প্রাচীন ভারতে যুদ্ধের জন্য তিন প্রকার বাহিনী রাখা হত।(1) বায়ু সেনা (2) নৌ সেনা ও (3) পদাতিক বাহিনী। পদাতিক বাহিনীর আবার চারটি ভাগ ছিল, (ক) রথ বাহিনী (খ)গজ বাহিনী(গ) অশ্ব বাহিনী ও (ঘ)পদাতিক সৈন্য।কৌটিল্য তাঁর ‘অর্থশাস্ত্র’ গ্রন্থে সৈন্য বাহিনীর বিন্যাস নিয়ে বলেছেন–“For every ten members of each of the constituents of the army,there must be one commander,called Padika;ten Padikas under a Senapati;ten Senapatis under a Nayaka.”অর্থাৎ কৌটিল্যের কথা অনুসারে সবথেকে ছোট সেনা ইউনিট ছিল দশ জনের (Squad of ten),যা একজন অফিসার (Padika)দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হত।এইরকম দশ ইউনিট (10×10=100) নিয়ে গঠিত বাহিনীর দায়িত্বে থাকতেন একজন সেনাপতি (Senapati)।আর এইরূপ দশ ইউনিট(100×10=1000) সেনার দায়িত্বে থাকতেন একজন নায়ক(Nayaka)। দশ সৈন্য বাহিনীর প্রধান কে দশাধিপতি এবং একশ সৈন্য বাহিনীর প্রধান কে শতাধিপতি বলা হত।প্রাচীন ভারতের সৈন্য বিন্যাস ছিল অসাধারণ।নিম্নের তথ্য থেকে প্রাচীন ভারতের সৈন্য বিন্যাস ও তার আধুনিক নাম সহজেই অনুমেয়।যেমন-
(1)বাহিনীর নাম-পত্তী,রথের সংখ্যা-01,হাতীর সংখ্যা-01,ঘোড়ার সংখ্যা-03,পদাতিক-05(Modern-Section)
(2)বাহিনীর নাম-সেনামূখ,রথের সংখ্যা-03,হাতীর সংখ্যা-03,ঘোড়ার সংখ্যা-09,পদাতিক-15(Modern-Platoon)
(3)বাহিনীর নাম-গুলমা,রথের সংখ্যা-09,হাতীর সংখ্যা-09,ঘোড়ার সংখ্যা-27,পদাতিক-45(Modern-Company)
(4)বাহিনীর নাম-ঘানা,রথের সংখ্যা-27,হাতীর সংখ্যা-27,ঘোড়ার সংখ্যা-81,পদাতিক-135(Modern-Battalian)
(5)বাহিনীর নাম-বাহিনী ,রথের সংখ্যা-81,হাতীর সংখ্যা-81,ঘোড়ার সংখ্যা-243,পদাতিক-405(Modern-Brigade)
(6)বাহিনীর নাম- প্রত্না,রথের সংখ্যা-243,হাতীর সংখ্যা-243,ঘোড়ার সংখ্যা-729,পদাতিক-1215(Modern-Division)
(7)বাহিনীর নাম-কামু,রথের সংখ্যা-729,হাতীর সংখ্যা-729,ঘোড়ার সংখ্যা-2187,পদাতিক-3645(Modern-Corps)
(8)বাহিনীর নাম-অনিকিনি,রথের সংখ্যা-2187,হাতীর সংখ্যা-2187,ঘোড়ার সংখ্যা-6561,পদাতিক-10935(Modern-Field Army)
(9)বাহিনীর নাম-অক্ষিনি,রথের সংখ্যা-21870,হাতীর সংখ্যা-21870,ঘোড়ার সংখ্যা-65610,পদাতিক-109350
(Modern-Army Group)(Art of war in ancient India,P.C.Chakravarti,পৃ-106)
প্রাচীন ভারতের সৈন্য বাহিনীর মধ্যে অনুশাসন ছিল কঠোর। নিয়ম পালন না করলে মৃত্যুই ছিল শাস্তি। প্রাত্যেক আট দিন অন্তর অন্তর নিয়মাবলী মনে করানো হত। রাজা কে অবশ্যই যুদ্ধে উপস্থিত থাকতে হত।শত্রু পক্ষের সাথে হাত মেলালে তার সাজা ছিল ভয়ানক। সমস্ত সৈন্যকে ড্রিলের সময় অবশ্যই উপস্থিত থাকতে হত। যে সমস্ত সৈন্য বা বাহিনী ভাল প্রদর্শন করতেন, তাদের বিশেষ সম্মানের ব্যবস্থা ছিল।কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র অনুসারে বৈদিক ভারতে দুর্গ নির্মাণ ছিল অত্যাবশ্যকীয় বিষয়।একজন রাজার কাছে তার শক্তপোক্ত দুর্গ ই হত তার স্বর্গ(the haven of the king and of his army is a strong fort)।সেই সময় বিভিন্ন ধরনের দুর্গ তৈরী করা হত শত্রুকে আটকানোর জন্য।যেমন-পর্বত্য দুর্গ বা পারবতা,জল দুর্গ বা উদাকা, মরু দুর্গ বা ধানবনা এবং জঙ্গল দুর্গ বা বনদুর্গ।