মৃত্যুপুরী কলকাতার ১৬ই আগস্ট, মুসলিম লিগের প্রত‍্যক্ষ সংগ্ৰামের ভয়ংকর দিন

সুধাংশু কুমার মজুমদার (Sudhanshu Kumar Majumdar) ( জন্ম ; ১৯১৬ )  কলকাতার পুলিশবাহিনীতে  ১৯৪১  সালে যোগ দেন  সাব – ইন্সপেক্টর হিসেবে। তিনি কলকাতার ১৪টি থানায় কাজ করেছেন , ক্রমান্বয়ে দারোগা থেকে সহকারী কমিশনার হয়ে ১৯৭৫ সালে অবসর নিয়ে কিছুদিন প্রখ‍্যাত দৈনিক The Statesman এ সিকিউরিটি অফিসারের দায়িত্ব পালন করেন।

তাঁর সুদীর্ঘ কর্মজীবনে তিনি উত্তর, সেন্ট্রাল, দক্ষিণ, নকশাল, পুলিশ প্রশিক্ষণ,  বম্ব স্কোয়াড  ইত‍্যাদি বিভাগে যে বৈচিত্র্যময় অভিজ্ঞতা লাভ করেছিলেন, তা তিনি লিপিবদ্ধ করে গিয়েছেন তাঁর ” স্মৃতি যখন কথা বলে “ গ্ৰন্থে। গ্ৰন্থটির প্রকাশক তিনি নিজে। প্রথম সংস্করণ প্রকাশ হয়  ২০০৩  সালে (   বাংলা ১৪১০ )।
বহু সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় উথালপাতালের তিনি প্রত‍্যক্ষদর্শী, কখনো কখনো আইনরক্ষী হিসাবে সচেতন অংশগ্রহণকারী।
১৬ই আগস্ট,  মুসলিম লিগের প্রত‍্যক্ষ সংগ্ৰামের ভয়ংকর দিনগুলোতে তিনি মৃত্যুপুরী কলকাতায়   শান্তিরক্ষার দায়িত্বপ্রাপ্ত  ছিলেন।

নাজিমুদ্দিন সাহেবের ভাগিনেয় সোবাহান সাহেব DC South এবং DC HQ দোহা সাহেব। তিনি ২ নং লাউডন স্ট্রিটে থাকিতেন, DC South-এর কোয়ার্টারে। এই (ব‍্যক্তি ) পুলিশের আমুল রদ-বদল ঘটিয়ে হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা বাধানোর জন্য প্রস্তুত হইতে থাকে।
এই সময়ে বেনিয়াপুকুর ফুলবাগানের মফিদুল ইসলাম সংঘের Secretary ছিলেন সালাউদ্দিন সাহেব। তিনি কট্টর লিগপন্থী ছিলেন এবং সুরাওয়ার্দী সাহেবের বিশেষ আস্থাভাজন ছিলেন।


এই সময়ে কলকাতার মুসলিম প্রধান অঞ্চলে প্রধানত চিৎপুর,
মানিক তলার মুরারীপুকুর বাগমারী, বেলেঘাটা থানার, রাজাবাজার, এন্টালি থানা, মতিঝিল বস্তি, বেনিয়াপুকুরের পার্কসার্কাস ও ফুল বাগান, ওয়াটগঞ্জ এবং একবালপুর এইসব জায়গায় লিগপন্থী মুসলমানগণ গোপনে গোপনে দাঙ্গা-হাঙ্গামা করিবার জন্য নানা রকম অস্ত্র , বিশেষ করে তরবারি ও ছোরা গোপনে সংগ্রহ করিতে থাকে। তৎকালীন মুসলিম লিগে এর সহযোগিতায় এবং কলকাতার ঐ সব অঞ্চলে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হাঙ্গামা বাধাইবার জন্য লিগপন্থি মুসলমানরা লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান বা মারকে লেঙ্গে পাকিস্তান এই ধ্বনি দিয়া হিন্দুদের মধ্যে প্রত্যক্ষ সংগ্রাম করিবার জন্য প্রস্তুত হইতেছিল।


১৯৪৬ সালের শেষের দিকে নোয়াখালিতে এবং বিভিন্ন প্রান্তে দাঙ্গা আরম্ভ হয়। বরিশালে কমুনাল দাঙ্গা আরম্ভ হয়। তখন অনেক হিন্দুদের হত্যা করা হয়। যদিও বরিশালের কংগ্রেস ও অনুশীলন পার্টির নেতা শ্রী সতীন সেন অনেক চেষ্টা করেন দাঙ্গা বন্ধ করিবার জন্য, করিতে পারে নাই। এই সময়ে লাকুটিয়ায় জমিদার শ্রী পি এল রায়, যিনি পূর্ব রেলের প্রথম ভারতীয় জেনারেল ম্যানেজার ছিলেন, তাহার বাড়িতে প্রায় ৫০০০ হিন্দুকে আশ্রয় দেওয়া হয়েছিল। তখন দাঙ্গাবাজ মুসলমানরা তাহার বাড়ি আক্রমণ করে অস্ত্রশস্ত্র নিয়া। তখন তিনি আত্মরক্ষার্থে গুলি চালাইয়া ঐ বেআইনি দাঙ্গাবাজদের তাড়াইয়া দিতে বাধ্য হন । এবং তাহার গুলিতে ৪/৫ জন মুসলমান দাঙ্গাবাজদের মৃত্যু হয়। তখন বরিশালের ডি.এম. লাকুটিয়ায় যাইয়া একটি পুলিশ পিকেট বসান এবং পি এল রায়কে রক্ষী দিয়া কলকাতায় পৌছাইয়া দেন।


