ষষ্ঠীব্রতের সঙ্গে প্রকৃতি ও পরিবেশের এক নিবিড় যোগাযোগ আমরা খুঁজে পাই । কারণ ষষ্ঠী উপাসনাকেকে উপলক্ষ্য করে বৃক্ষকেন্দ্রিক বহুরকম উপাদান ব্যবহৃত হতে দেখা যায় । যেমন , ষষ্ঠীব্রত অনেক সময়েই কাঁঠাল বা বটগাছের ডাল পুঁতে করা হয়ে থাকে । এছাড়া ষষ্ঠীপুজোর অন্যতম উপাচারগুলি হল দূর্বা , বাঁশের কিশলয় বা কোড়া , করঞ্চা , আমের পল্লব , মুলো , ঝিঙে ইত্যাদি অরণ্যজীবনের অনুষঙ্গ । শুধু তাই নয় , গ্রামের ষষ্ঠীথানগুলিও মূলত নিম , বট , অশ্বত্থ কিংবা মনসা বা সিজগাছের নীচেই হয় । দেবী ষষ্ঠীর রূপ কল্পনা করে লোকসমাজের মাতৃকুল সেই বৃক্ষেরই পুজো করে চলেছে মনের ভক্তিতে , সন্তানের মঙ্গলকামনায় । এভাবেই গাছের তলায় মাসে – মাসে ষষ্ঠীর ব্রতপালন সমগ্র বঙ্গদেশ জুড়ে ছড়িয়ে আছে এবং প্রতিটি ষষ্ঠীব্রতেরই পৃথক পৃথক ব্রতকথার অস্তিত্ব লক্ষ করা যায় । স্থানভেদে একই ব্রতর কথার ভিন্নতাও দেখা যায় ।
পূর্ববঙ্গের বিক্রম পুর একটি বিশিষ্ট ও সমৃদ্ধ ঐতিহাসিক অঞ্চল ছিল। এখানকার অধিবাসীরা বিদ্যা ও সম্পদে বিশেষ সমৃদ্ধ ছিলেন একসময়। এই ভুখন্ড জল বেষ্টিত ও অন্যান্য অঞ্চলের থেকে কিছুটা বিচ্ছিন্ন থাকায়, এখানকার লোকাচারগুলোর সাথে পূর্ববঙ্গের অন্য অঞ্চলের লোকাচার এর কিছু পার্থক্য লক্ষ্য করা যায়। যেমন, জামাই ষষ্ঠী বা অরণ্যষষ্ঠী ব্রতে পূর্ববঙ্গের অন্যত্র ষষ্ঠী পুতুল এর ব্যবহার দেখা না গেলেও, এখানে এক ধরনের মাটির টেপা পুতুলের পুজো দেখা যায়। এই পুতুল তৈরি করেন বাড়ির মেয়েরা অর্থাৎ ব্রতীরা। মধ্যে একটি বড় পুতুল পা ছড়িয়ে বসে। তার পা দুটো ফোলা ফোলা, মাথায় সিঁদুরের ফোঁটা, ইনিই মা ষষ্ঠী। আর সামনে, পেছনে, আসে, পাশে, কোলে, কাঁখে, অনেক গুলি ছোট ছোট পুতুল থাকে যা সন্তান সন্ততির প্রতীক ।
বঙ্গের অন্যত্র বট ও অশ্বথগাছ ষষ্ঠীর প্রতীকী বাসস্থান বলে মনে করা হলেও, এই অঞ্চলে কাঁঠাল ও করমচা গাছকে ষষ্ঠীর বাসস্থান মনে করা হয় ও উক্ত গাছের ডাল পুঁতে তার নিচে ষষ্ঠী পুতুলটি রেখে পূজা করা হয়। এছাড়া, ঘটের সামনে কতকগুলো কাঁঠাল পাতার ওপর ফল মূল এর কুচি সাজিয়ে, প্রসাদ হিসাবে বিতরণ করা হয়। জামাই ষষ্ঠী বা অরণ্যষষ্ঠী পূজার শেষে আমাদের পরিবারে যে ব্রত কথাটি বলা হয় তা বহুল প্রচলিত।
তবে বিভিন্ন ষষ্ঠীব্রতকথাগুলি পাঠ করলে দেখা যায় যে অনেক স্থানেই দেবী কে বুড়ি বলা হয়েছে। ষষ্ঠী হচ্ছেন বুড়ি , ‘ ষষ্ঠীবুড়ি ’ , তিনি বুড়ি বামনির ছদ্মবেশে হাজির হন । এখন প্রশ্ন হল ষষ্ঠীর কেন এমন বৃদ্ধার বেশ ?
