জানো তো অসুর কারা ? দিতি , দনুর পুত্ররাই কেবলমাত্র অসুর নয়। অসুর একটা স্বভাব, অসুর একটা মানসিক অবস্থা। তাই সুর গুণযুক্ত ব্যক্তি যেমন অসুর কুলে ছিলেন , তেমন অসুর গুণযুক্ত ব্যক্তি সুর কুলে ছিলেন। উপনিষদ্ বলছেন, যাঁরা সংযমে বিশ্বাস করেন না তাঁরাই অসুর হন।
উপনিষদ্ বলছেন , “তস্মাদ পাদ্যেহাদদানমশ্রদধানমযজমানমাহুরাসুরে। বত্তেতাসুরাপাত হোষোপনিষৎ যে তস্য শরীরং ভিক্ষয়া বসনেনালঙ্কারেণেতি সংস্কৃর্বজোতেন হামুং লোকং জেষ্যন্তো মন্যতে ॥”
অর্থাৎ, পৃথিবীতে যিনি দান করেন না , অপরকে শ্রদ্ধা করেন না , যজ্ঞ করেন না , তাঁদের বলা হয় ” ওঃ কি অসুর স্বভাব। ” কারণ যিনি অসুর হন , তিনি দেহকেই আত্মা বলে মনে করেন। তাই মৃতদেহ কে নগ্নভাবে সৎকার করেন না। তাকে নানা অলঙ্কারে সজ্জিত করেন, নব বস্ত্র, সুগন্ধি দেন। তাঁরা ভাবেন এইসব জাগতিক বস্তু দ্বারাই মৃত ব্যক্তি পরলোক জয় করবে।
অসুর স্বভাব যাঁরা , তাঁদের আগ্রহ কেবল ইন্দ্রিয়সুখের কাছে। যা স্থূল , যা ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য, যা চোখের সামনে আছে তার বাইরে কোনো কিছুর অস্তিত্ব তাঁরা স্বীকার করেন না। তাঁরা ঈশ্বরের প্রতি আস্থাবান নন। কোনো উচ্চচিন্তা তাঁদের মনে স্থান পায় না। এঁরা স্বার্থপর , কাউকে কোনো কিছু দিতে শেখেননি। এঁদের না আছে কোনো উচ্চ আদর্শে বিশ্বাস, না আছে কোনো ভালো জিনিসে শ্রদ্ধা – তা সে ভালো মানুষ , বা ভালো কাজ যাই হোক। ত্যাগ , স্বাত্তিকতা এসকল এঁদের নিকট হাস্যকর বিষয়। এঁদের ভাব হল ” আমি আমার জিনিস ভোগ করব। অন্য কারুর সাথে ভাগাভাগি করব কেন?”
এঁদের জীবনের উদ্দেশ্য কি , আদর্শ কি? এঁদের সকল চিন্তা দেহকে কেন্দ্র করে- দেহসর্বস্ব। মৃত্যুর পরেও মৃত ব্যক্তির দেহকে নানা উপকরণে সাজিয়ে দেন। ফুল , মালা নয় বরং স্বর্ণরত্ন অলঙ্কার, রেশম বস্ত্র, গন্ধদ্রব্য, খাদ্য, ব্যবহৃত দ্রব্য, এমনকি প্রিয় দাসদাসী কিছুই বাদ যায় না। মৃতদেহকে সুসজ্জিত করে তাঁকে ঔষধের মাধ্যমে সংরক্ষণ করতেও এঁরা কোনো ত্রুটি করে না। তাঁদের নিকট মৃতদেহ কত সুন্দর। এঁরা বিশ্বাস করেন যে মৃতদেহকে রাজার সাজে সাজিয়ে দিলে তিনি মৃত্যুর পরেও পরলোক জয় করবেন। স্বর্গের দেবদেবীরা তাঁকে শাসক পদে বরণ করে নেবেন।
