হিন্দু যত দিন, বাঙ্গালীও তত দিন

“বাংলায় কথা বললেই বাঙালি”- এটা একটা ধান্দাবাজি যুক্তি। এর কোনো নৃতাত্ত্বিক, ঐতিহাসিক, সমাজতাত্ত্বিক ভিত্তি নেই।

ভাষা দিয়ে যদি জাতি তৈরি হয়, তাহলে তো ব্রাজিলীয়দের পর্তুগিজ বলে ডাকতে হয়। কারণ ব্রাজিলের লোকেরা পর্তুগিজ ভাষায় কথা বলে। ইংল্যান্ড আর স্কটল্যান্ড দুটো অঞ্চলই UK রাষ্ট্রের অন্তর্ভুক্ত, দুই অঞ্চলেরই ভাষা ইংরেজি। অথচ স্কটল্যান্ডের লোকেরা কখনোই নিজেদের ইংরেজ বলে না, বলে ‘স্কট’। আইল অফ ম্যান UK-র অংশ, এরাও ইংরেজি ছাড়া আর কিছুতে কথা বলে না। তবু তারা নিজেদের ইংরেজ বলে না, বলে ‘ম্যাঙ্কসম্যান’।

জাতি তৈরি হয় ঐতিহ্য, একই ইতিহাস, সংস্কৃতি এইসব দিয়ে। জাতিগঠনে ভাষার ভূমিকা গৌণ। ইতিহাসের দুটো বিপরীত বিন্দুতে দাঁড়িয়ে থাকা জনগোষ্ঠী কখনোই এক জাতির অন্তর্ভুক্ত হতে পারে না। আপনারা বাংলা আক্রমণকারী বখতিয়ারকে নিয়ে গর্ব অনুভব করে ‘বখতিয়ারের ঘোড়া’ নামের কবিতা লেখেন, আমরা বখতিয়ারকে ঘৃণার চোখে দেখি। আপনাদের কাছে হুসেন শা নায়ক, আমাদের কাছে খলনায়ক। আমরা আর আপনারা ইতিহাসের দুটো সম্পূর্ণ বিপরীত দিকে দাঁড়িয়ে আছি। আমরা উভয়ে কিছুতেই এক জাতির অংশ নই, হতেও পারি না।

আর এখানেই ভাষাবাদীদের বেলুন ফুটো হয়ে চুপসে যায়। ভাষা দিয়েই যদি বাঙালি হয়, তাহলে আপনারা হুসেন শা বা বখতিয়ারকে নিয়ে গর্বভরে কবিতা লেখেন কেনো ? এরা তো কেউই বাংলা জানতেন না, বাংলা ভাষায় কথাও বলতেন না। তাহলে বখতিয়ার বা হুসেন শা-এর সাথে আপনাদের মিল কোথায় ? ঠিক ধরেছেন। ঐটাই আপনাদের জাতি। ইসলাম তো আপনাদের অন্য কোনো জাতির সাথে সম্পৃক্ত হবার অনুমোদন দেয় না।

আমাদের রাজ্যের ঠিক পাশেই বাংলাদেশ নামে যে স্বাধীন দেশটি রয়েছে তা বাঙ্গালীর নিকট সবচেয়ে বড় হুমকি। দেশটি বাঙ্গালীর কত ক্ষতি প্রতিনিয়ত করে চলেছে তা অনুমান করাও কঠিন। অনুপ্রবেশের কথা বলছি না। অনুপ্রবেশ একটা বড় সমস্যা মানি, কিন্তু সবচেয়ে বড় ক্ষতি বাঙ্গালী সত্ত্বার চুরি। জনসংখ্যাধিক্যের জন্য সমগ্র বিশ্বের কাছে এই আরবপন্থী ইসলামিক দেশটি বাঙ্গালীর নতুন বিকৃত পরিচিতি প্রচার করছে। বিশ্ব তাদেরকেই বাঙ্গালী ভাবছে। তারা বাঙ্গালা ভাষাটির মোটামুটি দফা রফা করে রেখেছে। তৎসম, তদ্ভব প্রভৃতি শব্দকে সরিয়ে আরবি শব্দ বাঙ্গালা অক্ষরে লিখে ভাষাটির মাধুরী সম্পূর্ণ বিনাশ করছে। ল্যাটিন হরফে লেখা ইতালিয়ান বা ফরাসী যেমন ইংলিশ বা জার্মান ভাষা নয়, তেমনি আসমানি, গোসল ইত্যাদিও বাঙ্গালা নয়। কিন্তু বাংলাদেশের জন্য ঐগুলিকেও বাঙ্গালা বলে মেনে নিচ্ছে ‘শিক্ষিত’ জনেও।
বাঙ্গালী মানে দুর্গাপুজো, বাঙ্গালী মানে পদাবলী, পদ্মপুরাণ, বাঙ্গালী মানে সন্ধ্যাপ্রদীপ, বাঙ্গালী মানে নববর্ষে ভগবতী জ্ঞানে গোয়ালঘরে গোসেবা। যেহেতু এর প্রতিটিই ইসলাম বিরোধী, তাই আরবী নামধারীদের কাছে ব্রাত্য। বহির্বিশ্বে বাঙ্গালী সংস্কৃতির প্রসারে এগুলিকে সযত্নে এড়িয়ে চলে এই সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙ্গালাভাষী। বাঙ্গালার সাথে সম্পর্কহীন আরবজাত সংস্কৃতিকে বাঙ্গালী সংস্কৃতি বলে প্রচারের প্রচেষ্টা চলছে প্রতিনিয়ত।
এভাবেই চুরি হয়ে যাচ্ছে বাঙ্গালীর সংস্কৃতি।

