আমার চিদাকাশে তুমি জ্যোতিষাং জ্যোতিঃ -দ্বিতীয়পর্ব

দেবতাদের প্রধান ইন্দ্র, অসুরদের প্রধান বিরোচন। তাঁরা সর্বদা পরস্পরের প্রতিদ্বন্দ্বী, প্রতিপক্ষ। কিন্তু প্রজাপতি তো সবার। তাঁর নিকট কোনো উচ্চ নিচ ভেদ নাই। তিনি সকলকে ব্রহ্মজ্ঞান দান করতে চান। সুর ও অসুর উভয়ের প্রধানই ব্রহ্মজ্ঞানের পিয়াসী। এই জ্ঞান অমূল্য, অমৃত হতেও অধিক। যিনি এই জ্ঞানের অধিকারী তিনি ত্রিলোকে জয়ী। তাঁরা আপন আপন মনস্কামনা আপনার মধ্যেই গুপ্ত রাখলেন। কিন্তু ব্রহ্মময়ীর মায়ার সংসার। সেখানে দেব অসুর কেউই ব্রাত্য যান না। তাঁর লীলায় উভয় পরস্পর বিরোধী প্রধান একই সময়ে উপস্থিত হলেন প্রজাপতির সম্মুখে। 

কিন্তু তাঁরা তো রাজা! দুজনেই অহংকারী, ঐশ্বর্যশালী, ক্রোধ , কাম, দ্বেষ ইত্যাদির ষড়রিপুর দোষে দোষী। অবিদ্যা স্বরূপ মায়ার সংসারে বন্দী। বিদ্যা স্বরূপ মায়ার ব্রহ্মজ্ঞান প্রজাপতির থেকে লাভে জন্য তো এসব অহং, দ্বেষ ইত্যাদি নিয়ে যাওয়া যায় না। তার জন্য ত্যাগ চাই শরীরে , মনে ও মস্তিষ্কে। তাহলে কিভাবে তাঁরা প্রজাপতির সামনে এলেন ? 

উপনিষদ বলছেন – সমিৎপাণী প্রজাপতিসাকাশম্ আজগ্মতুঃ

আমার যে সব দিতে হবে সে তো আমি জানি–

আমার যত বিত্ত, প্রভু, আমার যত বাণী ॥

আমার চোখের চেয়ে দেখা, আমার কানের শোনা,

আমার হাতের নিপুণ সেবা, আমার আনাগোনা–

                   সব দিতে হবে ॥

এলেন তাঁরা বিনম্রভাবে। দুই রাজা রাজসজ্জা ত্যাগ করে , সকল ঐশ্বর্য সরিয়ে রেখে, ব্রহ্মচর্যের বেশ ধারণ করে এলেন প্রজাপতি সম্মুখে। নিয়ম ছিল গুরুকুলে যাওয়ার সমিৎপাণী অর্থাৎ যজ্ঞের কাষ্ঠ বহন করে নিয়ে যাওয়া। সমিৎপাণী হল আত্মনিবেদন ও নম্রতার প্রতীক। তাঁরা তাই সমিৎপাণী বহন করে প্রজাপতি সম্মুখে রাখলেন। তাঁর এটুকু উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন যে ত্রিলোকের অধিপতি হওয়ার থেকে মায়ার সংসারে এই ব্রহ্মজ্ঞান অনেক বেশি মূল্যবান।

যমও নচিকেতার সকল ইচ্ছা পূরণ করতে প্রস্তুত ছিলেন। তিনি চেয়েছিলেন যে নচিকেতা যেন আত্মজ্ঞান যেন চান। বালক নচিকেতা সেদিন ইচ্ছা করলেই ত্রিলোকের অধিপতি হতে পারতেন। কিন্তু মায়ার সংসারের অবিদ্যা থেকে নিজেকে মুক্ত করে বিদ্যা স্বরূপ মহামায়ার জগৎকে একান্ত মনে পেতে চেয়েছিলেন। তিনি চেয়েছিলেন তাঁর পিতা জাগতিক তাড়নায় যে ভুল করেছিলেন তা তিনি নিজে যেন না করেন। তাই তিনি সকল কিছুর ঊর্ধ্বে গিয়ে চাইলেন ব্রহ্মজ্ঞান। সেই জ্ঞান যা লাভ করলে তিনিই জগৎসংসারে জয়ী হবেন। 

কিন্তু চির অহংকারী দুই প্রতিপক্ষ রাজা তাঁরা এত সহজে কি সকল কিছু বোধকে ত্যাগ করে ব্রহ্মজ্ঞান লাভ করবে? এত সম্ভব নয়। প্রজাপতির নির্দেশে তাঁদের ব্রহ্মচর্য ধারণ করতে হল। 