যেমন – প্রাচীন মিশর….. । প্রাচীন মিশর বা উর দেশের রাজারা মারা গেলে তাদের দেহ সংরক্ষণ করা হতো বিভিন্ন প্রকার শল্যক্রিয়ার মাধ্যমে , নানা প্রকার ভেষজ মলম ব্যবহার করে। সেই সঙ্গে রাজার ভৃত্য অনুচরদেরকেও ওই সমাধিতে প্রবেশ করানো হতো যাতে তাঁরা অনন্তকাল ধরে রাজার সেবা করতে পারেন। সঙ্গে দেওয়া হতো খাদ্য, রাজার ব্যবহৃত এবং ব্যবহার করতে পারবেন এরকম সকল জাগতিক বস্তু। উর দেশ মিশরের মতোই , বলতে গেলে আরও অদ্ভুত পদ্ধতি অবলম্বন করত। উর প্রাচীন মেসোপটেমিয়ার দক্ষিণাঞ্চলের একটি দেশ ছিল। এটি পারস্য উপসাগরে ইউফ্রেটিস ও টাইগ্রিস নদী দ্বয়ের আদি মোহনার কাছে অবস্থিত। এর কাছেই ছিল এরিদু শহর। সমুদ্র সরে যাওয়াতে বর্তমানে এর অবস্থানের জায়গাটি উপকূল হতে বেশ দূরে অবস্থিত। এটি বর্তমান ইরাকের ইউফ্রেটিস নদীর দক্ষিণ পারে বাগদাদের দক্ষিণে নাসিরিয়ার কাছে অবস্থিত। এর বর্তমান নাম তেল এল-মুকায়ার।
উর শহরের অবস্থানের স্থানটিতে একটি জিগুরাত বা উপাসনালয়ের ধ্বংসাবশেষ পাওয়া গেছে। এর পাশেই রয়েছে মানুষের আবাসস্থলের চিহ্ন। জিগুরাতটি ছিল নান্না অর্থাৎ সুমেরিয় উপকথায় বর্ণিত চন্দ্রদেবতার উদ্দেশ্যে নিবেদিত। এটি দুই স্তরে ইট দ্বারা নির্মিত। নিচের স্তরের ইটগুলি বিটুমেন বা পিচ দ্বারা যুক্ত, আর উপরের স্তরে চুন-সুরকি দ্বারা ইট গুলি গাঁথা হয়েছিল। উর এর স্বর্ণযুগে এই শহরে প্রায় ৩০,০০০ লোক বাস করত। তো এই উর দেশের কোনো রাজা মারা গেলে তার সঙ্গে সঙ্গে রাজার সকল কর্মচারী , প্রিয় মানুষ মায় মন্ত্রী , সেনাপতি সকলে বিষ খেয়ে আত্মহত্যা করতেন , যাতে তাঁরা রাজার সঙ্গে যেতে পারেন এবং দেবতাদের দেশে রাজার সঙ্গে রাজত্ব করতে পারেন।
কিন্তু সনাতনী মত, সনাতনী সভ্যতা কি বলেন? কি সেই সুপ্রাচীন হিন্দু মত? সেই মত বলে – ন জায়তে ম্রিয়তে বা কদাচিন্ নায়ং ভূত্বা ভবিতা বা ন ভূয়ঃ ।
অজো নিত্যঃ শাশ্বতোহয়ং পুরাণো
ন হন্যতে হন্যমানে শরীরে ॥
পরস্তস্মাত্তু ভাবোহন্যোহব্যক্তোহব্যক্তাৎ সনাতনঃ যঃ স সর্বেষু ভূতেষু নশাৎসু ন বিনশ্যতি ॥
তাহার উপরে যেই ভাবের নির্ণয় । সনাতন সেই ধাম অক্ষয় অব্যয় ॥ সকল সৃষ্টির নাশ এ জগতে হয় । সনাতন ধাম নহে হইবে প্রলয় ॥
