হয়তো নির্ধারিত কালের পূর্বে তাঁর আবির্ভাব। হয়তো কালের আগেই তিনি ভারতবর্ষে জন্ম নিয়েছিলেন। জন্ম হুগলির খানকুলের রাধানগর গ্রাম। আর মৃত্যু ইংলন্ডের ব্রিষ্টল শহর। কর্ম ও কৃত্যে তো বটেই, জন্ম-মৃত্যুতেও যিনি প্রাচ্য ও প্রতীচ্যকে যুক্ত করলেন, সেই রাজা রামমোহন রায় (১৭৭২/১৭৭৪–১৮৩৩) ছোটোবেলায় আমাদের কাছে কিছুটা অস্পষ্ট ছিলেন। হয়তো বড়দের কাছেও। কারণ আপাত-সহজ অথচ প্রতিক্রিয়াশীল একটি জ্ঞাতব্য বাম জামানায় ছোটোবেলা থেকেই শুনে আসছিলাম যে রামমোহন হিন্দু ধর্মের নন, তিনি ‘ব্রাহ্মধর্ম’ নামে পৃথক এক ধর্মের উপাসক ও প্রচারক, যা হিন্দু ধর্মের থেকে আলাদা; ব্রাহ্মরা হিন্দু নন।
হলফ করে বলতে পারি, ছোটোবেলা থেকেই আমার মতো বহু হিন্দু ছাত্র, তাদের বাম মাস্টার মশাইদের এবং পাড়াতুতো অভিভাবকদের শাসনে তা মেনে নিলেও, মনে নেন নি। নেবেন কীভাবে? একটা খচকা ছিলই, একটা অঙ্ক না মেলার অস্থিরতাও ছিল। হিন্দুদের অতি প্রাচীন এবং অতি সম্মানিত শাস্ত্রগুলি, বেদ -উপনিষদগুলি ব্রাহ্মদেরও যে অধীত ও আলোচ্য সাহিত্য! তা কী করে হয়? আর কোন কোন ধর্ম আছে যাদের শাস্ত্রীয় আকরগ্রন্থ হুবহু এক? আসলে রামমোহন রায়ের মতো এত বড় মাপের নবজাগরণের এক ঋত্বিকের কোনো আত্মজীবনী নেই। বিদ্যাসাগর নিজের আত্মজীবনী শুরু করেও শেষ করেন নি, রামমোহন শুরুই করেন নি, রচনা ও চিঠিপত্র থেকে জানতে হয় তাঁকে। আত্মজীবনী রচনা করা থাকলে অনেক অজানা প্রশ্ন, অনেক কৌতূহল নিবারণ হতে পারত। প্রকৃতপক্ষে রামমোহন ব্রাহ্মসমাজ স্থাপন করেন, আলাদা কোনো ধর্ম নয়।
কেন তাঁকে ‘গৌড়ীয়’ ব্যাকরণই রচনা করতে হল? এখানে ‘বেঙ্গলি’ না বলে ‘গৌড়’ বলাটা কী এক সাংঘাতিক ঐতিহাসিক ব্যঞ্জনা নয়? এটি কি সনাতনী গৌড়ীয় ঐতিহ্য বিস্তারের অন্তর্লীন আকাঙ্ক্ষা নয়? হিন্দু ব্রাহ্মণের উপবীত আমৃত্যু রামমোহনের সঙ্গে কেন ছিল? কেন খ্রিষ্টান সমাধিস্থলে তাঁর দেহ সমাহিত না করা হয়, তার জন্য অনুরোধ করেছিলেন? কেন তিনি প্রথম জীবনে রাধানগরের পাশের গ্রামের শিক্ষক নন্দকুমার বিদ্যালঙ্কার বা হরিহরানন্দ তীর্থস্বামীর কাছে গভীরভাবে হিন্দুশাস্ত্র ও দর্শনের পাঠ নিয়েছিলেন? ছাত্রাবস্থায় হাতের কাছের মাস্টারমশাইদের সামীপ্যে তা আমাদের জানবার উপায় ছিল না (হয়তো তাঁরা জানতেনও না, বা জেনেও না জানার ভান করতেন)। রামমোহন নিজেকে কোনও দিন কোনো বিশিষ্ট সম্প্রদায়ের বা বিশিষ্ট ধর্মমতের প্রবর্তক বলে দাবী করেছেন কিনা, ছোটোবেলায় আমরা তা জানতে পারি নি। বাম জামানার ছোটোদের ‘প্রগতিশীল’, ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ রাজনীতিবেত্তা বড়-মানুষদের কথাই শুনতে হত; হিন্দুধর্মের অনুসন্ধান মূলক জ্ঞান আহরণের সুযোগ, প্রশ্নই ওঠে না। বড় হয়ে জানবার প্রবৃত্তি অবশিষ্ট থাকলে (বন্ধুবান্ধবদের অধিকাংশই বামপন্থী হয়ে যাওয়ার পরও) এবং হিন্দুধর্মের মানুষকে বাস্তবের মাটিতে সংকটের মুখমুখি হয়ে তবেই ধর্ম সম্বন্ধীয় প্রকৃত সত্যের সন্ধানে রত হতে হয়েছে সেই প্রজন্মের মানুষকে৷
রামমোহন সম্পর্কে আলোচনার সূত্রপাতে ওঁর নিজের লেখাই উদ্বৃত করবো। রামমোহন তখন ইংলন্ড-প্রবাসী (১৮৩০ সালের নভেম্বর মাসে তিনি ইংলন্ড যাত্রা করেন, এবং ১৮৩১ সালের এপ্রিল মাসে ইংলন্ডে এসে উপস্থিত হন)। কলকাতার এক ইংরেজ বন্ধু (গর্ডন)-র অনুরোধে একটি চিঠিতে নিজের সংক্ষিপ্ত জীবনী লিখে পাঠিয়েছিলেন তিনি, যা এথিনিয়ন লিটারেরি গেজেটে প্রকাশিত হয়েছিল ১৮৩২ খ্রীষ্টব্দে। তারই বাংলা অনুবাদ পরে অন্য পত্র পত্রিকায় প্রকাশিত হতে দেখা যায়। সেখানে তিনি নিজের সম্পর্কে লিখছেন, “আমার সমস্ত তর্ক বিতর্কে আমি কখন হিন্দুধর্মকে আক্রমণ করি নাই। উক্ত নামে যে বিকৃত ধর্ম এক্ষণে প্রচলিত, তাহাই আমার আক্রমণের বিষয় ছিল।” জীবনের শেষপ্রান্তে এসে তিনি পরিস্কারভাবে বলেই দিচ্ছেন, তিনি হিন্দুধর্মের বিরোধী নন। হিন্দু ধর্মের দেবদেবীকে আক্রমণ করে ষোল বছর বয়সে রামমোহন যে বই লিখেছিলেন বলে প্রচার আছে, সেই কাহিনীও কিংবদন্তিমূলক বলে জানা গেছে। বিদ্যাবিদেরা (এমন কি বামপন্থীরাও) এর সাপেক্ষে কোনো প্রামাণ্য তথ্য পরিবেশন করতে পারেন নি (অসিতাভ দাশ, ১৯৯৬, বাংলা গদ্যসাহিত্যে নবজাগরণের পথিকৃৎ রাজর্ষি রামমোহন ও রচনাপঞ্জি, রামমোহন বিশেষ সংখ্যা, পশ্চিমবঙ্গ, পৃষ্ঠা ২১১-২১৬)। গীতার প্রতি শ্রদ্ধা থেকেই তিনি গীতা-মাহাত্ম্য বিষয়ক গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। রামমোহনের যা খোঁজার ছিল, তা হল ‘একেশ্বরবাদ’ এবং তিনি তা হিন্দুশাস্ত্রের মধ্যেই নিহিত আছে, এমনটাই গৌরবের সঙ্গে এবং আপন প্রতিভার নিরিখেই দেখতে পেলেন। এজন্য কম বাক-বিতণ্ডা করতে হয় নি তাঁকে। সত্যের জন্য, ধর্মের জন্য তিনি তরুণ বয়সে সংসার ত্যাগ করেছিলেন; সত্য সন্ধানেই তিনি দেশে দেশে ভ্রমণ করে বেড়ালেন, অসীম কষ্ট সহ্য করলেন। কিন্তু সর্বত্র এবং সমস্ত তর্কযুদ্ধে তিনি বিজয়ী সাব্যস্ত হলেন এবং বিলাতেও পূজিত হলেন। একদা সংসার তাঁকে পরিত্যাগ করলেও তিনি শেষপর্যন্ত সংসার পরিত্যাগ করেন নি। সমাজের অমঙ্গল তাঁকে আলোড়িত করল, সমাজের কান্নায় তিনিও ক্রন্দনশীল হলেন। এবং সেই অমঙ্গলকে দূর করলেন; হিন্দু ধর্মকে অন্তরের অনুভব দিয়ে দাঁড় করানোর চেষ্টা করলেন। সংসারে থেকেই ঈশ্বর উপাসনার কথা বললেন এবং হিন্দুধর্মকে সমকালে সংস্কারিত করে বাঁচিয়েও দিয়ে গেলেন৷