মহাভারতের সভাপর্বে জরাসন্ধের জন্মবৃত্তান্তে দেখা যায় রাজা বৃহদ্রথের দুই মহিষী অর্ধ অর্ধ অঙ্গ শিশুর জন্ম দেন। লোকলজ্জার ভয়ে এবং দুঃখে রাণীরা দাসী দিয়ে সেই সন্তান গহীন অরণ্যে প্রক্ষিপ্ত করার আদেশ দেন। সেই জঙ্গলে জরা নামক রাক্ষসী অবস্থান করতেন। তিনি নানা তন্ত্র ও চিকিৎসা বিদ্যায় পারদর্শী ছিলেন। দ্বিখণ্ডিত দেহ চতুষ্পদে করে দাসীরা জঙ্গলে ফেলে এলেন। জরা রাক্ষসী সেই টুকরো শিশু টুকরো দুটিকে একত্রে করে বিশেষ উপায়ে জুড়ে একটি শিশুতে পরিণত করেন। এরপর শিশু ক্রোড়ে তিনি রাজা বৃহদ্রথের নিকট উপস্থিত হলেন। অসম্পূর্ণ সন্তানকে সম্পূর্ণ আপ্লুত রাজা জরাকে তাঁর পরিচয় জিজ্ঞাসা করলে , জরা উত্তর দিলেন –
রাজার বচন শুনি বলে নিশাচরী।
গৃহদেবী দিলা নাম সৃষ্টি অধিকারী।।
দানব বিনাশে মোর হইল সৃজন।
সর্ব্বগৃহে থাকি রাজা করহ শ্রবণ।।
আমারে সপুত্রা নবযৌবন করিয়া।
যেজন রাখিবে গৃহ ভিত্তিতে আঁকিয়া।।
জায়া সুত ধন ধান্যে সদা তার ঘর।
পরিপূর্ণ থাকিবেক শুন রাজেশ্বর।।
তব গৃহে পূজা রাজা পাই অনুক্ষণ।
তেঁই রক্ষা করিলাম তোমার নন্দন।।
জরা রাক্ষসী সেই ব্রহ্মময়ীর নামান্তর, ব্রহ্মা কতৃক সৃষ্ট হয়ে তিনি দানব দলনের উদ্দেশ্যে অরণ্যে অবস্থান করছেন। ইনি গৃহস্থের কল্যাণে গৃহে গৃহে গমন করতেন বলে ইনি ‘গৃহদেবী’ নামেও সুপরিচিতা। মহাভারতের আদিপর্বে উল্লেখ করা হয়েছে “যে ব্যক্তি যৌবনসম্পনা সপুত্রা মূর্তি গৃহে রাখে, তার গৃহ সর্বদা ধনধান্য, পুত্রকন্যাদিতে পূর্ণ থাকে।”
সূত্রসন্ধান করে বলা যায় , ষষ্ঠীকে প্রাচীনতম দেবী বলে মনে করা হয় বলেই তাঁকে বৃদ্ধা রূপে কল্পনা করা হয়। কারণ প্রজনন চিন্তার সঙ্গে পশুপালনমূলক জীবনযাত্রার দিকে লক্ষ রেখেই এটা সম্ভব হয়েছিল। এই বার্ধক্যই আমাদের তাঁর পুজোর প্রাচীনত্ব নির্ণয় করতে সাহায্য করে । তিনি কন্যা হতে বৃদ্ধা সকল রূপে মাতৃকা হিসাবেই অবস্থান করেন।
ষষ্ঠী দেবীর একটি ধ্যান মন্ত্রে উল্লেখ আছে –
ষষ্ঠীং বিম্বাধরোষ্ঠীং সুচিরবসনাং কৃষ্ণমার্জার সংস্থাৎ
বর্ণাস্তাক্রান্তনেত্রাং
রুচিরভুজযুগাং ক্রোড়বিন্যস্তপুত্ৰাম্ ।
তারুণ্যোভিন্ন পীনস্তনঘনযুগলাং চিন্তয়েদিন্দুবক্তাম্ ।
দেবী কৃষ্ণ মার্জারে উপবিষ্টা। মার্জার যেমন করে তাঁর সন্তানকে ভীষণ গভীরভাবে আদর করে সযত্নে বিপদ থেকে রক্ষা করে, মাও যেমন ঠিক ঐভাবেই আপন সন্তানকে নিজের সবটুকু দিয়ে রক্ষা করেন।
