২০০২ সালে অপর্ণা সেন পরিচালিত একটি ছবি মিস্টার এন্ড মিসেস আয়ার। মিসেস আয়ার যখন তার বাচ্চাকে নিয়ে বাসে করে যাচ্ছিল তখন তার বাবা-মা একজন অপরিচিত যুবককে তাদের মেয়ে এবং নাতির খেয়াল রাখতে বলে কারণ বাসে একদল যুবক উপস্থিত ছিল এবং তার সঙ্গে বিভিন্ন ধর্মের আরো অন্যান্য যাত্রীরা। অপরিচিত ব্যক্তি নিজের ধর্মীয় পরিচয় প্রকাশ করে জানায় যে সে মুসলিম সম্প্রদায়ের এবং মিসেস আয়ার তখন থেকেই তাঁর প্রতি ঘৃণা প্রদর্শন করতে শুরু করে। বাস চলতে থাকে সিনেমাটিও এগোতে থাকে। কিন্তু মিসেস আইয়ার এর মনে মুসলিম ব্যক্তির প্রতি ব্যবহার বদলে যেতে থাকে যখন এক মুসলিম বৃদ্ধ ও বৃদ্ধাকে মেরে ফেললো হিন্দুরা। এরপরে মিসেস আইয়ার পুলিশের সামনে সেই মুসলিম ব্যক্তিকে তার স্বামী বলে পরিচয় দেয়। এরপর তাঁদের বন্ধুত্ব বাড়ে এবং ওই মুসলিম যুবককে তিনি চুম্বন করতে যান এবং বাসটা থেমে যায় l সিনেমার শেষ দৃশ্য দেখানো হল মিসেস আইয়ার এর প্রকৃত স্বামী তার স্ত্রী এবং ছেলেকে নিতে এলেন এবং মিসেস আয়ার সেই মুসলিম ব্যক্তির সাথে পরিচয় করালেন এবং বিস্তারিতভাবে সমস্ত ঘটনা জানালেন।
গোটা বিশ্ব জুড়ে ছবিটি দেখানো হলো এবং বেশ কিছু আন্তর্জাতিক পুরস্কার পেল। মূল উদ্দেশ্য কি ছিল? গোটা বিশ্বের সামনে দেখানো হলো হিন্দু ধর্মের উন্মত্ত গুন্ডারা কোনো প্ররোচনা ছাড়াই মুসলিম বৃদ্ধ-বৃদ্ধাকে মেরে ফেললেন। গোটা পৃথিবীর ইতিহাস খুঁজে এমন একটা ঘটনা পাওয়া যাবে না যেখানে হিন্দুরা অন্য ধর্মের কোন মানুষকে আক্রমণ করেছে। স্বামী বিবেকানন্দ নিজে লিখেছেন মুসলমান আক্রমণ তরঙ্গ ভারতবর্ষে আসবার আগে ধর্ম স্থাপনের জন্য রক্ত সংগ্রাম ভারতবর্ষের মানুষ কখনো চোখে দেখেনি। আরেকটি বিষয় ভীষণ ভাবে লক্ষণীয় যে সিনেমাটির নাম মিস্টার অ্যান্ড মিসেস আইয়ার। প্রশ্ন হল কেন মুখার্জী বা সেনগুপ্ত বা গুহ নয়? কারন বর্তমানে তামিল ব্রাহ্মণরা হিন্দুদের মধ্যে সর্ববিষয়ে সবার চেয়ে এগিয়ে। তাই হিন্দুদের নিচু করে দেখানোর জন্যএ ক্ষেত্রে বেছে নেয়া হলো অসম্ভব মেধাবী আইয়ার পদবী কে।
