চাঁদ-মুলুকে পাড়ি দিয়েছে ভারত। এ বার আদিত্য-অভিযান। এই প্রথম বার।
সূর্যের বাড়িতে গোপনে নজরদারি চালাতে উনিশের শেষ থেকেই শুরু হয়ে যাবে তোড়জোড়। আগামী বছর সূর্যের দেশের সীমান্তে গিয়ে উঁকি দেবে ভারত। নিরাপদ দূরত্বে জমিয়ে বসে শুরু হবে মাপঝোক, গবেষণা। চন্দ্রমুখে চন্দ্রযান ২ কে পাঠিয়ে ভারতীয় মহাকাশ গবেষণা সংস্থা ইসরো সৌর-মুলুকে যাকে পাঠাচ্ছে তাকে নিয়ে চর্চা ইতিমধ্যেই শুরু হয়ে গেছে। আদিত্য এল-১। সর্বাধুনিক এই উপগ্রহ সূর্যের ঠিক নাকের ডগায় বসে তার যাবতীয় অভিসন্ধির কথা সোজা সাপ্লাই করে দেবে নীল-গ্রহে।
ইসরোর ‘সোলার মিশন’ নিয়ে উত্তেজনা তুঙ্গে। কারণ নাসা আর ইউরোপিয়ান স্পেস এজেন্সির (ইএসএ বা ‘এসা’) পর আমরাই প্রথম পাড়ি দিচ্ছি সৌর-মুলুকে। এই অভিযান সফল হলে, মহাকাশবিজ্ঞানের ইতিহাসে পাকাপাকি ভাবে সেরার শিরোপাটা ছিনিয়ে নেবে ভারত। ইসরোর চেয়ারম্যান কে শিবন বলেছেন, ‘‘পৃথিবী থেকে ১৫ লক্ষ কিলোমিটার দূরে সূর্য ও পৃথিবীর মাঝের এক কক্ষপথ ‘ল্যাগরাঞ্জিয়ান পয়েন্ট’ বা ‘ল্যাগরেঞ্জ পয়েন্ট’-এ ল্যান্ড করবে স্যাটেলাইট আদিত্য এল-১। সূর্যের বাইরের সবচেয়ে উত্তপ্ত স্তর করোনার যাবতীয় তথ্য সে তুলে দেবে আমাদের হাতে। এই সোলার-মিশন তাই সবদিক দিয়েই খুব গুরুত্বপূর্ণ।’’ ২০২০ সালের প্রথম দিকেই সূর্যের দিকে পাড়ি জমাবে আদিত্য এল-১।
ল্যাগরেঞ্জ পয়েন্টে (এল-১) গিয়ে থিতু হবে আদিত্য এল-১
জ্বালানি-সহ প্রায় ১৫০০ কিলোগ্রাম ওজনের এই উপগ্রহ সাতটা সায়েন্স পে-লোড নিয়ে পৃথিবীর নিম্ন কক্ষ ৮০০ কিলোমিটার থেকে হলো অরবিট ল্যাগরেঞ্জ পয়েন্টের দিকে যাত্রা করবে। পৃথিবী ও সূর্যের মাঝের একটি অরবিট বা কক্ষপথ হলো এই ল্যাগরেঞ্জ পয়েন্ট। পৃথিবী থেকে যার দূরত্ব ১৫ লক্ষ কিলোমিটার। এই পথটাই পাড়ি দেবে ইসরোর সর্বাধুনিক উপগ্রহ আদিত্য এল-১। মহাকাশবিজ্ঞানীদের কথায়, এই কক্ষপথে সূর্য ও পৃথিবী, দু’জনেরই অভিকর্ষজ বল সমান ভাবে ক্রিয়াশীল থাকে এবং তৃতীয় কোনও বস্তুর উপর সেটা প্রভাব ফেলে। ১৭৭২ সালে ইতালীয় গণিতজ্ঞ জোসেফ-লুইস ল্যাগরেঞ্জ এই কক্ষপথের কথা বলেছিলেন, যেখানে বিশেষ ভাবে তিনি উল্লেখ করেছিলেন এই পয়েন্টের ‘থার্ড বডি প্রবলেম’-এর কথা। আদিত্য এল-১ কে তাই সে ভাবেই বানানো হচ্ছে যাতে কক্ষপথের বিপুল চাপ সহ্য করে অন্তত এক বছর ধরে ছবি ও যাবতীয় তথ্য সে অবিরাম পাঠিয়ে যেতে পারে।
সূর্যকে একবার সম্পূর্ণ প্রদক্ষিণ করতে পৃথিবীর সময় লাগে ৩৬৫ দিন। কাজেই এক বছরের মধ্য সূর্যকে পুরোপুরি সামনে থেকেই নজর রাখতে পারবে আদিত্য এল-১। সূর্যের বহিস্তর ‘ফটোস্ফিয়ার’ এবং আগুনে দুই স্তর ‘করোনা’ ও ‘ক্রোমোস্ফিয়ার’কে খুব কাছ থেকে নিরিখ-পরখ করতে পারবে এই উপগ্রহ। আর আদিত্য এল-১ এর চোখ দিয়েই সূর্যের অনেক না জানা কথা পৌঁছে যাবে আমাদের কাছে।
