জনগণনার তথ্য ঘাঁটিয়ে জ্ঞাত হলাম, ৬০ থেকে ১০০ বছরের জীবদ্দশায় অবস্থান। করছেন, এই রকম নাগরিকের সংখ্যা ভারতের ১০ কোটি ১৭ লক্ষ ১৩ হাজার ৫১ জন, যা ব্রিটেনের মোট জনসংখ্যার অর্ধেক। ২০২৬ সনে আমাদের দেশের মোট জনসংখ্যার ১২ শতাংশই হবেন এই প্রবীণরা। এক অর্থে এটা অবশ্য দেশের উন্নয়নেরই । পদধ্বনি। মানুষের পরমায়ু বৃদ্ধির পথে। পরিবেশ ক্রমশ উপযোগী হয়ে উঠছে। উন্নত চিকিৎসা ব্যবস্থা সরকারি বদান্যতার সুলভে তাদেরও কাছে লভ্য হতে চলেছে, যাদের ভঁড়ে মা ভবানী অবস্থা যেন চিরায়ত। কাজেই প্রবীণদের দিকে আর নজর দেবার দরকার নেই এবং প্রবীণদের ভোগস্পৃহাও ক্রমবর্ধমান, ঝটিতে এই রকম কোনও সিদ্ধান্তে আসবেন। না। বরং আর্থিক ও সামাজিক বিশ্লেষণে বসলে অস্বস্তিকর সংকেতগুলিকেই দেখতে পাই। বাস্তব পরিস্থিতি বলছে, বয়স্ক মানুষদের ৬৫ শতাংশ তাদের ন্যূনতম চাহিদা মেটাবার। ক্ষেত্রে অপরের করুণা ও বিবেচনার ওপর নির্ভরশীল। মহিলাদের ক্ষেত্রে নির্ভরতা। অধিকতর নির্মম। তাদের মতামতের দাম কম, সংসারে জোর গলায় কিছু বলতে গেলে সেটা নিছক স্পর্ধারূপে গণ্য হয়। কারণটা। ঐতিহাসিক। জাতি বহুকাল পরাধীন ছিল। পশ্চিমি সভ্যতার প্রভাবে ভারতীয়দের যৌথ পরিবারের মূল কবেই উৎপাটিত। মানুষে-মানুষে আজ যে বিচ্ছিন্নতা, তা । মনুষ্যেতর প্রাণীকুলকেও লজ্জা দেবে। এখন বরং হরেক মহোৎসবে সরকারি দাক্ষিণ্যেই। অকল্পনীয় মদ্যপ ঘনিষ্ঠতা দেখে রোমাঞ্চিত হবার মৌসম। কম বয়সীদের এমত ব্যাধি বয়স্কদের আরও নিঃসঙ্গ করছে। শহরের কথা না হয় বাদই দিলাম, চাকরির সুবাদে বহু গ্রাম চষে বেড়িয়েও একটি দুটির বেশি যৌথ । পরিবারের সন্ধান আমি পাইনি। আত্মিয়স্বজন, কার সঙ্গে কী সম্পর্ক—এগুলি নিয়ে পারিবারিক তথা বংশগত নথি তৈরি করতে তারা বিলকুল অসমর্থ। রৌদ্রের খরতাপ, শীতের মরণ কামড়, কালবৈশাখীর ভোঁ ভা জলঝড়-কম্পমান বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের পাশে যেন দাঁড়াবার মতো মানুষের একান্ত অভাব।
পরিস্থিতির উন্নয়নে বিজেপি সরকার যে যুগপৎ প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে সচেষ্ট, তা । অনস্বীকার্য। বিশেষত, চিকিৎসাক্ষেত্রে। যে নৈতিকতার দায় স্বীকার করে নিয়ে নরেন্দ্র মোদীজী ‘আয়ুষ্মন ভারত’কে বলবৎ করলেন, দৃষ্টান্ত হিসেবে তা অনন্য। আবার এটা অতি । অলুক্ষণে বিষয় যে আমাদের মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রীর ‘অনুপ্রেরণায় পশ্চিমবঙ্গবাসী ওই প্রকল্পের তাবৎ চিকিৎসাগত সুবিধালাভ থেকে বঞ্চিত থাকলেন। মহল্লায় মহল্লায় আমি অন্যদের। পাশাপাশি অনেক মাননীয় বয়স্ক ব্যক্তিদেরও এই নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করতে শুনেছি। এটা কেন? রাজনৈতিক প্রলোভনের একটা সীমা থাকবে না? মনে আসে আইনস্টাইনের সেই fasino tre, ‘Earth provides enough to every body’s needs, but every man’s greeds also.’
অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানে কর্মীরা অবসর নিয়ে । থাকেন ৬০ বছর বয়স পূর্ণ করবার সঙ্গে সঙ্গে। কিন্তু একবার খোঁজ নিয়ে দেখবেন, এ দেশে কটি মাত্র সংস্থা অবসরপ্রাপ্ত কর্মীকে অবসরভাতা বা পেনশন দিয়ে থাকে? কর গোনারও বোধ হয় দরকার হবে না। পরিসংখ্যান বলছে, দেশের মোট অবসরপ্রাপ্তদের মধ্যে মাত্র সাড়ে সাত অংশ বয়স্ক বয়স্কারা পেনশন পেয়ে থাকেন। যাঁদের পেনশন নেই, তাদের আপখোরাকির সংস্থান কীভাবে হবে, নিয়োগকর্তাদের নিকট এটা যেন নিতান্তই একটি অবাঞ্ছিত প্রশ্ন। জানি, যাঁদের অবসরভাতা নেই, তারা পি. এফ, গ্রাচুইটি, লিভ এনক্যাশমেন্ট ইত্যাদি। মোতাবেক একটা পুষ্ট থোক টাকা পেয়ে। থাকেন, যার সিংহভাগ ব্যাঙ্ক, পোস্টঅফিস ইত্যাদি নিরাপদ সংস্থায় স্থায়ী আমানতের রূপ নেয় এবং সেখান থেকে প্রাপ্ত সুদের টাকাতেই বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের ক্ষুন্নিবৃত্তির নিবারণ, চিকিৎসা ব্যয়…ইত্যাদি। কিন্তু ব্যাঙ্ক, পোস্টঅফিস ইত্যাদিতে আমানতের ওপর প্রদত্ত সুদের হার উত্তরোত্তর যে হারে হ্রাস পাচ্ছে, সুদ নির্ভর এই সমস্ত প্রবীণ নাগরিকরা এখন অভাবের তাড়নায় ও ক্ষোভে প্রতিদিন গর্জন করছেন। একটু কান পাতুন, শুনতে ঠিক পাবেন। বহুজন মান্য নেতা-নেত্রীদের কাছেও এই কানপাতাটা আবশ্যিক হওয়া উচিত গণতান্ত্রিক দেশে।
আবার পেনশন যাঁরা পাচ্ছেন, তাঁরা সকলেই যে খুব বহালতবিয়ত, তা কিন্তু নয়। পেনশন প্রদানে একাধিক সরকারি ও বেসরকারি সংস্থায় কুৎসিত অবিচার নজরে আসে। উদাহরণস্বরূপ টেনে আনছি ভারত তথা বিশ্বের বৃহত্তম বাণিজ্যিক ব্যাঙ্ক স্টেট ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়াকে। একটি নাতিদীর্ঘ উদাহরণ দিলে আপনাদের ধৈর্য বিঘ্নিত হবে না। আমার বন্ধুস্থানীয় ওই ব্যাঙ্কের একজন। প্রাক্তন ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার চাকুরি থেকে অবসর নেন ২০০০ সনের ৩০। নভেম্বর। সেই বৃদ্ধ বর্তমানে ব্যাঙ্ক থেকে মাসিক পেনসন পান ২৩ হাজার ১৩০ টাকা। আবার ওই একই ব্যাঙ্কের একজন সাধারণ ক্লাক ২০১৯ এর ৩০ সেপ্টেম্বর অবসর নিয়ে মাসিক পেনশন পেতে চলেছেন ৩৯ হাজার টাকা। কেন এই ভয়ানক অবিচার? কারণ ২০০০ সনে কর্মী ও আধিকারিকদের যে পে স্কেল ছিল, এখন তা কয়েকগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। কিন্তু যিনি অবসরপ্রাপ্ত বৃদ্ধ, তার দাবি নিয়ে বাগবিতণ্ডা করবার কেউ নেই। যদি থাকেও, কর্তৃপক্ষের বিবেক তাতে সাড়া দেয় না। যথারীতি এই অবিচার গণ্ডগোল চলছে দুরন্ত গতিতেই। একেই কয় আক্কেল গুড়ুম।
শেখর সেনগুপ্ত
2019-11-01