তারপর কার্যত পূর্ব নির্ধারিত এবং সুরাওয়ার্দী সাহেবের আগের প্ল্যান মতো ১৯৪৬ সালের ১৬ ই আগস্ট সকাল থেকে কলকাতার হিন্দুদের বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষ সংগ্রাম আরম্ভ হয়। এই direct action কলকাতা ছাড়াও পরে ঢাকা, কুমিল্লা, নোয়াখালি বিহারে ও ব্যাপক দাঙ্গা-হাঙ্গামা বা হিন্দুদের উপর অত্যাচার আরম্ভ হয় বা ছড়াইয়া পরে।
কলকাতায় ১৯৪৬ সালের ১৬ ই আগস্ট সকাল ৯ টার পর থেকে লিগপন্থী মুসলমানরা নানা অঞ্চলে দলে দলে মিছিল করে বাহির হয় নানা রকম অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান ধ্বনি দিতে থাকে। এরপর ব্যাপক নৃশংস পাশবিক অত্যাচার, হত্যাকাণ্ড ও লুঠপাট আরম্ভ করে হিন্দুদের উপর। তাহা একটানা চলে ১৭/১৮ ই আগস্ট পর্যন্ত। ছোটলাট ব্যারোজের এই দিনের একটি প্রতিবেদনে জানা যায় সকাল সাতটা ১৬ ই আগস্ট ১৯৪৬ সাল থেকেই উত্তর পূর্ব কলকাতায় মানিকতলা এলাকায় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা শুরু হয় দিনের বাকি অংশে তা চলার সঙ্গে সঙ্গে অন্যত্র ছড়িয়ে পড়ে।


আমি তখন এন্টালি থানার কয়েকজন লাঠিধারী সিপাহীদের নিয়া থানার লরিতে করে টহল দিতে আরম্ভ করি। আমার কাছে তখন revolver ছিল না। হাতে ছোট লাঠি ছিল। প্রায় ১০ টার সময় যখন আমরা মৌলালির মোড়ে পৌঁছাই, তখন দেখি মুসলমান মিছিলকারীরা আপার সারকুলার রোডের পশ্চিমে দিকের সমস্ত হিন্দুদের পিতলের বাসন দোকান লুট করছে। প্রায় ৮/১০টা দোকান যাহা তালতলা ও মুচিপাড়া থানার এলাকায় পড়ে, তাহা ভাঙ্গিয়া লুঠপাট করিতেছিল। আমি তখন লরি করিয়া সিপাহীদের নিয়া ঐ স্থানে উপস্থিত হই, তখন আমাদের দেখিয়া ওই মিছিলকারীরা লুণ্ঠন করা থালা-বাসন ইত্যাদি জিনিস নিয়া পালাইতে থাকে।আমি তাহাদের তাড়া করিয়া ৯/১০ জনকে গ্রেফতার করি এবং রাস্তা থেকে প্রায় ৩/৪ লরি ভর্তি লুন্ঠিত মাল উদ্ধার করিয়া এন্টালি থানার একটি ঘরে রাখিয়া দেই এবং ঐ ধৃত ১০/১২ জন লোককে থানায় ডাইরি লিখিয়া গ্রেপ্তার করিয়া রাখি। তারপর এলাকার মধ্যে কয়েকজন সিপাহী নিয়া লরিতে করিয়া প্রায় সমস্ত দিন টহল দিতে থাকিতাম। আমার থানার ওসি শ্রী ধীরেন মল্লিক মহাশয় খুব শান্তিপ্রিয় ছিলেন, উনি দাঙ্গার সময় টহল দিতে যাইতেন না। আমাদের পাঠাইতেন। বেলা ৪টার সময়ে পুলিশ কমিশনার মিঃ H.R.Hardweal এর নির্দেশে আসে যেহেতু কলকাতায় ব্যাপক দাঙ্গা হইতে পারে সেইজন্য এন্টালি থানায় ১০/১২ জন মুসলমান লুণ্ঠনকারীদের আটক করা হইয়াছিল, তাহাদের যেন সতর্কতা হিসাবে তখনই ছাড়িয়া দেওয়া হউক। আমি তখন আমার ওসির নির্দেশে জেনারেল ডাইরিতে লিখিয়া ঐ আটক ১০/১২ জন লুণ্ঠনকারীকে ছাড়িয়া দিলাম।
এরপর সন্ধ্যার পর থেকে কলকাতার বিভিন্ন জায়গায় দাঙ্গা-হাঙ্গামা,লুণ্ঠন ও হত্যাকাণ্ড আরম্ভ হয় অনেক হিন্দুদের উপর এবং কোথাও কোথাও কিছু হিন্দুদের বাড়িঘর পোড়াইয়া দেওয়া হয়।


