দীর্ঘ জীবনপথ, কত দুঃখতাপ, কত শোকদহন–

          গেয়ে চলি তবু তাঁর করুণার গান ॥

খুলে রেখেছেন তাঁর    অমৃতভবনদ্বার–

শ্রান্তি ঘুচিবে, অশ্রু মুছিবে, এ পথের হবে অবসান ॥

অনন্তের পানে চাহি   আনন্দের গান গাহি–

          ক্ষুদ্র শোকতাপ নাহি নাহি রে।

অনন্ত আলয় যার   কিসের ভাবনা তার–

          নিমেষের তুচ্ছ ভারে হব না রে ম্রিয়মাণ ॥

ইন্দ্র পুনরায় প্রজাপতি আশ্রমে ফিরে এসে প্রজাপতির নির্দেশে পঞ্চ বৎসরের কঠোর ব্রহ্মচর্য পালন করলেন। তারপর এক শারদ স্নিগ্ধপ্রাতে ব্রহ্মা ইন্দ্রকে ডেকে বললেন , “হে মঘবন্ আজ আমি তোমাকে আজ আমি তোমাকে সেই পরম জ্ঞান দানের সূচনা করব। এত বৎসরের কঠোর তপস্যায় তুমি সংযমের চরম পর্যায়ে উন্নীত হয়েছ। আজ শারদ প্রাতের শুভক্ষণে তোমাকে আজ আমার সেই পরম জ্ঞান দান করছি। “

মঘবন্মতং বা ইদং শরীরমাত্তং মৃত্যুনা তদস্যামৃতস্যাশরীর- স্যাত্মনোংধিষ্ঠান মাত্তো বৈ সশরীরঃ প্রিয়াপ্রিয়াভ্যাং ন বৈ সশরীরস্য সতঃ প্রিয়াপ্রিয়য়োরপহতিরস্ত্যশরীরং বাব সপ্তং ন প্রিয়াপ্রিয়ে স্পৃশতঃ ।।

প্রজাপতি বললেন, হে ইন্দ্র এই যে দেহ , এই দেহ মরণশীল। এই দেহের মৃত্যু ঘটবেই । কিন্তু তবুও যে এই দেহে আত্মার অধিষ্ঠান।যে আত্মা অমর ও নিরাকার। যার দেহ আছে তার সুখ দুঃখ আছে। যতক্ষণ দেহ আছে ততক্ষণ সুখ দুঃখের বিরাম নেই। যিনি দেহের ঊর্ধ্বে , তাঁকে কোনো সুখ দুঃখ স্পর্শ করতে পারে না। 

তাই তো কুরুক্ষেত্র যুদ্ধপ্রান্তে শ্রীকৃষ্ণ পার্থকে বলছেন  – 

জাতস্য হি ধ্রুবো মৃত্যুর্ধ্রুবং জন্ম মৃতস্য চ ।

তস্মাদপরিহার্যেহর্থে ন ত্বং শোচিতুমর্হসি ।।

জন্মগ্রহণ করলে মৃত্যু অবশ্যম্ভাবী। মৃত্যুর হাত হতে পরিত্রাণ লাভের উপায় নাই। মৃত্যু কাহাকেও উপেক্ষা করে না। অগণ্য গণ্য পরিবেষ্টিত লোক সংহারকারী বিবিধ অস্ত্র-শস্ত্র সমন্বিত সম্রাট হতে বৃক্ষতলবাশী ছিন্নকন্তা-সম্বল ভিখারী পর্যন্ত সকলকেই একদিন মৃত্যুমুখে পতিত হতে হবে।কর্ম্মক্ষেত্রে সংসারের কোন কার্য্যের বা কোন বিষয়ের স্থিরতা ও নিশ্চয়তা নাই; কিন্তু মৃত্যু নিশ্চয়ই হবে। মৃত্যুর মত অবশ্যম্ভাবী নিশ্চয়তা আর কিছুতেই নাই। প্রাতঃ কালে সূর্য্যদয় হলে সূর্য্যাস্ত যেমন অবশ্যম্ভাবী; দিবা অবসানে রাত্রি যেমন নিত্য সংঘটিত হতেছে, তেমনি জন্মগ্রহণ করলে মৃত্যু হবেই। শারীরিক বলবীর্য, ধন-জন, সম্পদ, মান, গৌরব, প্রতাপ ও প্রভূত্ব প্রভৃতি সর্ব গর্ব মৃত্যুর নিকট খর্ব্ব হবে। 