এই দেহ নশ্বর কিন্তু আত্মা অবিনশ্বর। একজন মারা গেলে তার দেহ কিছু সময় অক্ষত থাকে। কিন্তু সেই দেহকে প্রশ্ন করলে উত্তর দেয় কি? তারপর সেই দেহ সৎকার না হলে বা দেরি হলে পরজীবী এসে আশ্রয় নেয় এবং দেহটি পচে গলে যায়। কারণ যে আত্মা সে সেই দেহ ত্যাগ করে চলে গেছে।
কিন্তু এই দেহের কি তবে কোনো গুরুত্ব নেই? উপনিষদ্ কি বলছেন ? উপনিষদ্ বলছেন না যে এই দেহটার কোনো গুরুত্ব নেই। কারণ এই দেহ না থাকলে আত্মজ্ঞান লাভ করব কি করে ? জাগতিক বা আধ্যাত্মিক যেকোন উন্নতির এই দেহটাই তো সব, প্রধান যন্ত্র। মুণ্ডক উপনিষদ্ বলছেন – ” নায়মাত্মা বলহীনেন লভ্যঃ। যাঁর দেহে বল আছে তিনিই সেই পরমাত্মাকে জানতে ও লাভ করতে পারেন। দুর্বল, অসুস্থ, জরাজীর্ণ দেহ নিয়ে লড়াই করা যায় না।
শ্রীকৃষ্ণ তাই কুরুক্ষেত্রে অর্জুনকে বলছেন – ক্লৈব্যং মাস্ম গমঃ , তিনি বলছেন – ‘ন বিকম্পিতুম্’ । ক্লৈব্য ও ভয় পরিহার কর। তবে তুমি জয়ী হবে। কঠোপনিষদের বীর্যবান ও শ্রদ্ধাবান নচিকেতার চরিত্র যেমন । পিতা ঋষি বাজশ্রবসের যজ্ঞকালে বালক নচিকেতার শ্রদ্ধার উদ্রেক হয়েছিল। স্বামিজী বলেছেন এই ‘শ্রদ্ধা’ শব্দটি বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। এখানে ‘শ্রদ্ধা’ বলতে বোঝায় সংকল্পসাধনে অবিচলিত নিষ্ঠা যা মানুষকে সহস্র প্রলোভন জয় করতে শিক্ষা দেয়, যে নিষ্ঠার ফলে মানুষ ধর্মের পথ থেকে, সত্যের পথ থেকে ভ্রষ্ট হয় না।
কঠোপনিষদের প্রথম অধ্যায়ের প্রথম বল্লীতে – মৃত্যুরাজ যম নচিকেতাকে তিনটি বর দিতে চেয়েছিলেন। নচিকেতা প্রথম দুটি বরে পিতার যজ্ঞত্রুটি থেকে ক্ষমালাভ ও স্বর্গলাভের সাধনভূত অগ্নিবিদ্যা প্রার্থনা করে সহজেই তা’ লাভ করলেন। তৃতীয় বরে নচিকেতা পরলোকের রহস্য জানতে চাইলেন-
যেয়ং প্রেতে বিচিকিৎসা মনুষ্যে অস্তীত্যেকে নায়মস্তীতি চৈকে।
এতদ্ বিদ্যামনুশিষ্টস্ত্বয়াহ্হং বরাণামেষ বরস্তৃতীয়ঃ।।
কেউ বলেন মৃত্যুর পর আত্মা থাকে, কেউ বলেন আত্মা থাকে না। পরলোক সম্বন্ধে মানুষের মনে এই যে সন্দেহ বিদ্যমান সেই আত্মার তত্ত্ব আমি সম্যক জানতে ইচ্ছা করি।
