আফগানিস্তান

আফগানিস্তান

-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং সৈয়দ মুজতবা আলী।


আফগানিস্তান- নাম শুনলেই মনের মধ্যে এক বিভীষিকাময় দেশের ছবি ভেসে আসে, যেখানে তালিবান নামক মারণাস্ত্র ধারী জঙ্গি ঘুরে বেড়ায়, ইচ্ছে হলেই নারী, শিশুকে গুলি করে হত্যা করে।
অতীতে এমনটি ছিল না। শিক্ষা, সাহিত্য চর্চার সঠিকভাবে মূল্যায়ন হত। ছিল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিপুল জনপ্রিয়তা।

প্রসিদ্ধ কথা সাহিত্যিক সৈয়দ মুজতবা আলী তখন কিছুদিন হল নতুন চাকুরীতে ঢুকেছেন সেই সময়ের ঘটনা।

এমনিতে তার বাড়ি বাংলাদেশের শ্রীহট্টে। সেখানের স্কুল থেকে প্রবেশিকা পরীক্ষায় পাস করে এসে ভর্তি হয়েছিলেন গুরুদেবের শান্তিনিকেতনে। তিনি শান্তিনিকেতনের প্রথম মুসলিম ছাত্র এবং বিশ্বভারতীর কলেজে ভর্তি হওয়া প্রথম বাইরের ছাত্র।

তখন মুসলিম ছাত্র ভর্তির ব্যাপারে শান্তিনিকেতনের অনেক আশ্রমিকেরই আপত্তি ছিল। কিন্তু জহুরির চোখ মহামূল্যবান রত্নটিকে চিনতে ভুল করেনি। রবীন্দ্রনাথের ইচ্ছেতেই সব বাধা পেরিয়ে অবশেষে আশ্রমিকের তকমা জুটলো তাঁর।

রবীন্দ্রনাথ তার সাথে প্রাণ খুলে কথাও বলতেন। মুজতবা আলীর সাথে গুরুদেবের নিম্নোক্ত আলাপচারিতায় সেই আভাস কিছুটা পাওয়া যায় –

‘বলতে পারিস সেই মহাপুরুষ কবে আসবেন কাঁচি হাতে করে?

মুজতবা আলী লিখছেন, – “আমি তো অবাক। মহাপুরুষ তো আসেন ভগবানের বাণী নিয়ে, অথবা শঙ্খ, চক্র, গদা, পদ্ম নিয়ে। কাঁচি হাতে করে”?

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার স্বভাব সিদ্ধ ভঙ্গিতে বললেন, – “হ্যাঁ, হ্যাঁ কাঁচি নিয়ে। সেই কাঁচি দিয়ে সামনের দাড়ি ছেঁটে দেবেন, পেছনের টিকি কেটে দেবেন। সব চুরমার করে একাকার করে দেবেন। হিন্দু-মুসলমান আর কতদিন আলাদা হয়ে থাকবে?’

এমনই এক পরিবেশের মধ্যে এক সময় শান্তিনিকেতনের শিক্ষা শেষ হল মুজতবা আলীর। এবার ইচ্ছা ইউরোপে পড়তে যাবেন। বিশ্ববিদ্যালয়ও ঠিক হল জার্মানির বার্লিন বিশ্ববিদ্যালয় (১৯২৯)। কিন্তু বিদেশে পড়তে যাওয়া বললেই তো যাওয়া নয়। তার জন্য অর্থসংস্থান চাই। আর সেই কারণে তিনি চাকরী নিয়ে চলে গেলেন একেবারে কাবুলে (আফগানিস্তান)।

সৈয়দ মুজতবা আলী কাবুলে গেলেন মাত্র ২০০ টাকা মাস মাইনের চাকরী নিয়ে। কাবুল বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনার কাজ। তিনি সেখানে পড়াবেন ইংরেজি আর ফারসি। অল্প কয়দিনের মধ্যেই কাবুল সরকার আবিষ্কার করল তিনি জার্মান ভাষাও জানেন। তখন বিশ্বভারতী সারাদেশের একমাত্র শিক্ষা প্রতিষ্ঠান যেখানে ফরাসী, ফারসি, জার্মান একসঙ্গে শেখা যেত। ধাঁ করে মুজতবা আলীর মাইনে একলাফে বেড়ে তিনশো। সেই সময়ে তিনশো টাকা মানে অনেক টাকা। তার থেকে ত্রিশ বছর আগে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যখন পতিসরে জমিদারি করছেন তখন রবীন্দ্রনাথ মাস মাইনে পেতেন ২৫০ টাকা। বুঝতেই পারছেন ১৯২৭ সালে ৩০০ টাকা মোটেও কম নয়।

কিন্তু ঝামেলা দেখা গেল। সৈয়দ মুজতবা আলীর পাঞ্জাবী সহকর্মীরা এই বেতন বৃদ্ধিতে বেশ ক্ষুব্ধ হল এবং অভিযোগ গেল কাবুলের ওজীরে মাওয়ারীফের (শিক্ষামন্ত্রী) কাছে। তাদের বক্তব্য, -“সৈয়দ মুজতবা এক ‘অনরেকগনাইজড’ বিদ্যালয়ের ডিপ্লোমাধারী। আমরা পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয়ের বিএ এমএ। আমাদের মাইনে শ-দেড়শো, আর তার মাইনে তিনশো, এ অন্যায়”।

সেই সময়ে আফগানিস্তানের শিক্ষা মন্ত্রী খী দানীদ আগাজান, ওজীরে মাওয়ারিফ চি গুফতলের সেক্রেটারি ছিলেন সৈয়দ মুজতবা আলীর বন্ধু। তিনি সৈয়দ মুজতবা আলীকে গল্প করেছিলেন ঘটনাটা ফার্সিতে, – “জানো বন্ধু, শিক্ষামন্ত্রী তখন কি বললেন, খানিকক্ষণ চুপ করে থাকার পর শিক্ষামন্ত্রী বললেন, – “বিলকুল ঠিক। কিন্তু মুশকিল হচ্ছে এই, তোমাদের ডিগ্রিতে দস্তখত রয়েছে পাঞ্জাবের লাটসাহেবের। তাঁকে আমরা চিনি না, দুনিয়াতে বিস্তর লাটবেলাট আছেন – আমাদের ক্ষুদ্র আফগানিস্তানেও গোটা পাঁচেক লাট আছেন। কিন্তু মুজতবা আলীর সনদে আছে রবীন্দ্রনাথের দস্তখত, – সেই রবীন্দ্রনাথ যিনি সমগ্র প্রাচ্যের মুখ উজ্জ্বল করেছেন”।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.