তৌ হ দ্বাত্রিংশতং বর্ষাণি ব্রহ্মচর্যমূষতুস্তৌ হ প্রজাপতিরুবাচ কিমিচ্ছন্তা বাস্তমিতি তৌ হোচতুর্য আত্মাংপহতপাদ্মা বিজরো বিমৃত্যুর্বিশোকো বিজিঘৎসোংপিপাসঃ সত্যকামঃ সত্যসঙ্কল্পঃ সোহন্বেষ্টব্যঃ স বিজিজ্ঞাসিতব্যঃ স সর্বাংশ্চ লোকানাপ্নোতি সর্বাংশ্চ কামান্যস্তমাত্মানমনুবিদ্য বিজানাতীতি ভগবতো বচো বেদয়ন্তে তমিচ্ছন্তা বাস্তমিতি ॥

ইন্দ্র ও বিরোচন প্রজাপতির নির্দেশে সেখানে বত্রিশ বৎসর কঠোর ব্রহ্মচর্য পালন করলেন , যেমন আরো পাঁচটা সাধারণ শিষ্য গুরুগৃহে শিক্ষা গ্রহণের নিমিত্ত পালন করেন। একদিন প্রজাপতি তাঁদের উভয়কে ডেকে জিজ্ঞাসা করলেন , -” তোমরা কেন এখানে এসেছ সে বিষয়ে জ্ঞাত আছ  এখনো? ” ইন্দ্র এবং বিরোচন বললেন , – ” প্রজাপতি আমরা শ্রবণ করেছিলাম আপনি আত্মজ্ঞান সুর, অসুর, নর, পশু ,পক্ষী সকলকেই দান করতে চাইছেন। সেই জ্ঞান লাভে কোনো উচ্চ নিচ ভেদ নেই। আপনি বলেছেন একমাত্র আত্মাই যা জরা হীন, অমর এবং আনন্দস্বরূপ।  আমরা সেই পরমানন্দ অমর , অক্ষয়, অব্যয় আত্মাকে জানতে চাই। তাই তো বত্রিশ বৎসর আমরা ব্রহ্মচর্য পালন করছি আপনার আশ্রমে।”

আচার্য শঙ্কর তাঁর ভাষ্যে বলছেন – দেখুন ইন্দ্র ও বিরোচন দুই রাজা উভয় উভয়ের কেমন ঘোর শত্রু। কিন্তু মহামায়ার কি লীলা! আজ তাঁরা ব্রহ্মচর্য পালন করতে গিয়ে গুরুকুলে সব থেকে বিনয়ী এবং উদার শিক্ষার্থীতে পরিণত হয়েছেন। আজ দুই শত্রু জ্ঞানের পিপাসু হয়ে দুজনের পরম বন্ধু। আশ্রম তাঁদের মতো বন্ধু মেলা ভার। কিন্তু এ কেমন করে সম্ভব? তাঁদের স্বভাব এমন পরিবর্তিত হল কি করে ? উত্তর হল এই যে, তাঁরা নিষ্ঠার সঙ্গে ব্রহ্মচর্য পালন করেছিলেন দীর্ঘ বত্রিশ বৎসর। 

ব্রহ্মচর্য – ব্রহ্মণি চরতি যঃ – অর্থাৎ যিনি ব্রহ্মে চরণ করেন, সর্বদা ব্রহ্মের চিন্তা করেন এবং #অহং_ব্রহ্মাস্মি এই পরম সত্যকে উপলব্ধি করতে চেষ্টা করেন। ব্রহ্মকে কেন্দ্র করেই ব্রহ্মচারীর জীবন, ব্রহ্মকে ধরেই তাঁর আবর্তন। তিনি সংযত, রিপু দোষ মুক্ত, তাঁর চিন্তা ভাবনা , চলাফেরা, অভ্যাস, আচরণ সকল কিছু সংযত। তাঁর জীবন যাপন সাত্ত্বিক। আত্মসংযমই হল সিদ্ধির চাবিকাঠি কেবলমাত্র আধ্যাত্মিক জীবন নয় জাগতিক জীবনের কোনো ক্ষেত্রে তুমি যদি সফলতা চাও তবে আত্মসংযম একমাত্র চাবিকাঠি।

ব্রহ্মা সব শুনে বললেন , ” বেশ তবে বলছি আত্মার ব্যাখ্যা। বোঝার চেষ্টা করো।” –

য এষোংক্ষিণি পুরুষো দৃশ্যত এষ আত্মেতি হোবাচৈতদমৃতমভয়মেতদ্ ব্রহ্ম এতৎ ইতি…

চক্ষুতে এই যে পুরুষ দেখা যায় , ইনিই আত্মা। 

অর্থাৎ প্রজাপতি বলতে চাইলেন , এই চক্ষুর পিছনে যিনি আছেন , যাঁর প্রভাবে কেবল চক্ষু নয় ,বরং সকল ইন্দ্রিয় কাজ করেন তিনিই হলেন আত্মা। তিনি বললেন – এই আত্মা অমর , অভয়। ইনিই ব্রহ্ম। ” 