তাই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছেন “মরণ রে, তুঁহুঁ মম শ্যামসমান।/মেঘবরণ তুঝ, মেঘজটাজুট,/রক্ত কমলকর, রক্ত অধরপুট/ তাপবিমোচন করুণ কোর তব/মৃত্যু অমৃত করে দান’। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর জীবনের প্রথম প্রভাতে দাঁড়িয়ে মৃত্যুকে অমৃতের স্বরূপ বলেই আহ্বান করেছিলেন ভানুসিংহ ঠাকুরের পদাবলীতে ‘মরণ’ কবিতায়।

প্রজাপতি ইন্দ্রকে আত্মার স্বরূপ ব্যাখ্যা করতে শুরু করলেন। আত্মা নিরাকার, তাঁর কোনো রূপ নেই। অথচ যে কোনো কারণেই আমরা এই আত্মাকে দেহ বলে মনে করি। কেন ? এর কারণ অজ্ঞানতা। কিন্তু আত্মা তো শুদ্ধ চৈতন্যস্বরূপ , জ্ঞান স্বরূপ। তাহলে এই অজ্ঞানতা কোথা হতে এল? আলো ও অন্ধকার কি তাহলে একসঙ্গে থাকে? ঠিক তেমনই জ্ঞান ও অজ্ঞানের সহাবস্থান কি সম্ভব ? 

বস্তুতঃ , আত্মায় কোনো অজ্ঞানতা নেই। কিন্তু যেকোনো কারণেই হোক , দেহহীন আত্মা নিজেকে দেহের সঙ্গে অভিন্ন বলে মনে করে। যেমন , পৃথিবীর একদিকে প্রভাত হয় অন্য দিকে রাত্রি। একই পৃথিবীর একই সূর্য দুইদিকে দুইভাবে অবস্থান করেন। দেহের সুখ দুঃখকে নিজের বলে মনে করে।দেহ জন্মালে মনে করে আমি জন্মেছি। আবার দেহ যখন মারা যায় মনে করে আমারও মৃত্যু হয়েছে। কিন্তু বেদান্ত বলেন , এই অজ্ঞানতা সাময়িক। একে মুছে ফেলা যায়। ঠিক যেমন করে প্রদীপের নীচে অন্ধকারটুকুকে ঈশ্বরের কাছে উৎসর্গ করে পবিত্র করে তোলা হয় , সেই ভাবেই। 

বেদ, বেদান্ত , তন্ত্র এই অজ্ঞানতাকেই বলছেন #মায়া। অনেকসময় মায়া শব্দের অর্থ করা হয় অলীক। স্বামী বিবেকানন্দ বলেছেন , ” বাস্তবে যা ঘটছে ” তাই মায়া। Statement of fact.  মায়া অস্তিত্ব বিহীন একথা যেমন বলা যায় না , তেমনি মায়ার স্বরূপ কি তাও বোঝা যায় না। মায়া অনির্বচনীয়া। 

