মোকামঘাটের প্রতিশোধ

ক্ষুদিরামের সহযোদ্ধা প্রফুল্ল চাকী আত্মবিসর্জন করলেন  মোকামঘাট জংশনে। কিন্তু বন্ধুত্বের মুখোশপরা সেই ছদ্মবেশী ইন্সপেক্টর নন্দলালের কি হল ? 
হ্যাঁ , তার উত্তরও মিলছিল আত্মোন্নতি সমিতির বিশ্বস্ত সদস্য রণেন গাঙ্গুলীর লেখনীর মাধ্যমে। রোগাতুর দেহে মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করতে করতে তিনি সেই সব স্মৃতি নথি বদ্ধ করে গেছিলেন । ১৯৭৪ সালে তিনি দেহরক্ষা করেন রিষড়া সেবাসদন হাসপাতালে। তাঁর সেই স্মৃতিচারনা আমার এই প্রবন্ধের মূল পাথেয়।


১৯০৮ সালের ৩০ শে এপ্রিল মজঃফরপুরে কুখ্যাত কিংসফোর্ডকে হত্যার প্রচেষ্টায় ভ্রমবশতঃ ক্ষুদিরাম বসু ও প্রফুল্ল চাকী কেনেডি সাহেবের পত্নী ও কন্যাকে বোমার আঘাতে হত্যা করলেন।  এটা কিন্তু ব্যর্থতা ছিল না । এর মধ্যে ছিল এক সার্থক পরিব্যাপ্তি , তা কেবল সংগ্রামী ভারতবর্ষ জানত এবং সাম্রাজ্যবাদী ইংরেজরাও উপলব্ধি করেছিল। ক্ষুদিরাম ও প্রফুল্ল চাকীর আবির্ভাব ভারতের ভারতের ভবিষ্যতের জাতিয়তাবাদী আন্দোলনের অন্যতম মার্গ প্রদর্শক ছিল , তাঁদের আবির্ভাব ও আত্মত্যাগ পরবর্তীতে বহু বিপ্লবীর নিকট এক মুখ্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিল সে কথা অদ্য ইতিহাসও স্বীকার করছে। 


উক্ত ঘটনার পরদিন ১ মে তারিখে মোকামা ঘাটে পুলিশ ইন্সপেক্টর ধূর্ত নন্দলাল ব্যানার্জীর অতিরিক্ত উৎসাহে প্রফুল্ল চাকী পুলিশ ঘেরাও হন এবং তারপর তিনি দেশ, জাতি ও সহযোদ্ধাদের নিমিত্ত প্রাণ উৎসর্গ করলেন। তবে তিনি আদৌ আত্মহত্যা করেছিলেন নাকি তাঁকে হত্যা করা হয়েছিল তা নিয়ে বেশ কিছু বিতর্ক আছে। সে কথা অন্য একদিন বলব। 


এসব ঘটনায় নন্দলাল পুলিশ আনন্দে ডগমগ । বৈদেশিক শাসনের কৃপায় তার অর্থপ্রাপ্তি হল, চাকুরিতে উন্নতি হল। 
কিন্তু ভারতমাতার মুক্তি নিমিত্ত সংগ্রামকারীদের শাসন দণ্ডও তো অচল নয়। দুষ্কর্ম যে করল, তাকে ন্যায্য শাস্তি মায়ের সুযোগ্য সন্তানরা তো দেবেনই। প্রফুল্ল চাকীর আত্মবলিদানের পর মাত্র ছয় মাস এবং দিন কয়েক জীবিত ছিল ব্রিটিশ সরকারের পা চাটা জীবটি। 


রণেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায় সেই সময় #আত্মন্নোতি_সমিতি র একজন বিশ্বস্ত কর্মী। তিনি বিপিন বিহারী গাঙ্গুলীর একজন স্নেহধন্য যোদ্ধাও ছিলেন। কর্মের পরিকল্পনা ও দায়িত্বভার প্রথমে বহন করতেন সমিতির হরিশ সিকদার মহাশয়। তিনিই রণেন্দ্রনাথকে গোপন নির্দেশ প্রদান করেছিলেন নন্দলালের উপরে গোপন নজর রাখতে। কারণ , নন্দবাবুকে যমের বাড়ির পথ দেখাতেই হতো। 
এই সময় ঢাকার বিপ্লবী মুক্তি সংঘের নেতা হেমচন্দ্র ঘোষ মহাশয় আত্মোন্নতি সমিতির সঙ্গে বৈপ্লবিক সংযোগ রাখতেন। ক্রমশ নির্দেশ এল , মুক্তি সংঘের সদস্য শ্রীশচন্দ্র পাল এবং আত্মোন্নতি সমিতির রণেন্দ্রনাথ মহাশয়কে নন্দলালকে হত্যার দায়িত্ব প্রদান করা হয়।


৯ নভেম্বর , গুপ্ত সংবাদ প্রাপ্ত হলেন বিপ্লবীরা – নন্দলালকে  পাওয়া যাবে  সার্পেন্টাইল লেনে।  সশস্ত্র শ্রীশচন্দ্র পালের সঙ্গে রণেন্দ্রনাথ নন্দলালকে অনুসরণ করতে লাগলেন। সেন্ট জেমস স্কোয়ারের নিকট সুবিধামত অবস্থায় শ্রীশচন্দ্র সর্বপ্রথম নন্দলালকে গুলি করলেন।
নন্দলালের প্রাণহীন দেহ লুটিয়ে পড়ল। তখন প্রায় সন্ধ্যা সাতটা। ব্রিটিশ চাকর দেশদ্রোহী নন্দলাল মরে গিয়ে যেন আর বেঁচে না ওঠে , এই আশঙ্কায় রণেন্দ্রনাথ ছুটে গিয়ে রিভালবারের বাঁট দিয়ে তার মাথায় আঘাত করলেন। কার্য সম্পন্ন হতেই তাঁরা রাতের আঁধারে মিশে গেলেন। শ্ৰীশ পাল বা রণেন্দ্রনাথের এই ঘটনা পুলিশ তো দূরে থাক দলের কর্মীরাও জানতে পারলেন না।


বস্তুত নন্দলাল হত্যার ঘটনাটি এতই গোপনে ঘটেছিল এবং শ্রদ্ধেয় হেমচন্দ্র ঘোষের মুক্তি সংঘ এবং কলকাতার আত্মোন্নতি সমিতির পারস্পরিক Political understanding তৎকালে এতোই চমৎকার ছিল যে তা বলে শেষ করা যায় না। ইংরেজ চলে যাবার দিন অবধি বুঝতে পারে নি নন্দলালকে কে হত্যা করেছিল ?…এই গোপনীয়তা হেমবাবুর দল শেষ পর্যন্ত বজায় রাখতে পেরে ছিলেন বলেই ১৯৩০ সাল হতে প্রচন্ড আঘাতের পর আঘাত করে তাঁরা ব্রিটিশ শাসনকে ব্যাতিব্যস্ত করে তুলতে পেরেছিলেন। সূর্য সেনের অসাধারণ নেতৃত্বে ১৯৩০ সালে চট্টগ্রামে যে বিপ্লব রচিত হয়েছিল, তার পশ্চাতেও ছিল নিয়মানুগ এই মন্ত্রগুপ্তির মাধ্যমে নিখুঁত প্রস্তুতি। 


© দুর্গেশনন্দিনী
তথ্যঃ ১ ) রক্তের অক্ষরে
২) অগ্নিযুগ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.