ওঁ ধাত্রীত্বং কাৰ্ত্তিকেয়স্য ষষ্ঠী ষষ্ঠীতি বিশ্রতা । দীর্ঘায়ুষ্টঞ্চ নৈরুজ্যং কুরুস্ব মম বালকে ।
জননী সর্বভূতানাং সর্ববিঘ্ন ক্ষয়ঙ্করী ।
নারায়ণী স্বরূপেন মৎপুত্র রক্ষ সর্বতঃ ।।
অর্থাৎ হে ষষ্ঠী দেবী তুমি কার্ত্তিকের ধাত্রী রূপে ষষ্ঠী নামে বিখ্যাতা । আমার হংসনারায়ণ ভট্টাচার্য সন্তানকে তুমি দীর্ঘায়ু এবং নিরোগী কর । তুমি সকল জীবের জননী এবং সব বিঘ্ন ক্ষরকারিণী । নারায়ণী রূপে আমার সন্তানকে তুমি রক্ষা কর । শ্রদ্ধেয় হংসনারায়ণ ভট্টাচার্য মহাশয় মন্ত্রটি আলোচনা করে বলেছেন, ষষ্ঠীকে নারায়ণ স্বরূপ বলায় লক্ষ্মীর সঙ্গে তাঁর অভিন্নতা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে । কিন্তু ষষ্ঠীকে আবার কার্ত্তিকেয়ের ধাত্রী বলাতে অসঙ্গতি সৃষ্টি হয়েছে । এই মন্ত্রটিতে সম্ভবত ষষ্ঠী , দুর্গা – চণ্ডী – বিন্ধ্যবাসিনীর সঙ্গে অভিন্ন বলে তিনি মনে করেন ।
বর্তমান কালের শিক্ষিত শহুরে সমাজ হয়তো বলে , এসব ব্রত পার্বন মানুষের মন গড়া, এসবের কোনো যুক্তি নেই। কিন্তু প্রতিটি ব্রত পার্বন নিয়ে যদি সঠিক ভাবে পর্যালোচনা করা যায় তবে , প্রতিটির শাস্ত্রীয় তথা আয়ুর্বেদিক বা কৃষিভিত্তিক ইত্যাদি ব্যাখ্যা প্রাপ্ত হয়। সুপ্রাচীন সনাতনী সমাজের ঋষিগণ এমনি ত্রিকালঞ্জ ছিলেন না, তাঁরা সাধারণ মানুষের মধ্যেও নিজের পরিব্যাপ্ত করতে সচেষ্ট হয়েছিলেন। সেই সকল ব্রতজুড়ে থাকেন পরম ব্রহ্ম এবং আদি পরাশক্তির অশেষ অবস্থান এবং আশীর্বাদ।
প্রকৃতি তথা নিরাকার ব্রহ্ম ও শক্তি উপাসক সনাতনী সমাজ।
ততোহখিলং লোকমাত্মদেহ সমুদ্ভবৈঃ
ভবিষ্যামি সুরাঃ শাকৈরা বৃষ্টৈ প্রাণ ধারকৈ।
শাকম্ভরী বিখ্যাতং তদা যাস্যমহং ভূষি।।
ভারতবর্ষে বৃক্ষলতা উর্বরতা বর্ধনে সহায়ক এবং তা কেবল শস্যাদি , খাদ্য প্রদানের ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ থাকে না। অক্সিজেন, ওষধি , জ্বালানী , বাসগৃহ, বস্ত্র, বিদ্যা লাভের জন্য উপযোগী বস্তু সমূহ, সকল কিছু একটি বৃক্ষ প্রদান করতে পারে। তাই ধনজনসন্তান কামনা, রোগশোকপাপ দূরীকরণ ইত্যাদি পার্থিব ও পার্থিব আকাঙ্খা পূরণের জন্যও বটে। তাই নিরাকার পরম ব্রহ্ম রূপে বৃক্ষকে সেই প্রাচীন কাল হতে পূজা করে আসছে সনাতনী মানব। তাই দারুব্রহ্ম রূপে জগন্নাথ পুরীতে অবস্থান করেন । তাই ব্রহ্ম স্বরূপ নিরাকার প্রকৃতি মহামায়া মা দুর্গা বোধন হয় নবপত্রিকায়। ওই নবপত্রিকা এবং ঘটই পূজা মুখ্য বিষয়। আজও