ইসরোর চেয়ারম্যানের কথায়, সোলার-মিশন ভারতের দ্বিতীয় বৃহত্তম মহাকাশ-অভিযান। ‘মঙ্গলায়ন’ বা ‘মার্স অরবিটার মিশন’ (মম)-এর পরে এই অভিযান ইসরোর ইতিহাস বদলে দিতে চলেছে। সম্পূর্ণ দেশীয় প্রযুক্তিতে তৈরি এই উপগ্রহ। বৃহত্তর এই পরিকল্পনায় ইসরোর পাশে রয়েছে বেঙ্গালুরুর ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ অ্যাস্ট্রোফিজিক্স (আইআইএ), পুণের ইন্টার-ইউনিভার্সিটি সেন্টার ফর অ্যাস্ট্রোনমি অ্যান্ড অ্যাস্ট্রোফিজিক্স (আয়ুকা), মুম্বইয়ের টাটা ইনস্টিটিউট অফ ফান্ডামেন্টাল রিসার্চ (টিআইএফআর, আমদাবাদের ফিজিক্যাল রিসার্চ ল্যাবরেটরি (পিআরএল), এবং কলকাতার ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ সায়েন্স এডুকেশন অ্যান্ড রিসার্চ (আইআইএসইআর)
সূর্যের আগুনে স্তরগুলির হাল হকিকত পাঠাবে আদিত্য এল-১
পিএসএলভি-এক্সএল (PSLV-XL) রকেটের পিঠে চেপে শ্রীহরিকোটা থেকে সৌর-মুলুকে উড়ে যেতে এখনও প্রায় এক বছরের অপেক্ষা। সূর্যের সবচেয়ে রহস্যময় স্তর ‘সোলার করোনা’ নিয়েই কারবার করবে আদিত্য এল-১। সূর্যের বহিস্তরের তাপমাত্রা প্রায় ১ কোটি কেলভিন, নিম্নস্তরের প্রায় ৬০০০ কেলভিন। সূর্যের পৃষ্ঠদেশে ও করোনার তাপমাত্রার ফারাক এবং করোনা থেকে ছিটকে আসা আগুনে রশ্মি পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে কী ভাবে প্রভাব ফেলে সেটাই খুঁজে বার করবে আদিত্য এল-১। তার জন্য এই উপগ্রহে রয়েছে সাতটি সায়েন্স পে-লোড।
ভিসিবল এমিসন লাইন করোনাগ্রাফ (VELC)— বেঙ্গালুরুর ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব অ্যাসট্রোফিজিক্স (আইএএ) বানাচ্ছে এই করোনাগ্রাফ। ঝলসে দেওয়া তাপমাত্রাকে আড়াল করে করোনাগ্রাফ দেখাবে ‘করোনাল মাস ইজেকশন’ এবং সূর্যের চৌম্বক ক্ষেত্রের প্রভাব ঠিক কতটা পড়ে পৃথিবীর উপর।
সোলার আলট্রাভায়োলেট ইমেজিং টেলিস্কোপ (SUIT)— সূর্যের দ্বিতীয় বহিস্তর ‘ক্রোমোস্ফিয়ার’-এর ওপর নজর রাখার যন্ত্র ‘নিয়ার আলট্রা-ভায়োলেট ইমেজার’। আলট্রাভায়োলেট (২০০-৪০০ ন্যানোমিটার) স্তরের কাছে সোলার ফটোস্ফিয়ারের উপরও নজর রাখবে এই ইমেজার। এটি বানিয়েছে পুণের ইন্টার-ইউনিভার্সিটি সেন্টার ফর অ্যাস্ট্রোনমি অ্যান্ড অ্যাস্ট্রোফিজিক্স (আয়ুকা)।
ভিসিবল এমিসন লাইন করোনাগ্রাফ (VELC)— বেঙ্গালুরুর ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব অ্যাসট্রোফিজিক্স (আইএএ) বানাচ্ছে এই করোনাগ্রাফ। ঝলসে দেওয়া তাপমাত্রাকে আড়াল করে করোনাগ্রাফ দেখাবে ‘করোনাল মাস ইজেকশন’ এবং সূর্যের চৌম্বক ক্ষেত্রের প্রভাব ঠিক কতটা পড়ে পৃথিবীর উপর।
সোলার আলট্রাভায়োলেট ইমেজিং টেলিস্কোপ (SUIT)— সূর্যের দ্বিতীয় বহিস্তর ‘ক্রোমোস্ফিয়ার’-এর ওপর নজর রাখার যন্ত্র ‘নিয়ার আলট্রা-ভায়োলেট ইমেজার’। আলট্রাভায়োলেট (২০০-৪০০ ন্যানোমিটার) স্তরের কাছে সোলার ফটোস্ফিয়ারের উপরও নজর রাখবে এই ইমেজার। এটি বানিয়েছে পুণের ইন্টার-ইউনিভার্সিটি সেন্টার ফর অ্যাস্ট্রোনমি অ্যান্ড অ্যাস্ট্রোফিজিক্স (আয়ুকা)।