এবার আসা যাক, কৌশিক গাঙ্গুলির ২০১৭ সালের ছবি বিসর্জন। বাংলাদেশের হিন্দু বিধবা দূর্গা পূজার বিজয়া দশমীর দিন নদীতে এক মুসলিম যুবককে উদ্ধার করল। যদিও মুসলিম যুবককে প্রথমে জানাই দশমীর রাত্রিতে সে ভুল করে এদিকে চলে এসেছিল কিন্তু পরে জানা যায় যে সে আসলে চোরাকারবারি। সেখানকার হিন্দু জমিদার গণেশ বহুদিন ধরেই পদ্মাকে ভালোবাসতো কিন্তু পদ্মা কিছুতেই রাজি হচ্ছে না। পদ্মা অচেনা মুসলমান নাসিরের প্রেমে পড়ে যাওয়ার পরে জানতে পারে সে দেশে তার বান্ধবী আছে। পদ্মা তাকে দেশে ফিরিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করে এবং শেষ রাতে নাসিরের সাথে সঙ্গমে লিপ্ত হয়। সব জেনেও গণেশ পদ্মাকে বিয়ে করে নেয়। সিনেমার শেষে গিয়ে দেখা যায় পদ্মার যে সন্তান সে আসলে নাসিরের সন্তান ছিল। গণেশের চরিত্রে নিজেকে বসিয়ে ভাবুন তো আপনার সাথে এরকম হলে আপনি কি করতেন? আর কৌশিক গাঙ্গুলী কি দেখালো ? উপরি পাওনা, যে বাংলাদেশে প্রতিনিয়ত হিন্দুরা নির্যাতিত হয়ে চলেছে সেখানে নাকি প্রভাবশালী হিন্দু জমিদার আছে!
এরপরে আসা যাক অপেক্ষাকৃত নতুন চিত্রপরিচালক শিবপ্রসাদ মুখার্জীর সিনেমা গোত্র। ছেলে বিদেশে থাকার কারণে বৃদ্ধা মায়ের দেখাশোনা করার জন্য একজন প্রাক্তন আসামি মুসলমান যুবককে নিযুক্ত করলেন। প্রাক্তন আসামির ধর্মীয় পরিচয় বৃদ্ধা মা জানতেন না কিন্তু সেই প্রাক্তন আসামির ব্যবহার এবং ভালোবাসায় মুগ্ধ হয়ে সেই মা তাকে নিজের ছেলের মতো ভালোবেসে ফেললেন এবং এক হিন্দু মেয়ের সাথে তার বিয়েও দিলেন। অর্থাৎ, একজন প্রাক্তন আসামি মুসলমান হলেও সে সুস্থ স্বাভাবিক জীবনে ফিরে হিন্দু মেয়েকে বিয়ে করতে পারে। কিছুদিন আগেই নিকিতা তোমার বলে একটি মেয়েকে প্রকাশ্য রাস্তায় গুলি করে খুন খুন করে এক মুসলমান যুবক কারণ মেয়েটি তাকে বিয়ে করতে রাজি হয়নি- গোত্র সিনেমার সাথে এই গোত্র সিনেমার চিত্রনাট্যএর কোন মিল খুঁজে পেলেন নাকি ? কন্ঠ ছবিতে আবার শিবুবাবুর চিকিৎসক আসে ঢাকা থেকে।
শুধু মাত্র তিনটি উদাহরণ দিলাম এরকম আরো কয়েকটি উদাহরণ দিতে পারি সেখানে ক্রমাগতভাবে টলিউডের চিত্রপরিচালকের লাভ জিহাদের সমর্থনে এবং হিন্দুদের নিচু করে দেখিয়ে সিনেমা বানিয়ে চলেছে। অনুরাগ বসু, তার কাবুলিয়ালা সিরিজে মিনিকে দিয়ে নামাজ পড়িয়ে নিলেন l আপনাদের মনে হতেই পারে ট্র্যাডিশন টা নতুন, বাস্তবে তা একেবারেই নয়। সোভিয়েত ইউনিয়নের গুপ্তচর সংস্থা কেজিবি গোটা বিশ্ব জুড়ে কমিউনিস্ট মতাদর্শকে প্রতিষ্ঠা করার জন্য বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় করেছিল Critical