এতদিন এই তান্ডব চলিতে থাকে অতর্কিতে কারণ হিন্দুরা এর ব্যাপকতা তখনও বুঝিতে পারে নাই।সমস্ত থানার মুসলমান অফিসাররা কোন ব্যবস্থা নেয় নাই এই জঘন্য ঘটনার জন্য উপরের নির্দেশ মতো, বরং শোনা যায় কিছু কিছু মুসলমানদের পরোক্ষে উস্কানি দিতে সাহায্য করিত। তাই তাহারা হিন্দুদের সাহায্য করিতে আসে নাই।
আমিও আমার সহযোগী অন্য এন্টালি থানার অফিসাররা ২৪ ঘন্টা লরি করিয়া এলাকার ভিতর টহল দিতাম,তাহাতে এলাকায় ৩/৪ জনের বেশি হিন্দু খুন হয়নি আমাদের পুলিশি তৎপরতা ও সতর্ক প্রহরার জন্য। তবে বহু হিন্দু বাড়ি লুণ্ঠিত হইয়াছিল।
তখন বাজার দোকানপাট প্রায়ই বন্ধ থাকিত। তরিতরকারী মাছ খাইবার জন্য পাওয়া যেত না, প্রায় প্রত্যেক জায়গায়। আমাদের থানাটা এন্টালি কনভেন্ট রোডে ছিল। আসে পাশের জনসাধারণ থানায় আসিয়া কিছু তরিতরকারীর ব্যবস্থা করিতে আবেদন করেন।আমাদের সঙ্গে তখন শ্যামপুকুরের সেনবাবুর খুব জানাশোনা ছিল,তাহাদের অনুগ্রহে ৩/৪ দিন থানার লরি ভর্তি তরিতরকারী সেন বাবুদের ধাপার ক্ষেত থেকে আনিয়া বিনা পয়সায় আমাদের এলাকার কিছু লোকজনকে বিতরণ করিয়াছিলাম, এবং আমাদের এন্টালি থানার লোকজনকে দিয়েছিলাম। এই দাঙ্গা-হাঙ্গামা চলাকালীন এন্টালি থানা সংলগ্ন বেনিয়াপুকুর এলাকার বহু হিন্দুকে মুসলমানরা হত্যা করে এবং সেই মৃতদেহগুলি সালাহউদ্দিন সাহেবের মফিদুল ইসলাম সংস্থায় এমবুলেন্স গাড়ি করিয়া সালাউদ্দিনের নির্দেশে গোবরা বেরিয়াল গ্রাউন্ডে কবর দেওয়া হইত এবং কোন চিহ্ন পর্যন্ত পাওয়া যাইত না। স্থানীয় মুসলিম পুলিশ অফিসাররা কোন তৎপরতা দেখায় নাই, এইসব ঘটনা বন্ধ করার জন্য। এরপর মুসলমান মিলিটারি , পাঠান পুলিশ কলকাতায় টহল দিতে আরম্ভ করে। এবং টহল দিবার সময় হিন্দুদের উপর অত্যাচার করে,এবং অনেক হিন্দুকে বিনা অপরাধে গুলি করিয়া হত্যা করে। ১৮/১৯ শে অগস্ট আমি থানার লরি করে রাজাবাজারে কলিকাতা মেডিকেল স্কুল (এখন ESI hospital হয়েছে) কোন কাজে গিয়েছিলাম সকালের দিকে,তখন এন্টালি বাগানের কাছে আপার সারকুলার রোডে ২৩/২৪টা হিন্দুদের মৃতদেহ রাস্তায় পড়িয়া থাকে দেখিয়াছিলাম এবং দুর্গন্ধ আসিতেছিল। ৩/৪দিন পর রাস্তা থেকে মৃতদেহগুলি পুলিশ তুলিয়া সৎকারের ব্যবস্থা করিয়াছিল।


এই দাঙ্গা-হাঙ্গামা চলাকালীন আমরা source এর কাছ থেকে খবর পাই যে বেনিয়াপুকুর রোডের বাসিন্দা ডক্টর বেনীমাধব বড়ুয়া যিনি কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পালি বিভাগের হেড ছিলেন, আমাকে খুব ভালোবাসিতেন, কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় পড়িবার সময়ে এবং অনেক সাহায্য করিয়াছিলেন, মুসলমান দাঙ্গাবাজরা তাহার বাড়ি সেইদিন আক্রমণ করিয়া লুণ্ঠন করিবে এবং তাহার বয়স্কা কন্যাদের অপহরণ করিবে। আমি এই সংবাদ জেনারেল ডাইরিতে লিখিয়া কিছু বন্দুকধারী সিপাহী সহ তাহার বাড়িতে উপস্থিত হইয়া তাঁহাকে সমস্ত ঘটনার সংবাদ বলিয়া বাড়ি ছাড়িতে বাধ্য করি।আমি নিজে ওখানে দাঁড়াইয়া থাকিয়া ভাড়া লরি নিয়া আসিয়া তাহাদের সকলকে নিরাপদে জিনিসপত্রাদি সহ হাওড়া স্টেশনে পাঠাইয়া দিয়াছিলাম। বেনিয়াপুকুর থানায় ২ দিন যাবৎ দাঙ্গা চলিতেছিল এবং ৩/৪ হিন্দুকে খুন করা হয়। বহু বাড়িঘর জ্বালাইয়া দেওয়া হয়


