মোদী-শাহের পরিকল্পনা রূপায়ণের মূল মস্তিষ্ক দোভাল

অজিত দোভাল। এই নামটা বিগত পাঁচ বছরে অনেকের, বিশেষ করে সংসদীয় বিরোধীদের গাত্রদাহের কারণ হয়েছে। কারণ জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টার পদ অলংকৃত করে থাকা এই মানুষটি ছিলেন রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের একজন একান্ত অনুগত কর্মী, যাঁদের ‘স্বয়ংসেবক’ বলা হয়ে থাকে। ব্যক্তির থেকে সংগঠন বড়ো, আর সংগঠনের থেকে দেশ— আর এস এসে এই শিক্ষা যেমন দেওয়া হয়ে থাকে তেমন বিবেকানন্দের আদর্শ ‘ম্যান মেকিং ইজ মাইমিশন’ এই আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে মান ও হুঁশ-সমৃদ্ধ ‘মানুষ’ তৈরিও সঙ্রে অন্যতম উদ্দেশ্য, যারা দেশের সেবাকেই তাদের ধ্যান জ্ঞান করবেন। আর এস এসের মানুষ তৈরির কারখানাতেই পাওয়া গিয়েছিল অজিত দোভালকে। স্বাধীনতার পর থেকে যে কাশ্মীরের অশান্ত থাকাই রেওয়াজ, কাশ্মীরি যুবকদের দেশের নিরাপত্তাবাহিনীর ওপর পাথর ছোঁড়াই যেন একমাত্র পেশা হয়ে দাঁড়িয়েছিল, ৩৭০ ধারা আর ৩৫এ ধারা বিলোপের পর সেই কাশ্মীর আশ্চর্যজনক ভাবে শান্ত। এই দুই ধারার বিলোপ যে মূলস্রোতের ভারতীয় অঙ্গরাজ্য হিসাবে কাশ্মীরকে তুলে ধরেছে, তার অন্যান্য প্রমাণের চাইতে পাকিস্তানের প্রতিক্রিয়ার প্রমাণই সবচাইতে জোরালো প্রমাণ। নরেন্দ্র মোদী-অমিত শাহ এই কাজেযাঁর ওপর সবচেয়ে বেশি আস্থা রেখেছিলেন, তাঁরই নাম অজিত দোভাল। যিনি দীর্ঘ এগারোদিন কাশ্মীরে ছিলেন, এমন এক পরিস্থিতিতে যখন ৩৭০ ও ৩৫এ ধারা বিলুপ্ত হয়েছে; ও সেই সুবাদে পাক-পন্থী বিচ্ছিন্নতাবাদী আর পাক-পন্থী ভারতীয় রাজনৈতিক দলের নেতৃ বৃন্দ গোলমাল পাকানোর চেষ্টায় মরিয়া। এদের গৃহবন্দি করে। রাখাটাও বিপজ্জনক হতে পারতো, যদি না অজিত দোভাল কুরুক্ষেত্র থুড়ি কাশ্মীর ক্ষেত্রে দাঁড়িয়ে পরিস্থিতি সামাল না দিতেন।
এর নিট ফল কী হয়েছে শুনবেন? এর প্রত্যক্ষগোচর ফল হলো,কংগ্রেস নামক রাজনৈতিক দলের গান্ধী-প্রভুদের প্রধান বিশ্বস্ত অনুচর তথা জম্মু-কাশ্মীরের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী গুলাম নবি আজাদ অসহ্য রাগে বলে ফেলেছেন পয়সা ফেললেই নাকি কাশ্মীরিদের সঙ্গে মেলামেশার দৃশ্যের ছবি তোলানো যায়। হক কথা, পয়সা ফেললে কি যে না হয় কাশ্মীরে শেখ আবদুল্লা আর গোটা ভারতে জওহরলাল নেহরুর ষাট-সত্তর বছর ধরে চলা পৈতৃক জমিদারি তার প্রমাণ দিয়েছে। আসলে ৩৭০ ও ৩৫এ ধারার জন্য কাশ্মীরিরা কোনওদিনই ভারতের সঙ্গে একাত্ম হতে পারেনি। অজিত দোভাল এগারো দিন কাশ্মীরে থেকে ঠিক এই কাজটিই করেছেন। বন্ধ দোকানের সামনে তিনি কাশ্মীরিদের সঙ্গে খেয়েছেন, আড্ডা দিয়েছেন। ফলে যে দোকান বন্ধ ছিল, তা খুলে গেছে। অন্যান্যবার এই সময় ভারতবাসী ভগবানের নাম জপ করেন, অমরনাথ যাত্রীরা যাতে নির্বিঘ্নে ঘরে। ফিরে আসতে পারেন। ভগবান এই ডাক খুব কমই শুনেছেন।
