নুতন দিল্লি ও হরিয়ানার টিকরি সীমান্তের কৃষক আন্দোলন স্থলে ২৫ বছরের এক মহিলার শ্লীলতাহানি, গ্যাংরেপ ও মৃত্যুর অভিযোগ এবং এই দুষ্কর্মকে চাপা দেওয়ার অভিযোগ দেশকে স্তব্ধ করেছে। অভিযোগের মধ্যে উঠে এসেছে আন্দোলনকারী যোগেন্দ্র যাদবের নামও।
মহিলার বাড়ি পশিবমঙ্গ । তিনি এপ্রিলের মাঝামাঝি আন্দোলন স্থলে এসেছিলেন কিন্তু রহস্যময় অবস্থায় ৩০শে এপ্রিল তার মৃত্যু হয় । কেবলমাত্র একটি চিঠির মাধ্যমে তার বাবা জানতে পারেন যে তার মেয়ে কিছু কৃষক আন্দোলনকারী কর্মীর দ্বারা যৌন হেনস্তার শিকার হয়েছে।
তার বাবা, উৎপল বসু, মে মাসের ৮ তারিখ হরিয়ানা পুলিশের কাছে অভিযোগ দায়ের করেন । পরেরদিন FIR করা হয়, যেটা মেয়েটির মৃত্যুর প্রায় ১০ দিন পর।
হরিয়ানার ঝাজর জেলার বাহাদুরগড় থানায় মিস্টার বসুর অভিযোগের নিরিখে দায়ের করা FIR(০২০৩/২০২১) এর সম্পূর্ণ বিস্তারিত তথ্যগুলি দেওয়া হল।
FIR এ পিতার সম্পূর্ণ বিবৃতি
উৎপল বসু, তার অভিযোগে নিজেকে শ্রমিক সংগঠক ও অ্যাক্টিভিস্ট বলে পরিচয় দিয়েছেন। তিনি হুগলীর একটি সংগঠন Appreciation for Protection of Democratic Rights এর সদস্য । তার মেয়ে মৌসুমী( নাম পরিবর্তন করা হয়েছে তার গোপনীয়তার জন্য) একজন শিল্পী ও ডিজাইনার।
এপ্রিলের ১ তারিখ কিষান সোশ্যাল আর্মির( KSA) ৬ সদস্যের এক প্রতিনিধি দল হুগলীর স্থানীয় অ্যাক্টিভিস্টদের সঙ্গে দেখা করেন । এদেরমধ্যে ছিলেন অনিল মালিক, অনুপ সিং, অঙ্কুর সাঙওয়ান এবং কবিতা আর্য। কুস্তি কিষান ইউনিয়নের জগদীশ ব্রার নামের এক ব্যক্তি, যোগীতা সুহাগ, যে নিজেকে একজন অভিনেত্রী বলেন, তাদের সঙ্গ দিয়েছিলেন।
সংযুক্ত কিষান মোর্চার অভিযানের অংশ হিসাবে তারা বঙ্গে ছিলেন।
উৎপল ও তার মেয়ে মৌসুমী এদের সাথে ৪ ঠা এপ্রিল হুগলীতে সাক্ষাৎ করেন।
মৌসুমী, যে পূর্বে বহু আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছে, তাদের সাথে যুক্ত হওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করে। যোগীতা তাকে অনিল মালিকের কাছে পাঠায় যে ছিল কিষান সোশ্যাল আর্মির সমন্বয়কারী।
প্রথমদিকে উৎপল তাকে দিল্লি পাঠাতে অসম্মত থাকলেও পরে সম্মতি দেয়। কিছুদিন পর সেই দলের যোগীতা ছাড়া বাকিরা সবাই ট্রেনে দিল্লির উদ্দেশ্যে রওনা দেয়। উৎপল এবং তার স্ত্রী হাওড়া রেল স্টেশন যায় তাদের মেয়েকে বিদায় জানাতে ।
উৎপল অনিলকে বলে যে সে যেন মৌসুমীকে ভাইয়ের মত রক্ষা করে। উৎপল স্ত্রীও অনিলের সাথে কথা বলে এবং তাকে সব সময় মৌসুমীর পাশে থাকতে বলে ।
তাদের দল দিল্লি পৌঁছায় ১২ই এপ্রিল ।
মৌসুমী যেহেতু নুতন ছিল এবং চারিপাশ চিনত না তাই তাকে অনিল, অনুপ এবং অঙ্কুরের সাথে একই তাবুতে হয়।
মৌসুমী উৎপলেক ১৪ই এপ্রিল ফোনে বলে যে অনিল ট্রেনে তার শ্লীলতাহানি করেছিল । সে বলেছিল যে ট্রেনে যখন সবাই ঘুমাচ্ছিল তখন অনিল তার বার্থে এসে জোর করছিল তার উপর। সে তাকে জোর করে চুম্বন করেছিল। মৌসুমী কোনোভাবে নিজেকে বাঁচায় এবং অনিলকে তার থেকে দূরে থাকতে বলে ।