এন্টালি থানায় আমাদের তৎপরতার জন্য মুসলমান দাঙ্গাবাজরা বেশি লুণ্ঠন বা খুন করিতে পারে নাই। এই সময়ে এক টহলদারী ইংরেজ মিলিটারি লুণ্ঠন করিবার সময় গুলি করিয়া হত্যা করে এক মুসলমান লুণ্ঠনকারীকে দেব মার্কেটের কাছে ।পরে মফিদুল ইসলামের সেক্রেটারি সালাউদ্দিন মিথ্যা প্রচার করে যে আমি ঐ লুণ্ঠনকারী কে হত্যা করিয়াছি। এবং ঐ মার্কেটে leaflet দেওয়া হয় আমার নাম লিখিয়া এবং আমাকে হত্যা করিলে ১০০০ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করা হয়। বলা হয় আমার হত্যাকারীকে পুরস্কার দেওয়া হবে। এই সংবাদ লালবাজারে কমিশনার সাহেবের গোচরে আনিলে তিনি আমাকে (put up) পেশ করিতে বলা হয় তাহার নিকট। আমি তখন তার কাছে পেশ হই, তখন সেখানে Rai Bahadur Satyen Mukherjee এবং Shri Hiren Sarkar উপস্থিত ছিলেন। উহারা প্রত্যেকে আমাকে খুব সাবধানে থাকিতে বলেন এবং কমিশনার সাহেবের আদেশে লালবাজার অস্ত্রাগার থেকে একটি revolver তখনই দেওয়া হয় আমাকে আমার নিজের আত্মরক্ষার জন্য। এবং আমার কাজের প্রশংসা করা হয়।
এইসময় সন্ধ্যার পর হিন্দু পকেট এলাকাগুলিতে “বন্দে মাতরম”ধ্বনি দিতে এবং মুসলিম এলাকায় তেমনি “আল্লাহু আকবর” ধ্বনি দিতে শোনা যাইত, আতঙ্ক ও আক্রমণের ভয়ে।
১৬ই আগস্টের ৩/৪দিন পরে হিন্দুরাও সঙ্ঘবদ্ধ হয় এবং তাহারাও কিছু কিছু মুসলমানদের আক্রমণ করিতে আরম্ভ করে। কিন্তু মুসলিম ঘাতকরা ছুরি মারায় ওস্তাদ থাকায় রাস্তাঘাটে বেশি হিন্দুদের হত্যা করতে পারিয়াছিল। তারপর কিছু মুসলমান মিলিটারি এবং পাঠান পুলিশ টহল দিতে আসিলে তাহারা বেপরোয়াভাবে হিন্দু এলাকায় গুলি চালাইতে থাকে। তারপর এই সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা মাঝে মাঝে থামিয়া যাইত কলকাতায় আবার কয়েকদিন পরে নানা জায়গায় আরম্ভ হইত, এইভাবে চলিতে থাকে এমন সময় পটারি রোডের বেঙ্গল পটারির চিফ ইঞ্জিনিয়ার মিস্টার হুশিয়ার সিংহের কাছ থেকে ফোনে জানতে পাই যে প্রায় ৪/৫ শত অস্ত্রশস্ত্র নিয়া মুসলমান দাঙ্গাবাজরা তাহাদের ফ্যাক্টরি আক্রমণ করিয়া মেইন গেট ভাঙার চেষ্টা করিতেছে। আমি তৎক্ষণাৎ আমার ফোর্স নিয়া সেখানে উপস্থিত হই এবং কয়েক রাউন্ড গুলি চালাই। তারপর সেখানে পুলিশ পকেট বসানো হয়।


দাঙ্গা যখন কিছুটা থেমে গেছে তখন একদিন এন্টালি এলাকায় তৎকালীন councillor পুলিন খটিক আমার কাছে আসিয়া অনুরোধ করেন যে তিনি যে সময় তাহার পটারি রোডের বাড়ি আক্রান্ত হয়, তখন একটা কলসি ভর্তি এক লক্ষ টাকার নোট তাহার বাড়ির মাটির ভিতর পুঁতিয়া রাখিয়া আসিয়াছিলেন। ঐ টাকাটা উদ্ধার করার জন্য আমাকে সাহায্য করিতে বলেন।
তখন আমি উহার সঙ্গে তার পটারি রোডের বাড়িতে যাই এবং মাটি খনন করিয়া সেই কোর্সে ভর্তি এক লক্ষ টাকা উদ্ধার করা হয়।
আর একদিন মিস্টার মিত্র উনি জার্মানি থাকে chemical engineering পাশ করিয়া ফুলবাগান ও সারকুলার রোডের মোড়ে নিজের একটা ছোট বাড়ি ছোট কারখানা করেছিলেন। পরে দাঙ্গার সময় তাহার বাড়ি আক্রান্ত হলে তার স্ত্রীর সোনার গহনা তাহার কারখানার মাটির নিচে পুঁতিয়া রাখিয়া আসিয়াছিলেন। আমাকে ঐ গহনা উদ্ধার করিবার জন্য সাহায্য চান। আমি তখন উহার সঙ্গে সেই পরিত্যক্ত লুণ্ঠিত কারখানা ও বাড়িতে যাই এবং মাটির ভিতর থেকে গচ্ছিত তাহার সেই গহনা গুলি উদ্ধার করি।
তিনি পরে convent lane এ এন্টালি থানার কাছে তাহার কারখানা পুনরায় করিয়াছিলেন।
…………………………………………………………………….
মুচি পাড়া থানার ওসি সিরাজুল হকের হত্যার পর হিন্দুদের উপর পাঠান পুলিশের তান্ডব
দুইজন আহত কাবুলিকে ইসলামিয়া হাসপাতালে ভর্তি