কিন্তু যাঁদের মন শুদ্ধ না হয় তাঁর সর্বোচ্চ জ্ঞানলাভের অধিকারী নন। ইন্দ্র ও বিরোচন একত্রে প্রজাপতির আশ্রমে অবস্থান করে বত্রিশ বৎসর ব্রহ্মচর্য পালন করেছেন। তাতে তাঁদের মনের মলিনতা বেশ দূর হয়ে গেছে। কিন্তু তা সর্বোচ্চ জ্ঞানলাভের জন্য যথেষ্ট ছিল না।  তাই প্রজাপতির প্রথম বাক্যজ্ঞান তাঁরা উপলব্ধিই করতে পারলেন না। অর্থ কি বুঝতে উঠতে পারলেন। তাই তাঁরা জিজ্ঞাসা করলেন  – ” ভগবান , জলে যাঁকে দেখা যায় এবং দর্পণে যাঁকে দেখা যায় এর মধ্যে কোনটি আত্মা ?”  

অন্ধকার সন্ধ্যার আকাশে

        বিজন তারার মাঝে কাঁপিছে যেমন

        স্বর্গের আলোকময় রহস্য অসীম,

                  ওই নয়নের

        নিবিড় তিমির তলে, কাঁপিছে তেমনি

             আত্মার রহস্য-শিখা।

                তাই চেয়ে আছি।

ইন্দ্র ও বিরোচন ভাবলেন, কারোর মুখোমুখি দাঁড়ালে অপরজনের চোখের মধ্যে নিজের যে প্রতিবিম্ব পড়ছে , সেই প্রতিবিম্বকেই প্রজাপতি আত্মা বলছেন। ছায়া, প্রতিবিম্ব কে আত্মা তাহলে? 

প্রজাপতি স্মিত হাস্যে উত্তর দিলেন , ” আত্মা সকল কিছুর মধ্যে আছেন…!”

খুঁজিতেছি, কোথা তুমি,

                  কোথা তুমি।

             যে অমৃত লুকানো তোমায়

                  সে কোথায়।

তবে কি প্রজাপতি ব্রহ্মজ্ঞান দিতে চান না ? তিনি কি কেবল তাঁর শিষ্যদের বিভ্রান্ত করতে চাইছেন? না কখনোই নয়। শঙ্করভাষ্যে বলা হচ্ছে –  আত্মা সত্য, সত্য সর্বত্র এবং সব কিছুর মধ্যে রয়েছেন। কেবলমাত্র আমাকে তোমাকে অনুসন্ধান করে বড় করতে হবে। ইন্দ্র ও বিরোচন প্রজাপতি ব্রহ্মার বাকি আক্ষরিক অর্থে নিলেন। তাই তাঁরা ভুল বুঝলেন। প্রজাপতির উদ্দেশ্য ছিল যে শিক্ষার্থীরা তাঁকে প্রশ্ন করুন, প্রশ্ন , উত্তর , তর্ক বিতর্কের , বিচারবুদ্ধির সংঘাত মন্থনেই তো সেই অমৃত জ্ঞান লাভ করা সম্ভব। তিনি বুঝলেন ইন্দ্র ও বিরোচনের ব্রহ্মজ্ঞান লাভের সময় হয় নি। তাঁরা এখনো সর্বোচ্চ জ্ঞান লাভের জন্য প্রস্তুত নন। আরও কিছুকাল কঠোর ব্রহ্মচর্য পালন আবশ্যক।

তোমার বদনব্যাপী

                  করুণ শান্তির তলে

          তোমারে কোথায় পাব–

                  তাই এ ক্রন্দন।

                  বৃথা এ ক্রন্দন।

তাই তো রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন – “সর্বলোকে আপনাকে পরিকীর্ণ করা আত্মার ধর্ম– পরমাত্মারও সেই ধর্ম। তাঁর সেই ধর্ম পরিপূর্ণ, কেননা, তিনি শুদ্ধং অপাপবিদ্ধং। তিনি নির্বিকার, তাঁতে পাপের কোনো বাধা নেই। সেইজন্যে সর্বত্রই তাঁর প্রবেশ।

পাপের বন্ধন মোচন করলে আমাদেরও প্রবেশ অব্যাহত হবে। তখন আমরা কী হব? পরমাত্মার মতো সেই স্বরূপটি লাভ করব, যে স্বরূপে তিনি কবি, মনীষী, প্রভু, স্বয়ম্ভু। আমরাও আনন্দময় কবি হব, মনের অধীশ্বর হব, দাসত্ব থেকে মুক্ত হব, আপন নির্মল আলোকে আপনি প্রকাশিত হব। তখন আত্মা সমস্ত চিন্তায় বাক্যে কর্মে আপনাকে শান্তম্‌ শিবম্‌ অদ্বৈতম্‌-রূপে প্রকাশ করবে– আপনাকে ক্ষুব্ধ করে লুব্ধ করে লুব্ধ করে খণ্ডবিখণ্ডিত করে দেখাবে না।”

আচ্ছা তারপর কি হল? ইন্দ্র ও বিরোচন কি ব্রহ্মজ্ঞান পেলেন? 

ক্রমশঃ

©দুর্গেশনন্দিনী

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.