মৃত্যুরাজ যম নচিকেতার এই মহাজ্ঞান লাভের যোগ্যতা পরীক্ষা করার জন্য তাঁকে নানাভাবে প্রলুব্ধ করার চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু তত্ত্ব-জিজ্ঞাসু বালক কোনো প্রলোভনেই বিচ্যুত হলেন না। তখন যম তাঁকে বলেন –
অন্যৎ শ্রেয়োহ্ন্যদুতৈব প্রেয়স্তে উভে নানার্থে পুরুষং সিনীতঃ।
তয়োঃ শ্রেয় আদদানস্য সাধু ভবতি হীয়তেহ্র্থাদ্ য উ প্রেয়ো বৃণীতে।।
‘শ্রেয়’ অর্থাৎ কল্যাণকর বস্তু এবং ‘প্রেয়’ অর্থাৎ প্রীতিকর বস্তু এক নয়। শ্রেয়র প্রয়োজন মুক্তিলাভে, প্রেয়র প্রয়োজন ঐহিক সুখভোগে। যিনি শ্রেয়কে গ্রহণ করেন তাঁর কল্যাণ হয়, যিনি প্রেয়কে বরণ করেন তিনি পরমার্থ হতে বিচ্যুত হন।
যমরাজ বললেন ‘তুমি বালক হয়েও যে প্রেয়র পথকে পরিহার করে শ্রেয়র পথ বেছে নিয়েছ সে জন্য তুমি প্রশংসার যোগ্য’। তারপর যম নানাভাবে আত্মতত্ত্ব ও আত্মজ্ঞান লাভের উপায় বিবৃত করে বললেন- উত্তিষ্ঠত জাগ্রত প্রাপ্য বরান্ নিবোধত।
ক্ষুরস্য ধারা নিশিতা দূরত্যয়া
দুর্গং পথস্তৎ কবয়ো বদন্তি।।
উত্থিত হও, মোহনিদ্রা ত্যাগ করে জাগ্রত হও, শ্রেষ্ঠ আচার্যগণের সমীপে গমন করে আত্মতত্ত্ব জ্ঞাত হও; যাঁরা ক্রান্তদর্শী তাঁরা বলেন- আত্মজ্ঞানের পথ ক্ষুরধারের মতো দুর্গম, দূরতিক্রমণীয়।
স্বামিজী-প্রবর্তিত মাসিকপত্র ‘উদ্বোধন’-এর মটো ছিল ‘উত্তিষ্ঠত জাগ্রত প্রাপ্য বরান্নিবোধত’। স্বামিজী তাঁর অনেক বক্তৃতায় এই বচনটি উদ্ধৃত করে ইংরেজিতে এর ভাবানুবাদ করেছেন ‘Awake, arise and stop not till the goal is reached’ – জাগো, উঠে দাঁড়াও এবং লক্ষ্যে না পৌঁছান পর্যন্ত থেমো না।
শ্বেতাশ্বতর উপনিষদে ঋষি মানুষকে অমৃতের পুত্র বলে সম্বোধন করে বলেছেন ‘শৃন্বন্তু বিশ্বে অমৃতস্য পুত্রাঃ’(শ্বেতাশ্বতর-২/৫)। বলেছেন মৃত্যুকে অতিক্রম করার পন্থা- ‘বেদাহ্মেতং পুরুষং মহান্তম্ আদিত্যবর্ণং তমসঃ পরস্তাৎ। তমেব বিদিত্বাহ্তি মৃত্যুমেতি নান্যঃ পন্থা বিদ্যতেহ্য়নায়।।’ (শ্বেতাশ্বতর-৩/৮)। রবীন্দ্রনাথ এই দিব্যচেতনার শ্রুতিনন্দন অনুবাদ করেছেন ‘নৈবেদ্য’ কাব্যে-
‘শোনো বিশ্বজন,
শোনো অমৃতের পুত্র যত দেবগণ
দিব্যধামবাসী, আমি জেনেছি তাঁহারে,
মহান্ত পুরুষ যিনি আঁধারের পারে
জ্যোতির্ময়। তাঁরে জেনে, তাঁর পানে চাহি
মৃত্যুরে লঙ্ঘিতে পার, অন্য পথ নাহি’।