theory, Blank state এবং Theory driven Cons. – কালচারাল মার্কসিজম এর এই তিন স্তম্ভকে হাতিয়ার করে। মূল উদ্দেশ্য ছিল যে কোন দেশের প্রচলিত সামাজিক ব্যবস্থা কে ভুল হিসেবে প্রতিপন্ন করা এবং সমাজের সমস্ত শ্রেণীর মধ্যে বিভাজন তৈরি করে মানুষকে বিপ্লবের আদর্শে বলীয়ান করে তোলা। সামাজিক সংস্কারের মধ্যে দিয়েও যে সমাজের বিভিন্ন বৈষম্য দূর করা যায় তা কমিউনিস্ট আদর্শের বিরুদ্ধে- কমিউনিস্ট আদর্শের মূল উদ্দেশ্যই হলো সমাজের বিভাজন কে আরো প্রকট করে বঞ্চিত শ্রেণীকে দিয়ে বিপ্লব ঘোষণা করা।
কালচারাল মার্কসিজম এর একটি উদাহরণ দিই তাহলে বুঝতে পারবেন। হীরেন নাগ পরিচালিত, উত্তম কুমার এবং সুপ্রিয়া দেবী অভিনীত সবরমতী সিনেমায় উত্তম কুমার ছিলেন অত্যন্ত গরীব ঘরের ছেলে এবং সুপ্রিয়া দেবী ছিলেন অত্যন্ত বড়লোক ঘরের মেয়ে। আর্থিক অসচ্ছলতার কারণে সুপ্রিয়া দেবীর পরিবার কর্তৃক প্রত্যাখ্যাত হয়ে উত্তম কুমার নিজেকে একজন ব্যবসায়ী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে সুপ্রিয়া দেবী কে বিয়ে করলেন। দ্বিতীয় সিনেমাটি মৃণাল সেন পরিচালিত সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় এবং অপর্ণা সেন অভিনীত আকাশকুসুম। সিনেমার প্রেক্ষাপটটা অনেকটা একই ছিল, অত্যন্ত গরীব ঘরের ছেলে এবং অত্যন্ত বড়লোক ঘরের মেয়ে। সিনেমাটা শেষ হলো বড়লোক ঘরের মেয়ে গরিব ঘরের ছেলের প্রেম প্রত্যাখানের মধ্যে দিয়ে। Take Home message: প্রথম ক্ষেত্রে সামাজিক ব্যবস্থার মধ্যে থেকে নিজের ভালবাসার অধিকার সম্মানের সাথে গ্রহণ করা এবং দ্বিতীয় ক্ষেত্রে প্রচলিত সামাজিক ব্যবস্থার মধ্যে দিয়ে জীবনের আশা পূর্ণ তা সম্ভব নয়, অর্থাৎ বিপ্লবের পথে এসো বন্ধু।
১৯৯১ সালে সোভিয়েতের পতনের সাথে সাথে কমিউনিজমের নগ্নরূপ গোটা পৃথিবীর সামনে বেরিয়ে আসে। ইতিহাস সাক্ষী, যারা জান্তে বা অজান্তে চানক্য পন্ডিতকে অনুসরণ করেছেন, তারা মোটামুটি সবাই সফল আর যারা কার্ল মার্ক্স এর অর্থনীতি অনুসরণ করেছেন, তারা সবাই ব্যর্থ l এমনকি কমিউনিস্ট চীনও সাফল্য পেয়েছে বেসরকারী পুঁজির অবাধ অনুপ্রবেশের পর। সোভিয়েতের পতনের লেনিন, স্ট্যালিন, মাও, পলপট ইত্যাদি কমিউনিস্ট শাসকদের সাড়ে ১২ কোটি মানুষের গণহত্যা করে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব আনার গল্প যে মানুষ আর মেনে নেবে না সেটা কমিউনিস্টরা ভালভাবেই বুঝতে পেরেছিলেন। গোটা বিশ্ব জুড়ে উৎখাত হতে থাকে কমিউনিস্ট মতাদর্শ। সংগঠনকে হাতিয়ার করে মরিচঝাঁপি, বিজন সেতু বা সাঁইবাড়ি গণহত্যা ধামাচাপা দিয়ে বঙ্গেশ্বর জ্যোতিবাবু শুধুমাত্র পার পেয়ে গেছিলেন।