ব্রাহ্মসমাজ থেকে পৃথক হয়ে ভারতবর্ষীয় ব্রাহ্মসমাজের প্রতিষ্ঠাতা কেশবচন্দ্র সেন মনে করতেন, হিন্দু ধর্মের পুস্তকের মধ্যে একেশ্বরবাদ আছে কি না, এই প্রশ্নের উত্তর দেবার জন্য এবং সহজে বোঝাবার জন্য রামমোহন এসেছিলেন। ঈশ্বর যে জন্য তাঁকে পাঠিয়েছিলেন, তাই তিনি করে গেছেন৷ যে উপনিষদ-পুরাণ থেকে চার হাজার বছর আগে ব্রহ্মমন্ত্র উচ্চারিত হয়েছিল, সেই ওঁ-কার পুনঃ সংস্থাপন করেছিলেন তিনি। দেশীয় শাস্ত্রের যে বৃহৎ কথাগুলি গহন অরণ্যে পতিত হয়েছিল, তা তিনি উদ্ধার করেছিলেন। বিরুদ্ধবাদীরা চেষ্টা করেও তাঁর সত্যান্বেষণকে বাঁধা দিতে সমর্থ্য হন নি। বরং দেশের মানুষকে রামমোহন সৎপথ দেখিয়েছিলেন। রামমোহনের এই ব্রহ্মোপাসনার পদ্ধতি বিজাতীয় নয়, বিদেশ থেকে আমদানি করতেও হয় নি৷ এ ভারতীয় ধারাই বটে। এই পদ্ধতির ভিত্তি ছিল উপনিষদের ব্রহ্মমন্ত্র। তাঁর উপাসনালয়ে উপনিষদ পাঠ হত। আর ছিল সঙ্গীতের মাধ্যমে উপাসনা। সাঙ্গীতিক উপাসনা, সে তো মধ্যযুগের ভারতবর্ষে ছিলই, নতুন তো নয়! ভারতীয় মন্দির দেবালয়ে পরিবেশিত কীর্তন সঙ্গীতেরই মতোন একটি রূপ। রামমোহনের ক্ষেত্রে যেটা হয়েছিল, তিনি কেবল ধর্মসাধক ছিলেন না, ছিলেন সংস্কৃতি ও জ্ঞানের গভীরতম অধিকারী, বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী। এই অধিকার বলেই তিনি অন্ধকার যুগের এক আলোকিত পথিক হতে পেরেছিলেন, অন্যদেরও পথ দেখাতে পেরেছিলেন।
হিন্দুধর্ম ছাড়া অন্য কোনো ধর্মে এমন ধর্ম জিজ্ঞাসা উত্থিত হয় না। “যেখানে জিজ্ঞাসাই জাগে না সেখানে বিচারের অবসর কই? শাস্ত্রাদির প্রামাণ্য তখন বিচারের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত হয় না৷” ১৮১৫ সালে বেদান্তসূত্রের অনুবাদ ও ব্যাখ্যা করে তিনি যে বই লেখেন, তার নাম ‘বেদান্তগ্রন্থ’। যারা তাঁর মতাদর্শকে আলাদা ধর্ম আখ্যা দিয়ে হিন্দুদের মধ্যে বিভাজন আনতে সক্রিয় হয়েছিলেন, তাদের উদ্দেশ্য সৎ ছিল না। ব্রাহ্মধর্ম হিন্দুধর্মেরই একটি প্রতিবাদী শাখা, পৃথক ধর্ম নয়। তাঁর সম্পর্কে ক্ষিতিমোহন সেন লিখছেন, রাজার প্রবর্তিত উপাসনা বিজাতীয় না হইবার নানা কারণ আছে। এক তো রাজা ছিলেন অতিশয় ভারতীয় এবং ভারতের প্রাচীন সর্বশাস্ত্রে সুপণ্ডিত; তাহা ছাড়া তাঁহার সহায় ছিলেন ভারতীয় সাধনায় বৃহস্পতিতুল্য মহানির্বাণ-তন্ত্রমতের শ্রীমৎ হরিহরানন্দ তীর্থস্বামী।