দুর্গ যত শক্তপোক্ত ও দুর্গম হত ,রাজা তত বেশি নিশ্চিত হতেন।এই সময় অনেক রাজারাই গোপনে নিষিদ্ধ অনেক অস্ত্র রাখতেন, যা ছিল যুদ্ধ নীতির বিরুদ্ধে।যেমন বিষ মেশানো তীর,বল্লম প্রভৃতি।এই সময় লাঠির ব্যবহার ও ছিল যথেষ্ট।বিভিন্ন আকৃতির লাঠি কে প্রাথমিক নিদান হিসেবে ব্যবহার করা হত।এছাড়া বিভিন্ন ধরনের ধারালো কুঠার ও সৈন্যরা রাখতেন। যুদ্ধ হতো সম্পূর্ণ নিয়ম মেনে।বৈদিক যুগে ক্ষত্রিয়রাই যুদ্ধ করতেন। আর ক্ষত্রিয়রা যখন যুদ্ধ করতেন তখন অন্য সম্প্রদায়ের মানুষজন নিজ নিজ কাজে নিশ্চিন্তে ব্যস্ত থাকতেন। বিশাল যুদ্ধের কোনো আঁচই পেত না সাধারণ জনগন। সূর্যোদয় হতে সূর্যাস্ত এই সময়ের মধ্যেই যুদ্ধ সম্পন্ন হত।সম শক্তিসম্পন্ন ব্যক্তিরাই একে অপরের সাথে যুদ্ধ করতেন। অর্থাৎ অশ্বারোহীর সাথেই অশ্বারোহীর, গদাধারির সাথে গদাধারির, বর্শাধারির সাথে বর্শাধারির যুদ্ধ হত।একদম নিয়ম মেনে বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতিতে যুদ্ধ হত।বীরত্বই যেখানে শেষ কথা ছিল। রথচালনাকারী, জলবাহক,রন্ধনে নিযুক্ত ব্যাক্তি,যুদ্ধে আঘাত প্রাপ্ত ব্যাক্তি, সাধারণ নাগরিক, অসহায় প্রভৃতি কে কোনো মতেই আক্রমন করা যেতো না।এমন সভ্য ও বিজ্ঞান ভিত্তিক যুদ্ধ নীতি পৃথিবীর ইতিহাসে আর কোথাও নেই।কারন আমরা বিধর্মীদের মধ্যযুগীয় বর্বরতাময় যুদ্ধ বিদ্যা কিংবা বিদেশীদের ‘ধর্মযুদ্ধ’ সম্পর্কে যথেষ্ট ওয়াকিবহাল, যেখানে খুন, ধর্ষণ,রাহাজানি, গনিমতের মাল ভোগ করা,ছলনা,মহিলাদের অসম্মান, বিশ্বাসঘাতকতা, লুঠ করা,নৃশংস ভাবে হত্যা করাই ছিল যুদ্ধ নীতি। এ নীতি দাদুর হাত ধরে নাতিকূল এখন ও বর্তমান রেখেছেন। এ নীতি ক্লীবতা ছাড়া আর কি হতে পারে? কিন্তু বৈদিক যুদ্ধ বিদ্যার শিরায় শিরায় আর ধমনীতে ছিল কেবলমাত্র বীরত্ব, বীরত্ব আর বীরত্ব।
যুদ্ধে রথের গুরুত্ব ছিল যথেষ্ট। সাধারণত ষাঁড় বা ঘোড়া দ্বারাই রথ চালিত হতো। রথে একজন চালক ছাড়াও রাজা বা প্রধান সেনাপতি বা অন্য কোন সেনানায়ক অবস্থান করতেন। রথগুলো সাধারনত হালকা প্রকৃতির হতো এবং নদীর উপর দিয়েও সহজে যেতে পারত। রথের গতিবেগ একসময় তীব্র থেকে তীব্রতর হত। রথের অনুসরণ করতো রথের পিছনে থাকা গজ বাহিনী, অশ্বারোহী বাহিনী, ও পদাতিক বাহিনীর দল।এছাড়া রথে-রথে ও যুদ্ধ হত। অশ্ববাহিনীর ক্ষিপ্রতা ছিল সর্বাধিক। মেগাস্থিনিস এর বর্ণনা অনুযায়ী ভারতবর্ষে ঘোড়সওয়ার সৈন্যের দক্ষতা ছিল প্রশংসার যোগ্য।এবং ভারতের প্রশিক্ষণের জন্য নামকরা প্রশিক্ষকরা ছিলেন সেই সময়।ঘোড়া গুলিকে যুদ্ধের জন্য প্রত্যেকদিনই ট্রেনিং দেওয়া হতো। বিভিন্ন পদ্ধতিতে ট্রেনিং দেওয়া হত, যেমন-ধোরানা (gallop),ভলগনা(circular movement), নারোস্ত্রা (movement of following signals),লঙঘনা (jumping) নিশানা প্রভৃতি। এছাড়া ও বিপজ্জনক পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের জন্যে ছিল বিশেষ প্রশিক্ষণ। অশ্বারোহীরা ধনুক,খড়্গ, শূল,গদা,নালিক(বন্দুক) এই সমস্ত অস্ত্র ব্যবহার করত।এমনকি অশ্বারোহীরা প্রয়োজনে কামান ও ব্যবহার করত। তবে সবথেকে বেশি ব্যবহার করত তরোয়াল এবং বর্শা। ভারতীয় তরবারি তৈরি হতো উচ্চমানের লৌহ-ইস্পাত দিয়ে। ভারতীয় তরবারির নাম ছিল ‘দামাস্কাস’।যুদ্ধে গজ বা হাতী ছিল গুরুত্বপূর্ণ। ঋকবেদে হাতীর বর্ণনা পাওয়া যায় ‘হস্তিন’ রূপে।