বৃহদারণ্যক উপনিষদে মৈত্রেয়ীর প্রতি যাজ্ঞবল্ক্যের উপদেশে অমৃতত্ব লাভের উপায় বর্ণিত হয়েছে। মৈত্রেয়ীর জিজ্ঞাসা ‘যেনাহং নামৃতা স্যাং কিমহং তেন কুর্যাং?’- যা দিয়ে অমরত্ব লাভ করতে পারব না, তা দিয়ে কি করব?(বৃহদারণ্যক-২/৪/৩)।,ওরিয় উত্তরে যাজ্ঞবল্ক্য বলেছিলেন ‘আত্মনস্তু কামায় সর্বং প্রিয়ং ভবতি’- সংসারে যা কিছু আমাদের প্রিয় তা আত্মার জন্যই(বৃহদারণ্যক-২/৪/৫)। জীবদেহ নশ্বর, জীবের আত্মা অবিনশ্বর। ঊনবিংশ শতকের ইংরেজ কবি লংফেলো লিখছেন – Dust thou art, to dust returnest was not spoken of the soul।
এই আত্মাকে জানতে হবে। আত্মজ্ঞানী জরামৃত্যু-জনিত শোক উত্তীর্ণ হয়ে অমৃতত্ব লাভ করেন, আত্মাতেই যাঁর আনন্দ তিনিই স্বাধীন – সম্পূর্ণরূপে অপরতন্ত্র(ছান্দোগ্য-৭/২৫/২)। মুণ্ডক উপনিষদে আত্মাকে বলা হয়েছে ‘আনন্দরূপমমৃতম্’(মুণ্ডক-২/২/৮)- আনন্দময় আত্মা অমৃতস্বরূপ। মাণ্ডুক্য উপনিষদে(মাণ্ডুক্য/২) বলা হয়েছে এই আত্মাই ব্রহ্ম(‘অয়মাত্মা ব্রহ্ম’)। শ্রবণ, মনন ও নিদিধ্যাসন বা নিশ্চিন্তরূপে ধ্যানের দ্বারাই আত্মাকে বা ব্রহ্মকে জানা যায়। এবং যিনি ব্রহ্মকে জানেন তিনি ব্রহ্মই হন- ‘যঃ ব্রহ্ম বেদ সঃ ব্রহ্মৈব ভবতি’(মুণ্ডক-৬৩)। অদ্বৈত বেদান্তরও সিদ্ধান্ত এই। স্বর্গ বা নরক ভোগ জীবের চরম গতি নয়। যা থেকে জীবের উদ্ভব সেই পরমব্রহ্মে লীন হওয়া জীবের পরম লক্ষ্য। বৃহদারণ্যক উপনিষদে যে জীবন্মুক্তিবাদ স্বীকৃত বৈদান্তিকগণও সেই জীবন্মুক্তির কথাই বলেছেন। স্বামিজীও এই ত্রিবিধ সাধনের দ্বারা আত্মোপলব্ধির কথা প্রচার করেছেন।
ঈশোপনিষদের প্রথম শ্লোকে রয়েছে-
‘ঈশা বাস্যমিদং সর্বং যৎ কিঞ্চ জগত্যাং জগৎ’
এই গতিশীল জগতের সব কিছুতে ঈশ্বর অভিব্যক্ত আছেন। বৃহদারণ্যক উপনিষদেও (২/৫/১৮) অদ্বৈতবাদের মূল সূত্রে রয়েছে-
‘নৈনেন কিঞ্চনানাবৃতং নৈনেন কিঞ্চনাসংবৃতম্’
এমন কিছু নেই যা ঈশ্বরের দ্বারা আবৃত নয়, এমন কিছু নেই যাতে ঈশ্বর অনুপ্রবিষ্ট নন। আত্মোপলব্ধির দ্বারাই ঈশ্বর উপলব্ধি হয়। মুণ্ডক উপনিষদে বলা হয়েছে ‘নায়মাত্মা বলহীনেন লভ্য’(মুণ্ডক-৩/২/৪)- বলহীন ব্যক্তি এই আত্মাকে লাভ করতে পারে না। ‘বল’ শব্দে শুধু শারীরিক বা মানসিক বল নয়, আত্মনিষ্ঠা এবং আত্মজ্ঞান লাভের জন্য একাগ্রতার দ্বারা যে বীর্য লাভ হয় তাকেই ‘বল’ আখ্যা দেওয়া হয়েছে। কেন উপনিষদেরও শ্রেষ্ঠ বাক্য ‘আত্মানাং বিন্দতে বীর্যং’(কেন-২/৪) – আত্মার জ্ঞান থেকে বীর্য লাভ হয়।