…………………………………………………………………..
এরপর মুচি পাড়া থানার ওসি সিরাজুল হক বউবাজার স্ট্রিট কলেজ স্ট্রিটের মোড়ে ডাক্তার বগলা বাবুর চেম্বারে যাইতেছিলেন তখন তাকে গুলি করিয়া হত্যা করিয়াছিল গোপাল পাঁঠার লোকেরা।সেই সময় রনজিৎ রায় চৌধুরী মুচিপাড়া থানার দ্বিতীয় অফিসার ছিলেন, পরে তিনি ঐ থানার ওসি হয়েছিলেন। মুসলমানরা আবার ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। তখন পাঠান পুলিশরা যখন তখন বহুবাজার স্ট্রিট, কলেজ স্ট্রিটে গুলি করিয়া অনেক হিন্দুকে হত্যা ও জখম করে। এবং নানা জায়গায় দাঙ্গা-হাঙ্গামা আরম্ভ করে।

একদিন সকালে একদল পাঠান সশস্ত্র পুলিশ কিছু গরুকে কাটার উদ্দেশ্যে Entally Slaughter House- এর দিকে escort করিয়া লইয়া যাইতে ছিল, তখন এন্টালি এলাকার রাস্তার দুই পার্শ্বের হিন্দুদের বাড়িতে এলোপাথারি ১০২ রাউন্ড গুলি চালায়, তাহাতে অনেক হিন্দু জখম হয়। এইসময় DC হিরেন সরকার একজন ইংরেজ Sgt সহ সেখানে উপস্থিত হন। আমিও খবর পাইয়া পুলিশ বাহিনী লইয়া লরি করিয়া সেখানে উপস্থিত হইয়াছিলাম।
DC হীরেন সরকার আমাকে বলেন ওখানে কোথায় মুসলিমদের বাড়ি আছে। তিনি নিজেই কয়েকটা মুসলমানের বাড়ি খোঁজ করেন। উনি পাঠান পুলিশের এই অত্যাচারে অত্যন্ত মর্মাহিত হয়েছিলেন। ইংরেজ Sgt কে আদেশ দেন সেই মুসলমানদের এক বাড়িতে গুলি করিতে। ঐ ইংরেজ Sgt ২ রাউন্ড গুলি করে কিন্তু দুঃখের বিষয় গুলি ২জন কাবুলিকে আহত করে।
আমি তারপর Ambulance ডাকিয়া ঐ ২ জন কাবুলিকে ইসলামিয়া হসপিটালে পাঠাইয়া দিয়াছিলাম।পরে তাহারা কিছুটা সুস্থ হইলে ঐ হাসপাতালে যাইয়া তাহাদের বয়ান লিখিতভাবে লিপিবদ্ধ করিয়াছিলাম। আমরা অক্লান্ত পরিশ্রম করিয়া দিবারাত্র এলাকায় টহল দিবার জন্য এন্টালি এলাকার ১৬ ই আগস্ট দাঙ্গা আরম্ভ হওয়ার পর লিগপন্থী মুসলমানগন বেশি খুন,জখম ও লুঠপাট করিতে পারে নাই। তাই তাহারা আমার উপর খুব ক্ষুব্ধ ছিল। যদিও এলাকার হিন্দু মুসলমানদের রক্ষা করার চেষ্টা করিয়াছিলাম।
পরে জানিতে পারিলাম এলাকার লিগপন্থী ও তৎকালীন অঞ্জুমান মফিদুল ইসলামের Secretary সালাউদ্দিন সাহেব, প্রধান ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সুরাওয়ার্দী সাহেবের কাছে deputation ডেপুটেশন দেয়, যাহাতে আমাকে এন্টালি থানা থেকে বদলি করা হয়।তাই HC/HQ দোহার আদেশে আমাকে ২৪/১২/৪৬ তারিখে মানিকতলা থানায় বদলি করা হয়।
আমি ২৪/১২/৪৬ তারিখেই মানিকতলা থানায় যোগদান করি