কৌটিল্য বলেছেন- “ It is on elephants that the destruction of an enemy’s army depends. The victory of kings in battles,depends mainly upon elephants;for elephants, being of large bodily frame,are able not only to destroy the arrayed army of the enemy.” বৈদিক যুগে হাতী গুরুত্বের কারন হিসেবে Ancient military studies এর Dr. Avantika Lal বলেছেন- ” One main reason was the concept of military prowess associated with possessing and employing these huge beasts.The main use of the elephant was for its routing ability; at one sweep it could get rid of a number of enemy foot soldiers, scare away horses,and trample Chariots!! যুদ্ধ শেষে হাতির বিশেষ গুরুত্ব ছিল। বিশেষত সমস্ত জিনিসপত্র নিয়ে আবার ফেরার জন্য এদের জুড়ি মেলা ভার। উক্ত রথ বাহিনী, গজ বাহিনী,অশ্বারোহী বাহিনী ছাড়াও ছিল পদাতিক বাহিনী। যারা ছিলেন আসল যোদ্ধা। পদাতিক বাহিনীর যোদ্ধাদের বীরত্বের এবং শক্তি প্রদর্শনের উপরেই নির্ভর করত জয়-পরাজয়। পদাতিক বাহিনীর প্রত্যেকের জন্য বিশেষ প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা যেমন ছিল, ঠিক একই রকম ভাবে নিজের রাজার প্রতি নিজের দেশের প্রতি নিজের সভ্যতা সংস্কৃতি ও ধর্মের প্রতি তাঁরা ছিলেন সমর্পিত। প্রাচীন ভারতীয় যুদ্ধে আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য যোদ্ধারা ব্যবহার করতেন বর্ম, শিরস্ত্রাণ, কবচ, কণ্ঠ, গ্রীবাত্রাণ,কঞচুকম প্রভৃতি।
বৈদিক ভারতের নৌবাহিনী ব্যবহার হতো দূরের কোন যুদ্ধের ক্ষেত্রে।মূলত নদী ও সমুদ্র পথে রাজ্যকে সুরক্ষা করার জন্যই নৌবাহিনীর ব্যবহার ছিল যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। ব্যবসা-বাণিজ্যের সাথে সাথে যুদ্ধের জন্যও নৌ- বাহিনীকে প্রস্তুত করা হতো।মাঝ সমুদ্রে ভয়ানক যুদ্ধের উদাহরণও রয়েছে প্রাচীন ভারতীয় যুদ্ধের ইতিহাসে। কৌটিল্য বলছেন-” Pirate ships ,boats from an enemy’s country when they cross its territorial limits, as well as vessels violating the customs and rules enforced in port towns,should be pursued and destroyed. ” মনুস্মৃতিতে (vii,192) আছে- ” it is laid down that boats should be employed for military purposes when the theatre of hostilities abounded in water. “
এছাড়া ছিল বিমান।বিখ্যাত চিন্তাবিদ T.Willson প্রাচীন ভারতের যুদ্ধে বিমানের ভূমিকা প্রসঙ্গে বলেছেন- “The Vimana aircraft that are described in ancient Hindu sanskrit texts are flying machines of varying degrees, used in war.The word Vimana translates to ‘having been measured out’or ‘traversing ‘,and were machines piloted by the Gods.” ভরদ্বাজ মুনি বিমান বিষয়ক বর্ণনা তিনি দিয়েছেন তাঁর ‘যন্ত্রসর্বস্ব’ গ্রন্থে। যেখানে তিনি বিমান তৈরির নানা পদ্ধতি ও নকশা বর্ণনা করেছেন। এবং যুদ্ধে বিমানের ব্যবহার সংক্রান্ত ,ও যুদ্ধবিমান এর গুরুত্ব বর্ণনা করেছেন।এথেকে পরিষ্কার বোঝা যায় যে,সে যুগে যুদ্ধে বিমানের ব্যবহার হত।
(পরবর্তী অংশ তৃতীয় পর্বে)
ড.সুমন পানিগ্রাহী (Dr. Suman Panigrahi)