আরও একটা আখ্যান বলি – বুদ্ধদেব তখন বুদ্ধদেব হননি ; তিনি তপস্যা করে সিদ্ধিলাভ করতে চাইছেন । তখন তিনি সত্যজ্ঞান লাভের জন্য কঠোর তপস্যায় মগ্ন । দিনের পর দিন মাসের পর মাস কঠোর তপস্যায় , অনিদ্রায় , অনাহারে তাঁর শরীর শীর্ণ শুষ্ক হয়ে গেছে । তপস্যায় বসতে বড় কষ্ট। কোনো এক গোপ বালক একটি কুশের আসন রোজ জলে ভিজিয়ে দিয়ে যায়। তাতে বসলে কষ্ট একটু লাঘব হয়। এমন সময় একদিন তিনি নৈরঞ্জনা নদীতে স্নান করতে গেলেন । স্নান সেরে ফিরে আসার সময় তিনি শারীরিক দুর্বলতার জন্য মূর্ছিত হয়ে পড়লেন । এমন সময় তিনি দেখতে পেলেন । এক দেবপুরুষ সেতার বাজাচ্ছেন । তাঁর সেতারের তিনটি তার , প্রথম তারটি খুব শক্ত আর খুব টান করে বাঁধা । তৃতীয় তারটি খুব আলতো করে কোনো মতে দুপ্রান্ত বাঁধা আছে , এতে কোনো রকম টান নেই , ঝুলে পড়ে আছে । আর মাঝের তারটি না খুব টান করে বাঁধা , না খুব আলতো করে সুন্দরভাবে সুর দিয়ে বাঁধা । যে দেবপুরুষ সেই সেতার বাজাচ্ছেন । তিনি শুধু মাঝের তারটিতেই মধুর সুর তুলছেন ।
বুদ্ধ উঠে দাঁড়ালেন , বললেন – বুঝেছি এটাই জীবনের সত্য । আমাদের জীবন সেতারের তারের মতো । কঠোর তপস্যা করেও নয় , চরম ভোগ বিলাসে জবন এলিয়ে দিয়েও নয় , মাঝের পথ বা মধ্যপথ ( মঝঝিম পন্থা ) হল আসল পথ , সত্য লাভের উপায় । তখনি তিনি স্থির করলেন আর চরম কৃচ্ছ ধন নয় , পরিমিত আহার করে তপস্যা করতে হবে । কঙ্কালসার দেহ নিয়ে কিছু কাজ হবে না ।
এসব ভাবতে ভাবতে এক বট গাছের তলায় এসে বসে আছেন । নৈরঞ্জনা নদীর তীরে বন আর বনের এক প্রান্তে সেনানী নামে একটি গ্রাম । সেই গ্রামে নন্দিক নামে এক ধনী বণিক ছিলেন , সুজাতা ছিলেন তাঁর স্ত্রী । তাদের কোনো সন্তান ছিল না , তাই তারা ওই বনের বট গাছের তলায় বন – দেবতার কাছে মানত করেছিলেন যে , এঁদের সন্তান হলে তারা দেবতার পুজো দেবেন । তাদের সন্তান হয়েছিল , তাই সুজাতা সেই আনন্দে পূর্ণা নামে এক দাসীকে সঙ্গে নিয়ে দেবতার পুজো দিতে গিয়েছিলেন । আর পুজোর জন্য অন্য উপাচারের সঙ্গে পায়েস নিয়ে গিয়েছিলেন ।
