিটির উপাচার্য। কিন্তু এই একই তথ্য উপস্থাপন করেছেন টিফেনথেলারের ১০০ বছর পর ব্রিটিশ সরকারের অ্যাসিস্ট্যান্ট কমিশনার পি কার্নেগীও। ১৮৭০ সালে। কার্নেগীর বর্ণনা অনুযায়ী ১৮৫৫য় সাম্প্রদায়িক হিংসার ঘটনা ঘটার আগে পর্যন্ত দুই সম্প্রদায়ই ওই স্থানে পূজা ও প্রার্থনা করত। পি কার্নেগীর বর্ণনার কথা উল্লেখমাত্র করেননি ফয়জান মুস্তাফা। মুসলমানরা যে আগাগোড়াই ঐ মসজিদে প্রার্থনা করেছেন এমন প্রমাণ দিতে ব্যর্থ হয়েছে মসজিদপক্ষ বলে মন্তব্য করেছেন সুপ্রিম কোর্ট। ফয়জান মুস্তাফা তা-ও মানতে চাননি। কিন্তু ১৯৩৪এ অযোধ্যার পার্শ্ববর্তী শাহজাহানপুরের দাঙ্গায় যে মসজিদের চতুস্পার্শ্বস্থ দেওয়াল ও একটি গম্বুজ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল, যা ব্রিটিশরা পরে সারিয়ে দেয়, সে বিষয়টি বেমালুম চেপে গিয়েছেন মুস্তাফা। ওই সময় মুসলমানরা ওই মসজিদে প্রার্থনা করতেন না। কিন্তু হিন্দুরা জমি ছাড়েননি। নিত্য পূজা আচার চালিয়ে গিয়েছেন। অর্থাৎ নানাবিধ আংশিক সত্যের সুবিধাজনক উপস্থাপনের মাধ্যমে মসজিদ-সমর্থকরা রামলালার জয়কে ছোট করে দেখানোর নিরলস প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছেন।
মসজিদপক্ষের হয়ে নিয়মিত প্রচার চালিয়ে যাচ্ছে পশ্চিমবঙ্গের সংবাদমাধ্যমগুলিও। রামমন্দির রায়ের পর অযোধ্যার ওই জমিতে কেন মসজিদই হওয়া উচিত, মন্দির নয়, এমত প্রচারার্থে নেতিবাচকভাবে এই ক’দিনের মধ্যে যত বার রাম নাম করেছে আনন্দবাজার গোষ্ঠী, ততবার বোধকরি আনন্দবাজারের জন্মলগ্ন থেকে রামমন্দির রায়ের আগে পর্যন্ত কোনওদিন তারা করেনি। “পাপ কাটে, দুখ মিটে, লেত রাম নাম”—নিন্দার্থে নিলেও অফুরন্ত রামনামে আনন্দবাবুদের পাপস্খালন না হয়েই যায় না। মার্ক্সবাদী কম্যুনিস্ট পার্টির মুখপত্র দৈনিকটি অবশ্য মসজিদপক্ষকে সমর্থন জানাতে গিয়ে আরও বেশ কয়েক ধাপ এগিয়ে গিয়ে আর্কিওলজিক্যাল সোসাইটি অব ইন্ডিয়ার রিপোর্টকেও সত্য বলে স্বীকৃতি দিতে চায়নি। তার বিরুদ্ধেও নানা অসত্য ও অপপ্রচারে লিপ্ত হয়েছে তারা।
অর্থাৎ পশ্চিমবঙ্গীয় সংবাদমাধ্যমগুলির এমন প্রচার যে মসজিদ ভাঙ্গার মতো বেআইনি কাজ করল যারা, জমির স্বত্ত্ব পেল তারা, এবং তাও ধর্মবিশ্বাসের জোরে, তা একান্ত অসার ও মিথ্যা। সত্যটি হল হিন্দুদের দেবতার জন্মস্থান ওই একান্ত বিশেষ মন্দিরটি আজ থেকে প্রায় ৪৯১ বছর আগে হানাদারের পেশীশক্তির দাপটে হাতছাড়া হয়ে গিয়েছিল হিন্দুদের। টানা ৪৯১ বছরের ধৈর্য্য, লড়াই এবং শেষ পর্যন্ত আদালতে দাঁড়িয়ে কাগুজে প্রমাণ দাখিল করে লড়া আইনি যুদ্ধের মাধ্যমে দেবতার জন্মস্থানকে নিজেদের করে ফিরে পেলেন তাঁরা। এর জন্য তাঁদেরকে প্রমাণ করতে হয়েছে যে, তাঁদের দখলে থাকা জমিতে, তাঁদেরই একটি বিশেষ স্থাপত্য ভেঙ্গে, সেই স্থাপত্যের অংশবিশেষ দিয়ে মুসলমান শাসক গড়ে তুলেছিল ওই মসজিদ। তার জন্য না হয়েছিল সম্পত্তির হস্তান্তর, না ছেড়েছিলেন হিন্দুরা তাঁদের দাবি ও দখল। এই সুদীর্ঘ জমি লড়াইয়ের পথে কিছু বেআইনি কাজও কখনও কখনও তাঁদের দ্বারা হয়ে গিয়েছিল বটে, কিন্তু দীর্ঘ পাঁচ শতাব্দীর এই লড়াইয়ে এমন কিছু ভুলচুক না থাকলেই বরং আশ্চর্য হতে হত। মর্যাদা পুরুষোত্তম শ্রী রামও তাঁর গোটা জীবনে ন্যায়, নীতি ও আদর্শ মেনে চলতে গিয়ে বৃহত্তর স্বার্থে বেশ কিছু ভুলও করেছেন। এবং সে ভুলের দায়ভারও বহন করেছেন তিনিই। সেই হিসেবে রামচন্দ্রের জন্মস্থান পুনরুদ্ধারের জন্য যা কিছু ভুলভ্রান্তি হিন্দুদের তরফ থেকে হয়েছে, তার দায়ও বহন করতে হবে সমগ্র হিন্দু সমাজকেই। তবেই আমরা নিজেদের প্রমাণ করতে পারব মর্যাদা পুরুষোত্তম শ্রী রামের নীতি ও ন্যায়পরায়ণতার যথার্থ উত্তরসূরী হিসেবে। স্থাপন করতে পারব স্বপ্নের সেই রামরাজ্য। তাই এ জয় মাটি আঁকড়ে থাকা ধৈর্য্যের জয়, সত্যের জয়, নিজেদের প্রতি এবং আইনের প্রতি আস্থার জয়। এ জয় আপন ভূমিকে হানাদারমুক্ত করার জন্য গত পাঁচ শতাব্দীর জেদেরও জয়।