তাই বহু স্থানে নবপত্রিকার সম্মুখে ঘটেপটে পূজা হয়। নবপত্রিকার নয়টি বৃক্ষ হল কদলী, কচ্চি, হরিদ্রা , জয়ন্তী, শ্রীফল, দাড়িম্ব, অশোক, মান্য ও ধান্য। পূজা মন্ত্রগুলোতে দেখা যায় একটি বৃক্ষ বা পত্রিকাকে দেবতা বা তাঁর প্রতীক বলে উল্লেখ করা হয়েছে এবং তাঁদের বিশেষ বৈশিষ্ট্য অনুসারে যথোচিত প্রার্থনা জানানো হয়েছে।
ঠিক একই ভাবে লক্ষ্মী পূজায়ও মহাদেবীকে শ্ৰী হিসাবে এবং ভূমাতা হিসাবে, ধনদায়ীনি হিসাবে পূজার সময় ধান, আখ, সরিষা, নানা প্রকার শাক , কলার ভেলা ইত্যাদি পূজার উপকরণ হিসাবে প্রদান করা হয়। সনাতনী সমাজে মহাবিষ্ণু সংক্রান্তিতে #ফলদান_সংক্রান্তি ব্রত পালন করা হয়। উক্ত দিনে সবস্ত্র , সপাত্র নারিকেল ফল বিষ্ণুকে দান করলে নিখিল পাতক দূর হয়। পুরোহিত দর্পন, ক্রিয়াকান্ড বারিধি ইত্যাদি নানা গ্রন্থে সে কথা উল্লেখ আছে। এই রূপে একেকটি মাসের সংক্রান্তির দিন বিশেষ বিশেষ ফল দান করলে মোক্ষলাভ হয়। সুতরাং, জনধনউৎপাদন , পাপ দূরীকরণ , মোক্ষ প্রাপ্তি প্রভৃতি জাতীয় কামনা বাসনা বৃক্ষ উপাসনার নেপথ্যলোকে বিরাজিত থাকে। এই সকল কারনে বৃক্ষরোপণ সনাতনী প্রথায় একটি পবিত্র কর্তব্য বলে বিবেচিত হয়।
মৎস্য পুরাণে বলা হয় ” একটি বৃক্ষ দশজন সন্তানের সমান। ” বরাহ পুরাণে বলা হয়েছে , ” একজন সুসন্তান যেমন তাঁর পরিবারকে রক্ষা করে তেমনই পুষ্প ও ফলশোভিত একটি বৃক্ষ তাঁর পিতা সমান রোপনকারীকে নরকগামীতা হতে রক্ষা করে এবং যে ব্যক্তি পাঁচটি আম্রবৃক্ষ রোপন করেন তিনি নরকে যান না।” অর্থাৎ , বৃক্ষ রোপণের পুণ্যফল নরকগমনহতে রোধ করতে পারে।
বিষ্ণুধর্মোত্তর পুরাণের মন্তব্য এইরূপ ” একটি সন্তান যা সম্পাদন করে , কোন ব্যক্তি দ্বারা পরিচর্যাকৃত একটি বৃক্ষও সেইরূপ করে, কেন না এটি তার ফুল দ্বারা দেবতাকে , ছায়া দ্বারা পথচারীকে এবং ফলের দ্বারা ক্ষুধার্তকে তুষ্টি দান করে। ফলে, বৃক্ষ রোপণকারীর নরকগমন হয় না।” সন্তানের চাইতেও বৃক্ষরোপন কর্মটিকে অধিক গুরুত্ব সনাতনী শাস্ত্রে দেওয়া হয়েছে।
বৃক্ষই সব , তাই তাঁকেই পূজা কর, সেই কারণেই মহাকালী মহামায়া মহালক্ষ্মী মহাবিদ্যা দেবী দুর্গা শাকম্ভরী রূপেও পূজিতা। সুপ্রাচীন গ্রন্থাবলী সমূহ যথা – বেদ, রামায়ণ, মহাভারত , গীতা, নানা পুরাণাদি হতে কালিদাসের রচনাবলী , বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের রচনাবলী , সকল স্থানে বৃক্ষের প্রশস্তি হতে এই উপলোব্ধি করা যায় যে, ভারতে বৃক্ষোপসনা অতি প্রাচীন আচার ছিল। এই আচার কোনো কালেই লুপ্ত হয়ে নি। পদ্মপুরাণ এবং মৎস্য পুরাণে #বৃক্ষোৎসব বিধি পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে বিবৃত হয়েছে।
