এদিকে বিরোচন তো অসুরদের কাছে ফিরে গিয়ে বললেন যে , দেহই সব। দেহকে সুখ , ভোগ দাও। দেহি হল আত্মা। প্রজাপতির হেঁয়ালিতে তাঁর মনে না জেগেছে কোনো প্রশ্ন, না কোনো সংশয়। কিন্তু ইন্দ্রের কি হল? বুদ্ধির স্বচ্ছতা কি তাঁর জাগ্রত হল? কিছুমাত্র আধ্যাত্মিকগুণাবলী কি তাঁর ভিতর প্রশ্নকে উত্থিত করেছিল?  

আত্মা কি ও কে ? এ প্রশ্নের উত্তর অর্ধেক জেনেই ইন্দ্র দেবতাদের কাছে ফিরে যাচ্ছিলেন। কিন্তু মাঝ পথে থমকে দাঁড়ালেন। পথে একটি নগ্ন গলিত মৃতদেহ দেখলেন। তখন ইন্দ্রের মনে  প্রশ্ন উত্থাপিত হল- এই শরীর সুন্দরভাবে অলঙ্কৃত হলে এই শরীরের প্রতিবিম্বটিও সুন্দরভাবে অলঙ্কৃত হবে।  দেহ সুন্দর পোষাকে সজ্জিত হলে প্রতিবিম্বটিও সুন্দর পোষাকে সজ্জিত থাকে। দেহ পরিচ্ছন্ন থাকে প্রতিবিম্ব পরিচ্ছন্ন হয়। কিন্তু দেহ যখন অন্ধ হয়? আমি তখন কি আমার প্রতিবিম্ব দেখতে পাব? সে অন্ধ দেহ অসীম অন্ধকারের আলোকের সন্ধানে ব্যাকুল হয়ে উঠবে, দেহটার প্রতিবিম্ব হবে অন্ধ।  দেহ যদি খোঁড়া হয় প্রতিবিম্বটিও খোঁড়া হবে। শরীর আহত হলে প্রতিবিম্ব শরীরটিও আহত হয়। এই দেহের বিনাশ হলে এই প্রতিবিম্বের বিনাশ ঘটে। দেহের যেমন পরিবর্তন হবে , প্রতিবিম্বেরও তেমন পরিবর্তন হবে। শরীর যখন চলে যাবে তখন তার প্রতিবিম্বটিও নষ্ট হয়ে যাবে। তবে এতে কল্যাণকর কি আছে? কিভাবে একটি পচা গলিত মৃত দেহ আত্মা হতে পারে? প্রজাপতি বলেছিলেন আত্মা নিত্য, সকল পাপ দোষমুক্ত এবং অমর। আত্মার কোনো পরিবর্তন হয় না।  তবে সেদিন জল পূর্ণ পাত্রের দিকে নির্দেশ করে #ইনিই_আত্মা বলতে তিনি কি বোঝাতে চেয়েছিলেন? অনিত্য প্রতিবিম্বও কোনোদিন তো আত্মা হতে পারে না!

অস্য এবং শরীরস্য নাশমন্বেষ নশ্যতি নাহমাত্র ভোগ্যং পশ্যামীতি।

তাই রবীন্দ্রনাথ লিখছেন – ” আত্মা যে শরীরকে আশ্রয় করে সেই শরীর তাকে ত্যাগ করতে হয়। কারণ, আত্মা শরীরের চেয়ে বড়ো। কোনো বিশেষ এক শরীর যদি আত্মাকে বরাবর ধারণ করে থাকতে পারত, তা হলে আত্মা যে শরীরের মধ্যে থেকেও শরীরকে অতিক্রম করে তা আমরা জানতেই পারতুম না। এই কারণেই আমরা মৃত্যুর দ্বারা আত্মার মহত্ত্ব অবগত হই।

আত্মা এই হ্রাসবৃদ্ধিমরণশীল শরীরের মধ্যে নিজেকে ব্যক্ত করে। তার এই প্রকাশ বাধাপ্রাপ্ত প্রকাশ, সম্পূর্ণ প্রকাশ নয়; এইজন্যে শরীরকেই আত্মা বলে যে জানে সে সম্পূর্ণ সত্য জানে না।

মানুষের সত্যজ্ঞান এক-একটি মতবাদকে আশ্রয় করে নিজেকে প্রকাশ করতে চেষ্টা করে। কিন্তু সেই মতবাদটি সত্যের শরীর, সুতরাং এক হিসাবে সত্যের চেয়ে অনেক ছোটো এবং অসম্পূর্ণ।”

