আফ্রিকার জনজাতির মধ্যে পারস্পরিক হানাহানিকে ভারতের মহাজাতি নির্মাণের সঙ্গে তুলনা করা চলে না। অথচ সেই চেষ্টাই করছেন আমাদের দেশ- ভাঙ্গার মহাপন্ডিতরা। সম্প্রতি অধ্যাপক অমর্ত্য সেন সংখ্যাগরিষ্ঠের আধিপত্যবাদের অভিযোগ তুলেছেন এদেশে দ্রুত বিবর্ধমান জাতীয় জাগরণ সম্পর্কে আপত্তি জানাতে। হিন্দুত্ব তাঁর কাছে অত্যন্ত ঘৃণ্য শব্দ। জনপ্রিয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র দামদরদাস মোদী তাঁর কাছে অল্পশিক্ষিত আর যথারীতি রাষ্ট্র শাসনের পক্ষে অযোগ্য ।
মাতামহ আচার্য ক্ষিতিমোহন সেনের সঙ্গে অধ্যাপক অমর্ত্য সেনের বিতর্ক আর তার নির্যাস থেকে তিনি একদা লিখেছিলেন ‘হিন্দু বর্ণালির ব্যাপ্তির মধ্যে’ তিনি ‘লোকায়ত শাখায়’ নিজেকে রেখেছেন। মাতামহ তাঁকে বোঝাতে চেয়েছিলেন ‘হিন্দু মতাদর্শের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ’ যে ‘সর্বব্যাপী উদারতা’ – তার শিক্ষা তিনি সেই সময়েই পেয়েছিলেন। ( দেখুনঃ “ভারতঃ বৃহৎ ও ক্ষুদ্র – কিছু ব্যক্তিগত স্মৃতি”; ‘তর্কপ্রিয় ভারতীয়’ ; আনন্দ পাবলিশার্স ; কলকাতা ; তৃতীয় সংস্করণ আগস্ট ২০১০ )
সম্প্রতি রোয়ান্ডা গণহত্যার পঁচিশ বছর উদযাপনের উপলক্ষে তিনি লিখেছেন বর্তমান ভারতের সংখ্যাগুরু হিন্দু জন সাধারণের রাজনৈতিক প্রবণতা নাকি অনুরূপ ভয়ঙ্কর পরিণতির সম্ভাবনার দিকে যাত্রা করছে। যাকে দেখতে নারি তার চলন বেঁকা – বাংলা ভাষার এই প্রবচনের মত আচরণ করছেন অধ্যাপক সেন। ১৯৯৪ সালের ৭ই এপ্রিল থেকে ১৫ই জুলাই এই ভয়াবহ জাতিদাঙ্গা সংঘটিত হয়। এক লক্ষের উপর টুটসি গোষ্ঠীর মানুষের মৃত্যু ঘটে । গৃহহীন হয় অসংখ্য নরনারী । একথা ঠিক রোয়ান্ডায় টুটসিরা সংখ্যালঘু । সে দেশে সংখ্যাগুরু অধিবাসী ‘হুটু’। ‘হুটুদের’ শতকরা ৮৫ ভাগ অন্য দিকে ‘টুটসি’দের সংখ্যা বড়জোর ১৪ শতাংশ আর ‘তাওয়া’দের সংখ্যা মাত্র ১%। দক্ষিণ সাহারার হ্রদ অঞ্চলের দেশটিতে ১৯৯৪এর গণহত্যার পিছনে ছিল এক দীর্ঘস্থায়ী ঘটনা পরম্পরা । সংখ্যাগুরু ‘হুটু’দের মনে ছিল সংখ্যায় বেশি হলেও তাদের সর্বস্তরের বঞ্চনা সহ্য করতে হচ্ছে।
দশম শতাব্দী থেকে টুটসিরা এই দেশ দখল করে রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেছিল । রাজার জাত বলে তাদের যুদ্ধ বিদ্যা অনুশীলন এর নানাবিধ সুযোগ সুবিধা লাভের কারণে এক ধরনের আধিপত্যবাদী ধারণা তৈরি হয়। উনিশ শতকে বেলজিয়ামের অধীন হওয়ার পর এই আধিপত্য কমে নি। জার্মান ধর্ম যাজকরা এসে তাদের ক্রমে খৃষ্ট ধর্মে আশ্রয় দেয়। বেলজিয়ামের উদারনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির মানুষও হুটু- অস্মিতার বিকাশ ঘটায়।