স বিদ্যা পরমা মুক্তের্হেতুভূতা সনাতনী।

সংসারবন্ধহেতুশচ সৈব সর্ব্বশ্বরেশ্বরী ।।

 তথ্যটি মার্কণ্ডেয়পুরাণে এই তত্ত্বটি বিষদরূপে বিবৃত হয়েছে।  প্রথমোক্ত শ্লোক সেই কথাই প্রমান করে। উক্ত শ্লোকের অর্থ হল  – সেই সনাতনী পরমবিদ্যা রূপে মুক্তির হেতুভূতা। আবার সেই  সর্ব্বেশ্বরেশ্বরীই মায়া হয়ে সংসার বন্ধনে সাহায্য করেন।

তন্নাত্র বিস্ময়ঃ কার্যো যোগনিদ্রা জগৎপতেঃ।

মহামায়া হরেশ্চৈতত্তয়া সম্মোহ‍্য‍তে জগৎ।।

মহামায়া হলেন স্বয়ং যোগনিদ্রা স্বরূপিণী । সূতরাং , তিনিই আদি শক্তি এবং তিনিই জগৎমোহন হবে না তাতে বিস্ময় নেই। মার্কণ্ডেয়পুরাণ এবং চন্ডীতে বহুবার তিনিই বৈষ্ণবীরূপে কথিতা হয়েছেন। চন্ডীর ত্রয়োদশ অধ্যায় তাঁকে বিষ্ণুমায়া বলে উল্লেখ করেছেন। 

বেদের দেবী সূক্ত বা বাক্ সূক্তে উল্লিখিত হয়েছে :

অহং সুবে পিতারমস্য মূর্ধ্বন্মম যোনি রপ্‌স্বন্তঃ সমুদ্রে।

ততো বিতিষ্ঠে ভুবনানি বিশ্বোতামূন্দ্যাং বর্ষ্মণোপস্পৃশামি।।

অর্থাৎ, এই বিশ্বের উপরিভাগের দ্যুলোককে আমিই প্রসব করে থাকি। দিব্য কারণ বারি রূপ সমুদ্রে, যেখানে সমস্ত প্রাণীর উদয় ও বিলোপ হয়, সেই ব্রহ্মচৈতন্য আমার নিবাসস্থল। সর্বভূতে আমি প্রবিষ্ট এবং বিশ্বকে আমি নিজের মায়া দ্বারা স্পর্শ করে আছি।

শ্রীমদ্ভগবদ্গীতায় তিনি মায়া এবং যোগমায়া নামে অভিহিত হয়েছেন। সেখানে কৃষ্ণ পার্থকে বলছেন –

 দৈবী হ্যেষা গুণময়ী মম মায়া দুরত্যয়া। 

মামেব যে প্রপদ্যন্তে মায়ামেতাং তরন্তি তে।।

অর্থাৎ , মায়া যখন অবিদ্যা তখন সেই দৈবী মায়া ত্রিগুণাত্মিকা এবং তা দুরতিক্রমণীয়া। কিন্তু যাঁরা আমাতে প্রপত্তি করেন, তাঁরাই এই মায়া উত্তীর্ণ হতে পারেন। 

এই মহামায়ার সংসারে জাগতিক চাওয়া পাওয়া , দুঃখ যন্ত্রনা হতে মুক্তি পেয়ে বিদ্যারূপী পরম ব্রহ্মস্বরূপ , যোগ স্বরূপ মায়াকে প্রাপ্ত হবার নিমিত্ত সকল জাগতিক চাহিদা পরিত্যাগ করে আমার স্মরণ নাও। মায়ার সংসারে জীবকুল জাগতিক বিষয় বন্ধনে আবদ্ধ থেকে তাই আমি তাঁদের গোচর হই না। মূঢ় লোকে তাই আমাকে অজ ও অব্যয় বলে জানতে পারেন না।  চন্ডীতে আদি পরাশক্তি মহামায়া এবং শ্রীমদ্ভগবদ্গীতায় তিনিই বিষ্ণুমায়া, যোগমায়া এবং মহামায়া হিসাবে অবস্থান করছেন।