….. কাজেই রাজার প্রবর্তিত উপাসনারীতিতে সাধনা ও আদর্শের দিক দিয়া ভারতীয় ভাব হারাইয়া ফেলার কোনো ভয় ছিল না।” ক্ষিতিমোহন এ প্রসঙ্গে ব্রজভূমির নিকটস্থ সমসাময়িক ঢেঢরাজ প্রবর্তিত নিরাকার অসীম অনন্ত ঈশ্বরের উপাসনা পদ্ধতির সঙ্গে সাযুজ্য খুঁজে পেয়েছেন ব্রাহ্মসমাজের উপাসনারীতির। ঢেঢরাজ হিন্দু থাকলে কেন রামমোহন হিন্দু নন? ১৫৪৪ খ্রীষ্টাব্দ নাগাদ ভক্ত দাদূ ব্রহ্মসম্প্রদায় প্রবর্তিত সাধনমণ্ডলের তুলনাও এনেছেন ক্ষিতিমোহন।
রামমোহন হিন্দু শাস্ত্র বিষয়ে আলোচনা করতে করতে, অতি জটিল যুক্তিতর্ক ভেদ করে একেশ্বরবাদে পৌঁছে গেলেন। শাস্ত্র আলোচনা করতে করতেই যে সেই শাস্ত্র-সাগর সেঁচতে হয়, মন্থন করতে হয়, তা তরুণ বয়সে করে দেখালেন রামমোহন। দেখা যাচ্ছে রামমোহন যা করেছেন তা হল, প্রাচীনতম সনাতনী ভারতীয় আদর্শ ও রীতিগুলিকে যুগোপযোগী করা। বুঝেছিলেন সামাজিক সংহতির জন্যই সামাজিক উপাসনা করতে হবে, এ জন্যই তাঁর সমবেত উপাসনার প্রয়াস এবং ব্রহ্মসঙ্গীত। রবীন্দ্রনাথেরও বহু আগে রামমোহন নিজেই ব্রহ্মসঙ্গীত রচনা করে গেছেন। উপনিষদ ও বেদান্তের প্রতি আধুনিক মানুষের দৃষ্টি তিনিই প্রথম আকর্ষণ করেছেন। বাংলাভাষায় বেদান্তসূত্র প্রকাশের আগে হিন্দি ভাষায় বেদান্ত ভাষ্য অনুবাদ করেছেন। হিন্দি সাহিত্য রচনারও তিনি অন্যতম আদি লেখক। তাঁর মধ্যে প্রাদেশিকতার সঙ্কীর্ণতা নেই, উপরন্তু উপাসনাতে বাংলাভাষা প্রবর্তন করে তিনি এই ভাষার একান্ত উপকার সাধন করে গেছেন৷ ভারতের প্রাচীন ও নবীন বহু ভাষাতে তাঁর প্রজ্ঞা ছিল; পাণ্ডিত্য ছিল ল্যাটিন, গ্রীক, হিব্রু ভাষাতেও। আরবি ও পারসি লেখাতেও সুনাম অর্জন করেছিলেন তিনি।
ঊনবিংশ শতকের প্রখ্যাত জনসেবক ও পত্রিকা সম্পাদক ছিলেন ‘কাঙাল হরিনাথ’ (হরিনাথ মজুমদার, ২০ শে জুলাই ১৮৩৩ — ১৬ ই এপ্রিল ১৮৯৬)। হরিনাথ মনে করতেন, রামমোহনের ইচ্ছে ছিল, জ্ঞানাস্ত্রে যুদ্ধজয় করে হিন্দুধর্মদুর্গ অব্যাহত রাখবেন, কিন্তু অকালে দেহত্যাগ করায় তাঁর ব্রাহ্মধর্ম ঐ অবস্থাতেই রয়ে গেল৷ তিনি ব্রহ্মাণ্ডবেদ-এ রামমোহন সম্পর্কে লিখছেন, রাজা রামমোহন রায় হিন্দুশাস্ত্র-মহাসিন্ধু মন্থনপূর্বক মহানির্বাণতন্ত্রের ৩য় উল্লাসে লিখিত ব্রহ্মজ্ঞান অবলম্বন পূর্বক ব্রাহ্মধর্মের মতো একটি সময়োচিত ধর্ম প্রচার করে হিন্দুকুলের গৌরব এবং মর্যাদা রক্ষা করেছেন। অর্থাৎ রামমোহন রায় হিন্দুধর্মদুর্গ অক্ষত এবং অব্যাহত রাখার সৈনিক, তা দ্ব্যর্থহীন ভাষায় জানিয়ে দিচ্ছেন কাঙাল হরিনাথ। জানাচ্ছেন, রামমোহনের নেতৃত্বে ব্রহ্মধর্ম ছিল আদতে হিন্দুধর্মের চর্চা।