বাঙ্গালায় যারা দখলদার, তাদের এরা নায়ক বানায়। বখতিয়ার খলজি, শাহজালালের মতো হানাদারদের জাতীয় বীর বলে প্রচার করে। ভারত ভেঙে পাকিস্তানের দাবিদার মুজিবর রহমানকে বানায় ‘হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙ্গালী’! অতীশ দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান বাদ, শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু বাদ, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাদ, বিবেকানন্দ বাদ, বিদ্যাসাগর বাদ, রামমোহন রায় বাদ, সাহিত্য সম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র এনারা সবাই বাদ, শ্রেষ্ঠত্বের মুকুট পরে শেখ মুজিবর!

খুব বেশিদিন আগেকার কথা নয়, উনিশ শতকেই বাংলার মৌলবীরা বাংলাকে “হিন্দুর ভাষা অথবা ‘কুফুরি জবান’ অর্থাৎ কাফেরের ভাষা বলে ফতোয়া দিয়েছিলেন।” বিশ শতকের গোড়াতেও বাংলার অধিকাংশ মুসলমান বাংলাকে নিজেদের মাতৃভাষা বলে স্বীকার করতেন না, বেগম রোকেয়া, ফজলুল হকের পরিবার সহ অনেক অভিজাত মুসলমান পরিবারে উর্দু ছিল মাতৃভাষা। বাঙ্গালী যে হিন্দুই, এই নিয়ে কোনো দ্বিমত ছিল না; বাংলার মুসলিম সম্প্রদায় নিজেদের মুসলমান পরিচয় দিয়েই সন্তুষ্ট ছিল। কিন্তু ছাপাখানার সহায়তায় বাঙ্গালী হিন্দু প্রণীত সাহিত্যের ক্রমবর্ধমান প্রভাব ও ইংরেজ প্রবর্তিত প্রাতিষ্ঠানিক উচ্চশিক্ষার প্রসারের ফলে বাংলার মুসলমান সমাজে শুরু হয় জাতিসত্তার অনুসন্ধান, কিন্তু তা নিজেদের হিন্দু শিকড়কে অস্বীকার করে। নিজেদের জন্য পৃথক এক আইডেন্টিটি প্রতিষ্ঠা করার অন্যতম পন্থা হয় ক্রমাগত আরবি-ফারসি শব্দের অনুপ্রবেশ ঘটিয়ে বাংলা ভাষাকে ‘হিন্দুত্ব’ বর্জিত করে তার ইসলামীকরণ। এর প্রেরণা ছিল মধ্যযুগের আরবি, ফারসি, ও তুর্কি ভাষার বিপুল মিশ্রণে সৃষ্ট মুসলিম পুঁথি – সাহিত্য। এই বিজাতীয় ভাষার মিশ্রণের কারণ ব্যাখ্যা করেছেন বাংলাদেশের প্রখ্যাত সাহিত্যিক ও চিন্তাবিদ আহমদ ছফা, তাঁর প্রসিদ্ধ ‘বাঙালি মুসলমানের মন’ প্রবন্ধে:

“এই পুঁথিসমূহের দো-ভাষী অর্থাৎ বাংলা এবং আরবী-ফার্সী মিশ্রিত হওয়ার পেছনে একটি অত্যন্ত দূরবর্তী ঐতিহাসিক কারণ বর্তমান। হাদীসে তিনটি কারণে অন্যান্য ভাষার চাইতে আরবীকে অগ্রাধিকার দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। প্রথম হলো কোরআনের ভাষা আরবী, দ্বিতীয় কারণ বেহেশতের অধিবাসীদের ভাষা আরবী এবং তৃতীয়ত হজরত মুহাম্মদ নিজে একজন আরবীভাষী ছিলেন। এই তিনটি মুখ্য কারণে যে সমস্ত দেশে ইসলাম প্রচারিত হয়েছে, সেখানে অপ্রতিরোধ্যভাবে এই ভাষাটিরও অনুপ্রবেশ ঘটেছে। বাঙালী মুসলমানের চোখে ফার্সী এবং উর্দু দুটো আরবীর মতোই পবিত্র ছিল। আর এ দুটো রাজভাষা এবং শাসক নেতৃশ্রেণীর ভাষা হওয়ায়, তাদের শ্রদ্ধা নিশ্চয়ই অনেকগুণ বৃদ্ধি পেয়েছিল। কিন্তু এ দুটির একটিকেও পরিপূর্ণভাবে রপ্ত করার জন্য একটি সমাজের পেছনে যে শক্ত আর্থিক ভিত্তি এবং সাংস্কৃতিক বুনিয়াদ থাকা প্রয়োজন ছিল দুটির কোনোটিই তাঁদের ছিল না। কিন্তু বাঙালী মুসলমানেরা নিজেদের সামর্থ্য অনুসারে আরবী, ফার্সী এবং উর্দু এই তিনটা ভাষার তালিম গ্রহণ করার প্রাণান্তকর প্রয়াস চালিয়ে গেছেন। আরবী, ফার্সী এবং উর্দু ভাষাটাও যখন তাঁদের পক্ষে পরিপূর্ণভাবে রপ্ত করা অসম্ভব মনে হয়েছে তখন ঐ বর্ণমালাতে বাংলা লেখার চেষ্টা করেছেন।যখন দেখা গেল আরবী হরফে বাংলা লিখেও সমাজে চালু করা যায় না তখন পুঁথিলেখকেরা সবান্ধবে পরবর্তী পন্থাটা অনুসরণ করতে থাকলেন। বাংলা ভাষার সঙ্গে এন্তার আরবী-ফার্সী শব্দ মিশেল দিয়ে কাব্য রচনা করতে আরম্ভ করলেন। জনগণ তাঁদের এই ভাষাটিকে গ্রহণও করেছিলেন।”

ভাষার ইসলামীকরণের বিরুদ্ধে রবীন্দ্রনাথের পত্র, ‘মক্তব-মাদ্রাসার বাংলা’, প্রবাসী, বৈশাখ ১৩৪১, পৃ. ১০৩-১০৪

তিরিশের দশকে বাংলা ভাষার এই আরবি-ফারসি দূষণ নিয়ে প্রবাসী পত্রিকায় আলোচনা কালে এক বাংলাভাষী মুসলমান পাঠক তাঁর সম্প্রদায়ের এই অবস্থানকে সমর্থন করলে, এই ভাষা-জেহাদের বিরুদ্ধে গর্জে উঠেছিলেন রবীন্দ্রনাথ।

উইকিপিডিয়া থেকে শুরু করে অনলাইন বাঙ্গালা পোর্টালগুলোতে এই আরবমুখী বাঙ্গালাভাষীদের আধিপত্য। অর্ধসত্য ও অসত্য তথ্যে ভরিয়ে রেখেছে সে সব। লক্ষ্য একটাই – ইসলামের জয়গান। বাঙ্গালীর স্বাভাবিক ধর্ম নাকি ইসলাম! বৌদ্ধ যুগের পরেই এরা বখতিয়ারকে সামনে রেখে ইসলামী বাঙ্গালাকে দেখায়। হিন্দুত্বকে সম্পূর্ণ অস্বীকার করে। এদের দৃষ্টিতে বাঙ্গালী প্রথমে ছিল অনার্য (অর্থাৎ অহিন্দু), তারপর বৌদ্ধ, এখন ইসলামী। মূলনিবাসী তত্ত্বকে সামনে রেখে এরা বাঙ্গালার ইসলামীকরণের কাজ এখনো করে চলেছে। ব্রাহ্মণ, কায়স্থ, বৈদ্য প্রভৃতি গোষ্ঠীকে একাসনে রেখে বাকিদের প্রতিনিয়ত উস্কে যায় তাদের বিরোধিতা করার জন্য। কমিউনিস্ট শাসিত বাঙ্গালীও মূর্খের ন্যায় সেই ফাঁদে পা দিয়ে চলেছে প্রতিদিন।
বাংলাদেশে হিন্দুকে হত্যা করা হয়েছে। হত্যা করা হয়েছে বাংলাদেশকে ইসলামী দেশ করতে ও বাঙ্গালী সংস্কৃতিকে ধ্বংস করে আরবকে বঙ্গভূমিতে প্রতিষ্ঠা করতে।

হিন্দু যত দিন, বাঙ্গালীও তত দিন।

(সংগৃহীত)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.