মৃণাল সেন, ঋত্বিক ঘটক, উৎপল দত্তের মতন একনিষ্ঠ কমিউনিস্ট চিত্রপরিচালকরা একসময় সিনেমা নাটক তৈরি করে জ্যোতিবাবুর জয়ের রাস্তা প্রশস্ত করে দিয়েছিলেন। তাদেরই পরবর্তী বংশধর বর্তমান চিত্র পরিচালকেরা বুঝতে পেরেছেন সরাসরি কমিউনিস্ট মতাদর্শ বর্তমানে প্রচার করতে গেলে মানুষ জুতোর মালা পড়িয়ে ঘোরাবে। কিন্তু তা বলে কি সমাজের বিভাজন বন্ধ থাকবে? তাই সময়মত পরিবর্তন চাই এর হোর্ডিং ফেলে রাজনৈতিক শিবির পরিবর্তন করতে দ্বিধাবোধ করেননি এক অংশের চিত্র পরিচালকেরা। আর বাকিরা অরাজনৈতিক মোড়কে শুধুমাত্র বিজেপির বিরোধিতা করে ভোটের আগে এই দেশেতেই থাকবো গান গাইছেন। উদ্দেশ্য একটাই, বিভাজন বিভাজন আর বিভাজন। বর্তমান পশ্চিমবঙ্গের বিভাজন শুধুমাত্র হিন্দুদের দুর্বল করে দিয়ে সম্ভব। তাই যেনতেন প্রকারে হিন্দুদের ছোট করে দেখানোর নীতি প্রদর্শন করা হচ্ছে সিনেমার মধ্যে দিয়ে। আর বাঙালি হিন্দু কে নিজেদের ইতিহাস ভুলিয়ে দেওয়ার পথপ্রদর্শক ছিলেন ঋত্বিক ঘটক। তিনি জীবনে প্রায় সবকটি ছবি বানিয়েছেন উদ্বাস্তু সমস্যার উপর কিন্তু একটি সিনেমাতে তিনি বলেননি বাংলাদেশ থেকে হিন্দুদেরকে পালিয়ে কেন পশ্চিমবঙ্গের উদ্বাস্তু হতে হয়েছিল। সত্যজিৎ রায় ৪৩ এর দুর্ভিক্ষের উপর ছবি বানালেন, কিন্তু তৎকালীন বাংলার প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিনের ভূমিকার ব্যাপারে নীরব, যেমনটি অমর্ত্য সেন তার গবেষণায় খাজার ব্যাপারে নির্বাক l
পরিশেষে বলি, যাদের সিনেমার মাধ্যমে এই বিভাজনের গল্প ফুটিয়ে তোলার যোগ্যতা নেই, তারা বর্তমানে হাফ পর্ন ওয়েব সিরিজ বানাতে ব্যস্ত। এবং যাদের সেই যোগ্যতাও নেই তারা ঘন্টাখানেক টিভির পর্দায় গিয়ে বক্তৃতা দিয়ে নিজেদের ডি.এন.এ. এর প্রতি সুবিচার করছেন। আমার লিখতে ভালো লাগে আমি লিখি, তা আপনারা এখন আমার এই লেখা পরে এই সমস্ত শিল্পীদেরকে হামি খাবেন না রগড়ে দেবেন তা আপনাদের ব্যক্তিগত বিষয়।
রুদ্র প্রসন্ন ব্যানার্জী, গবেষক
অ্যালবার্টা বিশ্ববিদ্যালয়, কানাডা।