বিলেতের ব্রিষ্টল নগরে প্রয়াত হলেও শেষ ইচ্ছানুযায়ী ষ্টেপলটন গ্রোভের নিকটবর্তী একটি স্বতন্ত্র স্থানে নির্জন বাগিচায় রামমোহনের দেহ প্রোথিত করা হয়েছিল। খ্রিষ্টীয়ানদের সমাধিস্থানে তাঁর অন্তেষ্টিক্রিয়া সম্পন্ন হয় নি, তাদের মতেও হয় নি। তাঁর মৃতশরীরে যজ্ঞোপবীত দৃষ্ট হয়েছিল। বিলেতে রামমোহনের সঙ্গী রামরত্ন মুখোপাধ্যায় তাঁর মৃত্যুর পর সংস্কৃত ভাষায় (হিন্দুস্থানী ভাষায়) প্রার্থনা করেছিলেন, তা উঠে এসেছে বিলেতে তাঁর চিকিৎসক এসলিন সাহেবের দিনপঞ্জিতে। পরে রামমোহনের বন্ধু তথা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পিতামহ প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর তাঁর শব স্থানান্তরিত করে আরনোস ভেল-এ স্থাপন করান এবং সুদৃশ্য সমাধিমন্দির রচনা করিয়ে দেন। সেদিক থেকে দেখতে গেলে রামমোহনের জাতও যায় নি। কালাপানি পেরিয়ে যখন দু’-তিন হাজার বছর আগে ভারতীয় হিন্দু বণিকেরা সামগ্রী আমদানি-রপ্তানি করতেন, তখনও কিন্তু তাদের জাত যায় নি। বিলেতে যাওয়ায় রামমোহনেরও জাত যাবার নয়।
বিপিনচন্দ্র পাল রামমোহনের মূল্যায়ন করতে গিয়ে বলছেন, “অধিকাংশ লোকে ধর্মটাকে অন্তরের অনুভবের উপরে গড়িয়া না তুলিয়া বাহিরের আচার-বিচার দিয়া দাঁড় করাইয়া রাখিবার চেষ্টা করিতেছিল। হিন্দুর প্রামাণ্য শাস্ত্র যে বেদ, পণ্ডিতেরা এবং জনসাধারণ মুখে ইহা মানিতেন, কিন্তু বেদের অধ্যয়ন দেশে লোপ পাইয়া গিয়াছিল; স্মৃতি এবং পুরাণই ধর্মের প্রমাণ্য-শাস্ত্রের স্থান অধিকার করিয়া বসিয়াছিল। এই সকল স্মৃতি ও পুরাণের মধ্যে অনেক পরস্পর-বিরোধী কথা আছে৷ এই সকল বিরোধের নিষ্পত্তি করিয়া পুরাণের স্মৃতির উদ্ঘাটন ও মর্যাদা রক্ষা করার চেষ্টা কেহ করিতেন না, নিজেদের সুবিধামত শাস্ত্রবচন উদ্ধার করিতেন মাত্র।…..যে বেদশাস্ত্রের উপরে হিন্দু আপনার ধর্মের প্রামাণ্য প্রতিষ্ঠিত করে সেই বেদই যে জগতের সনাতন সত্যকে মানবের অনুভবসাপেক্ষ করিয়াছে, ইহা দেখাইবার জন্যই, মনে হয়, রাজা রামমোহন উপনিষদ ও বেদান্ত-সূত্রের প্রচার করিয়াছিলেন। রাজা ঈশ, কেন, কঠ, মণ্ডুক ও মাণ্ডুক্য — এই পাঁচখানি উপনিষদের মূল ও বাংলা অনুবাদ প্রচার করেন। আর এই ক’খানি উপনিষদই মোটের উপরে বিশ্বের পরমতত্ত্ব ব্রহ্মবস্তুকে সাধারণ মানবের সাধারণ অনুভবের উপরে প্রতিষ্ঠিত করিয়াছে।”