………………………………………………………………
দাঙ্গা-হাঙ্গামার সময় সোনার গহনা ভর্তি একটা লুণ্ঠিত বড় সিন্দুক ডি.সি হেডকোয়ার্টার বাড়ি স্থানান্তরিত করার ঘটনা
…………………………………………………………….
১৯৪৬ সালের ১৭ ই আগস্ট যখন কম্যুনাল দাঙ্গা চলিতেছিল এবং মুসলমান দাঙ্গাবাজরা অস্ত্রসস্ত্র নিয়া হিন্দুদের দোকান লুঠপাট করিতেছিল তখন আমার বাহিনী নিয়া সকালের দিকে মৌলালির মোড়ে পৌছাই তখন দেখিতে পাই এস এন ব্যানার্জি রোডের তালতলা থানা এলাকার অনেকগুলি সোনা রূপার দোকান প্রায় ১০/১২ টি লুণ্ঠিত হইয়াছিল এবং একটি লুণ্ঠিত দোকানের সামনে একটা বিরাট লোহার সিন্দুক পড়িয়াছিল। এইসময় ডি.সি হেডকোয়ার্টার মিস্টার দোহার এক আর্দালি ও তাহার মিস্টার দোহার নির্দেশে ঐ লুণ্ঠিত দোকানের বড় সিন্দুকটা লইয়া যাইবার জন্য তখন ঐ ASI অনেক লোকজন যোগাড় করিয়া অতি কষ্টে সেই বিরাট সিন্দুকটি মিঃ দোহার লাউডন স্ট্রিট অফিসে লইয়া গিয়েছিল। দোহা সেই বাড়িতে বাস করিতেন। তারপর সেই ASI কে মিস্টার দোহা ৫০ টাকা পুরস্কার দিয়েছিলেন।
কিছুদিন পর ASI Ramen Chatterjee আমাকে বলিয়াছিলেন যে সেই সিন্দুক ভাঙিয়া ভিতরের সমস্ত সোনা রূপার গহনা দোহা সাহেব নিজে নিয়া গিয়েছিলেন এবং তাহাকে ঐ সিন্দুক তাঁহার অফিসে পৌঁছবার জন্য ৫০ টাকা পুরস্কার দিয়েছিলেন মাত্র। এই DCHQ দোহা সাহেব একবালপুর এলাকায় এক বিরাট প্রাসাদ, নিজে তৈরি করিয়াছিলেন। পরে দেশবিভাগের অনেক পরে সেটি একটি মাড়োয়ারিকে বিক্রি করিয়াছিলেন।
সুরাওয়ার্দী সাহেবের সাকরেদ শরীফ খান এবং বেনিয়াপুকুরের মফিদুল ইসলামের সেক্রেটারি সালাউদ্দিন এবং দাঙ্গাবাজগণ ১৬ ই আগস্ট দাঙ্গার আগে হাতিয়ার ছোরা, গুপ্তি, তলোয়ার, বন্দুক ইত্যাদি বিলি করে। তখন মহম্মদ ওসমান কলকাতা নব মুসলিম লীগের সম্পাদক এবং কলকাতার মেয়র। তিনি, শরিফ খান ও সালাউদ্দিন শহর ঘুরে ঘুরে দেখা করার জন্য মুসলিম জনগণকে উত্তেজিত করেন। ওই দিন ছুটি ঘোষণা করা হয়েছিল। সেই দিন সুরাওয়ার্দীর সভাপতিত্বে মুসলিম লিগের সভা হয়। সভা ফেরত জনতা দোকান পাট লুঠ করিতে থাকে, পথচারী কে পাইকারিভাবে হত্যা করে। রাস্তার মুসলিম গুন্ডারা লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান, আল্লা ও আকবর ইত্যাদি স্লোগান দিয়া জনসাধারণের মনে আতঙ্কের সৃষ্টি করেছিল।


সুরাওয়ার্দী সাহেব একটানা পুলিশ হেডকোয়ার্টার লালবাজারে উপস্থিত ছিলেন দুই দিন ১৬/১৭ আগস্ট এবং স্বয়ং পুলিশকে মৌখিক ও লিখিত নির্দেশ দিতেছিলেন যে সব লুন্ঠনরত গুন্ডাকে পুলিশ হাতেনাতে ধরে গ্রেপ্তার করে, তিনি নিজের দায়িত্বে সকলকে ছেড়ে দেন। অনেক ঘন্টা ধরে হত্যালীলা চলিতে থাকে। রাস্তায় মৃতদেহের স্তুপ জমে থাকতে দেখা যায়। সুরাওয়ার্দী সাহেব দুদিন লালবাজারের কন্ট্রোল রুমে ছিলেন ১৬ এবং ১৭ আগস্ট ১৯৪৬ সালে। এই সময় দুটি RWAC ambulance গাড়িতে মুসলিম পতাকা নিয়া রাস্তায় ঘুরতে দেখা যায়। British সৈন্যদের সন্দেহ হইল, ওই গাড়ি দুটি তল্লাশি করিয়া উহার মধ্যে অনেক অস্ত্রশস্ত্র, ছোরা, তরবারী ইত্যাদি পাওয়া গেলে তখন সেই গাড়ি দুটি আটক করিয়া আরোহীদের গ্রেফতার করা হয়।


…………………………………………………………………….
মানিকতলা থানার দ্বিতীয় অফিসার হিসেবে ২৪/১১/৪৬ হইতে কার্যভার গ্রহণের পরে
……………………………………………………………………..