এবারও যে সেই চেষ্টা হয়নি তা নয়, দেশের নিরাপত্তারক্ষীরা পাক অনুপ্রবেশকারী জঙ্গিদের গুলি করে মেরেছে। নিরাপত্তা বলয়ে কাশ্মীরকে মুড়ে ফেলা ছিল দোভালের পরিকল্পনার একটি অঙ্গ। জঙ্গিরা মাঝে মধ্যেই কাশ্মীরে মসজিদে বিস্ফোরণ ঘটাতো আর সাধারণ কাশ্মীরিদের ঘাড়ে চাপানো হতো দোষ। কাশ্মীরি পণ্ডিত বিতাড়নের সুচারু অঙ্গ ছিল জঙ্গিদের জেল থেকে মুক্তি। অজিত দোভাল বুঝেছিলেন কাশ্মীরের বাসিন্দাদের জঙ্গিদের থেকে বিচ্ছিন্ন করতে পারলেই উপত্যকা আবার ভূ-স্বর্গ হয়ে উঠবে। জঙ্গিদের মদতে পাকিস্তান এক সময় গণভোটের দাবি তুলে ভারত -অধিকৃত কাশ্মীর-সহ গোটা কাশ্মীরই দখল করার স্বপ্ন দেখেছিল।
আজ অজিত দোভাল কাশ্মীরে এমনই পরিস্থিতি তৈরি করে দিয়েছেন, যে কেবল ভারতে থাকা কাশ্মীরই নয়, পাক-অধিকৃত কাশ্মীরও আজ পাকিস্তানের নিয়ন্ত্রণ থেকে মুক্তির দিন গুণছে। ইমরান যখন বলেন পাক-অধিকৃত কাশ্মীরে ভারত হাত দেওয়ার চেষ্টা করলেই ‘যুদ্ধ’ তখনই বোঝা যায় পাশা উলটেছে। অজিত দোভাল যে সবকিছুই একা করছেন এমন নয়। এটা আদতে একটা টিম ওয়ার্ক। যার মাথায় মোদী অমিত শাহের হাত রয়েছে। কিন্তু মাঠে নেমে যা কাজ করার তা দোভালকেই করতে হচ্ছে। তিনি দেশের মুখ্য নিরাপত্তা উপদেষ্টা, তাই দেশের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হলে কেউ তাকে ছেড়ে কথা বলবে না।
কেরল ক্যাডারের আই পি এস (১৯৫৮) দোভালের অভিজ্ঞতা আছে বিচ্ছিন্নতাবাদ মোকাবিলায়, মিজো আন্দোলনের সময় তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিলেন। শোনা যায়, পাকিস্তানে তিনি গুপ্তচরের কাজেও পটুতা দেখিয়েছিলেন। কাশ্মীরে সেই অভিজ্ঞতা তার নিশ্চয়ই কাজে লেগেছে। তাই পরোক্ষ নীট ফল দেখুন টুকরে গোষ্ঠীর ‘কাশ্মীর মাঙ্গে আজাদি’ আর শোনা যাচ্ছে না। কাশ্মীরি জাতীয়তাবাদের ধুয়ো আর উঠছে না। ঈদের দিন আকাশপথে দোভাল নজরদারি চালিয়েছিলেন, নিশ্চিন্তে কেটেছে ঈদ। মসজিদে বিস্ফোরণ, নৈব নৈব চ। তাই প্রত্যক্ষ যুদ্ধক্ষেত্রে থেকে কাশ্মীরিদের মন জয় যুদ্ধ জয় করেছেন দোভাল। সাফল্য স্বয়ংসেবকের, গর্ব দেশবাসীর।
ফলে খুব অসুবিধায় বিরোধীরা। দেশের স্বার্থ তুচ্ছ করে, বিদেশি শক্তির হাত শক্ত করতে যাদের দুর্ধর্ষ সব ভূমিকা গত পাঁচ বছরে দেখেছে। দেশ, মোদী শাহের পরিকল্পনা আর দোভালের রূপায়ণে বৈদেশিক শত্রু আর ঘর শত্ৰু উভয়েই এখন ঠাণ্ডা।
অভিমন্যু গুহ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.