দেবতার স্থানে গিয়ে সুজাতা দেখলেন যে বট গাছের তলায় দেবতার পুজো হয় , সেই গাছের তলায় এক সন্ন্যাসী বসে আছেন । সুজাতার মলে হল ইনি হয়তো সেই দেবতা , সন্ন্যাসীর রূপ ধরে বসে আছেন । সুজাতা পুজোর সেই পায়েস ভক্তি সহকারে সন্ন্যাসীকে নিবেদন করলেন । সন্ন্যাসী সেহ পায়েস গ্রহণ করলেন । আসলে এই পায়েস গ্রহণ তার সাধন পথের পরিবর্তনের সূচক , কঠোর কৃচ্ছ সাধনের পরিবর্তে মধ্যপথ গ্রহণের ইঙ্গিত । এই পায়েস মুছে দিল তার দীর্ঘ ছয় বছরের নিস্ফল কঠোর তপস্যা ।
পায়েস খেয়ে তিনি শরীরে বল পেলেন । সেখান থেকে উঠে তিনি নৈরনা নদীর তীর ধরে এগিয়ে চললেন । চলতে চলতে সন্ধ্যা নেমে এল । বৈশাখী পূর্ণিমার শুভ্র আলোকে তিনি এক অশ্বত্থ গাছের তলায় গিয়ে বসলেন । তিনি তপস্যায় বসলেন। তিনি তপোবলে মারের সাগর পাড়ি দিলেন।
ইহাসনে শুষ্যতু মে শরীরং
ত্বগস্থিমাংসং প্রলয়ঞ্চ যাতু
অপ্রাপ্য বোধিং বহুকল্পদূর্লভাং
নৈবাসনাৎ কায়মতশ্চলিষ্যতে।’
এই বল যাদের নেই, যাদের দুর্বল চিত্ত বিষয়-কামনা, সংসারের প্রলোভন দ্বারা বিক্ষিপ্ত তারা আত্মাকে লাভ করতে পারে না। স্বামী বিবেকানন্দ বলেছেন উপনিষদ আমাদের ‘অভীঃ’ বা অভয় মন্ত্রে দীক্ষা দিয়েছে। ‘অভীঃ’ মন্ত্রই স্বামিজী দিগ্দিগন্তে প্রচার করেছেন। তাঁর মতে ধর্ম-সাধনার প্রধান লক্ষণই হচ্ছে ভয়শূন্য হওয়া।
স্বামী বিবেকানন্দ উপনিষদের বাণীর উপর নূতন আলোকপাত করেছেন। তিনি শিখিয়েছেন- উপনিষদ বা বেদান্ত আমাদের শুধু প্রজ্ঞাবান করে না, বীর্যবান ও শক্তিমান করে তোলে। আর যিনি বৈদান্তিক, তিনিই যথার্থ কর্মযোগী হতে পারেন।
আমি মারের সাগর পাড়ি দেব গো
এই বিষম ঝড়ের বায়ে
আমার ভয়ভাঙা এই নায়ে
আমি মারের সাগর পাড়ি দেব গো
মাভৈঃ বাণীর ভরসা নিয়ে
ছেঁড়া পালে বুক ফুলিয়ে গো
তোমার ওই পারেতেই যাবে তরী
ওই পারেতেই যাবে তরী ছায়াবটের ছায়ে
পথ আমারে সেই দেখাবে যে আমারে চায়
আমি অভয় মনে ছাড়ব তরী, অভয় মনে ছাড়ব তরী
এই শুধু মোর দায় গো, এই শুধু মোর দায়
দিন ফুরালে, জানি জানি, পৌঁছে ঘাটে দেব আনি গো
আমার দুঃখদিনের রক্তকমল
দুঃখদিনের রক্তকমল তোমার করুণ পায়ে!
ক্রমশঃ
©দুর্গেশনন্দিনী