ইন্দ্র পুনরায় প্রজাপতির আশ্রমের দিকে ফিরে চললেন। এখনোও যে অনেক প্রশ্ন , অনেক সংশয় বাকি। শঙ্করাচার্য এখানে একটি গুরুত্বপূর্ণ মন্তব্য করেছেন । প্রশ্ন হল – ” বিরোচন যেখানে সন্তুষ্ট হয়ে চলে গেলেন সেখানে কেন ইন্দ্র ফিরে এলেন? ” উত্তরে শঙ্করাচার্য বলছেন – আমরা কোনো বিষয়কে বোঝার চেষ্টা করি নিজের স্বভাব অনুযায়ী, আমাদের মনের গঠন ও ঝোঁক অনুযায়ী। 

বৃহদারণ্যক উপনিষদ্ থেকে একটি দৃষ্টান্ত উল্লেখ করেছেন শঙ্করাচার্য। প্রজাপতি একদা ত্রিলোকের যত প্রাণী, জীব, জন্তু আছে তাঁদের সকলকে উপদেশ দিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন #দ। দেবতারা এই দ মানে বুঝেছিলেন দম্যত অর্থাৎ সকল রিপু দমন করে সংযত হও। মানবকুল ভাবলেন দ অর্থাৎ দত্ত , দান কর। আর অসুরকুল বুঝলেন, দয়ধ্বম্ , দয়া কর। 

একই কথা। কিন্তু যার যা স্বভাব , সে সেই অনুযায়ী ভিন্ন ভিন্ন অর্থ করলেন। দেবতারা ব্রহ্মের সবচেয়ে কাছাকাছি। তাঁদের আধ্যাত্মিকগুণ অন্যান্যদের হতে অধিক কিন্তু তাঁরা তো ত্রিগুনাতীত নন। তাঁরা কেউ এখনো ব্রহ্মের সঙ্গে একত্ব বোধ করতে পারেন নি। এখনো অজ্ঞানতার অন্ধকার একটু থেকে গেছে।  সেই অজ্ঞানতা মুছে তাঁদের পবিত্র হতে হবে। তার জন্য সংযম অভ্যাস প্রয়োজন। তাঁরা এখনও সংযত নন। তাই দ অর্থাৎ দমন কর, সংযত হও। যোগ সাধনা করো। সংযম করে তবেই ব্রহ্মকে একত্ব করবে। 

দেবতাদের পর মনুষ্যকুলের স্থান। তাঁরা দ অর্থাৎ দত্ত অর্থাৎ দান বুঝছেন। তাঁরাও ভুল নন। সংযম করলে তবেই নিঃস্বার্থ ভাবে ও নিঃস্ব হয়ে দান করা যায়। সেই নিঃস্বার্থ হওয়ার চেষ্টা করতে হবে। 

অসুররা বুঝলেন দয়ধ্বম্ অর্থাৎ দয়া। তাঁদের কয়েকজন যেমন সংযত হয়ে ব্রহ্মকে লাভের চেষ্টা করেছেন , অধিকাংশের হিংস্র ক্রুর স্বভাবের জন্য দু একজনের কর্মফল নষ্ট হয়ে গেছে। অসুররা আত্মসংযম বা দান কিছুই তেমন একটা করেননি। তাই প্রজাপতির উপদেশের অর্থ তাঁরা করলেন দয়া কর অর্থাৎ নিষ্ঠুরতা ত্যাগ কর।

প্রসঙ্গত , এই বিশ্ব জুড়ে বর্তমানে যে মানবজাতি বাস করেন , তাঁদেরও এরূপ তিন চরিত্র দেখা যায়। কারুর প্রয়োজন সংযম অভ্যাস করা, কারুর দান করা এবং কারুর প্রয়োজন দয়া করা। যার যেমন স্বভাব , সেই অনুযায়ী। 

বেদান্ত বলছেন , আত্মজ্ঞান লাভ করার জন্য যোগ্য অধিকারী হতে হবে। তার জন্যই তো প্রস্তুতি চাই। গুরুর উপদেশকে কে কতটুকু ধারণা করতে পারবে তা নির্ভর করে এই প্রস্তুতির উপর। ইন্দ্র বা বিরোচন কাউকেই প্রজাপতি বিভ্রান্ত করতে চান নি। পরীক্ষা করছিলেন মাত্র এবং উপলব্ধি করেছিলেন যে এঁরা কেউ আত্মজ্ঞান লাভের জন্য প্রস্তুত নন। 

তদেতৎ সত্যং তদমৃতং তদ্বেদ্ধব্যং সোম্য বিদ্ধি ।

তিনি সত্য,তিনি অমৃত,তাঁহাকে বিদ্ধ করিতে হইবে,হে সৌম্য,তাঁহাকে বিদ্ধ করো।

ধনুর্‌গৃহীত্বৌপনিষদং মহাস্ত্রং

উপনিষদে যে মহাস্ত্র ধনুর কথা আছে  সেই ধনু গ্রহণ করিয়া

শরং হ্যুপাসানিশিতং সন্ধয়ীত

উপাসনাদ্বারা  শাণিত  শর সন্ধান করবে!