মায়ার কার্য হল #বিমুখমোহন ।  আর মহামায়া বা বিদ্যার কাজ হল #উম্নুখমোহন। শ্রীভগবানের শক্তিগণকে , তাঁর পরিকরগণকে , এমন কি স্বয়ং ভগবানকে মুগ্ধ করতে একমাত্র সেই আদি শক্তি মহামায়া যোগমায়াই সমর্থা। এই মুগ্ধতাই হল লীলা। এই মুগ্ধতা তিনি স্বেচ্ছায় স্বীকার করে নিয়েছিলেন।

শ্বেতাশ্বর উপনিষদে মায়া প্রকৃতি নামে অভিহিতা হয়েছেন। 

মায়াং তু প্রকৃতিং বিদ্যান্মায়িনং তু মহেশ্বরম্।

ঈশোপনিষদে অবিদ্যা ও বিদ্যা এই দুই নামে সেই মায়াকে পাওয়া যায়।

বিদ্যাঞ্চাবিদ্যাঞ্চ যস্তদ্‌বেদোভয়ং সহ

অবিদ্যয়া মৃত্যুং তীর্‌ত্বা বিদ্যয়ামৃতমশ্নুতে।

বিদ্যা এবং অবিদ্যা উভয়কে যিনি একত্র করে জানেন তিনি অবিদ্যা অর্থাৎ কর্ম্ম-দ্বারা মৃত্যু হতে উত্তীর্ণ হয়ে ব্রহ্মলাভের দ্বারা অমৃত প্রাপ্ত হন।

এইটিই সংসারধর্ম্মের মূলমন্ত্র — কর্ম্ম এবং ব্রহ্ম, জীবনে উভয়ের সামঞ্জস্য-সাধন। কর্ম্মের দ্বারা আমরা ব্রহ্মের অভ্রভেদী মন্দির নির্ম্মাণ করতে থাকবে।  তিনি সেই মন্দির পরিপূর্ণ করে বিরাজ করতে থাকবেন।  বিদ্যা ও অবিদ্যা উভয়েই যুগপৎ জানতে বলেছেন। অবিদ্যাকে জানলে সংসারবন্ধন ঘটবে না। তার দ্বারা মৃত্যুকে উত্তীর্ণ হয়ে বিদ্যার দ্বারা অমৃতত্ত্ব লাভ করতে হবে। ঈশোপনিষদ্ অবিদ্যা ও বিদ্যা, সম্ভূতি ও অসম্ভূতি পৃথক নয় একত্রে উপাসনার কথা বলেন। উভয়কেই একত্রে জানতে হয় তবে মুক্তি ঘটে।

যোগমায়া আদি পরাশক্তি , ব্রহ্মময়ী ।

যঃ কৃষ্ণঃ সৈব দুর্গা স্যাৎ যা দুর্গা কৃষ্ণ এব সঃ।

অনয়োরন্তরাদর্শী সংসারোন্নো বিমুচ্যতে।।

 ব্রহ্মসংহিতায় বলা হয়েছে –

মায়য়া রমমাণস্য ন বিয়োগস্তয়া সহ।

আত্মনা রময়া রেমে ত্যক্তকালং সিসৃক্ষয়া।।

মায়ার সংসারে তাঁর বিয়োগ নাই। তাঁর ইচ্ছায় বারবার প্রলয় ও সৃষ্টি। শূন্য ও মায়া একত্রে তা সম্পাদন করছেন প্রতি নিয়ত। শূন্যের সঙ্গে রমা নিয়ত বিহারশীল তাই রমার অপর নাম নিয়তি। 

