পন্ডিচেরির শ্রীঅরবিন্দ আশ্রমের খেলার মাঠের একটি দেওয়ালে ভারতবর্ষের একটি খোদিত মানচিত্র আছে। ঐ মানচিত্রটি অখন্ড ভারতের।
এটি শ্রীমার উদ‍্যোগে স্থাপিত হয়েছিল।
মানচিত্রটি দেশ বিভাজনের পরে নির্মিত হয়েছিল।
ফরাসী দেশের Mira Alfassa বা মাদাম রিশার ( ১৮৭৮ -১৯৭৩ ) শ্রীঅরবিন্দের আধ‍্যাত্মিক প্রচেষ্টার সঙ্গে যুক্ত হয়ে অরবিন্দ আশ্রমকে গড়ে তোলেন। ১৯৪৩ সালে আশ্রমের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান তাঁরই উদ্যোগে স্থাপিত হয়‌। ১৯৬৮ সালে গড়ে তোলেন অরোভিল ( আন্তর্জাতিক টাউনশিপ )। তিনি শ্রীমা নামেই সারাবিশ্বে পরিচিত।
এই মানচিত্রের নীচে তাঁর বসার চেয়ার পাতা থাকত। শ্রীমার দেহাবসানের পরে আজও প্রতিটি ধ‍্যানের সময় তাঁর সেই আসনখানি পুরনো জায়গায় পাতা হয়।
১৯৫২ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু এসেছিলেন পন্ডিচেরি আশ্রমে। ভারতবর্ষের ঐ মানচিত্রের তলায় নেহরুর চেয়ার পাতা হয়, শ্রীমার বাঁ পাশে। তার পাশে বসেছিলেন কামরাজ, ইন্দিরা গান্ধী ও লাল বাহাদুর শাস্ত্রী।
ঐ মানচিত্র দেখে জওহরলাল মন্তব্য করলেন, এটা ঠিক নয়। পশ্চিম ও পূর্ব পাকিস্তানকে ভারতবর্ষের অঙ্গীভূত করে দেখানো হয়েছে। এতে আন্তর্জাতিক স্তরে ভারতকে সমস‍্যায় পড়তে হতে পারে।
শ্রীমা বিষন্নভাবে উত্তর দিলেন, ভারতবর্ষের বিভাজন আমরা অনুমোদন করি না। আমরা মনে করি ভারতবর্ষ অখন্ড ও এক।
প্রসঙ্গতঃ স্মরনীয়, ভারতের স্বাধীনতা প্রাপ্তির দিনে ( যেটি তাঁর নিজেরও জন্মদিন ) শ্রী অরবিন্দের একটি লিখিত বাণী প্রচারিত হয়েছিল মাদুরাই বেতার কেন্দ্র থেকে। তাতে শ্রী অরবিন্দ বলেছিলেন, যে স্বাধীনতা এল, তা দ্বিখণ্ডিত স্বাধীনতা। কিন্তু এটি একটি সাময়িক ব‍্যবস্থাপত্র মাত্র। এর বেশি এর কোন মূল‍্য নেই।
বহু বহু বছর আগে, ১৯০৪ সালে স্ত্রী মৃনালিনীকে তিনি চিঠিতে লিখেছিলেন, “অন‍্যলোকে দেশকে একটা ভূমিখন্ড, একটা জড়পদার্থ, কতকগুলি নদ – নদী পাহাড়ের সমষ্টি মাত্র বলে জানে। আমি স্বদেশকে মা বলে মানি। ভক্তি করি। পূজা করি।”
১৯৪২ সালের মার্চ মাসে স‍্যার স্ট‍্যাফোর্ড ক্রিপস ভারতে এলেন Dominion Status এর প্রস্তাব নিয়ে। দেশের কাঠামো অবিভক্ত রেখে স্বায়ত্বশাসনের আশ্বাস। শাসনকার্যে হিন্দু মুসলমান সকলের সমানুপাতিক ভারসাম্য বজায় থাকবে। পরিবর্তে জার্মানি ও জাপানের বিরুদ্ধে ব্রিটেনের যুদ্ধ প্রক্রিয়াকে সমর্থন করতে হবে। প্রস্তাবে পরিস্কারভাবে উল্লেখ ছিল যে ভারতবর্ষ — একক, স্বাধীন, ও অবিভক্ত ভারতবর্ষ সম্মিলিতভাবে সাম্রাজ্যের শত্রুদের বিরুদ্ধে দাঁড়াবে।
শ্রী অরবিন্দের মতে, এটি ছিল ভারতের বিভাজন রোখার একটি সুবর্ণসুযোগ। এতে অনেক জটিল সমস‍্যার সমাধান হবে ও পরিণামে আসবে মুক্তি। তিনি যেন বুঝতে পারছিলেন স্বাধীনতা এলেও তা বিভাজন, সাম্প্রদায়িক তান্ডব ও প্রবল রক্তক্ষয় ও উদ্বাস্তু সমস্যা নিয়ে আসতে চলেছে।
