বাংলাদেশের প্রিয়া সাহার নাম কিছুদিন আগেও সেভাবে কেউ জানতেন না। রাতারাতি তিনি বিখ্যাত হয়ে গেছেন সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হওয়া একটি ভিডিয়োর জন্য। ভিডিয়োতে দেখা গিয়েছে তিনি মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে বলছেন যে তার দেশ বাংলাদেশে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের বেঁচে থাকার অধিকারও লঙ্ঘিত হচ্ছে। তিনি ট্রাম্পকে এও বলেন, মুসলমান মৌলবাদীরা তার জমি কেড়ে নিয়েছে ঘরে আগুন লাগিয়ে দিয়েছে, কোনও বিচার পাওয়া যায়নি সরকারের থেকে, মুসলমান মৌলবাদীরা রাজনৈতিক আশ্রয়ও পাচ্ছে। এক পরিসংখ্যান উল্লেখ করে প্রিয়া আরও বলেন ট্রাম্পকে যে, ৩ কোটি ৭০ লক্ষ ধর্মীয় সংখ্যালঘু মানুষ বাংলাদেশ ছাড়া হয়েছে। এখনও যে ১ কোটি ৮০ লক্ষ সংখ্যালঘু আছে, তারাও বিপজ্জনক পরিস্থিতির মধ্যে বাস করছেন।
জানা গিয়েছে গত ১৬ থেকে ১৮ জুলাই ওয়াশিংটনে ধর্মীয় স্বাধীনতা বিষয়ে দ্বিতীয় সরকারি সম্মেলন উপলক্ষ্যে আহূত হয়ে ট্রাম্পকে এই কথাগুলো বলেন প্রিয়া, এবং বাংলাদেশে নিরাপত্তার চূড়ান্ত অভাব বোধ করা ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের জীবন রক্ষায় আমেরিকাকে এগিয়ে আসার কাতর আহ্বানও জানান। সর্বসাকুল্যে এক মিনিটেরও নয়, ৫৩ সেকেন্ডের একটা ভিডিও তা নিয়ে এপার ওপার দু’বঙ্গই উত্তাল। প্রিয়ার একটি পোশাকি পরিচয় আছে, তিনি বাংলাদেশের ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের অধিকার রক্ষা মঞ্চ ‘বাংলাদেশ হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ’-এর সংগঠন সম্পাদক।
প্রিয়া সাহা নতুন কিছু বলেননি। বাংলাদেশে হিন্দু -সহ বাদবাকি ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা কী কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে বাস করতে বাধ্য হচ্ছেন, তা কমবেশি সকলেরই জানা। অনেকের ধারণা আছে যে খালেদা জিয়া হলেন সাম্প্রদায়িক মুখ, আর শেখ হাসিনা উদারমুখ। একথা ঠিক যে, বাংলাদেশে মুসলমান সম্প্রদায়ের মধ্যে অনেক লিবারেল মানুষ আছেন, যাঁরা আন্তরিকভাবেই ভারত-বন্ধু, তারা খালেদা জিয়ার পাকপন্থী মনোভাব, মৌলবাদী নীতির জন্য আওয়ামি লিগকেই সমর্থন করেছেন। কিন্তু আজ বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি পাক-অনুসারী, ক্ষমতায় যারাই অসুক না কেন, মৌলবাদীদের সঙ্গে সমঝোতা করে চলতেই হবে। মৌলবাদীদের হাতে ওই দু’দেশের সেনার নিয়ন্ত্রণ, সেই সূত্রে রাজনীতিরও। ফলে ভারতের পশ্চিমপ্রান্তে পাকিস্তান যেমন দেশের সুরক্ষার জন্য বিপজ্জনক, বাংলাদেশও তেমন পূর্ব প্রান্তে ভারতের জন্য বিপদ সংকেত। একটা কথা মনে রাখুন, মৌলবাদীদের সমর্থন না পেলে শেখ হাসিনা তথাকথিত বিপুল জনাদেশ’ নিয়ে ক্ষমতায় ফিরতে পারতেন না। ফলে হিন্দুরা যে অসহনীয় পরিস্থিতির মধ্যে পাকিস্তানে বাস করছেন, বাংলাদেশেও তাদের একই শোচনীয় পরিস্থিতি।
