‘‘আমার মনে হয় জীবনানন্দ ঠিক ট্রাম দুর্ঘটনায় মারা যাননি। যদিও এই কথাটাই সর্বত্র বলা হয়ে থাকে, তথাপি আমার ধারণা তিনি আত্মহত্যা করেছেন।’’

লিখেছিলেন কবি সঞ্জয় ভট্টাচার্য। হাসপাতালে মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করতে থাকা মানুষটা তাঁর হাত ধরেই একটা কমলালেবু খেতে চেয়েছিলেন। আটদিন অপেক্ষার পর অবশেষে তাঁকে নিয়ে গিয়েছিল মৃত্যু। ২২ অক্টোবর, ১৯৫৪; বাংলায় ৫ কার্তিক। শম্ভুনাথ পণ্ডিত হাসপাতালের বাইরে তখন লুটোপুটি খাচ্ছিল চাঁদ। বাতাসে হিমের সঙ্গে ছাতিমের গন্ধ। অনতিদূরে, ময়দানে কার্তিকের জ্যোৎস্নায় মহীনের ঘোড়াগুলি হয়তো ঘাস খাচ্ছিল সেদিনও। আর, জীবনানন্দের নিথর শরীরটা দেখে এই মৃত্যুকে কিছুতেই স্বাভাবিক বলে মানতে পারছিলেন না সঞ্জয় ভট্টাচার্য। ভেবেছিলেন, অসুখী মানুষটা এভাবেই চলে গেলেন মুক্তি নিয়ে। হয়তো ভেবেছিলেন, কী করে এতখানি মিলে যেতে পারে সবটা!

মিলে তো গিয়েছিলই। নিজের কবিতার সঙ্গেই শেষযাত্রায় মিলে গিয়েছিলেন জীবনানন্দ দাশ। ‘ফুটপাথ’ কবিতাটা মনে পড়ে? ‘‘ট্রামের লাইনের পথ ধরে হাঁটি: এখন গভীর রাত/ কবেকার কোন্ সে জীবন যেন টিটকারি দিয়ে যায়/ ‘তুমি যেন রড ভাঙা ট্রাম এক— ডিপো নাই, মজুরির প্রয়োজন নাই/ কখন এমন হয়ে হায়!/ আকাশে নক্ষত্রে পিছে অন্ধকারে/ কবেকার কোন্ সে জীবন ডুবে যায়।’’ হয়তো এভাবেই মিলে যায় সব। অনন্তের ইতিহাসে এমন সমাপতন কত ঘটে। তবু সঞ্জয় ভট্টাচার্যর কথাটা কাঁটার মতো বেঁধে, খচখচ করে।

১৪ অক্টোবর সকালে রাসবিহারী এভিনিউর কাছে রাস্তা পেরনোর সময় ডাউন বালিগঞ্জ ট্রাম এসে ধাক্কা দিল। অবিরাম ঘণ্টা বাজিয়ে তাঁকে সতর্ক করার চেষ্টা করেছিলেন চালক, চেঁচিয়ে সাবধান করারও চেষ্টা করেছিলেন। অথচ জীবনানন্দ কিছুই শুনতে পাননি। অতলান্তিক এক ঘোর তাঁকে ঘিরে ছিল। ব্রেক কষেও দুর্ঘটনা এড়াতে পারেননি ট্রাম-চালক। কে যে কাকে ধাক্কা দিয়েছিল সেদিন!

জীবনানন্দের ‘গ্রাম ও শহরের গল্প’-তে জানলার ধারে দাঁড়িয়ে রাতের কলকাতায় বিছোনো ট্রামলাইনকে দেখে শশীর মনে হয়েছিল ‘বিরাট হাঙর’। সেই হাঙরের মুখের ওপরেই লুটিয়ে পড়েছিল জীবনানন্দের রক্তাক্ত, অচৈতন্য দেহটা। অপরিচিতরা তাঁকে নিয়ে যান হাসপাতালে। তারপর, আটদিন লড়াইয়ের শেষে জীবন ডুবে গেল। জীবনানন্দের শববহনে কাঁধ দিয়েছিলেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। পরের দিন কবির বাড়িতে উপচে পড়েছিল বিখ্যাত সাহিত্যিকদের ভিড়। আর এইসব শব্দানুসারী শোকের পাশাপাশি জীবনানন্দের শেষযাত্রার সাক্ষী অরবিন্দ গুহ দেখতে পেয়েছিলেন, “যেখানে দুর্ঘটনা ঘটেছিল, ট্রামলাইনের সেই জায়গা জুড়ে সবুজ ঘাস— আশ্চর্য, শানবাঁধা কলকাতায় জীবনানন্দের জীবনের চরম দুর্ঘটনা এমন জায়গাতেই ঘটল যেখানে ঘাস, ঘাস— যে ঘাসের প্রতি তাঁর ভালবাসা প্রগাঢ়, প্রবল।”

আর সেই অভিশপ্ত ট্রাম? একদিন আগুন লাগল তার গায়ে। কবির ঘাতক নিজেও পুড়ে শেষ হল দুর্ঘটনাতেই। এ কি নিয়তি? নাকি এক অসম্ভব আত্মহত্যা? কবিরা তো অসম্ভবেরই রাজা। হয়তো এই পংক্তিটাও আমাদের অজান্তেই সাজিয়ে গিয়েছিলেন জীবনানন্দ, লুকিয়ে রেখেছিলেন। যেভাবে ট্রাঙ্কে লুকোনো ছিল তাঁর ধূসর পাণ্ডুলিপিরা…

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.