সৌরবায়ু
আদিত্য সোলার উইন্ড পার্টিকল এক্সপেরিমেন্ট (ASPEX)— রহস্যময় সৌরবায়ু সম্পর্কে জানান দেবে এই উইন্ড পার্টিকল। এটি তৈরির দায়িত্বে রয়েছে ফিজিক্যাল রিসার্চ ল্যাবোরেটরি (পিআরএল)।
প্লাজমা অ্যানালাইজার প্যাকেজ ফর আদিত্য (PAPA)— স্পেস ফিজিক্স ল্যাবোরেটরি (এসপিএল)ও ভিএসএসসি-র যৌথ উদ্যোগে বানানো হয়েছে এই অ্যানালাইজার। সৌরবায়ু ও শক্তির বিকিরণ সম্পর্কে প্রয়োজনীয় তথ্য পাঠাবে।
সোলার লো এনার্জি এক্স-রে স্পেকটোমিটার (SoLEXS)— বিপজ্জনক সৌরঝড়ের সময় বেরিয়ে আসা এক্স-রে সম্পর্কে সাবধান করবে এই স্পেকটোমিটার। হিট মেকানিজম ও সোলার করোনা নিয়ে পরীক্ষা চালাবে এর স্পেকটোমিটার। এই এক্স রে স্পেকটোমিটার বানাচ্ছে ইসরো স্যাটেলাইট সেন্টার (আইস্যাক)।
হাই এনার্জি এল-১ অরবিটিং এক্স-রে স্পেকটোমিটার (HEL1OS)— সোলেক্সের মতোই সোলার করোনায় প্রতিদিন ঘটতে থাকা রহস্যের উত্তর খুঁজবে এই হাই এনার্জি স্পেকটোমিটার বা হেলিওস। ইসরো স্যাটেলাইট সেন্টার (আইস্যাক), পিআরএল এবং উদয়পুর সোলার অবজারভেটারি (ইউএসও) বানিয়েছে এই স্পেকটোমিটার।
ম্যাগনেটোমিটার— সূর্যের চৌম্বকক্ষেত্র পরিমাপ করবে এই শক্তিশালী ম্যাগনেটোমিটার। ‘ইনটারপ্ল্যানেটরি ম্যাগনেটিক ফিল্ড’ নিয়ে তথ্য দেবে এটি। এই ম্যাগনেটোমিটার বানানোর দায়িত্বে রয়েছে ইসরোর আইস্যাক ও ল্যাবোরেটরি ফর ইলেকট্রো-অপটিক সিসটেম।
সৌর-মুলুকের কোন রহস্যের সন্ধান চালাবে আদিত্য এল-১
ইসরো জানিয়েছে, সূর্যের করোনার তাপমাত্রা গড়ে ১০ লক্ষ বা তার কিছু বেশি ডিগ্রি সেলসিয়াস। এই তাপমাত্রা সব সময় একরকমের থাকে না। কখনও বাড়ে, কখনও কমে। এই ধাঁধার উত্তর খুঁজবে আদিত্য এল-১।
দ্বিতীয়, সৌরবায়ুর গতিপথ বোঝাবে এই উপগ্রহ। প্রোটন ও ইলেকট্রনের সমন্বয় এই সৌরবায়ু প্রবল গতিবেগে ছিটকে বেরিয়ে আসে সূর্যের প্লাজমা থেকে। এর গতি সেকেন্ডে প্রায় ৯০০ কিলোমিটার। তাপমাত্রা প্রায় ১০ লক্ষ ডিগ্রি সেলসিয়াস। সূর্যের উত্তপ্ত সোলার করোনার জন্যই এই সৌরবায়ুর জন্ম হয়। এর মধ্যেকার শক্তিশালী চৌম্বক ক্ষেত্র ও আয়নগুলো পৃথিবীর টেলিযোগাযোগ ব্যবস্থা ও জিপিএস নেটওয়ার্ককে তছনছ করে দিতে পারে।
তৃতীয়ত, সৌরঝড় (সোলার স্টর্ম) যার দ্বারা স্যাটেলাইটগুলো আক্রান্ত হয় ও টেলি যোগাযোগে বড় ব্যাঘাত ঘটায়। পাশাপাশি, বিশ্বের তাপমাত্রা বাড়ানোর জন্যও দায়ী এই সৌরবায়ু, সৌরঝড় এবং সৌর বিকিরণ। এই সৌরঝড় কোন পথে পৃথিবীতে আছড়ে পড়ছে পারে তার খোঁজ চালাবে আতিত্য এল-১।
চতুর্থত, সূর্য থেকে আসা যে ‘আল্ট্রা-ভায়োলেট রে’ বা অতি-বেগুনি রশ্মি আমাদের জলবায়ুর পক্ষে কতটা ক্ষতিকর, সেটাও জানার চেষ্টা হবে এই সৌর-অভিযানে।