১৯০৭ সালে বন্দেমাতরম পত্রিকায় যিনি চেয়েছিলেন ” A free national government unhampered even in the least degree by foreign control ” —- ” Absolute Swaraj — Self government as it exists in the United Kingdom. ” , ১৯৪২ সালে তিনিই বুঝলেন যে আপাতত Dominion Status মেনে নিলে পাঁচ বছর পরের অনাগত বিপর্যয় হয়তো বা ঠেকানো যেতে পারে।
এই প্রস্তাব গ্ৰহণ করবার জন‍্য তিনি দিল্লীর কংগ্রেস নেতাদের কাছে টেলিগ্ৰাম করলেন। ক্রিপসকে অভিবাদন জানিয়ে পত্র দিলেন। ক্রিপস সুভদ্র শ্রমিক নেতা, ধন‍্যবাদজ্ঞাপন করলেন শ্রী অরবিন্দকে।
শ্রী অরবিন্দের শিষ‍্য, মাদ্রাজ হাইকোর্টের উকিল দোরাইস্বামী, যিনি রাজাগোপালাচারীর বন্ধু, দিল্লিতে দূত হিসাবে প্রেরিত হলেন কংগ্রেস নেতৃবৃন্দের কাছে। হিন্দু মহাসভার ডঃ বালকৃষ্ণ সদাশিব মুন্জের কাছেও টেলিগ্ৰাম গেল।
লেবার পার্টির ক্রিপস ব্রিটেনের যুদ্ধকালীন ক‍্যাবিনেটের সদস‍্য ছিলেন বটে, কিন্তু অন‍্য সদস‍্য সাবেকপন্থী প্রধানমন্ত্রী স‍্যার চার্চিল ও ভারতসচিব লর্ড আমেরি ভেতরে ভেতরে চেষ্টা ক‍রে গেছেন যাতে ক্রিপসের উদ‍্যোগ ভেস্তে যায়।
বলাই বাহুল্য, ফল হল হতাশাব্যঞ্জক। কংগ্ৰেসী নেতারা ততদিনে দেশবিভাগের জন‍্য প্রস্তুতি নিতে শুরু করে দিয়েছেন। গান্ধীজি ক্রিপসের প্রস্তাবকে নস‍্যাৎ করলেন ” ফেল পড়া ব‍্যাঙ্কের তারিখ উত্তীর্ণ চেক ” বলে। ( Post dated cheque on a crashing bank )
কংগ্রেসের অসহযোগে বিরক্ত ব্রিটিশরা মুসলীম লিগের সহযোগিতার আশ্বাসে সন্তুষ্ট হলেন।
জিন্নাকে আশ্বস্ত করা হল, ভবিষ্যতে যদি কোন ইউনিয়ন গঠন হয়, জিন্নার নেতৃত্বে মুসলিমদের পূর্ণ স্বাধীনতা থাকবে তাতে যোগ না দেবার। জিন্না বুঝলেন, তাঁর স্বপ্নের পাকিস্তান আর বেশি দূরে নয়।
শ্রী অরবিন্দ ডোরাইস্বামীকে প্রেরণ করার পরেই বলেছিলেন, ” একটু নিষ্কাম কর্ম করলাম।”
তিনি তাঁর প্রচেষ্টার ব‍্যর্থতা সম্পর্কে পূর্বাভাস পেয়েছিলেন কি ?
ঐ মানচিত্রটি আজও আশ্রমের বিশ্বাস ও দর্শনের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িয়ে আছে।
শ্রীঅরবিন্দ আশ্রমের একটি ডায়েরির সামনের ছবি দেওয়া হল।
এখানে বলা হয়েছে, এই ম‍্যাপটি ভারত বিভাজনের পরে বানানো হয়েছিল । এতে পাকিস্তান, নেপাল, সিকিম ( তখনো ভারতে অন্তর্ভুক্ত হয়নি ) , ভূটান, বাংলাদেশ, বার্মা ও শ্রীলঙ্কাকে ভারতের অংশ বলে দেখানো হয়েছে। যে যাই বলে বলুক, এটিই ভারতের প্রকৃত মানচিত্র এবং চিরকাল তাই থাকবে।
তথ‍্যসূত্র ;
শ্রী অরবিন্দের সাথে বারো বছর ; নীরদবরণ ; শ্রীঅরবিন্দ পাঠ মন্দির
মহাবিশ্বের মহাবিস্ময় রবীন্দ্রনাথ ও শ্রীঅরবিন্দ —
ডঃ জগন্ময় বন্দ‍্যোপাধ্যায় ; সিগমা পাবলিকেশন ।
আসা যাওয়ার মাঝখানে ( দ্বিতীয় খন্ড ) ; নলিনীকান্ত সরকার ; মিত্র ও ঘোষ।
শ্রীমায়ের ছবিটির জন‍্য কৃতজ্ঞতা ; নীলাদ্রি মুখোপাধ্যায়
শ্রীঅরবিন্দ আশ্রম প্রকাশিত ডায়েরী, ২০১৫

পোস্ট ; ঋতুপর্ণ বসু।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.