প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুরের জননী অলকাসুন্দরী কি কখনও ভেবেছিলেন, তাঁর শেষ জীবন কাটবে গঙ্গার তীরে অন্তর্জলীযাত্রায়?

অথচ এটাই হয়েছিল। পুত্র দ্বারকানাথের বয়স যখন ১৩, তখনই মৃত্যু হয় তাঁর পিতা রামলোচন ঠাকুরের। তবে মৃত্যুর আগে নাবালক দ্বারকানাথকে বলে গেলেন, তাঁর হয়ে সম্পত্তি দেখাশোনা করবেন অলকাসুন্দরী‌।

ধর্মকর্ম থেকে বিষয়কর্ম—সব কাজেই সমান দক্ষ ছিলেন অলকাসুন্দরী। প্রতিদিন গঙ্গা স্নান সেরে সূর্য পুজো করতেন। তবে কোনো রকম কুসংস্কার ছিল না তাঁর মনে।

রামলোচন ঠাকুরকে দীক্ষা দিয়েছিলেন হরিমোহন গোস্বামী। আর হরিমোহন গোস্বামীর স্ত্রী কাত‍্যায়ণী দেবীর কাছে দীক্ষা নেন অলকাসুন্দরী। প্রতিদিন নিয়ম করেই সে দীক্ষা মন্ত্র জপ করতেন তিনি।

শেষে কিনা এই অলকাসুন্দরীকেই যেতে হলো অন্তর্জলীযাত্রায়! যাবার ইচ্ছে ছিল না এবং তাই যাবার বেলায় প্রতিবাদ করে বলে ওঠেন, —

যদি দ্বারকানাথ বাড়িতে থাকতো, তবে তোরা কখনোই আমাকে নিয়ে যেতে পারতিস নে। কিন্তু ১৮ বছরের দ্বারকানাথের চোখের আড়ালেই তাঁর জননীকে নিয়ে যাওয়া হলো গঙ্গার তীরে অন্তর্জলীযাত্রায়। বেজে উঠলো শাঁখ, বেজে উঠলো ঢোল। আর সেই শব্দে চাপা পড়ে গেল অলকাসুন্দরীর প্রতিবাদ।

তবে কি পরবর্তী সময়ে নবজাগরণের অন‍্যতম অগ্রণী যে ঠাকুর পরিবার, সেখানেও তাহলে একসময় ছিল মধ‍্যযুগীয় কুসংস্কার? ঘটনা প্রবাহ তো সেদিকেই ইঙ্গিত দেয়।

তারপর গঙ্গার তীরে একাকিনী অলকাসুন্দরী কতদিন মৃত্যুর প্রতীক্ষায় ছিলেন? ১০ দিন, ১৫ দিন, একমাস, নাকি আরও বেশি? উত্তর নেই।

যে নারী একসময় ছিলেন পরিবারের সর্বময়ী কর্ত্রী, সেই তিনি কিনা গঙ্গা তীরে মৃত্যুর প্রতীক্ষায়? না, অলকাসুন্দরীকে উদ্ধার করতে সেদিন এগিয়ে আসেনি পুরুষ শাসিত সমাজ। জাহ্নবী-যমুনা-বিগলিত করুণার দিকে চেয়ে চেয়ে এভাবেই একদিন চিরকালের জন্য চোখ বন্ধ করেছিলেন অলকাসুন্দরী।

পরবর্তীকালে অলকাসুন্দরীর পুত্র প্রিন্স দ্বারকানাথ ঐশ্বর্য, প্রতিপত্তি, শিল্প, স্ত্রী স্বাধীনতা সব দিক দিয়েই একটি মস্ত দাগ রেখে গিয়েছেন। তাঁর “কার টেগোর অ্যাণ্ড কোম্পানি” সেকালে বাণিজ্যিক জগতে একটি সফল নাম। তবুও তাঁর জননীকে এভাবেই মৃত্যুর প্রতীক্ষায় পাঠানো হয়েছিল। বর্ধমান থেকে কুশারী হয়ে পূর্ববঙ্গ এবং সেখানে পিরালি ব্রাহ্মণ হয়ে পুরুষোত্তমের বংশধর পঞ্চানন এসেছিলেন কলকাতায়। এরপর পঞ্চাননের নাতি নীলমণি বাস করতে শুরু করলেন কলকাতার একপ্রান্তে।

শুরু হলো শরিকি বিবাদ। সে বিবাদ শেষ পর্যন্ত গড়ালো আদালতে। নীলমণি ও তাঁর ভাই দর্পনারায়ণের সঙ্গে আরেক ভাই গোবিন্দরামের স্ত্রী রামপ্রিয়া দেবীর মামলা হলো। বড়ো তেজস্বিনী মহিলা ছিলেন রামপ্রিয়া। স্বামীর মৃত্যুর পর সম্পত্তির অধিকার দাবি করে মামলা ঠুকেছিলেন তদানীন্তন সুপ্রিম কোর্টে, ব্রিটিশ আদালতে যেটি ছিল ঠাকুর পরিবারের প্রথম মামলা। রামপ্রিয়ার পক্ষে ছিলেন জয়রাম ঠাকুরের ত‍্যজ‍্যপুত্র আনন্দিরামের পুত্র রামতনু। শেষে নীলমণি ও দর্পনারায়ণ আপোষ মীমাংসায় নিজেদের সম্পত্তি ভাগ বন্টন করে নিলেন।

এরপর ১৭৮৭ খ্রিস্টাব্দের জুনে স্ত্রী ললিতা, ৩ পুত্র ও কন্যা কমলমণিকে নিয়ে নীলমণি চলে এলেন জোড়াসাঁকোয়। এলাকাটি তখন “মেছুয়াবাজার” নামে পরিচিত ছিল। অন‍্যদিকে, নীলমণির ভাই দর্পনারায়ণ থেকে গেলেন পাথুরিয়াঘাটার পুরোনো বাড়িতে। আর সম্পত্তির ভাগ বুঝে নিয়ে শিবতলায় চলে গেলেন রামপ্রিয়া।

এভাবেই ঠাকুর বাড়ির উত্থান শুরু হয় জোড়াসাঁকো থেকে। বাকিটা ইতিহাস।

এই পরিবার বাংলাকে উপহার দিয়েছে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ থেকে আরও বহু কৃতি বাঙালিকে। প্রথমত পিরালি ব্রাহ্মণ এবং দ্বিতীয়ত এই পরিবার ব্রাহ্ম বলে তখন অনেকেই তাঁদের এড়িয়ে চলেছেন। তবে এই পরিবারের মেয়েরাই কলকাতার বুকে প্রথম ঘোড়ার গাড়ি চেপে গড়ের মাঠের হাওয়া খেতে যেতেন। বাড়িতে পশ্চিমী শিক্ষা চর্চাও করেছেন এই বাড়ির মেয়েরা। এই বাড়ির মেয়েরা গলা ছেড়ে গান গেয়েছেন, বিদেশে বক্তৃতা করেছেন, সাহিত্য চর্চা করেছেন। তবে সেসব অলকাসুন্দরীর চলে যাওয়ার পরের ঘটনা।

তথ‍্যসূত্র:

১) ঠাকুরবাড়ির অন্দরমহল: চিত্রা দেব।

২) ঠাকুরবাড়ির কথা: হিরণ্ময় বন্দোপাধ্যায়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.