১৯৬২ তে বেলজিয়ামের হাত থেকে রোয়ান্ডা স্বাধীন হলেও তাদের শাসন ব্যবস্থায় টুটসিদের আধিপত্য কমে না, বরং বৃদ্ধি পায়। এই অবস্থা থেকে পরিত্রাণের জন্য হুটুরা গড়ে তোলে একটি প্রতিবাদী সংগঠন – ‘ রোয়ান্ডা দেশপ্রেমী মঞ্চ’ (Royanda Patriotic Front) । এই মঞ্চ দ্রুত জনপ্রিয় হয়। সংখ্যা গরিষ্ঠের সমর্থনে নিরঙ্কুশ ক্ষমতা অর্জন করে।
এই ব্যবস্থা বদল স্বাভাবিকভাবেই টুটসিদের মনঃ পূত হয়নি। তারা তাদের প্রাচীন রাজকীয় আভিজাত্যের অহঙ্কার এর দেহ শক্তির কারণে হুটু বিরোধিতা চালিয়ে যেতে থাকল। বলে রাখি, টুটসিদের শরীর হুটুদের তুলনায় সক্ষম সবল ছিল, আর ছিল উস্কানি। অতি দীর্ঘ দিনের বশ্যতা স্বীকার করলেও হুটুরা তাদের চিরাচরিত ধর্ম বিশ্বাস ভোলেনি। এদের মধ্যে শতকরা ৬০ ভাগ খৃষ্ট ধর্মাবলম্বী মাত্র – মাত্র ১ শতাংশ মুসলমান আর বাকি ৩৫ শতাংশ উপর চিরাচরিত ধর্মাচারে বিশ্বাস করে। অন্য দিকে টুটসিদের বেশিরভাগ মুসলমান। তবে এই ভয়ঙ্কর নরসংহারের কারণ ধর্ম নয়। একে সমাজ বিজ্ঞানীরা জাতিদ্বেষ বলেই শনাক্ত করেছেন।
খর্বকায় হুটুরা আবাহুটু বান্টু – গোষ্ঠীর মানুষ। তাদের জাতিসত্তা ধারণা ‘রোয়ান্ডা-বাদ’ (Royandanness) – এর কারণেই দু-দুটি কঙ্গো যুদ্ধ হয়েছিল । ১৯৯৪ সালের ভয়ঙ্কর নর- সংহার সেসবেরই পরিণতি।
নোবেল বিজয়ী অধ্যাপক অমর্ত্য সেন আশঙ্কা প্রকাশ করছেন বর্তমান ভারতের সংখ্যাগুরু জনসাধারণ সংখ্যালঘু মুসলমানদের ওপর অনুরূপ হামলা করতে পারেন । বস্তুত একেবারেই ভুল কথা। ভারত কোনদিন অন্য ধর্ম বিশ্বাসকে নিশ্চিহ্ন করে একটি মতকেই চূড়ান্ত বলে প্রচার করেনি। পূর্ববর্তী প্রকাশন গুলিতে ক্রমাগত তিক্ত বিরক্ত তীব্র আপত্তি প্রকাশ করলেও অধ্যাপক সেন ভারতীয় সাধনা ধারার বহুমাত্রিক সহনশীলতাকে কখনো বাতিল করেননি। আজ তাঁর মন সঙ্কীর্ণ অবস্থান নিতে নিতে আফ্রিকার পঁচিশ বছর আগের আফ্রিকায় পৌঁছে গেছেন। জেনারেল রোমিও ডালাইরের ‘সেক হ্যান্ডস উইথ ডেভিল: দি ফেলিওর অফ হিউম্যানিটি’, ড. জেমস ওর বিনাস্কির ‘অ্যান ইম্পারফেক্ট অফারিংস’ কিংবা ইসমাকিলে ইলিবাগিপ্তার ‘ লেফট টু টেল: ডিসকভারিং গড: অ্যামিডস্ট দি রুয়ান্ডিয়ান হলোকাস্ট’ – প্রভৃতি অজস্র গ্রন্থ রোয়ান্ডায়ান হত্যা নিয়ে আলোচনা করেছে। কেউ তার সঙ্গে ভারতীয় রাজনীতির তুলনা করেননি। দেশ ভাঙ্গার ষড়যন্ত্র ছাড়া অধ্যাপক সেনের রচনাটির অন্য উদ্দেশ্য বোঝা দুষ্কর ।