আয়ম্য তদ্ভাবগতেন চেতসা লক্ষ্যং তদেবাক্ষরং সোম্য বিদ্ধি !

 রবীন্দ্রনাথ লিখছেন – 

“তদ্ভাবগত চিত্তের দ্বারা  ধনু আকর্ষণ করিয়া  লক্ষ্যস্বরূপ সেই অক্ষর  ব্রহ্মকে বিদ্ধ করো ।

সমস্ত প্রত্যক্ষ পদার্থের মধ্যে তদেতৎ সত্যং সেই-যে একমাত্র সত্য যদ্‌ অণুভ্যোণুচ, যাহা অণু হইতেও অণু– অথচ যস্মিন্‌ লোকা নিহিতা লোকিনশ্চ, যাহাতে লোকসকল এবং লোকবাসীসকল নিহিত রহিয়াছে– সেই অপ্রত্যক্ষ ধ্রুব সত্যকে শিশুতুল্য সরল ঋষিগণ অতি নিশ্চিতরূপে জানিয়াছেন। তদমৃতং, তাহাকেই তাঁহারা অমৃত বলিয়া ঘোষণা করিয়াছেন এবং শিষ্যকে ডাকিয়া বলিয়াছেন তদ্ভাবগতেন চেতসা, তদ্ভাবগত চিত্তের দ্বারা, তাঁহাকে লক্ষ্য করো– তদ্বেদ্ধব্যং সোম্য  বিদ্ধি, তাঁহাকে বিদ্ধ করিতে হইবে, হে সৌম্য তাঁহাকে বিদ্ধ করো! শরবত্তন্ময়ো ভবেৎ, লক্ষ্যপ্রবিষ্ট শরের ন্যায় তাঁহারই মধ্যে তন্ময় হইয়া যাও!”

ইন্দ্র পুনরায় যজ্ঞ সমীধ হস্তে প্রজাপতির আশ্রমে প্রবেশ করলেন। প্রজাপতি তাঁকে দেখে মনে মনে হাসলেন, মুখে বললেন, ” ইন্দ্র , দেবরাজ… মহারথী তুমি তো বিরোচনের সঙ্গে চলে গিয়েছিলে। তবে আবার কি মনে করে প্রত্যাবর্তন করলে ?” ইন্দ্র প্রজাপতির নিকট যজ্ঞকাষ্ঠ রেখে তাঁকে সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করে বললেন, ” হে ভগবন, হে গুরুদেব এই যে সুন্দর দেহ সুন্দর পোষাক , অলঙ্কারে সজ্জিত, তাই তার প্রতিবিম্বটিও হয় রাজকীয় সুন্দর। কিন্তু দেহ যদি অন্ধ, বিকৃত, বীভৎস হয় ! তবে প্রতিবিম্বও তো এই হবে। দেহ আহত, অসুস্থ হলে প্রতিবিম্বও তাই হবে। এই দেহ নাশ হলে প্রতিবিম্ব কি আর থাকবে? এ কেমন জ্ঞান ? এ জ্ঞানে কিবা সুফল হবে? “

প্রজাপতি স্মিত হেসে বললেন, ” ইন্দ্র ভালো হয়েছে তোমার হৃদয় আমার বলা শব্দগুলি আন্দোলনের সৃষ্টি করেছে। এরকমই বটে। তবে তুমি আরও বত্রিশ বৎসর এখানে থেকে ব্রহ্মচর্য পালন কর , তারপর না হয় আমি আবার জ্ঞান দেব।”

তারপর? তারপর কি হল? আরও বত্রিশ বৎসর?! ইন্দ্র কি জ্ঞান পেলেন? 

কেমনে রাখিবি তোরা তাঁরে লুকায়ে

চন্দ্রমা তপন তারা আপন আলোকছায়ে ॥

হে বিপুল সংসার, সুখে দুখে আঁধার,

কত কাল রাখিবি ঢাকি তাঁহারে কুহেলিকায়

আত্মা-বিহারী তিনি, হৃদয়ে উদয় তাঁর–

নব নব মহিমা জাগে, নব নব কিরণ ভায় ॥

©দুর্গেশনন্দিনী

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.