আমি ২৪/১২/৪৬ তারিখে মানিকতলা থানায় যোগদান করি দ্বিতীয় অফিসার হিসাবে। সেখানকার ওসি ছিলেন ফজলুল করিম চৌধুরী কট্টর লিগপন্থী চট্টগ্রামের। তাহার ছোট ভাই মিস্টার চৌধুরী বিএ পাশ করিয়া বেকার হইয়া থানায় তাহার দাদা ওসির কোয়ার্টারে থাকিতেন। পরে তিনি ইস্ট পাকিস্তানের Muslim league-এর president হইয়াছিলেন।
এই মানিকতলা থানায় তখন একজন কাশ্মীরবাসী মুসলিম Sgt ছিল। সে কলকাতা পুলিশের তখনকার দিনে নামকরা খেলোয়াড় ছিল। তাহার বাবা ইংরেজ ছিলেন এবং মা কাশ্মীরি ছিলেন।
তাহার কাছ থেকে এবং থানার অন্যান্য জুনিয়র অফিসারদের কাছ থেকে অনেক ঘটনার কথা জানিতে পারিয়াছিলাম। এই কট্টরপন্থী ওসির মদতে, উসকানিতে মানিকতলা, বেলেঘাটা ও চিৎপুর থানা এলাকায় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা মারাত্মকভাবে ঘটেছিল, সকাল ৭ টা হইতে ১২৬ই আগষ্ট মুচিবাজার মানিকতলা থানায় একটা outpost ছিল, আমি মানিকতলা থানায় যোগদান করার পরেও দেখিলাম মুরারিপুকুর ও বাগমারির অঞ্চল থেকে প্রায় হিন্দুরা বিতাড়িত। তখন মাঝে মাঝে দাঙ্গা চলিতেছিল।


একজন সিপাহীর নিকট হইতে জানিতে পারিলাম যে দাঙ্গাবাজ মুসলমানগন ওই ওসির মদতে যশোরের জমিদারদের বাগমারিতে “বাগমারিভিলা” দাঙ্গার সময়ে আক্রমণ করিয়া লোকজনকে বিতাড়িত এবং হত্যা করিয়া বাড়ির সমস্ত জিনিসপত্র লুণ্ঠন করে ২দিন ধরিয়া এবং সমস্ত সোনার গহনা একটি টিনের সুটকেসের ভিতরে ভরে ওসি থানার লরিতে লইয়া আসিতেছিল, তখন ঐ সিপাহীরা লরিতে ওসির সঙ্গে ছিল। রাস্তা খারাপ থাকার জন্য হঠাৎ ধাক্কা লাগিয়া সুটকেসের উপরের পাল্লাটা খুলিয়া যায়, তখন সোনার গহনা গুলি দেখা গিয়াছিল। পরে সেই সোনার গহনা ভর্তি সুটকেসটা ওসি তাঁহার কোয়ার্টারে লইয়া যায়, পরে ২/৩ দিনের মধ্যে ওসি ছুটি লইয়া ঐ সুটকেসের ও আরও অনেক লুটের জিনিস লইয়া চট্টগ্রামে তাহার বাড়িতে চলিয়া যান এবং আবার ফিরিয়া আসিয়া কাজে যোগদান করেন। আমিও ঐ থানায় যোগদান করার পরেও ঐ ওসিকে ৩/৪ বার অল্প দিনের জন্য ছুটি লইয়া চট্টগ্রামে গিয়াছিলেন আমাকে থানার দায়িত্ব দিয়া। বাগমারী ভিলা লুঠ করার জন্য থানার ওসি ফজলুল করিম চৌধুরীর বিরুদ্ধে F.I.R. পর্যন্ত করা হয়েছিল ঐ থানায়।
এক মুসলিম বেষ্টিত বস্তি বেলেঘাটা রোডের জগন্নাথ কোলের কয়েকজন আত্মীয়কে উদ্ধার করার ভার আমার উপর পড়িয়াছিল। আমি একটা প্রাইভেট লরিতে আমাদের থানার নেপালি ড্রাইভার ও ২ জন সিপাহী লইয়া বেলেঘাটার canal bridge পার হইয়া পূর্ব দিকে যাইতেছিলাম।তখন দেখি মিয়াবাগানের সামনে কয়েকজন মুসলমান দৌড়াইয়া আসিয়া একজন সাইকেল আরোহীর মাথায় আঘাত করে, তারপর তাহাকে ছুরিকাঘাত করে। এই ঘটনা যখন দূর থেকে দেখিতেছিলাম তখন হঠাৎ আমাদের লরির নেপালি ড্রাইভার ভয়ে গাড়িটা থামাইয়া দিয়াছিল তারপর আমি তাহাকে ধমক দিয়া তাড়াতাড়ি জোরে গাড়ি চালাইয়া ঐ ঘটনাস্থলের দিকে যাইতে বলি। আমি সেখানে যাইবার আগে আমার revolver থেকে কয়েক রাউন্ড গুলি চালাইয়াছিলাম সেই ঘাতকদের দিকে কিন্তু তাহারা আমার range এর অনেক দূরে ছিল। তাহারা তখন পালাইয়া মিয়াবাগান বস্তির মধ্যে ঢুকিয়া পরে আমি ঐ আহত যুবক ও তার সাইকেলটি লইয়া চলিয়া আসি এবং আহত যুবককে নীলরতন হাসপাতালে ভর্তি করাইয়া দেই। পরে সে মারা যায়।