নিয়তিঃ স রমা দেবী তং প্রিয়া তদ্বশং সদা।

ব্রহ্মসংহিতায় বলা হয়েছে –

এবং জ্যোতির্মময়ো দেবঃ সদানন্দঃ পরাৎপরঃ।

আত্মারামস্য তস্যাস্তি প্রকৃত্যা ন সমাগমঃ।।

তিনিই প্রকৃতি , আবার তিনি প্রকৃতি হতে নির্লিপ্ত । তিনি ও প্রকৃতি একই আবার এক হয়েও এক নয়। কালিকা পুরাণ ষষ্ঠ অধ্যায় বিষ্ণুমায়া ও মহামায়া  আদি শক্তির অংশ স্বরূপা। যিনি যোগীগণের মন্ত্র মর্ম্মোদঘাটনে তৎপরা , পরমানন্দ স্বরূপা, সত্ত্ব বিদ্যা – তাঁকেই জগন্ময়ী বলা হয়। ইনি বিষ্ণুমায়া নামে বলে অভিহিত হন। আর যিনি জীবকে ওই সংসার বন্ধনে আবদ্ধ রাখেন, মহাকালের চক্রের নিয়মে রেখে পরিচালনা করে সৃষ্টি করে সৃষ্টিকে রক্ষা করেন তিনি মহামায়া। 

দার্শনিকগন এই মায়াকে অঘটন পটিয়সী বলে উল্লেখ করেছেন। তাই শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা আলোচনার জন্য যোগমায়া তত্ত্ব জানা আবশ্যক। এই রহস্য জানতে হলে প্রসন্ন অন্তঃকরণে সাধনা আবশ্যক। পূর্ব্বাচার্যগনের পদাঙ্ক অনুসরণ পূর্বক তাদের বাণী রূপে গ্রহণ আবশ্যক। 

 দৈবী হ্যেষা গুণময়ী মম মায়া দুরত্যয়া। 

মামেব যে প্রপদ্যন্তে মায়ামেতাং তরন্তি তে।

এই মায়া কিভাবে কাজ করেন? তার ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে আচার্য শঙ্কর রজ্জুসর্পের দৃষ্টান্ত দিয়েছেন। ধরা যাক, অন্ধকার রাত্রে তুমি রাস্তা দিয়ে হেঁটে চলেছ। হঠাৎ দেখছ সামনে একটা সাপ শুয়ে আছে। তুমি ভ্যবপেয়ে গেছ। চিৎকার করে সাপ , সাপ বলে ছুটে যাচ্ছ উল্টো দিকে। চারপাশের লোকজন এসব শুনে বাইরে আলো নিয়ে , লাঠি নিয়ে বেরিয়ে এল। তারপর পথের উপর আলো ফেলে দেখল , ওমা সাপ কোথায়? ও তো দড়ি! 

আরো একটা দৃষ্টান্ত দিচ্ছি – মরীচিকা। ধর, তুমি মরুভূমি দিয়ে হেঁটে চলেছ । তুমি মরুতাপে, সূর্যের দারুন অগ্নিবানে দগ্ধ হয়ে ক্লান্ত, শ্রান্ত, তৃষ্ণার্ত। তুমি প্রখর রৌদ্রের মধ্যে মরুভূমিতে দূর দূ উ উ উ রে একটি জলাশয় দেখতে পেলে। তুমি উন্মাদের ন্যায় সেদিকে ছুটলে। কিন্তু একি ছুটে গিয়ে দেখলে সবই তো উত্তপ্ত বলুকা। জল যে আরোও ওওও অনেক দূরে সরে গেছে।  তুমি কিছুতেই কিছুতেই জলাশয় পর্যন্ত পৌঁছতে পারছ না। যখন তুমি মরুবালুকায় নিঃশেষ হয়ে পড়ে যাচ্ছ তখন তুমি বুঝতে পারছ , ওটা মরীচিকা। 

মায়া এমনই। তবে আমায় দুই প্রকার বলেছি। তাই বলতে পার অবিদ্যা স্বরূপ মায়া এমন। এই মায়াই তোমাকে সংসার জালে আবদ্ধ রেখে মরীচিকার লোভ দেখিয়ে ছুটিয়ে মারে। যদি মুক্তি পেতে চাও তবে সংসার ধর্মের মধ্যেও তোমাকে বিদ্যা স্বরূপ মহামায়ার সন্ধান করতে হবে।