অভিযোগ এটা বলে যে মৌসুমী কথা বলতে ইতস্তত করত এবং অনিল, অনুপ ভদ্র ছেলে ছিল না। অন্য তাবু খুঁজে সেখানে থাকতে এবং ঘটনাটির ব্যাপারে কিছু মহিলাকে জানিয়ে রাখতে বলে উৎপল তাকে ।
দুদিন পর অর্থাৎ ১৬ই এপ্রিল ফোনে উৎপলকে বলে যে সে জগদীশ ব্রার ও যোগীতা সুহাগকে ঘটনাটি জানিয়েছে। সে এটাও বলেছিল যে যোগীতা জগদীশের উপস্থিতিতে তার বক্তব্যের একটি ভিডিও তুলে রেখেছে।
( ভিডিও আমাদের দ্বারা পাওয়া যায়নি কিন্তু অভিযোগে বলা হয়েছে যে একটি পেনড্রাইভে সেই ভিডিও আছে এবং সেটি পুলিশকে দেওয়া হয়েছে । ভিডিও রেকর্ডের পর সেটি মৌসুমীর হোয়াটসঅ্যাপের মাধ্যমে উৎপলকে পাঠানো হয়েছে। )
সেই একই দিনে মৌসুমী তার বাবাকে জানিয়েছিল মূত্রের মধ্যে বের হওয়া রক্তের কথা। উদ্বিগ্ন উৎপল তাকে তার চারপাশের মহিলাদের শীঘ্রই জানাতে বলে এবং পারলে তাড়াতাড়ি একজন ডাক্তারের সাথে পরামর্শ করতে বলে। সে তাকে তাড়াতাড়ি তবু পাল্টাতেও বলে।
পরেরদিন অর্থাৎ ১৭ই এপ্রিল উৎপল যোগীতার সাথে ফোনে কথা বলে এবং তাকে সাহায্য করতে বলে । যোগীতা উৎপলেক বলে যে সে, সঙ্গে দুজন আইনজীবী- একজন চিৎওয়ান এবং আরেকজন অমিত সাঙওয়ান, জগদীশ ব্রার এবং হিম্মত সিংহের সাথে ব্যাপারটা দেখছে ।যোগীতা উৎপলকে বলে যে তারা ব্যাপারটা কিষান সোশ্যাল আর্মির নেতৃত্বের কাছে তুলবে।
মৌসুমী ৭৭৪ নম্বর থামের কাছে একটি তাবুতে চলে যায় যেখানে আরও অনেক মহিলারা থাকেন ।
কিছুদিন পর মৌসুমী তার বাবাকে জানায় যে সে নিশ্চিত যেহেতু তার পিরিয়ডস হয়েছে ।
” আমি তাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম যে এতে এত খুশি হওয়ার কী আছে, সে বলেছিল, ‘তোমরা পুরুষেরা বুঝবে না’, ” উৎপল দাস অভিযোগে বলেছে, সঙ্গে এটাও বলেছেন যে এরপর সে সব কিছু মিলিয়ে পুরো ব্যাপারটা বুঝতে পারে। সে এবার নিশ্চিত ছিল যে তার মেয়ের সাথে “মারাত্মক কিছু” হয়েছে।
এপ্রিলের ২১ তারিখ মৌসুমী মৃদু জ্বরে পরে । তার পায়খানা ও বমির সমস্যা শুরু হয়েছিল । সে টিকরির ওষুধের তাবু থেকে কিছু ওষুধ নেয় কিন্তু তার অবস্থার উন্নতি হয়নি। ২৪শে এপ্রিল পর্যন্ত তার খুব কাশি এবং চরম শ্বাসকষ্ট হচ্ছিল।
উদ্বিগ্ন উৎপল কলকাতার ডাক্তার অভীক সাহার কাছে যান, যিনি জয় কিষান আন্দোলনের সাথে যুক্ত ছিলেন। তিনি অভীক সাহার কাছে চিকিৎসার সাহায্য চান এবং তার সাথে দিল্লিতে ডাক্তার অমিত ভ্যাটসের সাথে যোগাযোগ করতে বলেন।
২৪শে এপ্রিল ডাক্তার অমিত, যোগেন্দ্র যাদব, যিনি একজন আন্দোলনকারী ছিলেন এবং সংযুক্ত কিষান মোর্চার একজন নেতা ছিলেন, তাকে ব্যাপারটার সাথে অবহিত করেন। যাদব ফোনে মৌসুমীর সাথে কথা বলেন এবং ডাক্তার অমিতকে বলেন মৌসুমীর চিকিৎসা করার জন্য।
পরেরদিন, অর্থাৎ ২৫শে এপ্রিল অনিল এবং অনুপ উপলব্ধি পারে যে সংযুক্ত মোর্চার নেতৃত্বগণ ঘটনাটি জানতে পেয়েছে। তারা মৌসুমীকে টিকরি থেকে সরিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়।