পরে তদন্ত করিয়া জানিয়াছিলাম হিন্দু যুবকটি কয়েকটি হিন্দু যুবকের সঙ্গে বাজি ধরিয়াছিল যে সে বেলেঘাটা রেল ব্রিজ থেকে বেলেঘাটা canal ব্রিজে সাইকেল করিয়া আসিয়া আবার ফিরিয়া যাইবে নিরাপদে এবং বাজি ছিল মাত্র ১০ টাকার। এই ১০ টাকার জন্য ছেলেটা তাহার অমূল্য জীবন বিসর্জন দিয়াছিল। এই যুবকটিকে হত্যা করিতে দেখা চাক্ষুষ ভাবে আমার সামনে এটাই আমার পুলিশ জীবনের একমাত্র ঘটনা। সেই দিন আমি আর উদ্ধার কার্য করতে পারি নাই।এই দাঙ্গার সময় আমরা শত শত হিন্দু মুসলমানদের উদ্ধার করিয়া নিরাপদ আশ্রয় পৌঁছাইয়া দিয়াছিলাম।
এই দাঙ্গার সময় পুলিশের মধ্যেও অনেকটা সাম্প্রদায়িক মনোভাব ছড়াইয়াছিল।মুসলমান অফিসাররা সবসময় মুসলমানদের বেশি সাহায্য করিত এবং হিন্দু অফিসাররাও কিছুটা সাম্প্রদায়িক মনোভাব পোষণ করিত
একদিন, তখন দাঙ্গা চলিতেছিল মানিকতলা থানায় কর্তব্যরত এক হিন্দু ASI আমাকে মৌখিক report করে যে সেই দিন ২ টার সময় লালবাগানের হাবিব গুন্ডা, মুরারী পুকুর ও বাগমারির কিছু লিগপন্থী নেতা গুন্ডাগণ ওসি ফজলুল করিমের সঙ্গে গোপনে তাহার ঘরে সভা করার পর ঠিক হয় তারপর দিন ঐ মুসলমানগন থানার কাছে নারী কল্যাণ আশ্রম আক্রমণ করিবে সকাল ৯টার সময়। প্রায় ২৫০ জন হিন্দু মেয়েরা তখন ঐ আশ্রমে ছিল, তাহাদের ধরিয়া লইয়া গিয়া লুঠপাট করিয়া পাকিস্তানে পাঠিয়ে দেবে।আমি এই সংবাদ শুনিয়া বিমূঢ় হইয়া পড়ি এবং চিন্তা করিতে থাকি কীভাবে ঐ নারীদের রক্ষা করা যায়। তারপর পরের দিন সকালে যে ASI duty তে ছিল তাহাকে ডাকাইয়া নির্দেশ দিই যে নারী কল্যাণ আশ্রম থেকে কোন আক্রমণের খবর আসিলে তাহা আমাকে যেন প্রথম জানানো হয় এবং কয়েকজন লাঠিধারী হিন্দু সিপাহীকে সকালে প্রস্তুত থাকিতে বলিয়াছিলাম আমার সঙ্গে কোন action এ যাইবার জন্য।


আমি রাত্রে ঐ নারী কল্যাণ আশ্রম এর যাইয়া উহার lady superintendentকে ব্যাপারটা বলি এবং অনুরোধ করি যদি পরদিন আশ্রম আক্রান্ত হয় দাঙ্গাবাজ মুসলমানদের দ্বারা তৎক্ষণাৎ থানায় যেন আমাকে telephone করেন এবং ঐ প্রতিষ্ঠানের সেক্রেটারি মিঃ গাঙ্গুলী যিনি মোহনলাল স্ট্রিটে থাকিতেন তাহার বাড়ি যাইয়া তাহাকে ঘটনাটা বলি, তাহার দোনালা বন্দুক ছিল। উনাকে তাঁহার বন্দুক লইয়া শেষ রাত্রে নারী কল্যাণ আশ্রমে থাকিতে বলি এবং আশ্রম আক্রান্ত হইলে তাহাকে গুলি চালাইতে অনুরোধ করি আত্মরক্ষার্থে।
পরদিন সকালে নয়টার সময় প্রায় ৫০০ সশস্ত্র দাঙ্গাবাজ মুসলমানরা নারী কল্যাণ আশ্রম অস্ত্রশস্ত্র লইয়া ঘিরিয়া ফেলে। তখন সেখানকার lady superintendent এর telephone পেয়ে আমি আমার পুলিশের লোকজন লইয়া ঐ সশস্ত্র জনতার মুখোমুখি হই এবং গুলি চালাই, ওদিকে আগেই ঐ সংস্থার secretary গুলি চালাইয়া ৫/৬ জনকে আহত করে, তখন দাঙ্গাবাজরা ব্যর্থ মনোরথ হইয়া পালাইয়া যায় আহত লোকজনদের লইয়া। আমাদের এই কাজের জন্য, মুসলমান ওসি, এসি ও ডিসি আমার উপর অনেকটা বিরূপ মনোভাব পোষণ করিয়া ছিলেন।

নিবেদনে – ঋতুপর্ণ বসু

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.