মাথায় ঝুঁটি, উজ্জ্বল নীলকণ্ঠী, রংবেরঙের পালকে ঢাকা সারা শরীর, তাতে আবার বর্ণময় কারুকাজ। যেন রংধনু খেলা করে সারা শরীরে। আমাদের জাতীয় পাখিটির (Bird) চেয়ে কোনও অংশে কম নন ইনি। স্থানীয়ভাষায় ‘মোনাল’ (Monal) নামেই বেশি পরিচিত এরা।
দীর্ঘ ৯০ বছরের বিরতির পর দার্জিলিং-এর সিনচেল অভয়ারণ্যে (Sinchel forest at Darjeeling) দেখা মিললো বিরল পাখি মোনালের। রাজ্য বনবিভাগের তরফে একটি ফেসবুক পোস্টে জানানো হয়েছে, ১৯৩৩ সালে শেষ ব্রিটিশ উদ্ভিদবিদদের একটি নমুনায় উল্লেখ করা হয়েছিল পাখিটির। এতদিন পর আবার এই বছরের এপ্রিল মাসে, জুওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়ার (জেডএসআই) বিজ্ঞানীরা এই অঞ্চল থেকে দেখা পান মোনালের।
নেপালের জাতীয় পাখি হিমালয়ান মোনাল (Monal Pheasant)। উত্তরাখণ্ডের রাজ্য পাখিও বটে। নেপালে এদের ডাংফে বা ডানফে নামে ডাকা হয়। হিন্দি ‘মুনাল’ শব্দ থেকে ‘মোনাল’ শব্দটি এসেছে। ফেজেন্ট দলের অন্তর্ভুক্ত এই রঙিন পাখিটিকে হিমালয়ের মোটামুটি ৫০০০ ফুট থেকে ১৪৫০০ ফুট উচ্চতার মধ্যে যেখানে আর্দ্র ওক, রডোডেনড্রন এবং ঘন বাঁশ ঝাড় রয়েছে, সেরকম জায়গায় দেখতে পাওয়া যায়। হিমালয়ের পাহাড়ি অঞ্চলের পাশাপাশি আফগানিস্তান, ভুটান, পাকিস্তান ও পশ্চিম চিনেও দেখা মেলে মোনালের।
ফেজেন্ট গোত্রের (Habitat) এই পাখিটি ময়ূরের মতো দেখতে হলেও ভালো করে উড়তে পারে না। আকারেও ময়ুরের থেকে ছোটো হয়। তবে চেহারা হয় বেশ ভারী। স্ত্রী পাখির তুলনায় পুরুষ পাখিদের বেশি বর্ণিল ও আকর্ষণীয় হতে দেখা যায়। এরা সাধারণত জোড়ায় বা ছোটো দলে চলাফেরা করে। নানান রকম সুরে ও স্বরে ডাকাডাকি করতেও ওস্তাদ মোনালরা! স্ত্রী মোনাল প্রতিবারে সাধারণত ৩ থেকে ৫টি ডিম দেয় এবং নিজেই ডিমের রক্ষণাবেক্ষণ করে। তবে ডিম থেকে বাচ্চা বের হওয়া পর্যন্ত পুরো সময়টা পুরুষ পাখি স্ত্রী পাখির আশেপাশে ঘোরাঘুরি করে। প্রায় ৬ মাস বয়সের পর বাচ্চাগুলো সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে চলাফেরা এবং খাবার খুঁজতে সক্ষম হয়। মূলত বিভিন্ন ধরনের বীজ, উদ্ভিদ মূল, ফল এবং ছোটো ছোটো কীটপতঙ্গ এদের প্রিয় খাদ্য।
টাইগার হিল (Tiger-hill) লাগোয়া এই সিনচেল বনাঞ্চলে একটা সময় নানা জীবজন্তুর দেখা মিলত। ধীরে ধীরে জনবসতি বৃদ্ধি, নগরায়ণ, দূষণ, শিকার ইত্যাদি কারণে একে একে হারিয়ে যেতে থাকে একাধিক প্রজাতির পাখিরা। তাদের দলেই ছিল মোনাল প্রজাতির পাখিটি। নেওরা উপত্যকা এবং সিঙ্গালিলা জাতীয় উদ্যানেও দেখা মিলতো এদের। যদিও সে দেখা আজ আর খুব সাধারণ ঘটনা নয়।
পুনরায় এতোদিন পর উত্তরবঙ্গের (North Bengal) বনাঞ্চলে বিরল প্রজাতির মোনাল পাখির সাক্ষাৎ স্বাভাবিকভাবেই স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে রাজ্য বনবিভাগের (WestBengal Forest Department) ইতিবাচক উদ্যোগকে। যদিও বিশিষ্ট জনের অনেকেই মনে করছেন, দীর্ঘ কয়েকমাসের লকডাউন পর্ব একটি বড়ো ভুমিকা নিয়েছে এক্ষেত্রে। ধীরে ধীরে বহু বিরল প্রজাতির পাখিরা আবারও হিমালয়মুখী হয়েছে তার পর থেকেই। মোনালও তার ব্যাতিক্রম নয়। পাশাপাশি এ কথাও অস্বীকার করার জো নেই যে, ভারতের অন্যতম প্রাচীন বন্যপ্রাণী (Wildlife) অভয়ারণ্য সংরক্ষণ এবং পরিচর্যার দিকে যথাযথভাবে নজর দিয়েছে বনদপ্তর। যার ফলে অভয়ারণ্যের সামগ্রিক চিত্রটাও অনেকাংশে বদলেছে।
বর্তমানে আমাদের রাজ্যে পাখি (Bengal Birds) দেখার রেওয়াজ ধীরে ধীরে মূল স্রোতের অংশ হয়ে উঠেছে। দিন দিন পক্ষীপ্রেমী, পাখি পর্যবেক্ষক এবং পাখির চিত্রগ্রাহকদের সংখ্যাও বৃদ্ধি পাচ্ছে। মানুষের ইতিবাচক কর্মসূচির জেরে আবারও ফিরতে চলেছে বাংলার হারিয়ে যাওয়া পাখি-বৈচিত্র্য।