সিন্ধু সভ্যতা অঙ্কিত নানা মূর্তি এবং পরবর্তী পর্যায়ে নানা ভাস্কর্যাদিতে বৃক্ষোপসনার প্রমাণ প্রাপ্ত হয়। খ্রিস্টপূর্ব প্রথম শতাব্দী র ভারত স্তূপে বোধি বৃক্ষ, কদলী, ন্যাদ্রোধ , উদুম্বর, শিরীষ, শাল , আম্র, তাল, অশোক , পাটলি , নাগকেশর ,পিপল প্রভৃতি বৃক্ষের পূজার দৃশ্য দেখতে পাওয়া যায়। আবার খ্রিস্টীয় প্রথম শতকের সাঁচী ও অমরাবতী এবং খ্রিস্টীয় দ্বিতীয় শতকের নাগার্জুন কোন্ডার ভাস্কর্যে পিপল ও বোধিবৃক্ষ পূজার দৃশ্য আছে। এছাড়াও খ্রিস্টীয় দ্বিতীয় শতাব্দীর মথুরা , খ্রিস্টীয় পঞ্চম শতকের গুপ্তযুগের দেওঘর, খ্রিস্টীয় সপ্তম হতে নবম শতকের ইলোরা এবং অন্যান্য স্থানের ভাস্কর্যে বৃক্ষের নিম্নে দেবী মূর্তি, ভগবান মহাদেব ইত্যাদি দেখতে পাওয়া যায়। ভাস্কর্যগুলি প্রমাণ করে বৃক্ষকে পূজা বহু অতীত কাল হতে সুবিশাল ভারতে প্রচলিত হয়ে আসছে।
যো দেবো হগ্নৌ যোহপসু
যো বিশ্বং ভুবনাবিবেশ।
য ওষধিসু যো বনস্পতিষু
তস্মৈ দেবায় নমো নমঃ।
গাছের ছায়ায় বসে বহুদিন, কাটিয়েছি
কোনোদিন ধন্যবাদ দিইনি বৃক্ষকে
এখন একটা কোনো প্রতিনিধি বৃক্ষ চাই
যাঁর কাছে সব কৃতজ্ঞতা
সমীপেষু করা যায়।
ভেবেছি অরণ্যে যাব-সমগ্র সমাজ থেকে প্রতিভূ বৃক্ষকে খুঁজে নিতে
সেখানে সমস্তক্ষণ ছায়া
সেখানে ছায়ার জন্য কৃতজ্ঞতা নেই
সেখানে রক্তিম আলো নির্জনতা ভেদ করে খুঁজে নেয় পথ….
সত্য , যে আমাদের পূর্ব পুরুষরা অকৃতজ্ঞ ছিলেন না। তাঁরা ধন্যবাদ জানাতেন , তাঁরা প্রণাম করতেন সেই ব্রহ্মকে যিনি অগ্নি, জল, ওষধি , বনস্পতি এবং বিশ্বভুবনে প্রবিষ্ট হয়ে আছেন। সেই সুপ্রাচীন কালে , মুনি ঋষিরা উপলব্ধি করেছিলেন প্রকৃতির শক্তির সঞ্চার ঘটলেই জীবকুলের জীবন ধারণ সম্ভব হবে।
মাতা চ যত্র দুহিতা চ ধেনূ সবদুর্ঘে ধাপয়েতে সমীচী।
ঋতস্য তে সদসীলে অন্তৰ্মহদ্দেবানামসুরত্বমেকম্।।
জীবনে জল, মৃত্তিকার গুরুত্ব, বাস্তুতন্ত্রে জলের ভূমিকা , জলচক্র ইত্যাদি সম্বন্ধীয় ধারণা সকলই বেদ আমাদের প্রদান করেছেন। সুপ্রাচীন ত্রিকালজ্ঞ মুনি ঋষিগণ প্রকৃতির বক্ষে যেস্থানেই শক্তির উৎস আবিষ্কার করেছেন সেখানেই তাঁকে উপাসনা করেছেন। সেই শক্তিকে সদাই সকল জীবকুলের থেকে ভীষণ এবং অপরাজেয় তা তাঁরা উপলব্ধি করেছিলেন।