দীর্ঘদিন ধরেই বাংলাদেশে হিন্দুরা নিপীড়িত, মা-বোনেরা লাঞ্ছিত- ধর্ষিত, প্রাণের ভয় এঁদের অধিকাংশ ভারতেশরণার্থী হিসাবে পালিয়ে আসতেও বাধ্য হচ্ছেন। তথাগত রায়, বিমল প্রামাণিক, মোহিত রায়-রা এই বিষয়ে বহুদিন ধরে সরব। মোহিত রায়ের ক্যাম্ব (ক্যাম্পেন এগেইনস্ট অ্যাট্রোসিটিস অন মাইনোরিটিস ইন বেঙ্গল) বাংলাদেশের হিন্দু-সহ ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের অধিকার রক্ষায় অনেকদিন থেকেই কাজ করে আসছে। এঁদের সৌজন্যে বাংলাদেশের হিন্দুরা কতটা ভয়াবহ অবস্থায় দিন কাটাচ্ছেন সেকথা সবাই জেনে গেছেন। কিন্তু গোল বেঁধেছে সাম্প্রতিক কালে। বাঙ্গালি বাঙ্গালি ভাই ভাই, বাংলায় আরবি সংস্কৃতি চাই’ ধুয়ো তুলে কিছু বিচ্ছিন্নতাবাদীর জন্ম হয়েছে এপার বাঙ্গলায়, এরা হিন্দু পদবিধারী হলেও আসলে। মুসলমানদের পদলেহন করাই এদের মূল কাজ। এদের সঙ্গে যোগ দিয়েছে এদেশের কমিউনিস্ট দলের কিছু লোক, বাংলাদেশপ্রেমী সাজতে গিয়ে যারা সেদেশের মৌলবাদকে চিরকাল প্রত্যক্ষ সমর্থন করে এসেছে, এদের। এখন ভারী রাগ প্রিয়া সাহার ওপর।
প্রিয়া কেন এমন কথা বললেন? তার বলা উচিত ছিল, বাংলাদেশে হিন্দুরা কী সুখে আছে ! বাংলাদেশ সবধর্মের তীর্থক্ষেত্র, বাংলাদেশই বাঙ্গালিদের একমাত্র ‘হোমল্যান্ড, আরও স্পষ্ট করা বলতে গেলে ‘ইন্ডিয়ায় অত্যাচারিত ‘বাঙ্গালি’রা বাংলাদেশের সঙ্গে জুড়ে গিয়ে রিপাবলিক অব বেঙ্গল’ গড়ে তুলুন ইত্যাদি। রিপাবলিক অব বেঙ্গল’-এর আশঙ্কার কথা দিলীপ ঘোষ বলেছেন, তবে রাজনৈতিক ভাবে। এর বৌদ্ধিক প্রক্রিয়া বেশ কিছুদিন যাবৎ বহাল। এক বাঙ্গালি হিন্দুনামধারী তথ্যচিত্র নির্মাতা অনেকদিন ধরে বাংলাদেশের হয়ে ওকালতি করছেন। সাম্প্রতিক ঘটনায় তার উর্বর মস্তিষ্কপ্রসূত ব্যাখ্যা হলো শেখ হাসিনার নীতি যেহেতু চীন-ঘেঁষা’, তাই হাসিনাকে শিক্ষা দিতে আমেরিকা প্রিয়া সাহার ঘটনা সাজিয়েছে। আবার আরেক ফেসবুক পোস্টে তিনি বাংলাদেশকে মহৎ-উদার দেখিয়েছেন। এই বিদেশি রাষ্ট্রের দালালদের মুখোশ খুলে দিয়েছে প্রিয়া সাহার ঘটনা। বাংলাদেশে এরপর প্রিয়ার ওপর নিশ্চিতভাবেই রাষ্ট্রীয় নির্মমতার খাঁড়া নেমে আসবে। বৃহত্তর ধান্দায় তখনও এই দালালরা বিদেশি খুনিদের গুণ গাইবে। ভারতের উচিত প্রিয়া সাহার পাশে দাঁড়ানো এবং বাংলাদেশে হিন্দুদের অধিকার সুরক্ষিত করা।
বিশ্বামিত্র-র কলম
2019-07-26