উৎপল অভিযোগ থেকে এটা জানতে পারা যায় যে তাকে একজন অজ্ঞাত ব্যক্তি কল করে মৌসুমীকে পশ্চিমবঙ্গে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া যেতে পারে কিনা জানতে চায় । উৎপল তার অনুমতি না দিয়ে বলে যে সে টিকরিতেই থাকবে এবং তার তৎক্ষণাৎ চিকিৎসা দরকার। উৎপল মৌসুমীর সাথেও কথা বলে যাকে “চুপ সোনাচ্ছিল” সেদিন।
মৌসুমী তার বাবার আপত্তির পরও বাড়ি ফিরে আসতে রাজি হয়েছিল এই শর্তে যে তার সাথে একজন মহিলাকে পাঠাতে হবে এবং অনিল এবং অনুপ অবশ্যই যেন দূরে থাকে। এরপর উৎপল যখন আবার মৌসুমীকে ফোন করে তখন মৌসুমী একটি গাড়িতে, বাড়ি ফেরার পথে, কিন্তু সঙ্গে অনিল এবং অনুপ।
উদ্বিগ্ন উৎপল আবার ডাক্তার ভ্যাটসের সাথে যোগাযোগ করেন যিনি প্রত্যুত্তরে যোগেন্দ্র যাদবের সাথে যোগাযোগ করেন। যোগেন্দ্র যখন অনিলকে ফোন করে তখন অনিল তাকে মিথ্যা কথা বলে যে সে মৌসুমীর বাবার অনুরোধে তাকে বাড়ি(পশ্চিমবঙ্গ) নিয়ে যাচ্ছে। অনিল বলেছিল যে তারা ইতিমধ্যে আগ্রা পৌঁছে গেছে। যোগেন্দ্র অনিলকে আন্দোলন স্থলে ফিরে যেতে বলে।
মৌসুমী যোগেন্দ্রকে হোয়াটসঅ্যাপে তার লোকেশন পাঠায় যাতে তার লোকেশন হরিয়ানার হাঁসি দেখায়। যোগেন্দ্র আবার অনিলকে ফোন করে বাহারুদগড়ে ফিরে যেতে বলে অন্যথায় সে পুলিশকে জানানোর কথা বলে ।
উৎপলের অভিযোগ থেকে এটা স্পষ্ট যে অনিল এবং অনুপ তার মেয়েকে অপহরণ করতে চেয়েছিল।
মৌসুমী ২৫শে এপ্রিল রাত্রে টিকরি ফিরে আসে।
পরেরদিন একটি আন্দোলন কমিটি মৌসুমীকে রোহতকের PGI হাসপাতালে নিয়ে যায় কিন্তু সেখানে বেড খালি ছিল না। এরপর তাকে শিভম নামক একটি বেসরকারি হাসপাতালে নিয়ে যায় নভকিশোর কৌর, যেখানে তাকে কোভিড-১৯ আক্রান্ত পাওয়া যায়। তার অবস্থার কোনো উন্নতি হয়নি ।
উৎপল ডাক্তার ভ্যাটসের কাছে মৌসুমীর অধগামী অবস্থার কথা শুনে টিকরির জন্য রওনা দেন। সে ২৯শে এপ্রিল দিল্লি পৌঁছায়( FIR এ ভুলবশত ১৯শে এপ্রিল লেখা হয়)। মৌসুমী তারপর তার বাবাকে সবকিছু বলে – সে বলে যে অনিল, অনুপের সাহায্যে তার সাথে তাবুতে যৌন হেনস্তা করে ।
“হামারে সাথ খারাপ কাম হুয়া হ্যায়” মৌসুমী উৎপলকে বলে।
” আমি এখন বুঝতে পারছি কেন সে আনন্দের সাথে বলেছিল যে তার মেন্সটুরিয়াল ডিসচার্জ হয়েছে এবং কেন তার প্রস্রাবের সাথে রক্ত বেরচ্ছিল। সে অনিল এবং অনুপের শাস্তি চেয়েছিল। সে এটাও চেয়েছিল যে কৃষক আন্দোলন যেন এর ক্ষতিগ্রস্ত না হয়,” অভিযোগ জানাচ্ছে ।
মৌসুমী ৩০ তারিখ সকালে মারা যায়।
অভিযোগ থেকে এটাও জানা যায় যে সেদিন যখন পুলিশ হাসপাতালে আসে তখন উৎপলকে চাপ দেওয়া হয়েছিল যাতে সে পুলিশকে বলে যে মৌসুমীর মৃত্যু কোভিড-১৯ এর জন্য হয়েছে। তাকে হুমকি দেওয়া হয়েছিল যে যদি সে এমন না বলে তাহলে তার মেয়ের দেহ তাকে দেওয়া হবে না( পুলিশ অভিযোগে এটা উল্লেখ করা হয়নি যে কে তাকে চাপ সৃষ্টি করেছিল)।
“মানসিক ভাবে ভেঙে পড়া” উৎপল পুলিশকে ক “ছোট্ট বিবৃতি” দেয়।
“তার শেষকৃত্যের পর আমি ওখানেই থেকে যাই এবং জড়িত সকলের সাথে কথা বলি। এইভাবেই আমি তার সাথে ঘটা ঘটনাটির পুরো চিত্র সংগ্রহ করতে পারি,” পুলিশ অভিযোগ থেকে জানা যায়।
বাপ্পাদিত্য