অবিদ্যা স্বরূপ মায়া অনেকটা শুক্তিতে রজতভ্রমের ন্যায়। সমুদ্রতটের বালুকা বেলায় কত ঝিনুক পড়ে থাকে। চকচক করে। দেখে মনে হয় রূপো। কিন্তু ও প্রাণী দেহের অবশিষ্ট অংশ ব্যতীত কিছু নয়। মৃত ঝিনুক তোমাকে তোমার দেহের, গৃহের সৌন্দর্য দিতে পারে কিন্তু রূপোর মূল্য দিতে পারবে না। ঠিক অবিদ্যা স্বরূপ মায়াও এমন । রূপো হতে পারবে না। বালিকে জলে পরিণত করতে পারবে না। তার জন্য তোমাকে বিদ্যা স্বরূপ মায়ার আশ্রয়ে যেতে হবে। তোমাকে পরিশ্রম করতে হবে। মুরভূমির বালি খুঁড়ে জল বের করতে হবে , দিক নির্ণয় করে চলতে হবে যাতে তুমি মরুদ্যানের সন্ধান পাও। বালুকার মাঝে পড়ে থাকা শুক্তি খুলে মুক্তের সন্ধান করতে হবে। তবে তো তোমার প্রাপ্তি স্বার্থক হবে। 

এই অবিদ্যা স্বরূপ মায়ার আবার দুটো দিক – আবরণ  এবং বিক্ষেপ। আবরণ কথার অর্থ হল যে আড়াল করে রাখে। যেমন , সর্প ভ্রম যেমন অন্ধকারে দড়ির প্রকৃত স্বরূপকে আড়াল করে রাখে। বিক্ষেপ শব্দের অর্থ জল যা আরোপ করা নয়। দড়িকে সর্পভ্রম, মরুবালুকাকে মরুদ্যান ভ্রম, শুক্তিকে রৌপ্য ভ্রম….। একে অধ্যাস বা আরোপ মানে ইংরেজিতে যাকে super imposition বলে। 

বেদান্ত বলেন , এমন সব অজ্ঞতা সাময়িক। আলো এলে ভ্রম কেটে যায়। তখন রজ্জুকে সর্পভ্রম হয় না। লড়াই করলে মরুদ্যানের সন্ধান বা জলের সন্ধান ঠিক পাওয়া যায়, মরীচিকা তখন হেরে যায়। শুক্তি ভেঙে খুঁজলে রূপোভ্রম ভেঙে মুক্ত খুঁজে পাওয়া যায়। ঠিক তেমনই , জ্ঞানের আলোক ফুটে উঠলে আমরা নিজেদের প্রকৃত স্বরূপ বুঝতে পারি। তখন এই দেহকে আর আমি বলে ভুল হয় না।

তাই রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন – 

একি মায়া,   লুকাও কায়া   জীর্ণ শীতের সাজে।

আমার   সয় না,   সয় না,   সয় না প্রাণে, কিছুতে সয় না যে॥

     কৃপণ হয়ে হে মহারাজ,   রইবে কি আজ

                   আপন ভুবন-মাঝে॥

     বুঝতে নারি বনের বীণা   তোমার প্রসাদ পাবে কিনা,

     হিমের হাওয়ায় গগন-ভরা ব্যাকুল রোদন বাজে॥

     কেন     মরুর পারে কাটাও বেলা রসের কাণ্ডারী।

              লুকিয়ে আছে কোথায় তোমার রূপের ভাণ্ডারী।

     রিক্তপাতা শুষ্ক শাখে   কোকিল তোমার কই গো ডাকে–

              শূন্য সভা, মৌন বাণী, আমরা মরি লাজে॥

ক্রমশঃ

©দুর্গেশনন্দিনী

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.