রামমোহন পরবর্তী সময়ে বঙ্গজীবনে হিন্দুদের মধ্যে চতুর্মুখী ধর্মীয়-সামাজিক আন্দোলন প্রকট হয়ে দেখা দিয়েছিল। তারমধ্যে ব্রাহ্মরা ছাড়াও ছিল রাধাকান্ত দেবের নেতৃত্বে ধর্মসভাপন্থীরা, ডিরোজিও-র নেতৃত্বে অত্যুগ্র অনুগামীরা এবং কিছুটা ব্যক্তিক প্রচেষ্টায় বিদ্যাসাগরেরা। উগ্র হিন্দু বিরোধী ডিরোজিয়ানরা গর্জন করে বলেছিলেন, “হিন্দুধর্ম নিপাত যাক, গোঁড়ামিপনা নিপাত যাক।” এই মতবাদ অবশ্য ব্রাহ্ম এবং ধর্মসভাপন্থীদের মনঃপূত হয় নি৷ বরং হিন্দু ধর্মের বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করে তার পরিণতিতে ডিরোজিয়ানরা সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলেন। বিদ্রোহও ব্যর্থ হল। যারা ইয়ং বেঙ্গল-কে মহীয়ান করতে এখনও সচেষ্ট, তারাই আদতে রামমোহন ও তাঁর মতাদর্শকে পৃথক ধর্মের অনুসারী বলে দাগিয়ে দিতে চান। একসঙ্গে একত্রে কাজ করে কিছু ভাড়াটে ঐতিহাসিক, সেকুলারপন্থী এবং রাজনৈতিক দলের কর্মীরা।
রামমোহন সম্পর্কে মুসলমান বিদ্বজ্জনের মতামত কেমন ছিল, তা আলোচনা করতে আমরা এবার কাজী আবদুল ওদুদ-এর মূল্যবান বক্তব্য নিরীক্ষণ করতে পারি। দেশের মানুষের প্রতি রামমোহনের নির্দেশ সম্পর্কে ওদুদ বলছেন, পৌরাণিক দেবদেবীর আরাধনার পরিবর্তে উপনিষদের নিরাকার ব্রহ্মের উপাসনা ও যুক্তিযুক্ত কল্যাণ-কর্মের অনুষ্ঠানের কথা বলেছেন রামমোহন। বলছেন, প্রাচীন শাস্ত্র অশ্রদ্ধেয় নয় কিন্তু তার ব্যাখ্যা করতে হবে বিচারবুদ্ধি ও লোকশ্রেয়ের আলোকে — অনিষ্টকর আচার প্রাচীন হলেও বর্জনীয়।
রামমোহন চেয়েছিলেন শাস্ত্র ও যুক্তির সমন্বয় ঘটিয়ে বাঙালি হিন্দুর ধর্মকে তার অনুভবে প্রতিষ্ঠিত করতে। রামমোহনের এই যুক্তিবাদ ইউরোপীয় যুক্তিবাদের অনুকরণে আসে নি। দেখা যাচ্ছে, রামমোহন ইংরেজির বর্ণমালার সাহচর্যে আসার পূর্বেই তিনি নিজের ব্রত ও লক্ষ্য নির্ণয় করে ফেলেছিলেন। বিশ্লেষকদের মতে রামমোহনের এই যুক্তি এসেছিল প্রাচীন মীমাংসার পথ ধরে। রামমোহন চেয়েছিলেন দেশবাসীর চিন্তা ও চিত্তকে অন্ধ শাস্ত্রানুগত্যের বন্ধন থেকে মুক্ত করতে। কেন চেয়েছিলেন? কারণ হিন্দুর ধর্ম যদি স্বাধীন হয়, তবেই হিন্দু স্বাধীনতার মন্ত্রে দীক্ষিত হবে৷ রামমোহন ছিলেন অন্তরে ভারতের স্বাধীনতার পূজারী৷ ধর্ম যেখানে সংস্কারবদ্ধ হয়েছে, এবং তার ফলে নিজের গতি হারিয়েছে, সেই প্রাণময়তাহীন ধর্মকে সংস্কার মুক্ত করে সজীব করাই তাঁর লক্ষ্য ছিল। এই পথেই তিনি ভারতে স্বরাজ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেছেন। জাতীয় জীবনে এ এক নতুন পথের সূত্রপাত আর সেজন্যই তিনি যুগ প্রবর্তক৷
কল্যাণ গৌতম।