চিত্রং দেবানামুদগাদনীকং চক্ষুর্মিত্রস্য বরন্যস্যাগ্নেঃ।
আহ প্রা দ্যাবা পৃথিবী সূর্য আত্মা জাগতস্তস্থুষশচ।।
বেদে ও উপনিষদের গ্রন্থ প্রকৃতি , মন্ত্রের গরিষ্ঠ অংশ জুড়ে আছে আর্তি ও প্রার্থনা। সাধারণ জীবসহ মানবকুলের স্বাভাবিক জীবনযাপনের জন্য প্রয়োজনীয় অন্ন , বাসস্থানের সংস্থান এবং শত্রুর হাত থেকে নিজেকে রক্ষা এগুলিই ছিল প্রাচীন কালের মানুষদের প্রাথমিক ও প্রধান সমস্যা। এই প্রার্থনা ও আর্তিই বিভিন্ন রূপে বিভিন্ন সময়ে প্রকাশ পেয়েছে। তাই ঋগ্বেদের মন্ত্রের মুনি ঋষিগণ ছিলেন প্রার্থী। তাঁর সকল জীবের মঙ্গলের জন্য অর্থাথী ছিলেন।
সেই একই আকুতি বঙ্গ তথা ভারতের ব্রতকথা গুলির মধ্য দিয়ে বারবার নানাভাবে প্রকাশিত হয়েছে।
সর্বভূতা সমাত্মানং সর্বভূতানি চাত্মনিঃ।
আসুন এই প্রচন্ড সময় আমরাও সকলের মঙ্গল কামনা করে, দেবী আদি পরাশক্তির স্তব করি –
ভূতং ভব্যং ভবিষ্যঞ্চ তৎ পদম পরমং স্মৃতম l
অর্চ্চ্যসে স্তূয়সে চৈব দৈবর্তৈমৎপুরোগমৈ: ll
(দেবীপুরাণ…)
ভূত ভবিষ্যৎ বর্তমান সর্বত্র ব্যাপ্ত সেই পরমাদেবীকেই দেবগণ সর্বোৎকৃষ্ট পরমপদ বলে স্মরণ করেন l ঈশানজননী মহামায়ার অর্চনা করেই সমুদয় দেবগণ সহিত সকলেই শুভকার্যে প্রবৃত্ত হোন।
শক্তিঃ সাক্ষান্মহাদেবী মহাদেবঃ স শক্তিমান্।
তয়োর্বিভূতিলেশো বৈ সর্ব্বমেতচ্চরাতরম্।।
বস্তু কিঞ্চিদচিদ্রূপং কিঞ্চিদ্বস্তু চিদাত্মবম্।
দ্বয়ং শুদ্ধমশুদ্ধঞ্চ পরাঞ্চপরমেব চ।।
যথা শিবাস্তথা দেবী যথা দেবী তথা শিবঃ।
নানয়োরন্তরং বিদ্যাচ্চন্দ্রচন্দ্রিকয়োরিব।।
শক্তি সাক্ষাৎ মহামায়া মহাদেবী , ব্রহ্ম হলেন মহাদেব। এই উভয়ের বিভূতিকণাই এই চরাচর বিশ্ব। জগতে যাহা কিছু বস্তু দেখা যায় , হয় তা অচিৎ অর্থাৎ জড়, না হয় তা চিৎ অর্থাৎ জ্ঞান স্বরূপ হয়ে থাকে। এর মধ্যে পার্থক্য এই যে , কোনটি শুদ্ধ অর্থাৎ চিৎ, কোনটি বা অশুদ্ধ অর্থাৎ অচিৎ, একে পর এবং অপর সংজ্ঞায় বলা যেতে পারে। কিন্তু তত্ত্বতঃ কোন ভেদ নেই – যেমন শিব তেমনই দেবী, যেমন দেবী তেমনই শিব। যেরূপ চন্দ্র এবং জোৎস্নার মধ্যে কোনো বিভেদ নেই, সেই রূপ ব্রহ্ম ও ব্রহ্মময়ীর মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। বেদান্তের অদ্বৈতবাদ শাক্তদর্শন , শৈবদর্শন একত্রিত হয়েছে। প্রকৃতি ও পুরুষ , আদিপরাশক্তি ও পুরুষ একত্রিত হয়ে স্বীকৃত হয়েছে।
এই সুবিশাল ব্রহ্মান্ডে যা হয় , সকলই তাঁদের ইচ্ছায় হয়। হিরণ্যগর্ভ সৃষ্টির সেই আদি কাল হতে আজ এই বিংশ শতকের বুকে দাঁড়িয়েও সেই বিশ্বাস জীবজগতের মধ্যে হতে একটুও যায় নি।
যা বা যার থেকে মানব খাদ্য, বস্ত্র , বাসস্থান পায় বা উপকৃত হয় তাই পূজ্য। আদিম সনাতনী বিশ্বাস এমনই। প্রতিটি মানবজাতির মধ্যেই সেই ব্রহ্ম ও শক্তির অবস্থান ছিল নানাভাবে , নানা রূপে। সেখানে ব্রহ্মই হলেন রুদ্র , সয়ম্ভূ, আদিম এবং শক্তি হলেন আদি পরাশক্তি। তাঁরা বৃক্ষ, শিলা, জল, বাতাস , আলোক , নদী , ভূমি , সূর্য , চন্দ্র, গ্রহ, তারা সর্বত্র অবস্থান করেন। নিরাকার থেকে তখন তাঁরা সাকার হয়ে ওঠেন। তিনি অবস্থান করেন প্রতি জীবে , যাঁরা আমাদের প্রাত্যহিক জীবনে উপকার করেন।
বিষ্ণু রূপে শালগ্রাম শিলা, শিব রূপে লিঙ্গ , ধর্ম রূপে কুর্ম , দেবী রূপে বিবিধ যন্ত্র এবং ঘট পবিত্র বস্তু এবং গরু পবিত্র পশু। এগুলিই শূন্য ও শক্তি স্বরূপ। তুলসী সহ দেবতার পূজা প্রকৃতি , শূন্য অর্থাৎ পরম ব্রহ্মের পূজার নামান্তর। সকল দেবদেবীর জর উপাসনা করা হয় তা সবই ব্রহ্মের উপাসনা। বিষ্ণু , শিব, দুর্গা , কালী, শ্ৰী, সরস্বতী প্রমুখেরা ব্রহ্ম স্বরূপ। আমরা পরম ব্রহ্মকে যে ভাবে দেখি সেভাবেই তিনি দেখা দেন। সুরেশচন্দ্র বিদ্যানিধি বলেছেন – ” অতএব বিষ্ণু, দুর্গা, কালী প্রভৃতি সমস্ত দেবতাই তাঁদের উপাসকের মধ্যেও উচ্চ নীচ নিরূপন হতে পারে না। “
সেই কারণেই সুপ্রাচীন কাল থেকে প্রকৃতির নানা বস্তুকে নানা ভাবে পূজা উপাসনা করা হয়ে আসছে। ভালো ফসলের আশায়, রোগ শোক হতে মুক্তি পেতে, পঞ্চভূতকে তুষ্ট করতে সেই উপাসনা আজও আমরা করে থাকি।
উপনিষদ্ বলছেন-
অন্তরিক্ষোদরঃ কোশো ভূমিবুধ্নো ন জীর্যতি।
দিশো হ্যস্য স্রক্তয়ো দ্যৌরস্যোত্তরং বিলম।।
স এষ কোশো বসুধানস্তস্মিন্বিশ্বমিদং শ্রিতম্।।
সমগ্র জগৎ রত্নপেটিকা। অন্তরিক্ষ যার উদর , ভূমি যার নিম্নভাগ, তা কখনো জীর্ণ হয় না। দিকসমূহ এর বিভিন্ন পার্শ্ব। দ্যুলোক হল ঊর্ধ্ব মুখ। এই ভুবনকোশ রত্নভাণ্ডারের মধ্যে রয়েছে সকল জগৎ, রয়েছে অপরূপা আরণ্যক প্রকৃতি। এই ব্রহ্ম সৃষ্ট কোশে সকল কিছু ব্রহ্মময়ী নিরাপদ রাখেন। হ্যাঁ , তাদের রূপ বদলায়, কিন্তু বিনাশ প্রাপ্ত হয় না। সময়ের অপেক্ষায় থাকে কেবল কু কে দমনের নিমিত্ত।
সমাপ্ত
তথ্যঃ ১. দেবী ষষ্ঠীর উৎস ও পরিচয়
২. বাংলার ব্রত ও আলপনা
৩. ঋগ্বেদ
৪. মহাভারত